এখনো আমার শরীরের সব লোম শিউরে ওঠে। আমার হৃদয়টা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় আচমকা হাত থেকে পড়ে যাওয়া আয়নার মতো। আমি মাঝে মাঝেই কিছু সময়ের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ইদানিং প্রায় সব রাতের আকাশের বুকে ভেসে থাকা ফুটফুটে চাঁদ আর নক্ষত্রের দিকে তাকিয়েই অনেকটা সময় পার করে দেই। এমনকি আমার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা একবছরের বাচ্চা ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেই আমি আবার রাতের আকাশ দেখতে থাকি। আমি কিছু সময়ের জন্যে এই শহরের অলিগলির চিৎকার, যানবাহনের কোলাহল, ইট-পাথরের কচকচ শব্দ থেকে ছুটি নিয়ে তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। ঢাকা শহরের বুকের উপর যতো নারিকেল গাছ আছে তার চিরল চিরল পাতার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আমি আকাশ দেখি। আমার বারান্দার অলকানন্দা, মধুমঞ্জুরী, লাল হলুদ গাদা – সবকিছুর সৌন্দর্য্যের গন্ধ উপেক্ষা করেই আমি আকাশের অসীম শূন্যে চোখের লেন্স ছড়িয়ে দিই। আমি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকি আমার ভেতরে গুমড়ে কেঁদে মরা অন্তরাত্মাকে। আমার খুব ডুকরে ডুকরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি তা পারি না। আমি কাউকে বলতে পারি না, আবার সইতেও পারি না। আমার ব্যথারা বোবা কান্নার বুকচাপা আর্তনাদে আমাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে।
নওশাদ দেখি আজকাল আমাকে বড্ড খেয়ালে রাখে। আমি বেলকনীতে আসলেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আবার কিছু না বলেই চলে যায়। এই ব্যস্ত নগরীর সবাই হয়তো খুব আরাম করে ঘুমোতে পারে শুধু আমি ছাড়া। আমার ঘুম আসে না। আমার চোখের পাতাযুগল মনে হয় চব্বিশ ঘণ্টার চুক্তিতে প্রহরীর চাকরী নিয়েছে – একেবারেই ঘুমোনো যাবে না। আমার ঘুম আসে না, আমি ঘুমোতে পারি না। আগে এতোটা তীব্র ব্যথা আমার ভেতরে চেপে বসে নি। তবে ইদানিং কালে আমার মধ্যে ব্যথারা জ্যোৎস্নার মতো খসে খসে পড়ে হৃদয়ে পাথরের মতো শক্ত শক্ত আঘাত করতে থাকে। আমার প্লাবন – যে কিনা একটু সুযোগ পেলেই আমার বুকের উপর কাঁঠালের বোঁটা হয়ে তৃতীয় স্তনের মতো ঝুলে থেকে দুদ্ধ পান করতে থাকে, তাকে দেখলেও আমার ভেতরটা পুড়ে যায়, ঝলসে ওঠে। আরও একজন হয়তো প্লাবনের মতোন করে বেড়ে উঠতে পারতো, ক্ষুধা পেলে হয়তো চাঁদের মতো মুখ নিয়ে আমার দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে কান্না করতো, আমার সাথে দুষ্টুমি করতো, আমি ওকে বকা দিতাম। হয়তো ওর সদ্য ওঠা দাঁতের বিষের কামড়ে আমার স্তনবোঁটা ফেঁটে ফেঁটে রক্ত বের হয়ে আসতো। আমি ওকে অনেক বকা দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে আবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করতাম - আমি তখন শুধু এই কথাই ভাবতে থাকি। এইসব ভাবলে আমার কান্না পায়। আমার কোনো কিছুই ভালো লাগে না; না ভালো লাগে সহকারী ভূমি কমিশনারের এই উচ্চ পদের চাকরী, দামী গাড়ি, বিলাসবহুল এই সরকারী চাকরীর সুযোগ সুবিধা। বস্তুজগতের সব মায়াবন্দী খেলা আমার ভালো লাগে না; স্বামী, সংসার, সন্তান, অফিস, সহকর্মী – কোনোকিছুতেই যেনো আমার সুখ জড়িয়ে থাকে না।
