স্বপ্নভাঙা সারথী ।। মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী


আবিদ চঙ্গভান্ডা গ্রামের তেত্রিশ বছরের উচ্চ শিক্ষিত কর্মঠ এক যুবক। এক স্বপ্নবাজ পুরুষ। সবসময় নতুন করে স্বপ্ন দেখা তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই কিশোর বয়স থেকেই সে স্বপ্ন দেখে সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকার। বস্তুতপক্ষে আবিদ সাদামাটা জীবনের অধিকারী। ব্যক্তিজীবনে নানা চড়াই উৎড়াই মধ্য দিয়েই সম্মুখপানে এগিয়ে চলা। স্ব অবস্থানে নিজের কর্মকৌশল ধরে রেখে ধীরগতিতে একটি সুন্দর ক্যারিয়ারের দিকে ধাবিত হওয়া। আবিদের ব্যক্তিগত অপূর্ণতা এতটাই প্রকট ছিল যে- একটা সময়ে এসে তার মুখ থুবড়ে পড়ে। মনের যত অতৃপ্তি, অযত্ন-অবহেলা এবং না পাওয়ার বেদনাগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে দুর্বলতার সুযোগে সে কেবলই মানুসিক অসুখে ভুগেছে। লাভের লাভ বা কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোন কোন সময় তো নিজেই ধরাশয়ী হয়েছে, পরাস্ত হয়েছে অতৃপ্ত ভাসনারা পূর্ণতা করতে গিয়ে। প্রতিপক্ষ হয়েছে নিজের ঘরের আপন লোকও। তবুও সে স্বপ্ন নিয়েই প্রাত্যহিক জীবনে আত্মরক্ষামূলক দীর্ঘপথ হেঁটেছে আবিদ। মাঝে মধ্যে প্রচন্ডভাবে হোঁচটও খেয়েছে। বিচ্ছেদ-বিরহের কষাঘাতে ঘরেরশত্রু বিভীষণের অনলে পুড়ে পুড়ে এভাবেই ছাই হয়েছে তার হৃদয় মন। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে হৃদপিন্ড। তবুও মননের যতসব বেদনা, তা ছাইচাপা দিয়ে গৃহদাহের নীরব যাতনাগুলো জনসম্মখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে কাটিয়েছে। আত্মসম্মান বোধবুদ্ধির দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের সব অব্যক্ত কথামালা কারো কাছে কখনও বলতে যায়নি। কিন্তু সেই আপেক্ষিক প্রশান্তির খোঁজে অবিরাম ছুটেচলা নিয়মটা যেন আবিদ কখনোই ছাড়তে পারেনি। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পেরে নীরবে নিভৃত্বে মানুষের নজরের আড়ালে কত কেঁদেছে, কত চোখের জল গড়িয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। পারিবারিক এই তাপদাহ থেকে সরে আসারও কোন সুযোগ ছিলনা আবিদের, আর তা ছিল সঙ্গত কারণেই। 

আবিদ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা এক যুবক।  একাদশ শ্রেণির গন্ডি পেরোনোর আগেই ওপারের পাহাড়ি এক সুন্দরী ললনার প্রেমে হাবুডুবু খায়। একটা সময়ে ওই সুন্দরীর প্রেমে মজে থাকে। সে ছিল খাসিয়া সম্প্রদায়ের বোঁচা নাক মসৃণ অবয়বের এক রাজহংসী। কিন্তু তার পরিবার সে সম্পর্কটা মেনে নেয়নি। পরিবারের বোধহীন মানুষগুলোর চরম অজ্ঞতা এবং নিজের যৌবন কামমোহ একটা সময়ে উন্মাতাল পথেই তাকে টেনে নেয়। এমন বিরহে সারা জীবনের জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার মধ্যেই দাগ কাটে তার। বাস্তবতায় শুদ্ধ ভালোবাসার অনুপস্থিতি আর অতৃপ্তি