ক্লেশবৃত্ত ।। আসিফ ইকবাল আরিফ

 কার্তিক মাসের বেশ কিছুদিন পার হয়ে গিয়েছে এরই মধ্যে। আবহাওয়া এমন বর্ণচোরা আচরণ করছে যে, না শীত ভালো মত পড়তে শুরু করেছে, না গরম একেবারেই কমে গিয়েছে। সারাদিনের সূর্য কিরণের উত্তাপ শেষে সন্ধ্যের পরপরই শীতল গুড়গুড়ি বাতাস শুরু হয়। আর কার্তিক মাসের এই মৃদু হাওয়া শেষ রাতের দিকে হালকা উষ্ণ কাঁথা গাঁয়ে জড়াতে বাধ্য করে। প্রকৃতি হালকা ঠান্ডা আর গরমের মিশেলে এমন এক বিশ্রী রকমের অবস্থা তৈরি করেছে যাতে এইসময়ে জনজীবনে এক প্রকার হাঁসফাঁস করা অস্বস্তি নেমে এসেছে। এসময়ে ঠান্ডা আর জ্বর যেন খুব পরিচিত অসুখ বা রোগবালাই গ্রাম বাংলার। চিকিৎসা শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা এটাকে ‘সিজনাল ডিজিজ’ বা ‘ঋতু পরিবর্তনকালীন রোগ’ বলে থাকেন। এই ঋতু পরিবর্তনকালীন রোগে ভোগা রোগীর সংখ্যা গ্রাম-বাংলায় কম নয়। গ্রাম-বাংলার অন্যান্য গ্রামবাসীদের মত সাতপুকুরিয়া গ্রামেও এই ঋতু পরিবর্তনকালীন সময়ে ঠাণ্ডা আর জ্বরের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। 


সাতপুকুরিয়া গ্রামের প্রায়ই সব বাড়িতেই এমন দু’য়েক জনকে পাওয়া যাবে যারা কেউ সবে সর্দি-ঠান্ডা আর জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, আবার কেউ কেউ সুস্থ্য হওয়ার পথে, আবার কেউ সদ্য সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। এমন সদ্য সুস্থ্য হওয়া একজন হলেন হাসিয়ারা বেগম। হাসিয়ারার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি হবে। হাসিয়ারার স্বামী বর্তমানে জীবিত নেই। তার দুই মেয়ের ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। গ্রামের একেবারেই মূল রাস্তার পাশেই হাসিয়ারার আধাপাকা ইটের বাড়ি।  

হাসিয়ারা বেগম আজ একটু ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে। গত কয়েকদিনের ঠাণ্ডা আর জ্বরে পড়ে এক প্রকার শুয়ে বসেই অতিবাহিত হয়েছে তার রাত আর দিনের অনেক সময়।আজ যেহেতু শরীর একটু ভালো হয়েছে তার, তাই সে একটু হাঁটতে বের হবে। কার্তিক মাসের এই হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরেই হাঁটতে যেতে হবে তাকে, না হেঁটে তার উপায় নেই কেননা ‘ডায়বেটিক’ নামক রোগ বাসা বেধেছে তার শরীরে। এটা এমন এক রোগ যে, কে বিধবা আর কে বিপত্নীক, কার সন্তান আছে, আর কে সন্তানহীন -  তা দেখার সুযোগ নেই। দু’চারটে তাজা সবুজ থকথকে মচমচে পান, কয়েক টুকরো  সুপারি, চুন আর জর্দা মিশিয়ে খিলি বানিয়ে আঁচলে বেঁধে নিল হাসিয়ারা। হাতের মোবাইল ফোনটা নিয়ে পাড়ার আরও দুইজন মহিলাকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগায় সে। হাসিয়ারার মত তাদের শরীরেও ডায়বেটিক রোগ আছে। ধর্মমতে, ‘পরপুরুষের সামনে যাওয়া পাপ’ আর এই গ্রাম্য সমাজে মেয়েমানুষ বাড়ির বাইরে গেলে রক্ষণশীল সমাজের রীতিনীতিতে বড্ড আঘাত লাগে, তবুও লোকমুখের এইসব বয়ান উপেক্ষা করেই তারা রোজ রোজ ভোর সকালে হাঁটতে বের হয়। 
সুখ আর দুঃখের নানান কথাবার্তা তারা হাঁটতে হাঁটতেই সেরে নেয়। গ্রামের একেবারেই পেট-বুক চিরে যে আধাপাকা রাস্তাটা আছে, সেই রাস্তা ধরেই হাঁটে তারা। একেবারে হাসিয়ারার বাড়ির ‘খোলা’  থেকে যাত্রা শুরু করে গ্রামের শেষ ভাগে নবগঙ্গা নদীর তীর থেকে আবার যে যার বাড়িতে ফিরে আসে তারা। তাদের এই নিত্য দিনের হাঁটাহাঁটিতে গ্রামের অনেক মানুষই বিরক্ত হয়। পঁচাত্তর বছর বয়সের আলফা মন্ডল তো মনে মনে রীতিমত গালি ছুঁড়তে থাকে যখন সে ফযর নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে এই তিন-চারজন স্ত্রীলোকের মুখ দেখে ফেলে। “মাগির ভাতার মরার পরে একেবারে মদ্দ্য লোক হয়েছে! নিজে তো পাপে মরবেই, আবার আমার বেটার বউকেও সাথী বানিয়েছে। মেয়ে-ছেলের মান এই মাগিগের জন্যি এ গ্রামে থাকলো না একেবারে” – সত্তর বছর বয়সের বিধবা মজুর মা তো এই রকম কথা রীতিমত মানুষ ধরে ধরে বলে বেড়ায়।  তবে গ্রামের আর যারা আছে তারাও বলার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে কিন্তু মুখের ওপর বলার সাহস কেউ রাখেনা। কেননা এই অজপাড়াগাঁয়ে তিন-চারজন স্ত্রীলোকের একসাথে হাঁটতে বের হওয়া যে রীতিমত বিরাট সাহসের কাজ – এই কথা গ্রামের অনেক পুরুষমানুষেরই জানা। যাক গে সে কথা। একে একে ফোন করতে সবাই হাসিয়ারার বাড়ির সামনে এসে হাজির। আজকের মত তারা হাঁটা আরম্ভ করল।  

