বর্ণালীর সাথে আজ দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারে নি প্রভাত। এক যুগ পর! ঠিক এক যুগ পরে তাদের দেখা হয়েছে।
কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের প্রাক্কালে প্রভাত অনেকটা হন্নে হয়েই খুঁজেছে বর্ণালীকে। ফেসবুকে তার যতো পরিচিত পারস্পারিক বন্ধু ছিলো – সবার বন্ধুর তালিকা সে চষে খুঁড়ে বেড়ালেও তাকে পায় নি। আর কোনোদিন দেখা হবে না বলে অনেকটা আশা ছেড়ে দিয়েই গভীর সংকল্প নিয়ে ঘর-সংসারে মনোনিবেশ করেছিলো সে। প্রভাত বর্ণালীকে সেই সময় খুঁজছিলো আপনা চাকরীর খবরটা জানাতে। অতীতকালের তিরস্কার আর নিন্দা ঢালা লোকের কাছে বর্তমান সময়ের সফলতা জানানো একপ্রকার দ্বৈত আনন্দ দান করে। প্রথমত, নিন্দাকারী অতীত কর্মের জন্যে হয়তো লজ্জাবোধ করে আর দ্বিতীয়ত, তিরস্কৃত ব্যক্তির সফলতার কথা শুনলে তার চোখ-মুখ দিয়ে বিষবায়ু ঝরে ঝরে পড়ার দুর্বার আশঙ্কা থাকে।
তবে আজ যে কীভাবে আচমকা কোনো এক খসে যাওয়া ধ্রুব তারার মতো বর্ণালী তার চোখের সামনে এসে হাজির হলো – তা প্রভাতের কোনো হিসেবেই মিলছে না। সৃষ্টিকর্তাতে খুব একটা বিশ্বাস নেই তার। আর বর্ণালীকে দেখতে পাওয়ার কোনো আঁকুতি সে ঈশ্বরের নিকট ঘুনাক্ষরেও জানায় নি। তবুও সে বর্ণালীকে চোখের সামনে দেখে আচমকা কৃতজ্ঞতার বশে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো।
‘স্রষ্টা তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিলো বর্ণালী’ – এটা বলেই প্রভাতের চোখ গিয়ে পড়লো বর্ণালীর চোখে।
চোখ দু’টো তার আগের মতোই আছে। কৃষ্ণবর্ণ চোখের মণি এখনো ঝলমল ঝলমল করছে। মনে হয় এক সমুদ্র সচ্ছ্ব জলের উপর ভেসে থাকে ওর চোখের মণি। ভ্রূযুগল তার আগের থেকে একটু চওড়া হয়েছে। বয়সের কারণে এমন হতে পারে হয়তো।
খুন করা চাহনী তার চোখে এখনো আছে ঠিক আগের মতোই। চোখের মায়াতে কাউকে বশীভূত করার গুণটি বর্ণালীর আজন্ম হাতিয়ার। চোখে তার যাদু টানা খেলা চলে। যে বেটা ছেলের অন্তত হৃদয় বলে কিছু একটা আছে বর্ণালীর চাহনীতে তার হৃদয়ে ব্যমো বাঁধতে পারে। বর্ণালীর চোখের ইশারা ধুপ করে বন্দুকের নলের গুলির মতো হৃদয়ে গিয়ে লেগে যে কারোর হৃদয়কে আহত করতে পারে। আর বিষ ব্যথাতে যে হৃদয় একেবারে সমুদ্রের তলে ডুবে গিয়েছে সেই হৃদয়কেও মৃত্যুকূপ থেকে টেনে তুলতে পারে বর্ণালীর চোখের এই মায়া চাহনী।
গা গতরে মাংস লেগেছে বেশ। একেবারে থলথলে না হলেও কম না। বয়স তো তিরিশের ঘরে। আবার দুইটা বাচ্চাও নাকি বিয়িয়েছে সে।
তার চোয়াল আগের থেকে একটু প্রসস্ত। গ্রীবাতে বড় ডিমওয়ালা রুই বা কাতল মাছের পেটীর মতো চর্বি জমে গিয়েছে। ঠোঁট দু’টো তার আর আগের মতো পাতলা মিহি নেই। দশ বছরের নালিশের জীবন তার। আবদার আর অনাবদারে কতো টানাটানি গেছে ওগুলোর উপর দিয়ে তার কোনো হিসেব নেই। তার নিচের ঠোঁটটি উপরের ঠোঁট থেকে একটু বেশিই ফোলা ফোলা লাগছে। মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগেও নাগরের আদরে ফুলে টনটনে হয়ে গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই মাথায় গণ্ডগোলে ধরা কোনো মৌমাছি হুল ফুটিয়ে দিয়েছে তার গোলাপী ঠোঁটে।