বেদনা নিয়ে সে থেকেই তার পথচলা শুরু। আবিদের পিতার ওপর ভর করেই সংসার চলে তখন। তিনিই তখন সর্বেসর্বা, হর্তকর্তা। তখনও পারিবারিক দায়ভারটা তার ওপর বর্তায়নি। অধিকন্তু উচ্চশিক্ষার অদম্য চিন্তা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগুতে থাকে আবিদ। অপূর্ণতার ঘেরাটোপ আর চুম্বনহীন তার ললাটে ক্রমেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এক অদৃশ্য ক্ষত, যে ক্ষত দেখা যায়না, ছুঁয়াও যায়না। সে যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রতিক্ষণে বড্ড বেনান মূর্র্তির ন্যায় হয়ে ওঠে। গৃহদাহে কালো টুকরো দাগ পড়ে যায় তার ললাটে। তবুও সুন্দর আগামীর প্রত্যাশার স্বপ্ন পূরণে বিভোর হয়ে পড়ে আবিদ। সে সময়েও থেমে ছিলনা তার পরিশ্রমী পথচলা। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটা সময়ে সেই স্বপ্নের পথে সফল যাত্রা। কিন্তু অপূর্ণতার চাপে সে সবসময়ই ছিল ক্লান্তশ্রান্ত। অপূর্ব সুন্দর সম্মানের জায়গায় অবস্থান করেও মনের প্রশান্তির অভাবটা ছিল তার প্রকট। সেও কী নাছোড় বান্দাহ। পূর্ণতার খোঁজে বিরামহীন তার পথচলা থেমে থাকেনি। একটা সময়ে অনেকটা আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েই দিব্যি হাঁটেত থাকে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে। নানা রকম বাধা-বিপত্তি, অসংকোচ অসংঙ্গতির মাথা খেয়ে নিজে সে পথেই হাঁটে। এক শুদ্ধ ভালোবাসার সন্ধানে কত নিদ্রাহীন রাত কেটেছে আবিদের। সত্যিকারের প্রেমিকার খোঁজতে খোঁজতে হয়েছে সে ভবঘুরের পথিক। অবশেষে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সেই স্বপ্নীল প্রেয়সির সন্ধান পায়। অপেক্ষার প্রহর কেটে যেন যুগপৎ পঞ্চদশীর চাঁদ তার মাথার উপর উঠে আসে। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে আবিদ। গভীর রজনীতে সীমান্তের চঙ্গভান্ডা নিভৃতপল্লীর ঝাউবনে বসে সেই কুঁড়িয়ে পাওয়া প্রেয়সির নামেই আবিদ বাঁশরীতে সুর তুলে। প্রেয়সি প্রেম নিবেদেনের সেই সুরে সময়ের ব্যবধানে অনেকটাই উন্মাতাল হয়ে যায়। বাঁশরীর সুরে বিমোহিত হয়ে এক কৃষ্ণকালো আধাঁর রাতে প্রেয়সি ছুটে আসে ঝাউবনে। মুহুর্তেই যেন আঁধার কেটে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে ঝাউবনজুড়ে।
-    
এই তুমি কে গো নাগর! বাঁশরীতে কেবল আমার নামেই সুর তুলছো! তা কী আমি বুঝিনা এত রাতে তোমার বাঁশরীর সুরে আমি গৃহে যে আর থাকতে পারলামনা! দিন ধরেই তো দেখছি তোমার এমন হাবভাব। বেশ ভালো মনে হচ্ছেনা তো!
-    
তাহলে তুমি বাঁশরীর সুর শুনলে? সে তো তোমার জন্যই বাজানো।
-    
মানে? আমার নামে সুর তুলছো বাঁশরীতে, আর আমি বুঝবোনা। তা কেমন কথা! আর তাই তো আমি ছুটে এলুম এই আঁধার রাতেও ঝাউবনে তোমার কাছে।
-    
তাই বুঝি!
-    
হ্যা তাই। তো বল তো দুষ্টু ছেলে ! তোমার বাঁশরীতে সুর তুলতে আর কাউকে পেলেনা বুঝি! শুধু আমাকেই কেন বেছে নিলে?