অফিস চলাকালীন সময়ে এতোটা খারাপ আমার লাগে না। অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সামনে আমি ভারাক্রান্ত মন শো অফ করতে পারি না। তবে অফিস থেকে ফেরার পরে রাতের সময়গুলো আমাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে। ছুটির দিনগুলোতে আমার আরও বেশি খারাপ লাগে। আমি নওশাদকে কিছু বলতে পারি না, কাজের বুয়া জারমিনাকে কিছু বলতে পারি না, আমার বাসার কেয়ারটেকার হাদি ভাইকে কিছু বলতে পারি না – বলতে পারি না আমার মা, ভাই আর বোনকে।
আমার এমন কথা শুনে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারে যে সরকারী সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ডুবে থেকে আমার বা কী এমন ব্যথা থাকতে পারে আর কেনোই বা আমি এতো হতাশা বুকের গহীনে করে বয়ে নিয়ে বেড়াই? সব মানুষের জীবনের সুখ-শান্তি কী আর একটি সরকারী চাকরীর চলক দিয়ে চলে? হয়তো হতে পারে একটি নিশ্চিত চাকরী কোনো মানুষের জীবনে সুখের সহায়ক হতে পারে; সুখ বা শান্তির না। যাইহোক, নিজের থেকেই বলে ফেলি আমার গুমরে কাঁদা অন্তরাত্মার পেছনের গল্পটি।
আমরা হলাম চার ভাই-বোন। লিজা আপা ছিলো সবার বড়ো। তারপরে আমি। তারপরে ইফতি আর ইমন। আমার বাবা ছিলেন একটি সরকারী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। বাবা এখন বেঁচে নেই। এইতো বছর দু’য়েক আগে তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। আমার মা পাঁকা গৃহিনী। এখনো মরি মরি করে মা বেঁচে আছেন। খুব সাজানো গোছানো আর খুব সুখী একটা পরিবার ছিলো আমাদের। আমাদের বাবা-মায়ের নিরলস পরিশ্রমে আমাদের চার ভাই-বোনের সবারই সৌভাগ্য হয়েছে বাংলাদেশের সব থেকে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডিগ্রি অর্জন করার। আমার ছোট ভাই ইমন বাদে আমরা সবাই সরকারী চাকরী করি। লিজা আপা একটি সরকারী ব্যাংকে চাকরী করেন, আমি বিসিএস পাশ করে পাবলিক সার্ভিসে আছি। ইফতি এবছর বিসিএস পাশ করে পুলিশে যোগ দিয়েছে। আর ইমন এপ্লাইড ফিজিক্সে এমএসসি করছে।
লিজা আপা যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করতো, তখন তার বিয়ে হয়েছিলো জাফর ভাইয়ের সাথে। জাফর ভাই তখন সদ্য বিসিএস পাশ করে ঢাকার একটি সরকারী কলেজে চাকরী করতো। তাদের বিয়ের একবছর পরেই একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছিলো। আর এমন সময় আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমরা আগে থেকেই জাফর ভাইদের বাসায় যেতাম। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে জাফর ভাইয়ের বাসা ছিলো। বিয়ের পরে লিজা আপা আর হলে থাকে নি। ওখানেই থাকতো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতো। যেহেতু লিজা আপা আর জাফর ভাই ঢাকাতে ছিলো, তাই আমি আর মেসে বা হলে উঠলাম না। আমি তাদের সাথেই থাকতাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ধরে আসা-যাওয়া করতাম। লিজা আপার তখন পড়াশুনা শেষ। চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলো একের পর এক। আর কোনো এক ব্যাংকের পরীক্ষায় নাকি মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছিলো সে।
প্রথম এক বছর বেশ আমার ভালোই গেলো। ঢাকা শহরে আমার থাকা-খাওয়া আর টাকা পয়সার টেনশন ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক টানপোড়েন নিয়ে আমার চিন্তা না করলেও চলতো। আমি আমার অন্যান্য ক’য়েকজন বন্ধুদের মতো টিউশনি করাতাম না। সুতরাং আমি লিজা আপার বাচ্চার সাথে অনেক খেলা করার সুযোগ পেতাম। প্রচুর বই পড়তাম সেসময়। বাংলা সাহিত্যের অনেক বই আমি সেসময় পড়ে ফেলেছিলাম। এমন কি লিঁও তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ – এই বিশাল ভারী বইটিও প্রায় পড়ে ফেলেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ এর নতুন কোনো