হাঁটাহাটি সেরে বাড়ি ফিরে এক পেটের খাওয়ার মত সারাদিনের রান্না একবারে করে নিলো হাসিয়ারা। ক'দিন আগে শহরের আদালত থেকে নোটিশ এসেছে। আজ আদালতে যেতে হবে। 

মায়া, আদর আর বিচ্ছেদ-বিরহ লেপনের এই মাটির পৃথিবীতে হাসিয়ারার আপন বলতে আর কেউ নেই দু'টো মেয়ে ছাড়া। মেয়েদের বিয়ের পরে তারা শ্বশুর বাড়িতে থাকে। একসময় আপনজনে ভরা সাজানো গোছানো এক পুষ্প বাগান ছিলো তার সংসার। এখন দিন-রাতের চব্বিশ ঘন্টার আপন সঙ্গী হলো তার দেহ আর মন। তবে বুক হাতড়ে হাতড়ে সে তার আপনজনের ঝাপসা আর বিবর্ণ ছবি চোখের সম্মুখে এনে আপনজনের পরশ অনুভব করে। মাঝে মাঝে মেয়ে-জামাই আসে। হাসিয়ারার সাজানো আর গোছানো সংসারে প্রথম ভাঙন আসে বছর তিনেক আগে। 

সুখ-শান্তি আর ছোটখাটো দুঃখ ব্যাথা নিয়ে যখন হাসিয়ারার স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে দিনাতিপাত হচ্ছিলো– এমন সময় আবেশ পাথরের মায়া মিশ্রিত সুখের বাতাস আচমকা পথ ভুলে দমকা হাওয়া হয়ে ক্লেশবৃত্তের উল্কা ছড়িয়ে দিল তার জীবনে। নিজ কন্যার জঠরে কোনো অনাগত সন্তান এই মাটির বুকে জন্ম নিবে, এই খবর তো নিতান্তই সুখের আর আনন্দের। নাতি হোক অথবা পুতি– নানা-নানিরা এই আনন্দ উপভোগ করে নিজেদের সাধ্য মত। যাইহোক, হাসিয়ারার বড় মেয়ে সাফিয়া সন্তানসম্ভবা ছিলো। সাফিয়ার বিয়েটা মোটামুটি ধুমধাম করেই দিয়েছিলো জয়নাল আর হাসিয়ারা।  বাড়িতে একটি বড় গরু আর তিনটি বড় খাসি জবাই হয়েছিলো। প্রায় শতজন বরযাত্রী এসেছিলো সাফিয়ার বিয়েতে। যাকগে সে বিয়ের কথা। সন্তানসম্ভবা সাফিয়াকে এই কিছুদিন আগে জয়নাল আর হাসিয়ারা দম্পত্তি নিজেদের বাড়িতে এনেছিলো। তবে সন্তান প্রসবের কয়েকদিন আগে শ্বশুরের মরণের ‘টানপাড়া’র খবর পেয়ে নিজের শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যায় সাফিয়া। এক এক করে দিনরাত যেতে থাকে। কোনো এক ভোর রাতে প্রসব বেদনা অনুভব করে সাফিয়া। সাফিয়ার প্রসব বেদনা চলাকালীন সময়েই খবর পেয়ে পাখির মত ডানা ঝাপটে সাফিয়ার কাছে ছুটে যায় জয়নাল আর হাসিয়ারা। 

কন্যা যে সন্তানের জননী হবে– এটাতো বড্ড আনন্দের খবর। মনে হয় এর থেকে আনন্দের খবর এই ধরাধামে আর থাকার কথা নয়। তবে সবসময় কন্যার সন্তানের মা হবার খবর যে পিতা-মাতার  কাছে আনন্দের হয়– তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে তা আবার লজ্জ্বা আর দুশ্চিন্তারও কারন হয় এই সাতপুকুরিয়া গ্রামে। যেমনটি হয়েছিলো এই গ্রামের হারুর মেয়ের সন্তান জন্মদানের বেফাঁস হওয়া খবরের সময়। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই হারুর মেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়েছিলো। বিবাহের পূর্বে এই গ্রাম সমাজে যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তা যে কত বড় লজ্জ্বা আর অপমানের– সেটা কেবল এর ভুক্তভোগীই জানে।  ঠিক যেমন ভুক্তভোগী হয়েছিলো হারুর মেয়ে আর তার পরিবার। পরে অবশ্য অনাগত সন্তানের পিতার সাথেই হারুর মেয়ের বিয়ে হয়েছিলো। ‘বিয়ে কি শকূন বেটায় করতে চেয়েছিলো? প্রথমে হাত-পা ধরে আর পরে গ্রামের বজ্জাত ছেলেদের দিয়ে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবার হুমকি দেখানোর পরে হারুর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।’– এই কথা সেইদিন মেহের আলী ছুলেমানের চায়ের দোকানে বসে বলছিলো। যাইহোক, গ্রামের মসজিদে গিয়ে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পরে হারু গ্রামবাসীর কাছে মাফ চাওয়ার পরে গ্রামবাসী এই বিয়েকে মেনে নিয়েছিলো। হারুর সেই নাতি এখন বেশ বড় হয়েছে। এখন সেই নাতী-ই ছেলে সন্তানহীন হারুর হাতের লাঠি রীতিমত। 