আবিদ ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে এমফিল করার মনস্থির করেছে। তার আগে থেকেই অদম্য ইচ্ছে ছিল গ্রাজুয়েশন শেষ করে উচ্চতর গবেষণায় কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পিএইচডি করবে। এদিকে রেবেকাও পড়াশোনা করছে ইডেন মহিলা কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স তৃতীয়বর্ষে। কিন্তু রেবেকা আবিদের এমন অপূর্ণতার কথা জেনে প্রথম দিকে তার সাথে শুধুমাত্র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বজায় রেখে তার আবেগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তার একজন ভাল লাগার মানুষ হয়েই থাকতে চেয়েছিল। অধিকন্তু আবিদ তার এই কৌশল বুঝতে পারেনি। আবিদের পুড়া মন বার বার রেবেকাকে নিজের মতো করে পেতে আবেদন নিবেদন করেই যাচ্ছিল। কখনও কখনও আবেগী হয়ে পড়তো। রেবেকাও তা বুঝতে না দিয়ে মিথ্যে অভিনয় শুরু করে। অন্তত সে যাতে একেবারেই চলে না যায়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা যেন বজায় রাখে। তাই চটিয়ে তাকে সময় দিতে লাগলো রেবেকা। এভাবে অভিনয় করতে করতে একটা সময় আবিদের ভালোবাসার মায়াজালে নিজেই বন্দি হয়ে হয়ে যায় সুন্দরী ওই যুবতী। একেবারে অন্ধ প্রেমিকার ন্যায়। হামলে পড়ে আবিদেও প্রেমে। বাস্তবতা যতই কঠিন হোক না কেন, সেও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তাকে হাত ছাড়া করা যাবেনা। একদম সাদামাটা অভিনয় থেকে প্রকৃত ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়লো রেবেকাও। দুজনেই অস্তি মজ্জায় নিমজ্জিত। কথায় কথায় আবিদ বলল-    
রেবেকা নামেই যে আমার বাঁশরীর সুরটা বাজে। আমি তো এই রত্নকেই খুঁজছিলাম। খোঁজতে খোঁজতে কত অনলে পুড়েছি, আঘাতে আঘাতে আজ আমি নিঃস্ব, হয়েছি ভারাক্রান্ত।
-    
তাই এতটা বিষাদ তোমার কীসের নাগর! আমি শুনতে পারি!
-    
হ্যা তা তো বটেই। আমার জীবনে হৃদয় উপত্যকায় বইয়ে যাচ্ছে কঠিন বিষন্ন খরা। যা আজো মন্তর গতিতে চলে আমার হৃদয়ের রংচটা অনুভূতিগুলো। অপূর্ণতার ঘেরাটোপে আমি আজ বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছিনে এমন অসারতায় ডুবে থাকতে।
আবিদের সব কিছু শুনে রেবেকা খানিকটা ভাবনা পড়ে গেল। কী একটা মানুষ! কি অনলে পুড়ছে। দুঃখে দুঃখে জীবন কাটছে এই হতভাগার। সে ভেবে আবিদের কাছে সময় নিল। দিন পর এসে সবুজ সংকেত দিল রেবেকা এবং খুব ভেবে চিন্তে নিজের স্বাধীনতা থেকেই তার স্বাধীন মতের জানান দিল।
-    
আচ্ছা শুনো আবিদ। আমি তোমার বাঁশরীর সুরের এতটাই ভক্ত হয়েগেছি যে, আমি যদি এই অপূর্ণতার গৃহে যেতে চাই, তুমি নেবে আমায়।
-    
তুমি পারবে তা মেনে নিতে! না কেবলই শান্তনা দিচ্ছো!
-    
হ্যা কেন পারবোনা। তুমি যে আমার কাব্য সারথি। জেনেশুনে তোমার এক বাহু হয়ে জীবন কাটাতে পারলেই তো আমার স্বার্থকতা আসবে। আমি তাই ভাবছি।  
-    
ঠিক জন্যই তো প্রতিদিন গভীর রাতে ঝাউবনে বসে তোমার নামে বাঁশরীতে সুর তুলি। তোমায় নিয়ে গভীরভাবে ভাবি।
-    
আমিও তা জানি আবিদ। সেখান থেকেই তো ভাললাগা। আর তাই সব কিছু মাটিচাপা দিয়ে আমি তোমার কাছেই চলে এলুম। আমিও তোমার হতে চাই।
-    
আচ্ছা তা কী সত্যি বলছো রেবেকা। না কেবলই আমায় শান্তনার মুখরোচক অশারবাণী!
