সকিনা ও তার মা ।। মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী

 সকিনা মুক্তির সংগ্রামে যুদ্ধজয়ী এক নারীর একমাত্র কন্যা। জন্মের পর থেকে চরম দরিদ্রতার কষাতে, বলতে গেলে জীবনযুদ্ধের মাঝেই বেড়ে ওঠা তার। মুখে‘বুলি’ ফোটার পর বাবা বলে কাউকে ডাকার ভাগ্য জুটেনি সকিনার। বহু বছর

পূর্বে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দোষ চাপিয়ে তার নির্দয় বাবা শহিদ আলী হতভাগিনী মায়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটিয়ে চলে যান। এর পর আর কখনও সকিনা ও তার মায়ের কোন খোঁজ খবর নেয়নি তার পিতা। একমাত্র মায়ের আদর-স্নেহেই বেড়ে উঠেছে সকিনা।
এ-তো নির্মম ও হৃদয় বিদারক এক গল্পকাহিনী। হতভাগিনী মা-ই যেন তার বাবা, মা-ই যেন তার মা। পোড়া কপালী ওই মা ছিলেন  সকিনার একমাত্র ভরসার নীড়, বেঁচে থাকার আশ্রয়কোল। কৈশোর থেকে জীবন জীবিকার তাগিদে বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। মায়ের সাথে অন্যের বাড়িঘরে জিইয়ের কাজ করে কিংবা দিকবেদিক ছুটোছুটি করে খেয়ে না খেয়ে জীবন বাঁচাতে হয়েছে সকিনাকে। একটু বয়স হওয়ার পর নিজে শ্রমিকের কাজ করে, কখনো ঠ্যালাগাড়ী কিংবা ভ্যানগাড়ী চালিয়েও এক-দুই বেলা মায়ের মুখে আহারের যোগান দিয়েছে। তার এই মাই যে-শেষবেলায় এই দেশের এক সংগ্রামী নারীর বীরত্বপূর্ণ খেতাবটি অর্জন করবেন কিংবা জাতির এক শ্রেষ্ট জননী হয়ে উঠবেন তা হয়তো জানা ছিলনা সকিনার।
ঘটনাটি ছিল এরকম যে- ওই সংগ্রামী নারী ছিলেন পাহাড়ী এক অগ্নিকন্যা। নাম তাঁর কাকাঁত হেঞ্চুয়িতা অথবা হেনুইঞ্চিতা, পরিবর্তিত নাম নুরজাহান বেগম।
ইতিহাসে অনবদ্য তিনি কাঁকন বিবি নামে, ছিলেন পাহাড়ি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক নারী। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই পাকিস্তান আমলে এক অবাঙালি পাকিস্তানি
সীমন্তরক্ষীর প্রেম বাঁশরীর সুরে বিমোহিত হয়েছিলেন তিনি। সে সূত্রেই খাসিয়া পাহাড়ি ওই ললনা নেমে এসেছিলেন সমতলে। এক শুদ্ধ ভালোবাসার অন্ধমোহে একটা সময়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন পরিণয়বন্ধনেও। কিন্তু  কৃষ্ণ লীলায় সেই বাঁশরীর সুরই তাঁর জীবনে বিষাদ বয়ে এনেছে। সংসার জীবনে একের পর এক মৃত সন্তান প্রসবের দোষে স্বামী হারা হয়েছিলেন সেই পাকিস্তান আমলেই। উদ্ভিন্ন যৌবনা কাকাঁত হেনুইঞ্চিতা স্বামীহারা হয়ে গেলেও ফিরে যাননি আর কখনও পাহাড়ে। তৎকালীন পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণে ঘেরা পূর্ববাংলা নামক ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী এক পশ্চাদপদ জনপদের সমতলেই থেকেছেন। আশা-নিরাশার