আবার এইতো বেশ কিছুদিন আগে মকিম মোল্ল্যার বউ একেবারে শেষ বয়সে একটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। শেষ বয়স মানে একেবারেই ‘পিরয়ড' বা মাসিক বন্ধ হওয়ার বয়স। মকিমের নিজ ‘নাতমেয়ের’ প্রায় বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতে সমাজের চোখে যে তারা রীতিমত লজ্জ্বায় লাল হয়েছিলো– তা এই গ্রামবাসীর অনেকরই জানা। আবার এইতো দিন বিশেক আগে তছিমের মেয়ের এক পুত্র সন্তান হলো। এই খবর তছিমের কাছে যতটা না আনন্দের ছিলো, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার ছিলো বটে। কেননা তছিমের মেয়ের বিয়ের বয়স একবছর না যেতেই শহরের কাছে একদিন ট্রাকের ধাক্কায় মারা গিয়েছিলো জামাই। এমনিতেই তছিমের জোয়ান মেয়ে, তার উপরে আবার স্বামীর মৃত্যু– এমন সময় মেয়ের সন্তান প্রসবের খবর একেবারেই মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত বিঁধেছিল তছিমের বুকে। তবে মেয়েকে যে তছিম আবার বিয়ে দিবেনা তা কিন্তু একেবারেই না। যাইহোক, তছিমের মেয়ের এই কন্যা সন্তানকে নিয়ে এখনও তছিমের কপালে বড় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পাওয়া যায়। 

জন্মের খবর নিদারুণ আনন্দের বাতাস বয়ে আনে যদি সমাজের চোখে সেই অনাগত সন্তান প্রত্যাশিত হয়। আর সন্তানের আগমনের বার্তা আরও বেশি আনন্দের হয় যদি সেখানে মা এবং অনাগত সন্তান সুস্থ্য থাকে, ভালো থাকে। যাইহোক, হাসিয়ারা আর জয়নাল এক মুহুর্ত দেরী না করে যে অটোভ্যানে চড়ে পৌছেছিল, সেই ভ্যানেই সাফিয়াকে তুলে নিয়ে শহরের হাসপাতালের দিকে যাত্রা শুরু করলো। তাদের সাথে আরও দুয়েকজনও গিয়েছিলো। কে আসলো আর কে আসলো না সেটা হাসিয়ারা আর জয়নালের মাথায় থাকারও কথা না। তবে জয়নাল একবার তার জামাই বকুলকে বলেছিলো সাফিয়ার সাথে যেতে। 

হাসপাতালে পৌছে জরুরী বিভাগের নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকিৎসক এসেছিল। ‘অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফরিদপুরে একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। ওখানে নিয়ে যান’- এই কথা বলে ডাক্তার সাফিয়ার কাছ থেকে প্রস্থান করলো। একটি হস্তচালিত নলকূপ থেকে হাতল চেপে এক জগ পানি ভরতে যে সময় লাগে, জয়নালের একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করতে ততোটা দেরি হয়নি। হাসিয়ারা, জয়নাল আর তাদের জামাই বকুল সাফিয়াকে নিয়ে ফরিদপুর চলে যায়। এক থেকে দেড় ঘন্টা পরে তারা ফরিদপুর পৌছায়। 

কর্তব্যরত ডাক্তার এসে হালকা পর্যবেক্ষণ করার পরে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানোর নির্দেশ দিলো। সাফিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হলো। বকুল আর জয়নাল হাসপাতালের 'ফরমালিটি' সম্পন্ন করে ফেললো। 

কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স বেরিয়ে এসেছিল ও.টি থেকে। বড্ড মলিন মুখ তার। কারোর মৃত্যুর খবর দেওয়া যে রীতিমত কঠিন কাজ- তা তার মুখ দেখে বোঝা গিয়েছিলো। আর তাছাড়া অনাগত শিশুর সুস্থ্য আর সবলতার খবর পৌছালে বকশিস কপালে একেবারে কম জোটেনা। যাইহোক, সাফিয়ার সন্তান গর্ভেই মারা গিয়েছিলো। অপারেশন করে মৃত সন্তানকেই শুধু বের করা গিয়েছে।  

খবর শুনে জয়নাল আর হাসিয়ারা রীতিমত আহাজারি শুরু করেছিল। সাফিয়ার কান্না বোঝা যাচ্ছিলো না। কেননা তখনও সাফিয়ার জ্ঞান ফেরেনি। কি ভীষণ ব্যাথা আর যন্ত্রণার পাহাড় হাসিয়ারা আর জয়নালের উপর ভেঙে পড়েছিলো- তা বলে শেষ করা যাবেনা হয়তো। বকুলও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। 

একসময় সাফিয়ার জ্ঞান ফিরেছিলো। ঘুমঘোরেই মৃত সন্তান প্রসব করার কথা আবছা আবছা জানতে পেরেছিলো সে। কান্না করার সামর্থ্য তার ছিলো না। 'সিজার' করলে যা হয়, তা কেবল যার পেট কাটা পড়ে- সেই জানে। যে ক্লেশ আর জরা বৃত্তে তারা ঘুরপাক খাচ্ছিলো তা কখনোই বলে শেষ করা যাবেনা। 'ফল গেছে গেছে, গাছ বেঁচে আছে'- এই সান্ত্বনা নিয়ে চারদিন বাদে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে তারা।

সাফিয়ার অনাগত সন্তানের মৃত্যুর পরে তাদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। এই শোক আর জরা হাসিয়ারার মনে কঠিন আঘাত হয়ে নেমে এসেছিল। ‘নাগর আমার দুনিয়াতে আসার আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। কি সুন্দর নাক! আর কি সুন্দর মুখ রে! আহা! আহা!’- বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে হাসিয়ারা। গ্রাম সমাজে নানি আর নাতীর সম্পর্ক অতি আদরের সম্পর্ক। বড্ড রসিকতার সম্পর্ক এটা যা যুগ যুগান্তর থেকে চলে আসছে এই তেপান্তরে। প্রত্যেকটা আদরের সম্পর্কই একেকটা কল্পিত নাগর সামলানোর মত। মায়ায় বাঁধতে হয়, বেঁধে রাখতে হয়। অভিমান করতে হয়, অভিমান ভাঙাতে হয়। যাইহোক, সাফিয়ার সুস্থ্য হতে মাস দু'য়েক সময় লেগেছিল। আর তার মাস চারেক পরে সে আবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলো। 