-    
তবে কী মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি! আমি তোমার হওয়ার অধিকার চাই এবং এটিই চুড়ান্ত। এতেই আমি সন্তোষ্ট।
-    
সে তো আমার পরম পাওয়া। আমি যা চাই তাই পেলুম। তবে আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে শুরুতেই কেটে পড়া শ্রেয়। নতুন করে কষ্ট নিয়ে বেড়াতে পারবোনা যে।
-    
সে বিশ্বাস যেন তুমি রাখতে পারো, এই নিবেদন করছি। আর তোমাকে পেলে আমারও পরম পাওয়া হবে বলে মনে করছি।
-    
তুমি তো অনেক ভাবেই স্বাধীন। তবে কীভাবে পাওয়টা স্বার্থকতা হবে!
-    
সে ব্যাখ্যাটা যদিও জানা নেই। তবে এতটুকুন জানি আমিও তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। অনেকটাই তোমার প্রতি দুর্বল।
-    
তা সত্যি! এই বিশ্বাস রাখতে পারি।
-    
হ্যা তাই রাখতে পারো। তবে হবে আমার জন্য এক সংগ্রামের। এক অনবদ্য সংগ্রামের। তবুও আমি তোমার কাছে থাকতে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে অটল অবিচল থাকবো শেষ অবধি। যদি তুমি থাকো।
-    
সে আমি কথা দিলুম। আমি তো তোমাকে পেতেই বহুদিন ধরে নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছি।
-    
তাহলে চালিয়ে যাও। আমি আছি, পাশে থাকবো, সফলতার চুড়ায় পৌছা অবধি পর্যন্ত হাল ছাড়বোনা। সফল হলেই তো আমি আর তুমি যুগলবন্দি জীবন কাটাবো।   
রেবেকা খুব কম সময়ে সবকিছু জেনেশুনেই সারা দেয় আবিদের প্রেম নিবেদনে। সুরে সুর মিলিয়ে আবিদের অনলে পুড়া মননের সব কিছুই শুনে রেবেকাও উদগ্রীব আবিদের প্রেমে। একটা সময়ে সব কিছু জেনেশুনে নিজের স্বার্থ পরিত্যাগ করে একটা নিখাদ প্রেমের প্রত্যাশায় নিজেকে সোপর্দ করে দেয় আবিদের তরে অবশেষে আবিদের অপূর্ণতার গৃহে পা রাখার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় রেবেকা। খুব কম সময়ে দুজন এক স্বর্গীয় প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়। দিন যত ঘনাতে থাকে রেবেকা অনেকটাই ভক্ত এবং মানবিক  হয়ে ওঠে। দুর্বল হয়ে পড়ে আবিদেও ভালোবাসায়। সংগোপনে শুরু হয় তাদের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। কিন্তু রেবেকা পরিবার পরিজনকে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি। তার এক বোন কিছুটা জানতো তার গোপন সম্পর্কের ব্যাপারটা। রেবেকা আগে থেকে জানতো সম্পর্কটি কেউ মেনে নেবেনা। না পরিবার, না অন্য কেউ। তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছে একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি চটিয়ে প্রেম করে যাবে এবং তা কেবল গোপনই থাকবে। এভাবেই চলতে থাকে রেবেকা আবিদের প্রেম
-    
এই আবিদ শুন। তুমি বাঁশরীতে তো খুব সুন্দর তুলতে পরো। তবে কী গান গাইতে পারো?
-    
না আমি প্রেমের কবিতা পাঠ করতে পারি এবং তা অনেক মন মাতিয়ে কন্ঠদান করতে পারি। শুনবা?