দোলাচলেই কাটিয়েছেন ভরা যৌবনকাল। এই নারী প্রথমা যৌবনে শুদ্ধ ভালোবাসার টানে, দেশমাতৃকার আত্মিক মায়াবী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, হয়তো এটাই
ছিল তাঁর দেশ প্রেম, দেশাত্ববোধ। তাই তো তিনি হয়েছেন আজ ইতিহাসে অনবদ্য, এক সংগ্রামী নারী।
প্রথমবার স্বামী হারা হয়ে গেলে সত্তোর দশকের গোড়ার দিকে কাঁকনের দ্বিতীয় বার বিয়ে হয় দিরাই উপজেলার জনৈক শহিদ আলীর সঙ্গে। ভাগ্যিস! আবার
দুর্ভাগ্যের থাবা প্রসারিত হয় তাঁর দিকে। গতবার ছিল মৃত সন্তান প্রসবের দোষ এবার দোষটা একটু অন্যরকমের। এবার দোষটা মৃতসন্তান প্রসবের নয়, তবে কন্যা সন্তান প্রসবের। কাঁকনের এই কন্যার নাম সকিনা। সকিনার বাপের বিবেচনায় সকিনাকে জন্ম দেওয়াতেই সকিনার মায়ের দোষ হয়েছে। কন্যা সন্তান প্রসবিনীর সঙ্গে আর ঘর করা চলে না! স্বাভাবিকভাবেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য উপস্থিত হয় এবং এক পর্যায়ে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠে, শহিদ আলীর সঙ্গে কাঁকনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কাঁকন পুরোপুরি অসহায় ও নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন। একটু অস্বাভাবিক হলেও ঘটনা এমনই ঘটেছিল কাঁকনের জীবনে।
৭১ এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সকিনার মা  অসহায় এই নারী দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত হয়ে ওঠেন। শিশু সকিনাকে অন্যের ঘরে রেখে নিজে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর আসলো সেই
মাহেন্দ্রক্ষণ। হানাদার মুক্ত হয় দেশ। সকিনা তখনো শিশু। একটি সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভবঘুরে পথিকের ন্যায় কন্যা শিশুকে নিয়ে কত দিকে ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কখনও মানুষের কাছে
হাত পেতে কিংবা শ্রমিকের কাজ কওে, কখনোবা বাজারে বাজারে সুঁটকি বিক্রি করে আহার জুগিয়েছেন, জীবন বাঁচিয়েছেন উদরের সন্তানের। মা তো মাই। নিষ্ঠুর
বাবা জন্ম দেয়া শিশুটিকে ফেলে চলে যেতে পারলেও জন্মদাত্রী মা তো আর সন্তানকে ফেলে চলে যেতে পারেন নাহ! সকিনা যখন কৈশোরে উপনীত হয়, সেও মায়ের সাথে কাজ করেই জীবন চালিয়েছে। তখন হয়তো মায়ের বয়সটা ভাটা পড়ে যায়। আগের মতো শরীরে শক্তি নেই। কাজ কামও করতে পারছিলেন নাা। প্রাত্যহিক জীবনে তখনো সকিনার মায়ের দুঃসহ কষ্ট যেন বইয়ে যাচ্ছিল। জীবন জীবিকার তাগিদে মা কাকঁন একদিন চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিলেন-
-সখিনা এখন থেকে ত্যুই আমার লগে কামে যাবি। খাইয়া বাঁচতে অইবো তো! মারে
কপাল পোড়া আমরা মায়ে-জিইয়ে। বসে থাকলে অইবো!