সাফিয়ার সন্তান মরে যাওয়ার দু:খটা ছিলো হাসিয়ারার জীবনে এক পরোক্ষ আঘাত। সন্তান হারানোর ব্যাথা মা-ই কেবল ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে। মায়ের নাড়ীতেই মানব শিশু বেড়ে ওঠে, তার নাড়ী ছিঁড়েই শিশু ভুমিষ্ঠ হয়– সে-ই বোঝে ব্যাথা। সন্তান সুস্থ্য থাকলে মা সব ভুলে যায়। তবে সন্তান যদি মারা যায়- সে ব্যাথা কোনো কলম দিয়ে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।  

'সুখ-দু:খ মিলেই জীবন' - একথা মেনে নিয়েই তাদের জীবন বয়ে যেতে থাকে। দিন যখন মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিল, এমন সময় এমন এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল হাসিয়ারা। এমন নির্মম বাস্তবতা যা তার জীবনকে গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে ঢেউয়ে আছড়ে আসা বালুকণার মত ভাসিয়ে দিয়েছিল- এমন কিছু বালুরাশি যা সহজে থিতু হয়না, ঢেউ এসে আবার অন্যদিকে সরিয়ে দেয়।

একদিন মাঘের কনকনে শীতে সুবেহ সাদেকের সময় মুয়ায্যিন যখন ফযরের আযান দিল, এমন সময় নিজ গ্রাম থেকে মাইল দশেক পূর্বের দিকে শহরের হাটে পান বেচতে গিয়েছিল জয়নাল। জেলা শহরের বড় হাট বলে কথা। এই এলাকার অধিকাংশ কৃষি উৎপাদিত ফল, ফুল, লতা-পাতা, ফসল আর শস্যের কেনা-বেচার বড় হাটও এটা। প্রতি সপ্তাহের দুইদিন এখানে হাট বসে। নিজের পরিচিত এবং বিশ্বস্ত ভ্যান চালক হাটের আগের দিন ‘পেনো হাটাতে' রেখে আসে পান। প্রত্যেক পানের ‘বোঝাতে' নির্দিষ্ট কিছু প্রতীক থাকে এবং এই প্রতীক দেখেই হাটের দিন ভোর সকালে হাটে উপস্থিত হয়ে পানচাষীরা। 

মাঘ আর ফাল্গুন মাসে পানের দাম সবথেকে বেশি হয়। এই সময় পান চাষীদের মুখে বেশ ভালো হাসি থাকে। যাক সেসব কথা। অন্যান্য দিনের মত গতবছরের মাঘ মাসের একেবারে ঘন কুয়াশা সরিয়ে নিজের বাইসাইকেল চালিয়ে চালিয়ে পানের হাটে গিয়েছিল জয়নাল। জয়নালের পান বিক্রি করতে সময় বেশি লাগেনি। দুই এক ব্যাপারীকে দেখাতেই মনের মত দামে পান বিক্রি করে ফেলল জয়নাল। 

অন্যান্য দিন জয়নালেরা একসাথে অনেকজন বাড়ি ফেরে, দল বেঁধে। তবে ঐদিন নিজের ইরিধানের জমিতে লাঙ্গল দিবে বলে জয়নাল একা একা রওনা দেয় বাড়ির দিকে। আর যেহেতু জয়নালের পান একটু আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, তাই সে আর কারোর জন্য অপেক্ষা না করেই চলে আসতে থাকে বাড়ির গন্তব্যে। চাষী-গেরস্থের জীবন এরকমই; যখন কাজ থাকে তখন কেউ কারোর জন্য একমিনিটও অপেক্ষা করতে চায় না। আবার যখন কাজ কম থাকে তখন নাওয়া আর খাওয়া ছেড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে খোশ গল্প করে সময় পার করে। 

যাইহোক, ঐদিন একটু আগেই বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে হাট থেকে বেরিয়ে পড়ল জয়নাল। ঘুটঘুটে কুয়াশা; নিজের চোখের সামনের দুই-দশ হাত দুরের জিনিস পত্র ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শহরের ল্যাম্প পোষ্টের বাতিগুলো কোনো রকম মিটমিটিয়ে জ্বলছিল। এমন কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে যদি কোনো সোনাদানাও পথে পড়ে ঝকঝক আর চকচক করে– তা নিতান্তই সত্যিকারার্থে জিনিসপত্র কুড়ানোয় পারদর্শী না হলে কারো খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। 

জয়নাল যখন উপজেলা শহরের মূল কেন্দ্র অতিক্রম করে আসছিল, ঠিক এমন সময়ই দুজন ছিনতাইকারী এসে জয়নালের পথ রোধ করে। গলার উপর ছুরি ধরতেই জয়নাল ভয়ে আঁতকে ওঠে। ছিনতাই বিদ্যার যে কিছু বুলি শেখানো আছে, সেইগুলো তারা আবৃত্তি করতে থাকে। ছিনতাইকারীরা রীতিমত রাগে ফঁসফঁস করে। জয়নালের কাছে যা যা ছিলো- টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন– সব একে একে দিয়ে দিয়েছিল  জয়নাল। এইসব নেওয়ার পরে ছিনতাইকারীরা জয়নালের কাছে আর কোনো জিনিস আছে কিনা জানতে চেয়েছিলো। জয়নাল বাকরুদ্ধ ছিলো। নিজের কাছে আর কিছু আছে কি নেই– এইসব নিয়ে কথা বলার মত শক্তিটুকু সে পাচ্ছিলো না। জয়নাল যখন প্রাণ ভয়ে রীতিমত কাঁপছিলো, ঠিক তখনই ছিনতাইকারী দলের একজন জয়নালের কোমরে হাত দিতেই একটি টর্চ লাইট পায়। ‘শুয়োরের বাচ্চা। আর কিছু নেই বলে। এটা কি তোর…..।’ বলেই জয়নালের বুকের উপর– একেবারেই হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরি ঢুকিয়ে দিল।
 