-    
হ্যা আমি উদগ্রীব। শোনাও
-    
আমি কবি নই, তবুও এক কবির কবিতাটি তোমার জন্যই পাঠ করছি এবং এটি নিবেদনও করছি তোমায়
‘‘
আমার শেষ বিকেলের প্রেম নিবেদন
এই ছিল যে শেষ চাওয়া,
কথা দিয়েছো অকপটে তুমি
ছেড়ে যাবেনা এবেলা, পরবেলা কোন বেলা।
তোমার ভালবাসায় অতৃপ্ত হৃদয় আমার পূর্ণতা পেয়েছে
পূরণ হয়েছে আজি প্রত্যাশার সাতকাহন,
অযুত স্বপ্নে বিভোর আমি
যুগলবন্দিতে কাটবে শীত গ্রীষ্মের দিন
বুকে বেঁধেছে তাই প্রবল আশা।
বেলায় এসে ভালবাসাহীন হয়ে গেলে আমি
হবেনা আর স্বচ্ছলতার ঘর বাঁধা,
বেদনা নিয়েই থাকতে হবে আমায়
কলংক সে তোমারই হবে, করতে পারবেনা যে দায়সারা।
সুখে হোক দুঃখে হোক
একই সঙ্গে কাটবে দুজনের যুগলবন্দি জীবন
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক!
ইতিহাস ঠিক করবে তা স্মরণ,
তবুও তোমার বুকে মাথা রেখেই যেন হয় আমার মরণ।’’
-
বাহ আবিদ তুমি তো দারুণ আবৃত্তি করলে তো। আমায় নিবেদনকৃত কবিতার কথামালাও সেই। আমি আরও তোমার ভক্ত হয়ে গেলাম গো।
-
তাই রেবেকা আমি তোমায় পূর্ণ মর্যাদা দিতে চাই।
-
হ্যা তাই।
-
আচ্ছা রেবেকা কখনও তুমি এসব আবেগ জড়ানো প্রেম-ভালোবাসার কথা ভুলে যাবে। পারিবারিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক বাধা বিপত্তি, আশপাশের মানুষগুলোর কথায়! একেবারেই বাদ দিতে পারবে?
-
এই আবিদ আমি কখনও কারো প্রেমে মত্ত হয়নি, কারো সাথে এমন প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। এটিই আমার প্রেমপ্রত্যুষ। আমি এর নাম দিলাম অধ্যায়। আজ হতে আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু।
   যে অধ্যায় কেবল তোমার আমার,
  
যে অধ্যায় তীব্র ভালোবাসার।
    
যে অধ্যায় শুধু সময়ে অসময়ে চুমু খাওয়ার,
    
যে অধ্যায় হাতে হাত রাখার।
-    
আমি তা বিশ্বাস করি। জানো আমার বেলায় এসে যদি হেরে যাই। তোমায় না পাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই যে অসার হয়ে যাবে।
-    
সে তো আমারও
-    
সত্যিই মন থেকে বলছো?