থুতনিতে হালকা তেল জমে একেবারে টনটন করছে। বুকটা তার বেশ প্রসস্ত হয়েছে। আবছা অন্ধকারে দেখলে বাগানের ছোট বড় উঁইপোকার ঢিবির মতো মনে হবে।
ওর সরু বাঁশির মতো লম্বা নাকটি এখন আর নেই। নাকে মাংস জমে একটু ডান দিকে বেঁকে গেছে। তবে দেহের চাঞ্চল্য তার আগের মতোই আছে। একটুও বদলায় নি।
আমাদের কলেজের সব থেকে সুন্দরী আর মেধাবী মেয়ে ছিলো বর্ণালী। চিকন পাতলা গোছের লম্বাটে মেয়ে ছিলো ও। গায়ের রঙ একেবারেই ধবধবে ফরসা। সকালের কাঁচা রোদে ও যখন কলেজে আসতো তখন মনে হতো ওর মুখ দিয়ে চকচকে সোনা খসে খসে পড়ে বাতাসের সাথে মিশে যেতো।
বর্ণালীর সাথে প্রথমে প্রভাতের বন্ধুত্ব হয়েছিলো তারপরে প্রেম। এক বছরের মতো প্রেমের সম্পর্ক ছিলো ওর সাথে।
ধূসর শালিকের ঠোঁটের মতো ঠোঁট উঠিয়ে বর্ণালী বলে, ‘কেমন আছো প্রভাত? কি করো এখানে? বউ বাচ্চা আছে নাকি বিয়ে করো নি?’ – এমন ডজন খানেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রভাতও ঐ একই প্রশ্নগুলো করে উত্তর আদায় করে নিলো।
বর্ণালীর হাজবেন্ড -আবু কামাল- এই শহরে বদলী হয়ে এসেছে। পেশায় সে পুলিশ। পুলিশের এ এস পি। নতুন বদলী আদেশ না আসা অব্দি পরিবার সমেত এখানেই থাকবে। থানার গাঁ ঘেঁষেই একটা পুলিশ কোয়াটারে থাকে।
বর্ণালী এখন কোনো চাকরি করে না। ইউএনডিপিতে কোনো একটা প্রোগ্রামে সে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে ছিলো। তবে তার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেবার পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে পুরোপুরি গৃহিনী। বাচ্চা সামলায়, স্বামী সামলায়। আর বিষাদ অবসরে সে বই পড়ে। যে কবিতার বই তার যৌবনকালে বিষের মতো ছিলো এখন তা তার সময় পার করার একমাত্র মাধ্যম। এখন সে জীবনানন্দ, রবীন্দ্রণাথ, বোদলেয়ার, বিষ্ণু দে, মহাদেব সাহা আর সুনীলের কবিতা শরবতের মতো করে গিলে অবসর পার করে।
দীর্ঘ পরিচয় দেওয়া নেওয়া আর আলাপচারিতা সেরে নিজ বাসার ঠিকানাটা বর্ণালীর হাতে দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলো প্রভাত।
আশিকুর রহমান প্রভাত – বর্তমানে যিনি ব্রক্ষ্মপুত্র সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। থাকে এই শহরেই ঠিক নদীর ধারের পাঁচতলা বাড়ির চারতলার ফ্লাটে। তার স্ত্রী লীনা মজুমদারও এই শহরের মরিউমনেছা সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। ঘরে তাদের তিন বছর বয়সের একমাত্র ছেলে সন্তান আছে।