বই আসলে মনে হয় আগে আমিই কিনতাম আর চোখ-মুখ বন্ধ করে পড়া শুরু করতাম। আর বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে যাদের লেখা নিয়ে বেশি বিতর্ক উঠতো, তাদের লেখা আমি বেশি করে পড়াতাম। আর আমার পড়ার তালিকাতে সবচেয়ে বেশি পড়া হতো হুমায়ূন আজাদের বইগুলো। তার লেখা; আমার অবিশ্বাস, নারী, ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ, কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ, সবকিছু ভেঙে পড়ে, মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ – সব বই-ই আমি পড়ে ফেলেছিলাম। আমি সুনীল, সমরেশসহ অনেকের বই-ই পড়ে ফেলেছিলাম। তখন আমার বিভাগের বাইরের বইগুলো পড়তে অনেক ভালো লাগতো। যাক এখন ওসব কথা। প্রথম বর্ষের চুড়ান্ত ফলাফল যখন হাতে আসলো, তখন দেখি আমার অবস্থান প্রথম দশের মধ্যেও নেই। রেজাল্ট দেখে আমি একটু হতাশ হলাম। তখনো আমি অতোটা বুঝে উঠতে পারি নি ভালো ফলাফল করার উপায় সম্পর্কে। আমার রেজাল্ট প্রকাশের পরের সকালে দেখি লিজা আপা জলিলকে দিয়ে মিষ্টি কিনিয়ে আনলো। আমি ভাবলাম আমাকে মনে হয় অপমান করার জন্যে আপা মিষ্টি কিনে এনেছিলো – এটা ভাবতেই আমার ভেতরে অপমানবোধ কাজ করতে শুরু করলো। সেই সময় মিষ্টি দেখে আমার এমন মনে হচ্ছিলো যে মনে হয় পরের বছরের সব পরীক্ষাতে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ফ্যাকাল্টির রেকর্ড ভেঙে ফেলবার মতো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। যাইহোক, লিজা আপা সেসময় আমাকে অপমান করার জন্যে বাসায় মিষ্টি আনে নি বরং তার চাকরী হয়েছিলো বলে উৎফুল্ল হয়ে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছিলো।
সপ্তাহ খানেক পরে লিজা আপা চাকরীতে যোগ দিলো। প্রথম দশদিন অফিস করার পরে মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেলো। অনন্যাকে দুলা ভাই আমার মায়ের কাছে রেখে আসলো। আমাদের গ্রামের বাসা ঢাকা থেকে বেশি দূরের পথ ছিলো না।
তখন লিজা আপার বাসায় ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যেতো। জাফর ভাইয়ের ক্লাশ থাকলে কলেজে যেতো আর না থাকলে যেতো না। আমিও তাই করতাম। আপার বাসার কাজের বুয়া রোজিনা পেট বাঁধিয়ে ফেললো। সপ্তাহ দু'য়েক মতো সে আর কাজ করতে আসলো না। জাফর ভাই আর একটি কাজের বুয়া ঠিক করেছিলো। ছুটা বুয়া – সকালে এসে তিন বেলার রান্না একবারে করে ঘর মুছে কাপড় ধুয়ে চলে যেতো। আর কেয়ারটেকার জলিল ভাইয়ের বৌয়ের মেয়ে হয়েছিলো বলে সে বাসা ছেড়েছিলো দিন দু’য়েক আগেই।
তখন ফ্লাট জুড়ে পুরোদিন আমি আর জাফর ভাই-ই থাকতাম। প্রথম তিন চারদিন আমরা খুব স্বাভাবিক ছিলাম। লিজা আপা যখন বাসা থেকে বের হয়ে যেতো, তখন সে আমাকে জাফর ভাইয়ের খেয়াল রাখার কথা বলে যেতো। আমার খেয়াল রাখার কথা জাফর ভাইকে সে বলে যেতো কি না – তা আমি জানতাম না। আমি জাফর ভাইকে চা বানিয়ে দিতাম। এক সাথে বসে চা পান করতাম।
আমার আপা জাফর ভাইকে এতোই ভালোবাসতো যে মাঝে মাঝে আমার এমন মনে হতো যে আপার মনে হয় নিজের জীবনের সুখ-শান্তি বলে কিছুই ছিলো না জাফর ভাই ছাড়া। আপার মুখে জাফর ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে আমি প্রায়ই পাগল হয়ে যেতাম। তখন আমার চোখের সামনে জাফর ভাইয়ের ছবি ছাড়া আর কারোর ছবিই আসতো না। আমার চারপাশ জুড়ে খালি জাফর ভাই-ই ছিলেন। সে ছাড়া আর অন্য কোনো পুরুষের প্রতি মনে হয় আমার কোনো দৃষ্টিপাত ছিলো না। জাফর ভাই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে দেখলে আমার রাগ হতো। অন্য কাউকে আমার