শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়— শুধু আফিম বিক্রির জন্য অন্যায়ভাবে একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল চীনের উপর। কতোটা হীন ও দুর্বল হলে বিদেশিদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া শর্ত মেনে নিতে হয়— নিজেদের ৫টি বন্দর দিয়ে দিতে হয় বিদেশিদের। যে দেশের জনগণ আফিমের নেশায় চুর হয়ে থাকতো— দেশের আমলারা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যেতো— বন্যায়, মন্বন্তরে যে দেশের মানুষ এক সময় পড়ে থাকতো রাস্তাঘাটে— গৃহবিবাদে বিধ্বস্ত যে দেশের অর্থনীতি ছিল মৃতপ্রায়; সেই বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আজ সেই দেশ বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে সেই দেশটি। কী সেই সোনার কাঠি যার ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙ্গলো চীনের আর ঘুম থেকে জেগেই প্রায় ৭২ বছরের মধ্যেই আজ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হলো সে। সেই জীয়ন কাঠির খোঁজ পেতে চাইলে আমাদের যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে, যাঁর চোখে ধরা পড়েছিল সেই ঘুমন্ত সিংহের জেগে উঠার মূলমন্ত্র।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা দেশটির ক্ষমতায় আসে। ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি জেলখানা থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। সেপ্টেম্বর মাসে চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের নিমন্ত্রণ আসে। ৩৭টি দেশের অংশগ্রহণ থাকবে তাতে। পাকিস্তান থেকেও একটি দল যাবে। সেই দলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আতোয়ার রহমান, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সহ আরো কয়েকজন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগ দেন।
২১ দিন ছিলেন গণচীনে। ঘুরেছেন চীনের বড় বড় শহরে। রাস্তাঘাটের অসংখ্য মানুষের সাথে করেছেন মতবিনিময়। মিশেছেন রিকশাওয়ালা থেকে কারখানার শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিদের সাথে। একজন জাতীয়তাবাদী নেতার চোখ দিয়ে দেখেছেন নয়া লাল চীনকে।
বঙ্গবন্ধু নিজে নিজেই দাড়ি কামাতেন। একদিন ব্লেড কিনতে গেলেন দোকানে। কিন্তু আশ্চর্য কোনো ব্লেড পেলেন না, যদিওবা এক দোকানে ব্লেড পেলেন কিন্তু সেটা কয়েক বছরের পুরানো, জং ধরা। এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন কেন ব্লেড রাখেন না তারা। দোকানদারের ঝটপট সহজ উত্তর— আমরা কোন বিদেশি পণ্য ব্যবহার করি না। যেহেতু ব্লেড তৈরির প্রযুক্তি আমাদের নেই তাই আমরা ব্লেড ব্যবহার করি না। যেদিন আমরা ব্লেড তৈরি করতে পারবো সেদিনই আমরা ব্লেড ব্যবহার করবো। ততদিন আমাদের দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুরই আমাদের জন্য যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু বুঝে নিলেন, তীব্র দেশপ্রেম যে জাতীর মানুষের মধ্যে তাকে রুখে কে?
বঙ্গবন্ধু যে বছর চীনে যান সেই ১৯৫২ সালেই ভাষার জন্য প্রাণ দেন বাঙ্গালিরা। তিনি দেখেছেন চীনের অনেক মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও তারা তাদের সাথে কথা বলছেন দোভাষীর মাধ্যমে। তাঁরা একবার নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যান। সেখানকার অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে— “সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ইংরেজি জানেন, কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনা করলেন চীনা ভাষায়। দোভাষী আমাদের বুঝাইয়া দিলো। দেখলাম তিনি মাঝে মাঝে এবং আস্তে আস্তে তাকে ঠিক করে দিচ্ছেন যেখানে ইংরেজি ভুল হচ্ছে। একেই বলে জাতীয়তাবোধ। একেই বলে দেশের ও মাতৃবাষার উপর দরদ।” অথচ আজ ৫০ বছর পর আমরা দেখছি শিশুদের স্কুল থেকে শুরু করে রাস্তার পানের দোকানের নাম রাখা হচ্ছে ইংরেজিতে। দেশে রয়েছে নানা মাধ্যমের স্কুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বইগুলো এখনো ভিন্ন ভাষার। তাহলে একটা জাতি গঠনে কতোটা এগুলাম আমরা?
বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের আরেক জায়গায় লিখেছেন— “একটা বিষয় দেখে সত্যই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এক এক দেশে এক এক প্রকারের ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ (‘প্রিভিলেজড ক্লাস’) আছে- আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’; অন্যদেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগসুবিধে পেয়ে থাকে। নয়া চীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১০/১৫ বছর পর এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?”
আজকের যে চীনকে আমরা দেখি তা বঙ্গবন্ধুর দেখা সেই নয়া জাতের চীন। যাদেরকে তারা তৈরি করেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধে দিয়ে। একটা প্রজন্ম নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে জাতিটা গড়ে তোলার জন্য। একদিন ব্রিটেন জোর করে আফিম খাইয়েছিল চীনকে, হংকংকে জোর করে কেড়ে নিয়েছিল, আমেরিকা এসে ভাগ বসিয়েছিল, ফরাসি-পর্তুগাল এসেও ভাগ বসিয়েছিল। ধর্মান্ধ তাইপিং বিদ্রোহে প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সেই চীন আজ পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি।
সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলো ৩৭ টি দেশের ৩৬৭ জন ডেলিগেট, ৩৭ জন পর্যবেক্ষক, ২৫ জন আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি। এতো লোককে থাকতে দিবে কোথায়? চীনের সরকার তাঁর জনগণকে ডেকে বললেন বিদেশ থেকে মেহমান আসবে। তাদের থাকার জায়গা দিতে হবে। একটা বিল্ডিং বানাতে হবে। সমস্ত লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো। মাত্র ৭০ দিনে চারতলা এক দালান করে ফেললো। জনগণও নিজেদের কাজ মনে কাজ করে দেয়। এভাবেই তারা তৈরি করেছে বহু রাস্তাঘাট।
নতুন চীনে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ৩ বছরের মাথায়। চীনকে দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আবিষ্কার করেছিলেন একটি জাতির জেগে উঠার মূলমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু তখনো জাতীয় নেতা হয়ে উঠেন নি। তখন কী তিনি জানতেন তাঁর হাত দিয়েই ১৯ বছর পরেই প্রসব হতে যাচ্ছে পৃথিবীর নতুনতম রাষ্ট্র। সেদিনের নয়াচীন কী তাঁর বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো? জানি না, কিন্তু এটা জানি সেদিন দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে চীন ছিলো আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধে সেদিন তারা শুধু আমাদের বিরোধিতাই করে নি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের স্বীকৃতির জন্য।
একটি রাষ্ট্রের স্থায়ী শত্রু ও মিত্র বলে কিছু নেই। যার যার স্বার্থের দিক বিবেচনা করেই রাষ্ট্র তার বন্ধু নির্ধারণ করে থাকে। তাই জন্মের সময় যারা আমাদের বিরোধিতা করেছিলো তারা আজ আমাদের উন্নয়নের বড় অংশীদার।
এক সময় আমাদের পূর্বপুরুষের সাথে চীনের ছিলো আত্মিক সম্পর্ক। আমাদের ধর্ম আর দর্শন তাদের করেছে বিমোহিত। তাদের ভদ্রতা আর জ্ঞানচর্চা আমাদের করেছে সমৃদ্ধ। এই তো ৬০০ বছর আগেও আমাদের সোনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র সাথে দেখা করতে এসেছিলেন চীনের অ্যাডমিরাল ঝেং হে। সুলতান চীনের রাজাকে উপহার পাঠিয়েছিলেন দীর্ঘ গ্রীবার জিরাফসহ নানা উপহার সামগ্রী। সেই সব নানা কথা লেখা আছে তাদের গ্রন্থে।
আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী, বাংলাদেশেরও অর্ধশত বছর। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা সেদিন লাল চীনেকে যেভাবে দেখেছিলেন, যেভাবে উপলব্দি করেছিলেন; আমরা কী পেরেছি সেইভাবে আমাদের জাতিকে গড়ে তুলতে? চীনের নেতারা যেভাবে তার আফিমখোর জনগণকে বের করে এনেছিলেন আলোর পথে, অসৎ আমলাদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলার জন্য যে কর্মকৌশল নিয়েছিলেন আমরা কী তা পেরেছি? আমরা কী তা পারব?
চমৎকার লেখা।
ReplyDelete