-    
হ্যা সত্যিই তাই।
-    
আমি এর প্রতিদান শোধ করতে পারবোনা জানি। তবুও কথা দিচ্ছি আমি অনলে পুড়েও তোমায় শীতল উষঞতায় তোমায় আগলে রাখবো সারা জীবন। বিনিময়ে এক নদী রক্ত দেব তোমায়।
-    
আমি সেটা চাইনা। আমি চাই তুমি আমি দুজনেই শীতল হিমেল হাওয়ায় উজাড় করা স্নিগ্ধ ভালোবাসায় আমৃত্যু স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করবো। এক সাথে সারা জীবন কাটাবো।  
-    
আমিও তো তাই চাই। তবে কী সে অধিকার আছে আমার! তুমি চাইলেই হল।

একটা সময়ে এসে দুজনেই গভীর প্রেমে ডুবে যায়। নিজেরাই একটা সময় নির্দিষ্ট করে ওই সময়ে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার। দুজনের মধ্যেই বিশ্বাসটা ছিল অকাট্য প্রামাণিক। তবে পারিবারিক বাধা বিপত্তি এবং নানাবিধ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এবং যৌক্তিক কারণে তাদের সম্পর্কটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত আগেবাগেই চুড়ান্ত হয়। এমন প্রস্তাবনা প্রথমে রেবেকার কাছ থেকেই আসে। আবিদ তা সাপোর্ট করে এবং দুজনেই গোপনীয়তা রক্ষা করেই সম্পর্ক অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এভাবেই চলতে থাকে তাদের গোপন প্রেম, গোপন ভালোবাসা। সময়ের ব্যবধানে বিশ্বাসের জায়গাটা দুজনেরই আরও শক্ত হয়। একজন আরেকজনকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে এবং ভালোবাসে। কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায়না। মাঝে মাঝে দেখা হতো আড়ালে আবদালে। মুঠোফোনে কথা হতো রাতবিরাতে চটিয়ে একটি মুহুর্তের জন্য দূরত্ব হলেই তাদের মধ্যে অভিমান হতো, কথাকাটাকাটি হতো। তবে ভালোবাসা ছিল দুজনের প্রচন্ড। রাগারাগি হলেও তৎক্ষনাৎ তা মিটিয়ে দেয়া হতো। এরই মধ্যে আবিদের সহপাঠি বন্ধু মাইশার সাথে কথা হয়। মাইশা ঢাকাবিশ্বদ্যিালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত এক সাথেই পড়াশোনা করেছে দুজনে। আবিদের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু বটে মাইশা। তার পারিবারিক সমস্যাগুলো আগে থেকেই জানা ছিল। তার এই গোপন সম্পর্কের কথা বলা বারণ হলেও অতি বিশ্বাসে এবং একান্ত বন্ধু হিসেবে বিষয়টি শেয়ার করে মাইশার সাথে। সেও ভালো করেই জানতো রেবেকাকে। আবিদ তার বন্ধুকে বিষয়টি কারো সাথে শেয়ার না করার শর্তে প্রতিশ্রিুতি নেয়। এর কিছুদিন পরে  হঠাৎ দেখা হয় তাদের ঢাকায় একটি কনফারেন্সে। সেখানে আরও খোলামেলা আলোচনা হয় রেবেকার সাথে তার গোপন সম্পর্ক নিয়ে।
-    
কিরে বন্ধু কেমন চলছে তোর প্রেম। সে কী সত্যিই তোকে ভালোবাসে, তোকে চায়? না অন্য কিছু। তবে নিয়ে সবসময় সতর্ক থাকিস। ক্ষতি হলে তোর বেশি হবে।
-    
চলছে তো চটিয়ে এখন পর্যন্ত তো সব ঠিকই আছে।
-    
সে কোনভাবে ফেক কিছু করছেনা তো? দেখিস!