আর ভালো লাগতো না। এমনকি আমাদের ব্যাচের যে ছেলেটি সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েও আমার পেছনে ঘুরঘুর করে বেড়াতো, ওকে দেখলেও আমার রাগ হতো। আমার রাগ বাড়তো এই ভেবে যে - ও কেনো জাফর ভাইয়ের মতো হতে পারতো না, তার মতো করে কেনো হাঁটতে পারতো না, চুল আঁচড়াতে পারতো না, তাকাতে পারতো না। আমার চোখের সামনে আর মাথা জুড়ে শুধু জাফর ভাই-ই থাকতো। তিনি ছিলেন আমার আইডল; আদর্শ পরিপূর্ণ আর সফল একজন মানুষ। আমি তার মতো করে হাঁটার চেষ্টা করতাম, কথা বলার চেষ্টা করতাম, পড়ার টেবিলে বসার চেষ্টা করতাম, বেলকনীতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখার চেষ্টা করতাম, সে যে ভঙ্গিতে আমার নাম ধরে ডাকতো, আমিও ঐরকম করে কাউকে নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করতাম।
একদিন দুপুরবেলা আমি স্নান সেরে জাফর ভাইয়ের সামনে গেলাম। আমার চুলগুলো তখন আধভেজা ছিলো। মাথার ভেজাচুলের ডগাগুলো আমার পিঠ-কোমরে ঠেকে গিয়ে আমার গোলাপী ফ্রকেরর উপরে লেপ্টে ছিলো। আমার চুল অনেক লম্বা ছিলো। একেবারে কোমর পর্যন্ত ঝুলে থাকতো। ঐদিন জাফর ভাই আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়েছিলেন। আমি তখন কোনোকিছু ঐ সময় বুঝে উঠতে পারলাম না। এরপর প্রায় ঘণ্টা খানেক বাদে জাফর ভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘মিলি, তোমার চায়ের হাত তো বেশ ভালো! কাপ থেকে চুমুক সরাতে মন চাচ্ছিলো না। আমার জিহ্ববাতে এখনো মনে হচ্ছে চা লেগে আছে।‘ জাফর ভাইয়ের কাছ থেকে এমন প্রসংশা পেয়ে আমার ভেতরে খুব সুখ লেগেছিলো। যার হাঁটা-চলা আর কথা-বার্তাতে আমার এতো মুগ্ধতা ছিলো, তার থেকে প্রসংশা পেয়ে আমার খারাপ লাগার কথা ছিলো না। বাদ দিই ঐ সময়ের সেই আবেগের কথা। লিজা আপা নিয়মিত অফিস যেতো। আবার অফিস শেষে বাসাতেও ফিরে আসতো। আমি আর জাফর ভাই বাসাতেই থাকতাম। সে সময় জাফর ভাই অফিস ফাঁকি দিতো অসুস্থতার কথা বলে আর আমি দিতাম কাশ ফাঁকি।
একদিন দুপুরবেলা জাফর ভাই আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম। সেদিন জাফর ভাই আমার মুখের দিকে কেমন করে জানি তাকালেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বকাটে আর লোফার ছেলেগুলো যেমন চোখ বড় বড় করে থাকাতো, জাফর ভাইও ঠিক ঐভাবেই তাকিয়ে ছিলো। এক সময় জাফর ভাই আমার হাত চেপে ধরেছিলো। আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম। তারপর জাফর ভাই কেমন যেনো অসভ্যের মুখ নিয়ে আমার মুখের দিকে তেড়ে আসছিলেন। আমি খুব ভয় পেলাম। জাফর ভাইকে দু’হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে আমি শোবার ঘরে গিয়ে ছিটকানি লাগিয়ে দিলাম।
তখন আমি ভেবেছিলাম আপাকে সব বলে দিবো। কিন্তু এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আপার মুখখানা আমার চোখের সামনে লালপদ্মের মতো ভাসতে লাগলো। আমার আপা জাফর ভাইকে খুব বিশ্বাস করতো। আর আপার সেই বিশ্বাস ভাঙলে হয়তো সেসময় সে হার্ট ফেল করে মারা যেতো। যদিও জাফর ভাই আর লিজা আপা এখন একসাথে নেই। পরেরদিন সকালবেলা আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। ‘আমি হলে গেলাম। মালিহার সাথে থাকবো। একটা এসাইনমেন্ট করতে হবে। বাসায় আসবো না’ – বলে বের হয়ে গেলাম।