আশিকুর রহমান প্রভাত একজন আপাদমস্তক কর্মট পতি। ঘর-সংসারে সে কোনোকিছুর ঘাটতি রাখে না। ঘাটতি রাখে না তার পড়াশুনা আর গবেষণাতেও। এবছরের বইমেলাতেও তার দুইটি গবেষণা গ্রন্থ বের হয়েছে; একটি রবীন্দ্রণাথের উপর আর অপরটি কবি মহাদেব সাহার উপর। তবে প্রভাতের স্ত্রী লীনা মজুমদার একেবারেই আলাদা কিছিমের। ক্লাসে লেকচার দেওয়ার জন্যে শেলি, কিটস, শেক্সপিয়র, মিল্টনসহ প্রমুখ নামকরা সাহিত্যিকদের লেখালেখি ঠিক যতোটুকু না পড়লেই নয়, ততোটুকুই পড়ে। আর লিংগুইস্টিক তার একেবারেই ভালো লাগে না পড়তে। তবে যতোটুকু চর্চা না হলে তার হয় না সে ততোটুকুই চর্চা করে। তার কাছে স্বামী, সন্তান আর সংসারই মূল বিষয়। আর শিক্ষকতা তার কাছে মহান কোনো পেশা নয় যেমনটি প্রভাত ভাবে। স্রেফ একটা চাকরি হিসেবেই শিক্ষকতাকে দেখে লীনা মজুমদার।
বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে ঢুকেই জামা প্যান্ট পরিবর্তন করে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দক্ষিন দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো প্রভাত। চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো তার কলেজ জীবন। বুকের ভেতরে ছাইচেপে থাকা বর্ণালীও আজ আয়নার মতো ফুঁটে ফুঁটে উঠছে তার চোখের সামনে। সেই বর্ণালী যেই বর্ণালীর সাথে কলেজে পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে প্রভাতের প্রেম হয়েছিলো।
প্রভাত চলে গেলো তার প্রথম যৌবনের দিনে – সেই কলেজ চত্ত্বর, শ্রেনীকক্ষ, তাবিবুর স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া আর কাঁচা সোনারঙের সেই সময়ের বর্ণালী নামের মেয়েটির সাথে কাটানো দিনে।
কলেজে পড়ার প্রথম দিকে বর্ণালী আর প্রভাতের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়। বর্ণালীর পিতৃকুলের নিবাস ছিলো বরিশাল শহরের নিচিনপুরে। বর্ণালীর পিতা সেই সময় পুলিশের চাকরী করতো। চাকরীতে বদলী সুত্রে সপরিবারে উকিলপুর শহরে এসেছিলো। আর বর্ণালীকে উকিলপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো। প্রভাতও বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলো। উকিলপুর শহরের একটু অদূরেই তার পৈত্রিক নিবাস। তার পিতা ছিলো মায়ামনি সরকারি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক।
বর্ণালীর সাথে একদিন দুইদিন করে মিশতে মিশতেই গভীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো প্রভাত। তখন প্রভাতের উঠতি বয়সে বেশ পরিবর্তনের ছাপ এসেছিলো মন আর শরীর জুড়ে। উকিলপুর সরকারি কলেজের সবথেকে প্রতিভাবান আর বাদর প্রকৃতির ছেলে ছিলো প্রভাত। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সেই সময় সে জীবনানন্দ আর রবী ঠাকুরের কবিতার বই নিয়ে ঘুরতো। প্রভাত একজন তুখোড় বিতার্কিকও ছিলো। একবার তো উকিলপুর কলেজের বিতার্কিক দল সারা বাংলাদেশের মধ্যে সেরা হয়েছিলো। প্রভাত হয়েছিলো সেরা বক্তা। মোটকথা প্রভাতের মধ্যে যেমন মন্ত্রমুগ্ধ গুণ ছিলো তেমনি বর্ণালীও সুন্দরী ছিলো। পড়াশুনাতে দুইজনেই ভালো ছিলো। এক সময় তাদের ব্যাটে-বলে মিলেই প্রেম হয়েছিলো। প্রেম ঠিক বলা যায় কি না! তবে ঐ বয়সের যে মোহ থাকার কথা ছিলো – তা একে অপরের প্রতি জেগেছিলো।