সেইদিনকার সে ভোর সকালে শহরে ট্রাফিক পুলিশের  টহলও কম ছিল। রক্তাক্ত শরীর  আর নিথর দেহ নিয়ে কাতর হয়ে পড়েছিল জয়নাল। বাঁচার আকুতিতে ভেতরটা ছটফট করছিল তার। ব্যাথা আর যন্ত্রণায় দু'চোখ দিয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে বুকের রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছিল। নেত্রের নোনা জল যখন গড়িয়ে গড়িয়ে বুকের ক্ষততে বিঁধছিল, তখন জয়নালের বুকের যন্ত্রণা আর বাঁচার মিনতি স্ফুলিঙ্গের মত শিউরিয়ে উঠছিল। এমন সময়ই  পাশ ঘেষে হেঁটে চলতে থাকা এক ট্রাফিকের কানে পৌছায় জয়নালের আর্তনাদ। যে হাত আর যেই বুক মাটিতে ফসল ফলিয়ে ফলিয়ে ঘাম ঝরিয়েছে অবিরত, সেই হাত আর বুক শরীরের রক্তেই ভাসছিল জয়নালের। ট্রাফিক পুলিশ জয়নালকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই জয়নালের প্রাণবায়ু পরপারে চলে গিয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর হৃৎপিন্ড ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারনেই জয়নাল মারা গিয়েছিল বলে জানায় একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
  
জয়নালের গায়ে যে শীতের কাপড় জড়ানো ছিল, সেই কাপড়েরই কোনো এক পকেটে এলোমেলো আর আঁকাবাঁকা করে এক টুকরো কাগজে জয়নালের ঠিকানা লেখা ছিল। গ্রাম থেকে এখনো যারা দুর-দুরান্তে যায়, তাদের প্রায় প্রত্যেকের পকেটেই ছোট একটুকরো কাগজে নিজের ঠিকানাটা লিখে নিয়ে যায়– যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়– তাহলে বাড়ির লোকের কাছে খবর পৌছিয়ে যায়। যে নিজে লেখাপড়া জানে টুকটাক, সে নিজেই লেখে। আর যে লেখাপড়া জানেনা, সে অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। ওসব কথা থাক এখন। ঠিকানা পেয়েই সাতপুকুরিয়া গ্রামে খবর পাঠিয়েছিল পুলিশ। আর ইতোমধ্যেই একজন অনলাইন পত্রিকার রিপোর্টার জয়নালের লাশের ছবি দিয়ে নিউজ করেছিল। সেই খবর মুহুর্তেই ভাইরাল হয়েছিল। হাসিয়ারাদের বাড়ির পাশের সদ্য এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ফেসবুকে ঐ খবর দেখেই হাসিয়ারাদের বাড়িতে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল জয়নালের মৃত্যুর খবর নিয়ে। জয়নালের মৃত্যুর খবরে হাসিয়ারা ঘুটঘুটে অমাবশ্যার এক অন্ধকার কূপে পড়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের সকল মানুষই- আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী– যারা ছিল, তারা প্রায় সবাই স্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক, জয়নালের ছোটভাই তরফদার সর্দার গ্রামের কিছু আত্মীয় স্বজনদের সাথে নিয়ে শহরের সেই হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল। অত:পর, পুলিশি মামলা দায়েরপূর্বক ময়নাতদন্তের নিয়ম সিদ্ধ করেই জয়নালের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল তারা।
সাতপুকুরিয়া গ্রামে তো বটেই, আশেপাশের দশ গ্রামে জয়নালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল।

জয়নালের লাশ যখন বাড়িতে আনা হল, তখন গ্রাম ভেঙ্গে মানুষ এসেছিল তার বাড়ির উপর। জয়নালের আশি বছরের বিছানাগ্রস্থ বাপ চিৎকার করে কাঁদতে পারছিল না। তবে তার চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিলো। আহা! কতটুকু ব্যাথা পেলে একজন মৃতপ্রায় বৃদ্ধ মানুষের চোখে জল আসে– সেই ব্যাথা কেবল সে আর তার মনের সৃজনদাতাই ভালো বলতে পারবেন। অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া বড্ড কষ্টের, জয়নালের কি বা এমন বয়স হয়েছিলো যে এই পঁয়তাল্লিশ-পঁঞ্চাশ বছর বয়সেই তাকে এই দুনিয়া ছাড়তে হল! জয়নালের সত্তর বছরের মা ছেলের লাশ বুকে নিয়ে রীতিমত গড়াগড়ি করে কেঁদেছিল। গর্ভকাল থেকে কষ্ট সয়ে সয়ে সন্তান লালন-পালন করা যায়, আদর-অনাদরে তাদের বড় করা যায় কিন্তু কোনো মা জীবিত থাকাকালীন তার সন্তানের লাশ চোখের সম্মখে দেখার যে কষ্ট আর দু:খ, তা কিভাবে সইবে সে? বাদ দেই সেসব দু:খের কথা। জয়নালের মা কাঁদতেই থাকে। মাঝে মাঝে তার ‘দাঁতে খিল' লেগে যায়, মুহুর্তে মুহুর্তেই মুর্ছা যায় সে। 

জয়নালের বউ হাসিয়ারা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। মাঝে মাঝে এমন মনে হচ্ছিল যে, মনে হয় বুকের ভেতরের যত আর্তনাদ আর কষ্ট সব বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে বুঝি বের হয়ে যাবে। জয়নালের মৃত্যুতে হাসিয়ারার মাথার উপরে সপ্তম আসমান সমেত ভেঙ্গে পড়েছিল। এদিকে সাফিয়া আর সোনিয়াও চিৎকার করে তড়পাতে তড়পাতে কেঁদেছিল। অন্যদিকে জয়নালের তিনবছরের মেয়ে রানিয়াও কিছু না বুজেই কান্না করছিল রীতিমত। কীভাবে মারা গিয়েছিল বা কেন মারা গিয়েছিলো এইসব রানিয়া না বুঝলেও হয়তো এটা বুঝতে পেরেছিল যে তার বাবা আর নেই।

নিজ নিজ নিকট আত্মীয় আর পাড়া-প্রতিবেশীরা মুর্দা দাফনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল;  কেউ বাঁশ কাটে, কেউ কাফন কিনে আনে, কেউ কেউ কবর খোড়ে, আবার ক'য়েকজন মিলে জয়নালকে শেষ গোসল করায়। শেষ দেখা দেখতে অনেকেই এসেছিল। লাশের গোসল শেষে চারজন তাদের কাঁধে করে গোরস্থানে নিয়ে যায় দাফন করার জন্য। এটাই তো নিয়ম! 