এরপর ঠিক দু’দিন বাদে আমি আপার বাসায় আসলাম। জাফর ভাই বাসায় ছিলেন। মুখটা তার একেবারেই কুচকে ছিলো। ঠিক ডিসেন্ট্রি হলে পেটের বিষে মানুষ যেমন করে – তেমনই ছিলো তার চোখ-মুখ। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে বসে রবী ঠাকুরে শেষের কবিতা উপন্যাসটি পড়ছিলাম। আমাকে শেষের কবিতা পড়তে দেখে সে মুচকি হাসলো। এরপর সে শেষের কবিতা উপন্যাসের একটি কবিতা শোনালো। আমি তার কবিতা শুনে যখন উঠতে গেলাম, তখন সে আবার আমার হাত চেপে ধরলো। খুব শক্ত করে আমার হাত ধরেছিলো। তার কব্জি জোড়া থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিলো না। একসময় আমার মুখের খুব কাছে এসে সে আমার উপর ঠোঁটে কামড় দিলো। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একটু ব্যথা পেলাম সাথে সাথে ভয়ও। তারপর দেখি সে আমাকে চুমু খাওয়া শুরু করলো। আমি মুখ সরিয়ে সরিয়ে নিচ্ছিলাম। সে এক প্রকার জোর করেই আমার নাকের ডগাতে, কানের লতিতে, ঠোঁটে, গ্রীবার তলজুড়ে সে চুমু খেতে লাগলো। একপর্যায়ে আমি আর তাকে প্রতিরোধ করতে পারলাম না। আমারও রক্ত-মাংসের শরীর ছিলো। তার জোরালো চাপে আমার অঙ্গ-প্রতঙ্গও পুলকিত হতে শুরু করেছিলো। এক সময় জাফর ভাই আমার বুকের উপর চেপে বসলো। তারপর সে নেমে যাওয়ার ভান করলো। আমি তাকে নামতে দিলাম না বরং উল্টো আরও বুকের উপরে শক্ত করে চড়িয়ে নিলাম। তখন আমার ভেতরে আগুন জ্বলে যাচ্ছিলো। পরে যা হওয়ার হতো কিন্তু জাফরকে নামানো যাবে না। কেননা সে ছাড়া আমার সেসময়ের আগুন নিভতো না। এক সময় জাফর ভাই কেমন জানি পুলকের ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। আর আমিও তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত হলাম।
আমি গোসল করলাম। খুব পুলকের গোসল ছিলো সেটা। শাওয়ারের নিচে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি বিশাল একটা প্রশান্তি খসে খসে পড়ছিলো আমার বাহুযুগল বেয়ে। এরপর আমি কিছু না খেয়েই ঘর বন্ধ করে ঘুমোতে চলে গেলাম।
আমার নিজের ভেতরে খুব অপরাধবোধ কাজ করছিলো সেসময়। আমি শুধু ভাবছিলাম যে লিজা আপা জানলে কি হতো – এইসব। এমন অপরাধবোধে যখন আমি ভুগছিলাম, তখন আমার পুরো শরীর জুড়ে অন্যরকম এক সুখের ঝড় উঠে যাচ্ছিলো। আমার স্তনে হাত পড়তে কেমন যেনো একটা ঝাঁকুনি লেগেছিলো আমার ভেতরে। অবশ্য একটু ব্যথা ছিলো। আর ব্যথা থাকারই কথা ছিলো কেননা জাফর ঐগুলোকে একেবারে লেবুর মতো করে চুষে চুষে খেয়েছিলো। তারপর দেখলাম আমার নিতম্বেও বেশ ব্যথা ছিলো। আর আমার দুই পায়ের মাঝখানে অসহ্য রকমের ব্যথা ছিলো। জাফর আমার দুইপাড় ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলো। বিবাহিত পুরুষ – অভিজ্ঞতা তার খুব ভালোই ছিলো। হয়তো প্রথম প্রথম তাই এমন ব্যথা ছিলো। তবে যেই আমার শেষ ধাক্কার কথা মনে হলো, তখন আমি সব ভুলে গেলাম। অসহ্য রকমের এক সুখ লেগেছিলো সেসময় আমার। আমার এতো সুখ লেগেছিলো যে, ঐ সুখ আমি আগে আর কোনোদিন পাই নি তার আগে। আমি সব ব্যথা ভুলে সুখের আলিঙ্গনের স্মৃতিতে ডুবে ঘুমিয়ে গেলাম।
ঐ ঘটনা ঘটার পরে লিজা আপার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর খুব বেশি কথা বলা হয়ে ওঠে নি। তার দিকে তাকালেই আমার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হতো। আমার মনে যখন এমন অপরাধবোধের ঝড় বয়ে যেতে লাগলো, তখন আমি অনেক কষ্টে হলে একটি সিট ম্যানেজ করে বই-পত্তর আর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে হলে উঠে পড়লাম।
