আলোকচিত্রের স্মৃতিতে স্বাধীনতা ও শেখ মুজিব ।। আহাদ মোহাম্মদ তাহমিদ





আজ ১৯ আগষ্ট, বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস৷ ১৮৩৯ সাল থেকে দিনটি পালন শুরু হয়েছে৷ মূলত শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত আলোকচিত্রের অগ্রযাত্রায় যারা নিরলস পরিশ্রম করেছেন তাদের শ্রদ্ধা জানাতেই এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করা হয়৷ তাছাড়াও আলোকচিত্রের ভূমিকা, ছবিয়ালদের ত্যাগ স্বরণীয় করে রাখতে এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ৷ বিশ্বে ফ্রান্সে প্রথম এই দিনটি পালন শুরু হয়৷ ১৮৩৯ সালের জানুয়ারীর ৯ তারিখে ফ্রেন্স একাডেমি অব সাইন্সেস আলোকচিত্রের এক উপায় আবিস্কারের ঘোষণা দেন। এই উপায়ের নাম হল ড্যাগুইররিয়ো টাইপ।
 
নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে তারা এই প্রক্রিয়াকে কয়েক মাস পর ১৯শে আগস্ট, ১৮৩৯ সালে সর্বসাধারনের সম্মুখে একটি নতুন যন্ত্র উপস্থাপন করেন যা মূহুর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দী করতে সক্ষম। বিজ্ঞানী লুইস ড্যাগুইর সর্বপ্রথম ছবি তোলার ব্যাবহারিক এ উপায় আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারেই ছবি তোলার এই উপায়ের নাম দেয়া হয় ড্যাগুইররিয়ো টাইপ ফটোগ্রাফি।১৮৩৯ সালের ১৯ শে আগস্ট ফ্রেন্স একাডেমি অব সাইন্সেস, প্যারিসে একটি জনসভা ডাকে এবং সেখানে এই উপায়ে ছবি কিভাবে তোলা হয় তা সবাইকে দেখানো হয়। মাত্র কয়েকদিনের মাঝে ড্যাগুইররিয়ো টাইপ ফটোগ্রাফির জনপ্রিয়তা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। 

ড্যাগুইররিয়ো টাইপ ফটোগ্রাফি মুক্তি লাভের সেই দিনটিকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের এই দিন বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। এর সাথে আলোকচিত্র ও ছবিয়ালের গুরুত্ব ও অবদান স্বরণ করাই এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। ছবিয়াল বা ফটোগ্রাফার, মূলত যারা ছবি তোলে তাদের এই নামগুলোতেই ডাকা হয়। তাদের কাজ মূহুর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দী করে রাখা, এবং সেই স্মৃতিগুলোকে আজীবন সতেজ রাখা। কেওবা ছবি তোলে সখের বসে আবার কেও পেশা হিসেবে৷ এই আলোকচিত্রের শুরুতে বর্তমানের মত এত উন্নত ক্যামেরা বা ডিএসএলআর ছিল না। যুগে যুগে উন্নত আর স্পষ্ট ছবি ধারনের উদ্দেশ্যে এগুলোর তৈরি।এই আলোকচিত্রের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস ও আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা ও আন্দলন সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পেরেছে৷




পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্নতা পায় না। তা পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে পাকিস্তানের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়৷ পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে ১২০০ কিলোমিটার দূরে ছিল পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন ভাবে শোষণ ও নিপিড়ন চালাত৷ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রথম আঘাত হানে বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলার উপরে। তার জন্যে সেসময় ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলন হয়। তৎকালীন সময়ের কিছু দেশি বিদেশি সাংবাদিকগন সেই আন্দোলন এর অনেক স্থিরচিত্র ধারন করেন। তাছাড়াও আলোকচিত্রের অনেকটা সময় পেরিয়ে তখন ভিডিওগ্রাফিও আবিষ্কার হয়েছিল, যার ফলে বর্তমান প্রজন্মকে আমরা সেই ইতিহাস জানাতে পারি এই আলোকচিত্রের মাধ্যমে। আমরা সেই বীরের জাতি যারা জীবন দিয়েছিল মাতৃভাষার জন্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ জানতে ও দেখতে পেরেছে এই আলোকচিত্রের জন্যে। এছাড়াও ১৯৪৯ সালে আওয়ামীলীগ সৃষ্টি, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট এর বিজয় ও মন্ত্রীপরিষদ এর চিত্র, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা পেশকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিত্র, ১৯৬৯ সালের উনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান, ১৭৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সব চিত্রগুলো এবং এর গুরুত্ব আমরা ঐসকল স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখতে পাই৷ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যেই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আজকের বাংলাদেশের সৃষ্টি।

