চ্যাকোর ।। বিপুল রায়


প্রায় ছয়খান মাস থাকি খগেনের বনুষের কালা ধুদিছাগলটা আদি আনি পুষেছে ছবিনের বনুষ। ঘাস খায়া খায়া ছাগলটার যা দলদলা চেহারা হইসে, যে কাহ দেখিলেই নজর নাগাবে। 

          একবার কি এমন একটা বিয়াদি আসিল প্রায় সগারে ছাগল সেই বিয়াদিতে ‌মরি ধুয়া হইল। তাতে ছবিনের বনুষের একটা মাত্র খাসি ছাগল বাদে সব ছাগলে মরি শ্যাষ। সাতশো টাকা মসোং এর কেজি দরে প্রায় কয়েক হাজার টাকা মাটিত মিশি গেইল উমার! যাই হউক-- সেই খাসিটা ব্যাচেয়া একটা ভাল জাতের পাটিছাগল কিনিবার কথা ছিল ছবিনের বনুষের। কিন্তু ভাদর মাসের মাঝামাঝি সমায় ছবিনোক রাস্তার একটা ভুটি কুকুর গাসান দিসে। সেই মুহুর্ত্বে হাত শূন অবস্থায় চিকিৎসার বাদে উয়ার বনুষ খাসি ছাগলটায় বেচাইল। 

         আদি ছাগলটা এলা গাবিন হইসে। আর কয়েক মাস বিতি গেইলেই বাচ্চা দিবে। একদিন দুপুরা টাইমে ছবিনের বনুষ আন্দন বসাইসে। বাপের বাড়ির লোক আসিবে বুলি মাছ-মসোং আনি নিসে। সেই সমায় উয়ার আদি ছাগলটা দড়ি ছিঁড়ি যতীনের কবি বাড়িত ঢুকিসে। ডগডগা কবিগিলা অতবড়ো ছাগলটা ঘপাঘপ খাবার ধরিল। কুহাশার বাদে যতীনের বাড়ির কুনো লোকেরও নজরত পড়ে নাই।... কিছুক্ষণ বিতি যায়া যতীন বাড়ির বায়রা বিরাইলে নজরত পড়ে ছাগলটা। ততক্ষণে মেল্লা কবি খায়া নস্ট করিসে। 

          যতীন যে ছবিনের বনুষের আদি ছাগলটা চিনে না এমনটাও কিন্তু না হয়। তাও জাত-বেজাতের গালাগালি করি গাবিন ছাগলটাক ডাঙাইতে ডাঙাইতে বাড়ি আনি উয়ার ছোটো বেটি পিংকির হাতোত ধরে দিয়া‌ খোয়ার প্যাটে দিসে। 

          ছবিনের বনুষের আন্দন-বারণ শ্যাষ করি সাগাইক খাবার দিতে দিতে প্রায় বিকাল হয়া গেইল। তারপর সাগাই বাড়ি যাইতে যাইতে প্রায় ‌সইন্ধ্যা। সেলাসিনি কোনেক ফাঁকা হয়া দোলার ছাগল বাড়ি আনির বাদে বিরায়। কিন্তু জাগা মতন ছাগলটাক দেখির না পায়া খানেক চিন্তাত পড়ে। ছিঁড়া দড়িখান দেখিয়া ভাবে-- অগোলে-বগোলে হয়তো কুনো জঙ্গলোত ঢুকিসে যায়া। জঙ্গলগিলাতও যায়া অনেক খুঁজা-খুঁজি করিল, কিন্তু দেখা পাইল না। তারপর ফিরি আসি হেবাড়ি-হোবাড়ি খোঁজ করির ধরিল।

          প্রথমেই যায় যতীনের বাড়ি। উয়ার বনুষোক পুছ করিলে ‘জানোং না’ উত্তর পায়া আরও খুঁজিবার ঘাটা ধরে। পরপর কয়েকটা বাড়ি খোঁজ করিলেও কুনো খোঁজ পায় না। পাড়ার শ্যাষ মাথাত নিবারণ ঘোষালের বাড়ি গেইলে উয়ার ছোটো বেটির মুখোত জানির পারে-- দুপুরে পিংকির সাথে যায়া একটা বড়ো ধুদিছাগলোক উয়ায় খোয়ারোত দিয়া আসিসে! নিবারণের বেটির মুখোত এই কথাটা শুনি যুনি ছবিনের বনুষের অঙ্গ জ্বলেছে। 

          ফটাফট ঝড়ের ব্যাগে আসি হাজির হইল যতীনের বাড়িত। নাগি গেইল ঝগড়া! ছবিনের বনুষ যতীনের বনুষোক কইল, ‘নালাকারি, ছাগলটা খোয়ারোত দিসেন তে দিসেন-- কথাটা কইলে কি হয়! কতক্ষণ থাকি হয়রান হয়া খুঁজি বেরাছোং!’