প্রভাত সেই সময় রসায়ন, পদার্থ বা উচ্চতর গণিত বিষয়সমূহ যতোটুকু সময় পড়তো তার থেকে বেশি সময় পড়তো মনে হয় কবিতার বই। কবিতা আবৃত্তির গলা তার সেই রকম ছিলো। তখনকার সময়ে পুরো উকিলপুর শহরে তার থেকে ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতো শুধু কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসমা ম্যাডাম। একবার তো স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে কলেজে কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রভাত রবীন্দ্রণাথের দুই বিঘা জমি কবিতাটি আবৃত্তি করে সবার মন জয় করে নিয়েছিলো। সেই আবৃত্তি শুনে স্বয়ং কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যক্ষ আতিউর রহমান পাঁচশো টাকার দুইটি কচকচে নোট প্রভাতের পকেটে উপহার সরূপ গুজে দিয়েছিলেন।
প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ কবি হয়, কবিদের মতো হাবভাব ধরে, কবিতার মতো করে কথা বলে – এইসব প্রচলিত বচনগুলো সেই সময় প্রভাতের জন্যে একেবারে মিথ্যে ছিলো না।
তাদের প্রেম প্রেম ভাব আর লেখাপড়া ভালোই চলছিলো। ঐ বয়সে মেয়েরা যেমন প্রেম প্রেম ভাব দেখিয়ে নিজেদের পেছনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছেলেদের নাকানি চুবানি খাওয়ায় – প্রভাতও তেমন হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছিলো বর্ণালীর পেছনে। বর্ণালী তাকে মন দিয়েছিলো কি দিলো না – এই নিয়ে প্রভাত একটা রহস্যের মধ্যে থাকতো। নারী মাত্রেই রহস্যময়ী আর উঠতি বয়সের নারীরা যে আরও বেশি মায়া আর রহস্যের জাল বিস্তার করে থাকে – প্রভাত সেই সময় কোনো এক কবির কবিতাতে পড়ে জানতে পেরেছিলো।
এমন আবেগভরা মনের অবস্থা নিয়েই একদিন প্রভাত তাবিবুর স্যারের বাসা থেকে বর্ণালীর পেছন পেছন আসছিলো। সে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার ক’য়েক চরণ পাঠ করতে করতে যখনই ‘চুল তার কবে কার…’ – এই চরণে এসেছিলো তখন সে বর্ণালী কোমল কালোকেশে অনেকটা জোর করেই হাত বুলিয়েছিলো। এমন আচমকা জোরাজোরি করে চুলে হাত দেওয়াতে বর্ণালী প্রভাতের উপর ক্ষেপে গিয়েছিলো। একটানা দশদিন বর্ণালী প্রভাতকে এড়িয়ে চলেছিলো সেসময়।
ঐ বয়সের প্রেম সম্পর্কে নারী হৃদয়ে যে এক ধরণের ইউটোপিয়ান প্রেমের ধারণা থাকে – তেমন ধারণা বর্ণালীর মধ্যে ছিলো বলেই হয়তো সে তার চুল ছোঁয়াকে ভালো ভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। তার কাছে হয়তো প্রেমের অর্থ শরীরের বাইরে কিছু ছিলো। প্রেম মনে হয় শুধু স্বর্গীয় অনভূতির নাম যা শুধুই অনুভব করার বিষয় ছিলো বর্ণালীর কাছে। আর প্রেমের টানে শরীর ছুঁলে প্রেম অপবিত্র হয়ে যায় বা প্রেম নোংড়া হয়ে যায় – এমন ধারণাও তার মগজে গেঁথে ছিলো। আর এমন ধারণার বশে বশীভূত হওয়া দোষের কিছু ছিলো না কেননা ঐ বয়সটাই ছিলো এমন ভাবনার বয়স।