হায়রে জীবন! যে জীবনের আগমনে মানুষের এত আয়োজন থাকে, সেই জীবনকে না কত অপ্রস্তুতভাবেই বিদায় দিতে হয়। সন্তানের জন্মের পরে অনেক পিতা-মাতা আগত সন্তানকে সোনা, মানিক, মধু, যাদু ইত্যাদি বলে উচ্ছ্বাসিত হয়ে নিজের কোলে স্বাগত জানায়। আবার অনেক সময় পিতা-মাতা জীবিত থাকাকালীন সময়েই মৃত সন্তানকে জড়িয়ে ধরে সেই একই সোনা, মানিক, মধু, যাদু ইত্যাদি বলে হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদ করে কবরে রেখে আসে। তবে পিতা বা মাতা যদি সন্তানদের উপস্থিতিতে ধরাধাম ত্যাগ করে তখন সন্তানেরা বাবা, আব্বা এবং মা আর শ্রেনীভেদে এর প্রতিশব্দ ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। অথচ পিতা মাতার শব্দ ভাণ্ডারে সন্তানদের পরিচয় বহনকারী নামের পাশাপাশি কত আদরের নাম থাকে!  আজব মায়া আর আদরের সূতার নাটাই বহনকারী এই মাতা-পিতা!  যাইহোক, বিধি-বিধান মোতাবেক জয়নালের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গেল সেইদিন।

যেদিন জয়নালের লাশ দাফন হয়েছিল, সেই রাতে কেউ বিছানাতে ঘুমাতে পারেনি। একমাত্র অবুঝ দুধের শিশু যারা ছিলো তারা ছাড়া। বাদবাকী যারা জয়নালের বাড়িতে ছিলো তারা যে যেখানে বসে কান্না করছিল সেখানেই কেউ কেউ ঘুমিয়ে গিয়েছিল। এইভাবে প্রায় একটানা ক'য়েক দিন ধরে হাসিয়ারার বাড়িতে তার স্বামী জয়নালের অকাল মৃত্যুর শোক চলছিল। আবার ধর্মের বিধান মতে, মৃত্যু পরবর্তী যে আচার-অনুষ্ঠান ছিল, সেটাও পালিত হচ্ছিল এরই সাথে সাথে। তবে হ্যাঁ। জয়নালের মৃত্যুতে  হাসিয়ারা, আর তার তিন কন্যার উপর যে শোকের ছায়া নেমেছিল, জয়নালের ভাই-বোন আর বৃদ্ধ পিতা-মাতাও এক সময় নির্বাক হয়ে যায়। যে যায়, সে আর ফিরে আসে না, এই সান্ত্বনা নিয়েই জয়নালের মৃত্যুর শোক ভুলতে থাকে তারা। 'ও সাফিয়ারার মা। কান্তি (কান্না) কান্তি কি তুই জয়নালের আর পাবি? কান্দিস না বু (বোন)। মেয়ে দু'টোকে বুকে কর। তুই এইভাবে কানলি (কাঁদলে) তো ওরা মরে যাবে’- একদিন কাল সন্ধ্যায় হাসিয়ারাকে কাঁদতে দেখে পাশের বাড়ির মজুর মা এইভাবেই সাত্বনা দিয়েছিল।  

আপন মানুষ চলে গেলে তার সাথে কাটানো বিরহ, রাগ-দু:খ আর ক্ষোভের স্মৃতি মনে হয় মনে আসেনা। তার সাথে অতিবাহিত করা সুখের স্মৃতিগুলো বাবলা গাছের কাঁটার মত বুকে বিঁধে। হাসিয়ারা যেই ঘরে এখন বসত করে, সেই ঘর যে জয়নালের নিজ মেহনতে গড়া। কত মিলন আর বিরহের স্মৃতি জড়িয়ে যে আছে এখানে, তা বলে শেষ করা যাবে না। হাসিয়ারা অনেক দিন আর রাত জয়নালের পরণের লুঙ্গি আর গায়ে পরা জামা বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিল। যাইহোক, দিন যত যেতে থাকে, শোকের ছায়া ততোই ম্লান হতে থাকে। নিজের মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়েই হাসিয়ারা মনে সাহস আনতে বাধ্য হয়েছিল।

জয়নালের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হাসিয়ারাকে নতুন জীবন যুদ্ধে জড়াতে হয়েছিল। নিজের স্বামীর নামের বিঘা তিনেক জমিতে যে ফসল ছিল, সেগুলো এতোদিনে জয়নালের ছোট ভাই দেখাশুনা করে দিয়েছিল। তবে সবার সংসারেই কমবেশি কাজ থাকে।  একসময় জয়নালের ছোট ভাইয়ের সংসারে কাজের চাপ বাড়তে থাকে। দুই সংসারের কাজ সামলাতে গিয়ে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। আর তাছাড়া দুই এক সপ্তাহ হয়তো নিকট আত্মীয় আর  পাড়া-প্রতিবেশীরা খাবার-দাবার দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একসময় না এক সময় নিজের উনুন জ্বালাতেই হয়। হাসিয়ারাও এক সময় উনুন জ্বালিয়েছিল। প্রতিদিনের মত ভাত-তরকারি রান্না করত; শুধু জয়নাল যে পরিমাণ খাবার খেত,  সে পরিমাণ খাবার বাদ দিয়েই রান্না হত। শুধু উনুন জ্বালিয়ে পার পাওয়ার উপায় ছিল না হাসিয়ারার, কোনো পুত্র সন্তান না থাকার কারনে তাকে সংসারেরও হাল ধরতে হয়েছিল। যাইহোক, এইভাবেই একসময় প্রিয়জনের শোককে আড়াল করে তার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়, জীবন চালাতে হয়।
 