          যতীনের বনুষ কথাটা কাড়ি নিয়া ফটকরি কইল, ‘হুশ করিয়া কথা কইস চারোডাঙি। নজরে যুদি দিবার না পান তে ছাগল পুষেন ক্যানে! কবিখান খায়া কি করিসে দেখসিস একবার?’

          ‘কতখান খাইসে হায়! কতখান খাইসে? আর তোমার গোরুটা ছিঁড়ি যেলা হামার পাটাখান খায়া শ্যাষ করিল-- হুলা কথা এলা ফমে হারাসিস কয়টা দিনোতে!’

          ছবিন উয়ার বনুষোক বাধা দিলেও বাধা আর মানে না! আরও বেশি করি কমোড় বান্ধি ঝগড়া করে। এক কথায় দুই কথায় ঝগড়ার আকারটা বিশাল হয়া গেইল। মনে হছে যুনি অস্ত্রহীন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ! কিছুক্ষণের মাথায় মুখের ভাষার যা পরিবর্তন হইল, তা আর বর্ণনা না করায় বরঞ্চ অনেক ভালো। 

          ছবিন কান বন্ধ করি বাড়ি থাকি বিরি চলি গেইল ছাগলটাক জাবিন করি আনিবার।

          আগা দিনের ঝগড়ার কারণে পরের দিন যতীন-- ছবিন ঘরের ঘাটাটাত চ্যাকোর দিসে। যাতে ছবিনের বাড়ির কাহ যতীনের খোলান দিয়া যাওয়া-আইসা করিবার না পারে। যতীনের খোলান পার হয়া যাবার নাগে ছবিনের বাড়ি।

          চ্যাকোরখান দেখি ছবিন মহাগরম। কোনেক মাত্র ঝগড়া-ঝাটিতেই ঘাটা বন্ধ! দ্বন-ঝগড়া পছন্দ করে না বুলি আগা দিনে একটা টু শব্দ করে নাই ছবিন। সেদিন দুপুরে উয়ায় নিজে যতীনোক চ্যাকোরখান খুলিবার কথা কয়। কিন্তু যতীন কথার কুনো উত্তর না দিয়া চুপচাপ যায়া ঘর ঢুকে। ছবিন বুঝির পারে যতীন চ্যাকোরখান খুলিবার না হয়। 

          চ্যাকোরখানের পূব মাথাত একটা বড়ো ডিঘি। ছবিন সেলা জঙ্গল কাটি ডিঘির বান দিয়া বাড়ি ঢুকিবার ঘাটা বানাইল। 

          বিতি গেইল কয়েক মাস। চাইরোপাখে শুরু হইল রোয়া গাড়া। যতীন সেলাও চ্যাকোরখান খুলায় নাই। এই চ্যাকোরখানের বাদে পাড়ার মানষিগিলারও বিশাল অসুবিধার সৃষ্টি হইসে। দোলাত গাড়ি ঢুকির পারে না কাদো দিবার বাদে। কাহরে কুনো কথা শুনে না যতীন। কাজে বাইধ্য হয়া মানষি বহুদূর ঘুরিয়া গাড়ি আনে নিজের জমিত।

          ভগবানের কৃপায় অবশ্যাষে আসিল যতীনের নিজের পালা। সেদিন উয়ায় নিজের জমিত গাড়ি ঢুকাবে বুলি চ্যাকোর খুলাইসে। সেই মুহুর্ত্বে ছবিন আগে যায়া কয়, ‘মোর বাড়ির ঘাটা দিয়া যুনি কুনো গাড়ি যায় না।’... ছবিনের এই কথায় যতীনের বুকখান হাকাউ করি উঠিল। চ্যাকোর তো যতীনের নিজের খোলানোত। কিন্তু খোলান পার হইলে যে হুটা ছবিনের বাড়ি যাবার রাস্তা। আর সেই রাস্তা দিয়ায় যাবার নাগে দোলার পাখে। এই মুহুর্ত্বে গাড়ি ঢুকিবার এইটায় ঘাটা। আজি যুদি ছবিন গাড়ি ঢুকির না দ্যায়, তাহলে তো রোয়া গাড়া হবার না হয়। অইন্য কুনোপাখে আলাদা ঘাটাও নাই-- সগারে রোয়া গাড়া শ্যাষ। রোয়া উকুরি কাহ উয়াক ঘাটাও দিবার না হয়, কারণ-- উয়ায় চ্যাকোর খুলি কাহকে গাড়ি ঢুকিবার ঘাটা দ্যায় নাই। উয়াক কায় ঘাটা ছাড়ি দিবে? একমাত্র উয়ার তানে মানষির কত অসুবিধা হইসে এইবার!... গাড়িওয়ালাও ছবিনের কান্ড দেখি গাড়ি ঘুরি ধরি চলি গেইল। যতীনের মাথাত হাত পরিল! এক হাল জমি-- চাষ যুদি না হয়, বিছনগিলা নষ্ট হয়া যাবে! সারাবছর খাবে কি?... সেই মুহুর্ত্বেই কত অস্বাভাবিক চিন্তা উয়ার মাথার ভিতিরা উৎপাৎ করির ধরিল। সেদিন আতিটা চিন্তায় চিন্তায় নিন হয় নাই উয়ার। 