দিনের পর থেকে সে প্রায়শই অতি উৎসাহী হয়ে নিজে থেকে ফোন করেই বন্ধু আবিদের খোঁজ খবর নিতো। কেমন চলছে, কি হচ্ছে জানতে চাইতো। আবিদ বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে তাকে সব আপডেটও দিতো। প্রেম যখন গভীর থেকে আরও গভীরতর হলো, সে মুহুর্তে রেবেকা আবিদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু আপত্তিকর কথা তৃতীয় পক্ষের কাছে শুনতে পেল। যা আদৌ সত্য ছিলনা। প্রথম দিকে অভিনয় থেকে সত্য ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়া। এর মানে ধর্ষনের অভিনয় করতে গিয়ে নিজেই ধর্ষিত হওয়ার মতোই কান্ড ঘটে গেল রেবেকার জীবনে। যা আবিদ বুঝতে পারেনি। আবিদ প্রথম থেকেই জানতো রেবেকাও সত্যিকার অর্থে প্রচন্ডভাবে তাকে ভালোবাসে এবং শেষ অবধি তার কথা থেকে সে সরে যাবেনা। আবিদ সে পথে, সে ভাবেই হাঁটতে শুরু করলো। একটা সময়ে মধ্যস্বত্তভোগীর ন্যায় তৃতীয় পক্ষের কেউ তাকে  আবিদের ব্যাপারে কিছু বুঝাচ্ছে এবং এমন প্রেম পরিহার করার পরামর্শও দিচ্ছে তা অবশ্য আবিদের জানা ছিলনা এবং রেবেকাও আবিদকে বলেনি। শেষ দিকে এসে রেবেকা কিছুটা পিছুটান লক্ষনীয় ছিল। কিন্তু সেটা আবিদ না জেনেই ভুল বুঝে গেল যে, রেবেকা তো বাস্তবতায় অভিনয় করছে তার সাথে। অথচ আবিদের বুঝার ছিল যা প্রথম দিকে, সেটা বুঝতে শুরু করলো শেষের দিকে এসে। যদিও শেষের দিকে রেবেকাও সত্যিকারের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তার সাথে অভিনয় করতে গিয়ে নিজেই প্রেমে জড়িয়ে পড়ার পর এর চেয়ে লোভনীয় কয়েকটি বিয়ের প্রস্তবনা আসায় এবং সামগ্রকি বিষয় চিন্তা করে রেবেকা সম্পর্কটা জিইয়ে রাখলেও প্রতিশ্রুত কথা থেকে কিছুটা পেছনে ফিরতে শুরু করলো। আগের চেয়ে এখন কিছুটা এলোমেলো কথা বার্তা এবং সন্দেহজনক কাজ শুরু করে দিল রেবেকা। যা আবিদ কোনভাবেই বরদাস্ত করতে পারেনি। মেনে নিতে পারছিলনা। রেবেকা চাইলো এই ভেবে আবিদ এমন কিছু আচরণ করুক, যাতে রেবেকা অন্তত তার দেয়া প্রতিশ্রুত কথা থেকে সরে যাবার পথ খুঁজে পায় এবং শেষ পর্যন্ত তাই হলো। রেবেকা ছুটে যেতে যৌক্তি কিছু পরিকল্পিত অজুহাত সামনে হাজির করলো। আবিদের কিছু দোষ ত্রুটি এবং কিছু একটা গোপন করা হয়েছে মর্মে নির্দিষ্ট সময় থেকে সরে আসার বাহানা করতে লাগলো। অন্য দিকে যেসব সমন্ধগুলো তাকে প্রতিনিয়ত নক করছে , সে সব বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলো। তাও আবিদকে বুঝতে দেয়নি। এমনি একদিন
-    
আচ্ছা আমাদের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যে কথাগুলো বলা হয়েছিল তা পরিবর্তন হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এখন সময়ের অপেক্ষা করো। তবে আমি আমি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।
-    
মানে ? এটা কি রকম কথা!
-    
হ্যা এরকমই। কেননা বিভিন্ন দিক বিচেনা করে এবং নানা বাধা বিপত্তি, তোমার আচরণ ইত্যাদির কারণে আমাকে তাই বলতে হচ্ছে। এছাড়া তোমার উপর ভরসা করার মতো তেমন কোন সাপোর্টও পাচ্ছিনা। আমাকে ভাবতে দাও।
-    
তাহলে কী তুমি এতদিন ছলনা করেছো? কী বলছো এসব!
-    
হ্যা তাই যদি মনে করো তাই! নতুবা এমন কথা বলছো কেন!