জাফর মাঝে মাঝেই হলের সামনে এসে বসে থাকতো, আমার জন্যে অপেক্ষা করতো। আমি আর জাফর সন্ধ্যের পরে কিছুটা সময় একসাথে হাঁটতাম, চা খেতাম, ঘুরতে যেতাম। আমরা একদিন গোপালগঞ্জের পদ্মবিলে গিয়েছিলাম লালপদ্ম দেখতে। ঐ দিনটা অনেক আনন্দের ছিলো। সারাদিনের ঘোরাঘুরি সেরে আমরা রাজবাড়ী শহরের মোড়ের পাশে এক হোটেলে রাত কাটিয়েছিলাম দু’জনে। লিজা আপা এসব কিছুই জানতো না। আর ওর এসব জানার সময়ও ছিলো না মনে হয়। লুকোচুরি লুকোচুরি খেলেই অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো। একসময় আমার অনার্সের চুড়ান্ত পরীক্ষাটাও হয়ে গেলো। আমি মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। জাফরের প্রমোশন হলো। লিজা আপাও বড় একটা প্রমোশন পেলো। লিজা আর জাফরের মেয়েটাও বেড়ে উঠতে লাগলো।
সেসময় আমি গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা বললেই জাফর খুব রাগ দেখাতো। মাঝে মাঝে আমার বাবা-মা ঢাকায় এসে লিজা আপার বাসাতে উঠতো। দু’য়েকদিন থেকেই তারা আবার চলে যেতো। আমিও যেতাম তাদেরকে সঙ্গ দিতে। তারপর তারা চলে গেলে আমি আর জাফর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মেলামেশা করতাম।
আমরা রুমমেটরা – সবাই মিলে যখন ‘ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্স অব সেক্স’ নিয়ে আলাপ করতাম, তখন আমার খুব খারাপ লাগতো। আমি ওদের মতো করে জাফরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলতে পারতাম না। আমার রুমমেট মোহিনী দিদির নাকি প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতেই। তার এক বিবাহিত শিক্ষকের সাথে নাকি এমনটি হয়েছিলো। মোহিনী দিদি তার কাছে ফিজিক্স আর ক্যামেস্ট্রি প্রাইভেট পড়তো। আবার আমাদের ফ্যাকাল্টির তমা নাকি প্রথম সেক্স করেছিলো তাদের গ্রামের এক মাদ্রাসার হুজুরের সাথে। তখন সে ক্লাশ নাইনে পড়তো। হুজুরের কাছে সে আমপারা পড়তে যেতো আর হুজুর নাকি তমার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন কেমন করতো। যাইহোক, একদিন নাকি তাদের মধ্যে কাজ হয়েছিলো। শিমলা আপা নাকি নিয়ম করে তার পুলিশ বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটাতো। আর আমার বিভাগের মাস্টার্স শেষ পর্বের মৌলি আপা নাকি রাতের আঁধারে বাথরুমে গিয়ে অনেক সময় নিয়ে বের হয়ে আসতো। কানে হেডফোন থাকা তার জন্যে খুব কমন ছিলো। অনেকেই তো সেসময় লুকিয়ে লুকিয়ে ‘মাস্টার্বেট মৌলি’ বলেও ডাকতো। এইসমস্ত বিষয় নিয়ে ওরা খুব স্বতঃফূর্তভাবে আলাপ করতো। শুধু আমিই বলতে পারতাম না। জাফরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমি কাউকে বলতে পারতাম না শুধু নাহিদাকে ছাড়া।
নাহিদাও ছিলো আমার মতোই। তবে ওরটা আমার মতো এতো জটিল ছিলো না। নাহিদা তার পিতার আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করতো। একটু দূরের রক্তের সম্পর্ক ছিলো নাহিদার সাথে ওর প্রেমিকের। আর প্রেম কি – তাদের মধ্যে রীতিমতো সবকিছু হয়ে গিয়েছিলো। চাচার সাথে প্রেম করতো বলে ও কাউকে বলতে পারতো না।
এমন তালবাহানা করতে করতেই আমার মাস্টার্স শেষ হলো শুধু থিসিস সাবমিশন ছাড়া। ইতোমধ্যে আমি আবার বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করে ফেলেছিলাম।
আমি একরাতে লিজা আপার বাড়িতে গেলাম। ‘তুই এসেছিস। ভালো হয়েছে। আমি আজ একটু বাইরে থাকবো। তিহিমকে নিয়ে গেলাম। তোর ভাইয়া যেতে পারবে না। তোরা বাসায় থাক।’ – বলেই লিজা আপা বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