-কিতা খরতাম মাই। কাম কাইজ কী আর আছে।
-আমার লগে মাইনসের বাড়িতে গিয়া ঘরের কাইজ কাম করতে অইবো। দেশ স্বাধীন করছি, নিজের ইজ্জত দিছি, এহনও থাকি অন্যের বাড়ি। আমরারে কেউ দেখার তো নাইরে মাই। 
এভাবেই সকিনা মায়ের সাথে জীবন সংগ্রাম করে বাঁচতে শিখেছে। কাজ করেই বড়ো হয়েছে। বাবা নেই, বোধবুদ্ধির পর বাবার মুখটাও দেখতে পায়নি, মা-ই তার জীবনের সব। বেশ কয়েক বছর পর স্থানীয় সংবাদ কর্মী এবং গণমাধ্যমের বদৌলতে লাইমলাইটে চলে আসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ওই সংগ্রামী নারী। একটা সময়ে সকিনার গর্ভধারীনী মা কাকঁন বিবির যুদ্ধ জয়ের গল্পকাহিনী পত্রিকার পাতায় উঠে আসে। এনিয়ে দেশব্যাপি শুরু হয় বেশ মাতামাতি।
তবুও কমতি কি। আশার প্রদীপ যেন জ¦লে উঠেছে শেষ বেলায়। সকিনার মা কাঁকন পরিণত বয়সে উপনীত হয়েও একটু সুখের দেখা পেয়েছেন, এটাই হয়তো বড়ো প্রাপ্তি। এই মা মেয়ের জীবনে কিছুটা হলেও শান্তির সু-বাতাস বইতে থাকে । দেশস্বাধীনের দীর্ঘ পচিশ বছর পর এক খন্ড সরকারি ভূমি পান। সেখানে কুড়েঘরের ছাপটা বানিয়ে মাথাগোঁজার ঠাঁই হয় হতভাগিনী মা, মেয়ের। পরবর্তীতে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, খোদ সরকার বাহাদুরসহ নানা ভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলে স্বস্তি ফিরে সকিনার জীবন সংসারে। জীবন বদলে গেলেও এর রেশ বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি সকিনার। জীবন সংগ্রামে বয়োবৃদ্ধা মাকে নিয়ে কাটাতে হয়েছ তার।
তখন সকিনার মধ্য বয়স। তারও সংসারজীবনেও ঘটেছে নানা বিপত্তি। পদে পদে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে সকিনাকেও। এক অসহায় মায়ের কন্যা বলে সংসার জীবনও ভেঙেছে কয়েকবার। তবুও মাকে আগলে রেখেছে সকিনা আমৃত্যু। মায়ের সেবায় ছিল সে নিবেদিতা। সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে তার গৃহে ফিরে আসে কিছুটা সুখের আবেশ। কিন্তু মা কাকন তখন শতবর্ষী এক বৃদ্ধা। তিনি বয়সের ভারে নুজ্ব্য। তবুও সকিনা অতীতের সব লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর দুঃসহ কষ্টের বেদনা ভুলে গিয়ে মায়ের স্বীকৃতির গৌরবগাঁথা নিয়েই দিন কাটাতে থাকে। একদিন বৃদ্ধা মা কাকন তাকে ডেকে-
- সকিনারে এহন আমারে মানুষ কত ইজ্জত দেয়। এতটা বছর গেছে কত কষ্ট করছি
তোরে নিয়া। তহন শরীলে শক্তি আছলো। আইজকা টেখা-পইসা পাইতাছি কিন্ত শরীল তো
নুইয়া গেছেরে মাই।
- হ মা। এখন তুমি খুশি! দ্যাখছো মা তোমারে মাইনসে কত ইজ্জত সম্মান দেয়।
দেশের মানুষ এত বছর পরে তোমারে চিনতে পারছে।
- অয়রে মাই। কিন্ত আমি মরি গেলে তোরে কার কাছে রাইখ্যা যাইমু, এই চিন্তায়
এহন দিন যায়।
- আমারে নিয়া এতা ছিনতা কইরোনা মাই। তুমি আরও অনেক বছর বাইচ্ছা থাকবা।
তুমিই আমার বাপ, তুমিই আমার মা। এই জীবনে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে।
এর পর থেকে সকিনার মা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় একেবারেই বিছানায় শুইয়ে যান। আর উঠে দাড়াতে পারেননি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসাপাতাল বেডেই হঠাৎ একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাতির শ্রেষ্ট জননী সকিনার মা কাকঁন বিবি চলে যান না ফেরার দেশে। সে দিন মায়ের মৃত দেহ জড়িয়ে ধরে সকিনা কি যে বিলাপ করেছিল তা বলাইবাহুল্য। সকিনার কান্নায় যেন বাংলার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠেছিল। অন্ধকার নেমে এসেছিল ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চারিদিকে দেশপ্রেমিক ওই জননীর মৃত্যুতে শোকের মাতম শুরু হয়।  আজো সকিনা মায়ের কবরের পাশে বসেই কাঁদে, জননীকে হারিয়ে সে যেন আজ অসহায়।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।