-    
তাই তো দিন ধরে তোমার এমন কিছু প্রত্যক্ষ করছি আমি। এলোমেলো কথা বার্তা, অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ পাচ্ছি তোমার কাছ থেকে।
-    
এখন থাকো। পরে কথা হবে।
রেবেকা তখনও ভালোবাসলেও বেশ চাপের মুখে এবং নানা ধরণের বিপত্তির কারণে সম্পর্কটার ইতি টানতে চাইলো। আবিদ তার এমন আচরণ সহ্য করতে না পেরে সেও উত্তেজিত হয়ে এমন কিছু কান্ড ঘটালো যা রেবেকা ধরে নিল আবিদ আসলেই ভালোবাসার আদলে তাকে ঠকানোর ব্যবস্থা করছিল। সে মনে মনে ভেবে নিল ভালই হলো সম্পর্কটার ইতি ঘটছে। তবে আবিদ যা করেছে তা নিতান্তই প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেছে। এমনও ভাবতে লাগলো রেবেকা। সত্যিকার অর্থে দুজনের মধ্যে দুই ধরণের অনুভূতি এবং বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে ঘোরপাক খেতে থাকলে রেবেকা ইচ্ছে করেই সম্পর্কটা ভেঙে দিতে চাইলো। যদিও এমনটি কখনোই আশা করেনি আবিদ। কেননা সম্পর্ক গড়ার সময়ে এসব বিষয়েই চুলছেড়া বিশ্লেষণ করেছিল আবিদ। বুঝিয়েছিল এমন একটা সময় অপেক্ষা করছে। রেবেকা তখন ভালোবাসার মোহে এবং ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তার সব কথাই মেনে নিয়েছিল অকপটে। যদিও শেষের দিকে এসেই ভুল বুজাবুঝি এবং বিভিন্ন অজুহাত সামনে আসার কারণে একটা সম্পর্কের বিশ্বাসের জায়গাটা রেবেকাই ঘোলাটে করে ভেঙে দিতে চাইছে। পক্ষান্তরে রেবেকার বিশ্বাসে আবিদের ধারণা কিছুটা ভাটা পড়লেও এখানে আবিদ তার জায়গা অটল অবিচল রয়েছে। আর যাই হোক আবিদেও দৃষ্টিতে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সম্পর্কটা ঠিখে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। নতুবা নতুন করে হোঁচট খেতে হবে তাকে, যার ক্ষত সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
দিকে রেবেকা চিন্তা ভাবনা করে কিছুটা অবিশ্বাস অন্যদিকে এর চেয়ে ভালো কিছু সমন্ধ পাওয়ায় সম্পর্কটার একেবারেই ইতি টানতে চাইছে। তাই সে এমন কিছু কথা আচরণ শুরু করলো যাতে আবিদ তাকে ঘৃণা করে এবং স্বেচ্ছায় চলে যায়। এতে তার কোন আপত্তি নেই। তবে সে কষ্ট পাক তাও চায়না রেবেকা। কারণ সম্পর্কচ্ছেদে আবিদের কোন গাফিলতি নেই। সেটা নানা দিক বিবেচনায় রেবেকাই শেষ করে দিতে চাইছে। রেবেকা চাচ্ছে আমার এই প্রতিশুতি ভঙ্গের কারণে এরকম কিছু কাজ করুক আবিদ, যাতে রেবেকা বলতে পারে সব ঠিকই ছিল, কিন্তু ঠিক রাখেনি আবিদ। এটা ছিল রেবেকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ছেড়ে যাবার একটা অভিনব কৌশল। আবিদ যা করার, ভুল বুঝে এমন কিছু করলো যাতে সে আর রেবেকার সাথে যোগাযোগ করার অধিকারটাও হারিয়ে ফেলে। একটা সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। রেবেকা তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। অধিকন্তু ক্ষত থেকেই গেল আবিদের। পুরো জীবনটাই যেন তার বিষাদময় হয়ে উঠলো। কত নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছে রেবেকার বিচ্ছেদে তা বলাইবাহুল্য। যদিও সে রেবেকাকে হারিয়ে তা বুঝতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু রেবেকা তার পরবর্তী আচরণের কারণে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে। বাস্তবতায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রেম অভিনয় সর্বশেষ ভুলবুঝাবুঝি এবং অনিন্দ্য সুন্দরের মোহে সম্পর্কটা নষ্ট হওয়ার পেছনে রেবেকার হাতই বেশি। কেননা তার শুরুটাই ছিল অভিনয় দিয়ে মাঝখানে গভীরতায় জড়িয়ে পড়লেও আবারও নতুন মোহে পড়ার কারণে তা একেবারেই শেষ পরিণতিতে গড়ায়। বন্ধুর কারণেই একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। অপমৃত্যু হল এক কাব্য সারথির

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
কবি গণমাধ্যম কর্মী
সুনামগঞ্জ

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।