এরপর আমি জাফরের সাথে শুয়েছিলাম। জাফর ক্লান্ত হয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। আর আমি একটু পরপর ওর কাছে চাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওর আর কুলাচ্ছিলো না। তারপরেও আমি চাচ্ছিলাম। জাফর কেমন জানি আমার দিকে শয়তানের মতো করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। যাইহোক, আমাদের মিলন হলো। আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে আমি আবার হলে এসে থিসিসে কাজ শুরু করলাম। একটানা সাতদিন কাজ করে আমি থিসিস জমা দিলাম। আমি থিসিসে কি লিখেছিলাম আর কি লিখি নি – সেটা আমার মনে ছিলো না। আর ওসব পরাশুনার ধৈর্য্য আমার ছিলো না। বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা আমার ভালো হয়েছিলো। আর আমি শুধু ঐটা নিয়ে বেশি মনোযোগী ছিলাম।
আমার থিসিস জমা দেওয়া শেষ হলে আমি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার প্রচন্ড বমি বমি লাগছিলো। আমার তলপেট আর নিপলে অনেক ব্যথা ছিলো। আমার নিতম্ব আর স্তনগুলো কেমন জানি ফুলে ফুলে উঠছিলো। প্রথমে ভাবলাম এমনিতেই মনে হয় থিসিস করতে গিয়ে মানসিক চাপের কারনে এমন হয়েছিলো। আমি আরও সাত-আটদিন অপেক্ষা করলাম। এরপর একদিন আমি খুব করে বমি করতে লাগলাম। ‘কি রে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করলি কবে? অভিনন্দন! তুই মনে হয় মা হতে যাচ্ছিস।‘– আমাদের ব্যাচমেট তুলির এমন কথাতে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তুলি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। ‘কিন্তু জাফর তো কনডম নেয়। আর ও আমাকে বাচ্চা দিবে কেনো?’ – এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমি জাফরকে ফোন করলাম। সেই দিন সহবাসের সময় যে কনডম ফেঁটে গিয়েছিলো, জাফর তা আমার কাছে লুকিয়েছিলো।
এরপর আমি জাফরকে নিয়ে ডাক্তার দেখালাম। আমার প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ ছিলো। আমার ভেতরে একজন বেড়ে চলছিলো। তাকে ক্যারি করার কোনো ভিত্তি আমাদের ছিলো না। আর সব থেকে বড় কথা আমি লিজার সংসার ভাঙতে চাচ্ছিলাম না। যাইহোক, ডাক্তারের পরামর্শে কিছুদিন পরে আমি গর্ভপাত করালাম।
গর্ভপাতের পরে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। মাসখানেক পরে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলাম। আমি একদিন জাফরকে ডাকতেই সে আমাকে এভোয়েড করলো। আমি বুঝলাম না।
একদিন আমার খুব ইচ্ছে হলো জাফরকে আদর করার জন্যে। কিন্তু জাফর আসলো না। ‘তোমাকে আর ভালো লাগে না। তুমি অনেক লুজ হয়ে গিয়েছো।’ – জাফরের এমন কথাশুনে আমার রাগ বাড়তে থাকে। জাফর আমাকে পেট বাঁধালো আর আমাকেই ঢিলা বলে এড়িয়ে চললো! এরপরে একদিন বিকালে আমরা চার-পাঁচজন রুমমেট মিলে ধানমন্ডি লেকে ঘুরতে গেলাম। ঐখানে আমরা গিয়েছিলাম মন ভালো করার জন্যে। অন্য সবার মন হয়তো ভালো হয়েছিলো তবে আমার মন আরও বেশি খারাপ হয়েছিলো। আমি কাউকে বলতে পারলাম না আমার মন খারাপের কথা। লেকের প্লে গ্রাউন্ডের চায়ের দোকানের পাশে জাফর কাকে নিয়ে যেনো চায়ের কাপে চুমুক মারছিলো। জাফর লুতুপুতু হয়ে পড়ে পড়ে যাচ্ছিলো সুখে আর খুশিতে। ঐ মেয়েটার বয়সও মনে হয় আমার মতোই ছিলো। যাইহোক, ঐদিন আমার আর মন ভালো করা হলো না। বরং খুব মন খারাপ করে হলে ফিরে আসলাম। তারপর থেকে কুত্তার বাচ্চা জাফরকে আর ফোন করি নি, ডাকি নি। লিজা আপার বাসাতেও যাই নি।