          পরের দিন সকালে উঠি যতীন পাড়ার আরও দুইজন ডাঙোরিয়াক হাত-পাও ধরি, অনেক কাউলাকাটা করি ধরি যায় ছবিনের বাড়ি। ছবিন উদার মনোভাবের মানষি। ‘অতিথী দেব ভব’-- কথাটা মাথাত রাখি সগাকে বেঞ্চিত বসিবার আব্দার করে। ছবিন জানে-- বিতা কালিকার ঘটনার বাদেই আজি যতীন উয়ার বাড়ি আসি উপস্থিত। ছবিনের বনুষ চা জ্বালে আনে। চা খাইতে খাইতে হঠাৎ একজন ডাঙোরিয়া কয়, ‘ছবিন দা, বুঝিবার পাসিস মনে হয়-- ক্যানে আসিলি?’

          ‘কইলে তো বুঝিম। না কইতে আর কি বুঝিম সমীর ভাই।’

          ‘দ্যাখ ছবিন দা, কতদিন আর এংকরি থাকা যায়! যতীন কছে-- চ্যাকোরখান খুলি দিবে, তুই এই বিষয়ে কিছু কবু নাকি?’

          ‘খুলাউক। খুলাইলে তো ভালোয় হয়। মুই আর কি কইম এই ব্যপারে।’

          হঠাৎ যতীন হাত জোড় করি কয়া উঠিল, ‘ছবিন দা, যা কিছু হয়া গেইসে ওইলা ছাড়। মনত কিছু রাখিস না রে। মোর ভুল হয়া গেইসে ছবিন দা।’

          যতীনের কথায় ছবিন খুব খুশি। উয়াও কইল, ‘ঠিকে কসিস যতীন, এংকরি বেজার হয়া থাকা যায় না রে। পাড়া-পরশি সবসমায় মিলিমিশি থাকির নাগে। বিপদে-আপদে আগে যায়া খারা হবার নাগে।’

          ‘ঠিক কসিস ছবিন দা, মোর বুঝিতে ভুল হইসে রে। মোক মাপ করি দিস।’

          ‘ধুর পাগলা মুই মাপ করিবার কায় রে! ভুলটা বুঝিয়া যে তুই আজি স্বইচ্ছায় মানি নিছিস-- ইয়ার থাকি বেশী মহৎ কর্ম আর কি হবার পারে রে।’

          ‘হয় ছবিন দা, “পরার বাদে খাল খুরিলে নিজকে সেই খালোত পড়ির নাগে” রে-- আজি বুঝিলুং মুই।’

          ‘ছাড় ওইলা কথা। যত ভাবিবু তত মন খারাপ হবে। ধাঁও করি গাড়ি ধরি আয় তুই। ফটাফট চাষ করি নেক। তাড়াতাড়ি গাড়েক। কতদিনে আর গাড়িবু?’ দেড়ি হয়া গেইসে অনেকটায়।’...যতীন আর ডাঙোরিয়া দুইজন সমস্যার সমাধান করি ছবিনের বাড়ি থাকি উঠি চলি যায়।

          বাড়ি ঢুকিবার আগোত যতীন চ্যাকোরখান খুলিয়া উয়ার বনুষোক আকার খড়ি বানে দ্যায়। তারপর বড়ো টেক্টার আনি জমি চাষ করি নিয়া রোয়া গাড়ে।

          হয়তো একখান চ্যাকোর মানষির মাঝোত এপাশ-ওপাশ যাওয়া-আইসা বন্ধ করির পারে। কিন্তু মানষির মানবিক বোধের মাঝোত কুনোদিন খারা হয়া থাকির পারে না।

তারিখ: 05.02.2021

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।