নিতবরের রীতি-নীতি আর ননদিনীর বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করে হাসিয়ারা যেইদিন হাতে দা আর কোমরে করে পানের ঝুড়ি নিয়ে নিজ স্বামীর পানের বরজে গিয়েছিল, সেইদিন গ্রামের অনেক ময়মুরুব্বি আর সদ্য জাতে ওঠা নিজ আত্মীয় স্বজনের অনেকেরই ইজ্জতে আঘাত লেগেছিল। হাসিয়ারার মেজো দেবর তো রীতিমত হাসিয়ারার সংসারের ভার নিজে নিতে চায়, তবুও তার ভাইয়ের বউকে সে মাঠে যেতে দিবেনা।

ননদিনীর পর্দার জাল সরিয়ে সেইদিন হাসিয়ারা জয়নালের ভিটামাটি রক্ষা আর সোনিয়া ও রানিয়াকে বাবার দু:খ ভুলিয়ে নতুন জীবন শুরু করার এক যুদ্ধে নেমেছিল। এমন কি জয়নালের সাথে কাটানো প্রথম বাসরের আলাপনে সমাজ এবং সংসারের যে নিয়ম-কানুনের দীক্ষায় হাসিয়ারা দীক্ষিত হয়েছিল, সেই দীক্ষাতেও চিড় ধরেছিল বেঁচে থাকা নামক জীবন জাহাজের নোঙ্গর চালানোর জন্য। 'মেয়ে মানুষের বাড়ির বাইরে যেতে নেই। পরপুরুষের সামনে গেলে পাপ হয়'- সেই দিনকার সেই নিতবরের মহা বয়ান  হাসিয়ারার কাছে বড্ড ধূসর ঠেকেছিল। সাতপুকুরিয়া গ্রামের মানুষের জাত আর মান খুব ঠুনকো। একেবারে অল্পতেই খসে যায়; জ্বলন্ত মোমবাতির মত। এইখানে স্ত্রীলোক ঘরের বাইরে গেলে পাপ হয় কিন্তু পুরুষগণ চুরি করলে, পর-নারীর সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করলে বা একের অধিক বিবাহ করে স্ত্রীদের ভরণ-পোষণ না দিলে, জমি চাষের সময় অন্যের জমির আইল ভাঙলে, বৃদ্ধ মা-বাবার পাতে খাবার না দিলে, আপন ভাই হয়ে আপন ভাই আর বোনের গায়ে হাত তুললে, মসজিদে মসজিদে উদ্দেশ্যহীন আর বেপড়োয়া ফতোয়া দিলে এদের পাপ হয় না বা জাত যায় না। এদের জাত যায় শুধু স্ত্রীলোক ঘরের বাইরে গেলে।  যাইহোক, সেইদিন হাসিয়ারার বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ফসলের মাঠে যাওয়াতে যেমন অনেকের জাত-মান গিয়েছিল, তেমনি আবার অনেকেই আহাজারি করে বিধবা হাসিয়ারাকে সাহস দিয়েছিল। 'পেটে ভাত না থাকলে মান ধুয়ে খাব? আর তাছাড়া চুরিদারি তো করছিনে। কাজ করে খাব, কাজ করিয়ে খাওয়াব।' -  এইসব বলে মজুর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে হাসিয়ারা।

জয়নালের মৃত্যুর পর হাসিয়ারার পিতা-মাতা আর ভাই-বোন অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল হাসিয়ারাকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে। তবে হাসিয়ারার মুখে একটাই কথা ছিলো যে স্বামীর ভিটা আর মাটি থেকে সে একপাও নড়বে না। হাসিয়ারার বাবা বেশ বুদ্ধিমান ছিল। হাসিয়ারার দুই কন্যা; সোনিয়া আর রানিয়া সাবালক না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকার যৌক্তিকতা ছিল। যৌক্তিকতা এই অর্থে যে,  অন্তত এইখানে থাকলে জয়নালের যে সহায় সম্পত্তি আছে, এইগুলোর উপর ভর করেই সোনিয়া আর রানিয়া মানুষ হতে পারবে। আর এক সময় সাবালক হলে তাদের নামে যদি সম্পত্তি থাকে, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও নিরাপদ হবে। যাক গে সে কথা, নিজের কন্যাদ্বয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জয়নালের ভিটাতে বসবাস করতে থাকে হাসিয়ারা। 

এইভাবে মাস তিনেক যাওয়ার পরে একদিন সাফিয়া তার স্বামী বকুল এবং তাদের একমাসের দুধের বাচ্চা কোলে নিয়ে হাসিয়ারার বাড়িতে এসেছিল। প্রায় মাস খানেক ছিলও তারা। জামাই মাঠের কাজ দেখাশুনা করত। বাজারের বেচা-কেনাও সে করত। 'মাগির এতদিনে নিজে কাজ করে হয়নি। এখন জামাই দিয়ে কাজ করাচ্ছে'- একথা নেপলার মা ঘটা করে বলে বেড়াচ্ছিল। তবে মজুর মা দরদী ছিল। 'যাক বাবা, তুমি এসেছো ভালো হয়েছে। শ্বাশুড়ি হোক আর যেই হোক, সে তো তোমার মায়ের মতই। আর শালি দুটোকে নিজের বোন ভেবে এই সংসারের থাক বাবা। তোমার শ্বশুর মরার পরে তোমার শ্বাশুড়ির এত কষ্ট চোখে দেখা যায় না।' বকুলের হাত ধরে বলতে বলতে অনর্গল কাঁদতে থাকে মজুর মা।  