যার ইতিহাস কে আমরা সবচেয়ে প্রাধান্য দেই তা আজও সজিব শুধুই এই আলোকচিত্রের জন্যে৷ আমাদের নতুন প্রজন্ম দেখেছে কিভাবে নিরস্ত ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর পাক হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে,কিভাবে তাদের লাশ পাখিতে-কুকুরে ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে। জীবন বাচাতে কিভাবে এদেশের মানুষ ভারতে গিয়েছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা। আমাদের দামাল ছেলেরা কিভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে৷ আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত কিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, সবকিছু শুধু গল্পে বা পাঠ্যপুস্তক পড়ে নয়, নতুন প্রজন্ম তা নিজ চোখেই দেখেছে এই আলোকচিত্রের মাধ্যমে।

যুদ্ধের ভিডিও গ্রাফি গুলো দেখিয়েছে তৎকালীন সময়ের অবস্থা৷ এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর এর বিজয়ের চিত্র, পাক বাহিনী আত্নসমর্পণের, বাঙালি যোদ্ধাদের আনন্দ-উল্লাস সব ই এই আলোকচিত্রের দ্বারা আজও প্রানবন্ত। এই আলোকচিত্র গুলো দেখলে আজো এ জাতি আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে।




বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি জাতির পিতা। যার হাত ধরে, যার নেতৃত্বে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র জীবন থেকেই উদ্যমী ছিলেন। নেতৃত্ব দানে তার জুড়ি মেলা ভার। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ গঠন, ৬ দফা দাবি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে তার ভাষন, তার কার্যক্রম এর স্থিরচিত্র, ৭ই মার্চের ভাষন, স্বাধীনতার পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সহ সকল ঘটনাই আজও নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেভাবেই প্রচারিত হচ্ছে এই ছবিয়ালদের জন্যে। এই আলোকচিত্রের জন্যে আজও আমাদের ইতিহাস অনেক চেষ্টা করেও কেও বিকৃত করতে পারে নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মহল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ও শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি মুছে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা তা করে উঠতে পারে নি শুধুই উপযুক্ত প্রমান এর অভাবে৷ এই আলোকচিত্রের অবদানেই বাংলাদেশ সহ পুরো বিশ্ব জেনেছে বাঙালি জাতির বীরত্বের গল্প। বিশ্ব জেনেছে শেখ মুজিব কে, শেখ মুজিবের অবদানকে৷ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ গড়তে যে ত্যাগ তিতিক্ষা করেছেন তা কখনই ভোলা সম্ভব নয়৷

এছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্দোলন, সেনা শাসন, নতুন করে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দেশনেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও তার ভূমিকা সব কিছুই চিরযৌবনা রবে এই আলোকচিত্রের মাধ্যমে । তাই আনন্দ মাধ্যম হোক আর ইতিহাস ঐতিহ্য চর্চা। স্মৃতি গুলোকে প্রানবন্ত রাখতে আলোকচিত্র বর্তমান সময়ে অপরিহার্য ।




সকল প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইসে এর ব্যবহার রয়েছে৷ তাছাড়াও অতি উচ্চ মানের স্থিরচিত্র বা ভিডিওগ্রাফি ধরনের জন্যে রয়েছে উন্নতমানের ক্যামেরা৷ তাই বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসে সম্মান জানাই তাদের যারা এই বিশ্বখ্যাত যন্ত্র আবিষ্কার করেছে আরো সম্মানজানাই সেই ছবিয়ালদের যারা জীবনের ঝুকি নিয়েও অতীত ও বর্তমানে সত্যকে সামনে উপস্থাপন করতে নিরলস পরিশ্রম করেন।



আহাদ মোহাম্মদ তাহমিদ

ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।