আমি একদিন বিকেলে ছাদে বসেছিলাম। আমার বান্ধবী আকলিমা একদিন আমাকে একটা ঘটনা বলেছিলো। ওর ঘটনাটা শুনে আমি শক্ত হতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওর সাথেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো। তারপর ও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আবার পড়াশুনা শুরু করেছিলো। ‘মানুষের জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে। জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হয়। ‘ – ওর এই কথাটা আমাকে অনেক সাহস দিয়েছিলো। আর তাছাড়া এই দুনিয়াতে আমি যে প্রথম গর্ভপাতকারী নারী ছিলাম, তা কিন্তু না। পুরুষের সংসারে টাকা-পয়সা নেই, পেট বাঁধালে নারীকে করতে হয় গর্ভপাত। প্রেমিকের প্রতারণার খপ্পরে পড়ে পেট বাঁধলে, নারীকে করতে হয় গর্ভপাত। জোর পূর্বক সঙ্গমের শিকার হলে পেট বাঁধে নারীর, গর্ভপাত করতে হয় নারীকেই; ধর্ষকের পেট বাঁধে না। আবার বাচ্চা লাগবে না, পেট বাঁধলে নারী করে গর্ভপাত। পেট তো নারীরই বাঁধে, পুরুষের তো আর বাঁধে না। আমার মতো হয়তো অনেক নারীই এমন ঘটনার শিকার হয়েছিলো, হয়, হচ্ছে। তাই বলে তাদের জীবন তো থেমে নেই। তারা তো সবাই মরে যান নি। আমিও বাঁচতে শুরু করেছিলাম।
এর মাস খানেক পরেই খবর পেলাম লিজা আপা আর জাফরের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো। জাফর তাদের বাসার কাজের বুয়া রোজিনার পেট বাঁধিয়ে ফেলেছিলো। লিজা আপা সব জেনে গিয়েছিলো। লিজা আপা নিজেও সাত মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো। জাফর হয়তো পরে রোজিনাকে বিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে পেট ফেলে দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলেছিলো। রোজিনার আর কিইবা করার ছিলো। টাকা দিয়েই তো ওদের মুখ বন্ধ করা যায়। কতো রোজিনা এমন করে মুখ বন্ধ করে ফেলে! শুয়োরের বাচ্চা জাফর, ছয় মাসের ব্যবধানে তিনজনকে পেট বাঁধিয়ে ছিলো। পুরুষেরা এটা পারে। একসাথে মনে হয় একশো জনকে প্রেগন্যান্ট করতে পারে। নারীরা এটা পারে না। এই জায়গাতেই পুরুষগণ বাহাদুরী করে বেড়াই। পুরুষের বাবা বা পিতা হতে সময় লাগে এক থেকে পনেরো-কুড়ি মিনিট বা তার একটু বেশি। আর একজন নারীকে মা হতে হলে কম করে একটি বছর নির্ঘুম থাকতে হয়। বীর্য দিলেই পুরুষের বাবা হওয়া হয়ে যায়। রোজিনাকে পেট বাঁধানোর কথা শুনে আমি আমার চোখের সামনে জাফরের নাম আর আনলাম না। জাফর মনে হয় পথের কোনো নেড়ি কুকুর পেলেও পেট বাঁধিয়ে দিতে পারবে – এই কথা ভেবেই আমার বমি আসতে লাগলো। আমি জাফরকে ভুলে যেতে লাগলাম। বন্ধুদের সাথে গিয়ে লাইব্রেরীরে বসে বসে বিসিএস পড়তাম। বছর দু’য়েক পরে আমি বিসিএস পাশ করে এডমিন ক্যাডারে যোগ দিলাম।
চাকরীটা পাওয়া আমার জন্যে ছিলো একটা যুদ্ধের মতো। আমি জয়ী হয়েছিলাম। একসময় নওশাদের সাথে আমার বিয়ে হলো। একটা বাচ্চাও আছে আমাদের।
দিন পনেরো আগে ইফতির বিয়েতে লিজা আপা এসেছিলো। সাথে অনন্যা আর লিজা আপার ছোট বাচ্চাটাও এসেছিলো। ঐ ছোট বাচ্চাকে দেখে আমার মায়া জেগেছিলো। জাফরের ঔরশজাত। আমার গর্ভেও এমন একটি সন্তান এসছিলো। হয়তো সেও এমন দেখতে হতো কেননা লিজা আপা আর আমার চেহারা খুব কাছাকাছি। দূর থেকে পার্থক্য করা অনেক কঠিন হবে যে কারোর জন্যেই। আমি প্রায়ই সবই ভুলে গিয়েছিলাম। ঐদিন থেকেই আমার গর্ভপাত করা সন্তানের কথা বুক ফুঁড়ে বের হয়ে আসতে থাকে। আমি কাউকে বলতে পারি না। বাচ্চাটার কথা মনে পড়লে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি পাগলের মতো হয়ে যায়। আমার ভেতরের এই কান্নাকে আমি কাউকে শোনাতে পারি না। আমার সেই বাচ্চাটার জন্যে আমার কোনো অপরাধবোধ জাগে না, তবে খুব মায়া জাগে। বড্ড শূন্যতা চেপে বসে বুক জুড়ে। গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে মরে আমার মন। আচ্ছা! আমার মতো আর যারা এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তাদেরও কি আমার মতো এমন খারাপ লাগে?
লেখকঃ আসিফ ইকবাল আরিফ
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।