'জামাই অতি আদরের ধন, জামাই দিয়ে কাজ করালে মান যায়'- নিতবর আর ননদিনীর নিয়ম-রীতি এইভাবেই চেপে বসেছিল হাসিয়ারার উপর। আর বকুল একটু আলাভোলা স্বভাবের ছিল। লোকের কথায় উল্টা-পাল্টা চলত। পাড়ার সব লোক তো আর হাসিয়ারার ভাল চাইত না। বেচা-কেনাতেও উল্টা-পাল্টা করত। আর তার থেকেও বড় কথা হাসিয়ারার ছোট দেবর কোনোভাবেই চাইত না যে কোন মদ্দ্য মানুষ স্থায়ীভাবে এই ভিটেতে বসবাস করুক। মুখে প্রকাশ না করলেও আকারে ইঙ্গিতে সে রীতিমত বোঝানোর চেষ্টা করত।

যাইহোক, একদিন হাসিয়ারা তার পাগলাটে জামাই আর সাফিয়াকে বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দিলে, তারা সাতপুকুরিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল।  'জমি অসম্ভবে ভাগাড় চাষ, আর ছেলে অসম্ভবে জামাই নিয়ে বাস'- এ যেন ভীষণ তিক্ত এক সত্য। পরঘরে জামাই ছেলের মত হতে পারে কিন্তু ছেলে হয়না। জামাই শত আদরের হলেও শাসন করার অধিকার থাকে না।  যাইহোক, এরপরে সোনিয়া আর রানিয়াকে নিয়ে হাসিয়ারা বসবাস করতে থাকে। 

সব ক্লেশ আর জরাকে দু'পায়ে ঠেলে হাসিয়ারার জীবন ভালোই চলছিল। সোনিয়াও বেড়ে উঠতে থাকে। এদিকে একসময় হাসিয়ারার ছোট দেবর এবং মেজো দেবর বিদেশ চলে গিয়েছিল। হাসিয়ারার শ্বশুরও পৌঢ়ের ভারে ভুগতে ভুগতে মারা গিয়েছিল। পুরুষ মানুষ বলতে হাসিয়ারার মেজো দেবরের পনেরো বছর বয়সের আশিক ছাড়া আর কেউ-ই ছিলো না। একই গ্রামের হাতেম নামে হাসিয়ারার খালাতো দেবর মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে আসত। 

মানুষের বিখ্যাত হতে সময় লাগে বটে। অনেক 'কাঠ-খোড়' পুড়িয়ে মানুষ সেই সুনামের কাছাকাছি যায়। কিন্তু কুখ্যাত হতে বেশি সময় লাগেনা। চোখের পলকেই কুখ্যাতির তকমা জোটে। যাক গে সে কথা। অনেক ঘাটের জল খরচ করে আর সংসারের অনেক কাজ ফাঁকি দিয়ে হাতেম রীতিমত সদ্য বিধবা হওয়া প্রায় শেষ যৌবনা হাসিয়ারার সংসারের খাদেম হয়। কিন্তু কোনো এক রাতে হাসিয়ারাকে ঘুমের মধ্যে আচমকা জড়িয়ে ধরাতেই হাসিয়ারার হাতে রাম দা উঠেছিল তার সেই খালাতো দেবর হাতেমের উপর। মুহুর্তেই উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল হাতেমের এতদিনের ভালো মানুষ সেজে থাকার মুখোশ। ফ্যাঁকাসে আর  বেলুনের মত  চুপসানো মুখ নিয়ে সেই যে বিধবা হাসিয়ারার বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরেছে, তারপর থেকে আর ঐ বাড়ির ত্রিসীমানায় যায়নি হাতেম।

সেদিন হাতেমকে রাম দা দিয়ে তাড়ানোর পরে অবশ্য হাসিয়ারার ননদিনী আর নিতবর বেশ নাখোশ হয়েছিল। তবে নিজের ইজ্জত যে নিজেকেই রক্ষা করতে হয়, এটা হাসিয়ারা শিখেছে। ঐদিন ঐ ঘটনার পরে অনেক মদ্দ্য লোকেরই গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। বাজে মতলব যাদের ছিল, তারা রীতিমত কিছুদিনের জন্য হলেও সাবধান হয়েছিল। হাসিয়ারার অন্য দুই দেবরেরও বউয়েরাও বিছানায় একটা করে রাম দা নিয়েই ঘুমায় তখন। হাসিয়ারা ওদের সাহস যুগিয়েছিল। 

এইভাবেই দু'য়েক বছর যায়। সোনিয়া বেশ গায়ে গতরে বড় হয়ে যায়। ভালো একটা সম্বন্ধ আসাতেই হাসিয়ারা তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। হাসিয়ারা নিজেই তার জাদ্বয়কে নিয়ে সোনিয়ার বিবাহের যত কাজ সম্পন্ন করেছিল। পুরুষগণের মুখের দিকে না তাকিয়েও যে নারীরা ঘরের বাইরের কাজ আর সামাজিকতা যে ধারালোভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তা হাসিয়ারা করে দেখিয়েছিল। 

সোনিয়ার কপালে সুখের ছোঁয়া মিললেও রানিয়ার কপালে তা জোটেনি। রানিয়া বেশ আগে থেকেই একটু রোগাটে ছিল; একেবারে ট্যাংটেঙা চিচিংগার মত। সোনিয়ার বিয়ে হওয়ার মাস তিনেক পরে রানিয়ার বড় অসুখ হয়। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখালে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সার ধরা পড়ার মাস তিনেক পরেই রানিয়া মারা যায়। রানিয়া মৃত্যুতে হাসিয়ারা নিথর হয়ে গিয়েছিল। 

দিন যেতে থাকে, হাসিয়ারা শোক ভুলতে থাকে। জীবন যুদ্ধের জরা বৃত্ত থেকে হাসিয়ার রেহাই মেলেনি। হাসিয়ারার জীবন সংসার বড্ড অভিমানের। সংশয়ের বিরহমালা তার জীবন থেকে সরেনা। 

আজ আর মাঠের কাজে যাওয়া হবে না হাসিয়ারার। আজ জয়নালের হত্যা মামলার রায় দিবে। দুই মেয়ে আর জামাইদের সাথে নিয়ে ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধে আদালতের দিকে রওনা হয় তারা।


সূচিতে ফিরতে ক্লিক করুন

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।