বর্ণালীর চুলে হাত দেওয়ার পরে প্রভাতের মনেও পাপবোধ জেগেছিলো নাকি। এই জীবনে সে মনে হয় কোনো একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে – এমন স্বীকারোক্তি তার বন্ধুদের কাছে সে হরহামেশেই দিয়ে বেড়াতো।
পাপবোধের ভারে প্রভাতের মুখ তেমন ভার হয়ে থাকতো যেমন ভাব যখন চরম উত্তেজনায় ঘুমের মধ্যে তার স্বপ্নদোষ হওয়ার পরে হতো। পাপভরা কালো মুখ নিয়ে কিচ্ছুক্ষণ একা একা বসে থাকতো অমন ঘটনার পরে। শুধু স্বপ্নদোষই নয়, সেই বয়সে যৌন উত্তেজনার বশে হস্তমৈথুন করার পরেও তার মনে এমন পাপবোধ জেগে উঠতো।
এক সময় আবার তাদের মান ভাঙলো। আবার তারা প্রাইভেট পড়তে যাওয়া আরম্ভ করলো। তারা আবার আগের মতোই পাশাপাশি বসতো। স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে একে অপরের পায়ে চিমটি কাটতো, পায়ের উপরে পা দিতো।
দিন যতো গড়াতে থাকে ততোই তাদের মধ্যকার পাপবোধের ধারণা দূর হতে থাকে। একসময় তারা পাশাপাশি আসলে তাদের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গে অন্যরকম অনুভূতি সঞ্চারিত হতে থাকতো যা পৃথিবীর অন্যান্য অনুভূতি থেকে একেবারেই আলাদা রকমের ছিলো। আর এমন অনুভূতির চাহিদা মেটাতেই তারা আরও বেশি কাছাকাছি ঘেঁষে থাকতে চাইতো সেই সময়।
একদিন আগষ্ট মাসের এক ঝুমবৃষ্টির দুপুরে কলেজের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বর্ণালী আর প্রভাত উকিলপুর শিশু পার্কে গিয়েছিলো। ঐ শহরের ঐ পার্কটিই ছিলো উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রেম বিনিময়ের একমাত্র নিরাপদ জায়গা। খুব বেশি অশ্লীল পর্যায়ে না গেলে পার্কের লোকজন কাউকে উঠিয়ে দিতো না। পূর্ণ বয়স্ক নর-নারীরাও আসতো ঐ পার্কে। মূলত সামাজিকভাবে যাদের প্রেম দৃষ্টিকটু ছিলো – এমন যুগলও আসতো সেখানে।
প্রভাত যেই বর্ণালীর শরীরের নরম নরম জায়গাগুলোতে হাত রাখছিলো ভূমিকম্পের মতো কেঁপেকেঁপে উঠছিলো বর্ণালী। ‘অসহ্য রকমের যন্ত্রণা’ – বলে বর্ণালী প্রভাতকে ঠেলে ফেলিয়ে দিয়ে পার্ক থেকে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিলো।
এরপর একমাস দুই মাস যেতে না যেতেই প্রভাত আবিষ্কার করলো বর্ণালী তাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করে দিয়েছিলো। বর্ণালীর মুখে সেই সময় কলেজের লিটন স্যারের প্রশংসাই বেশি থাকতো। সারাদিনের চিন্তার বেশির ভাগ সময়ই সে লিটন স্যারকে নিয়ে করতো।
প্রভাতের আর বুঝতে বাকি থাকলো না কিছুই। সেই পার্কে যেই অসহ্য যন্ত্রণা বর্ণালী পেয়েছিলো সেই যন্ত্রণা তার শান্ত নদীর মতো হয়ে গিয়েছিলো হয়তো লিটন স্যারের দ্বারা। কলেজের দু’য়েকজন তো রীতিমত বলাবলিই করতো যে লিটন স্যার বিশেষ কেয়ার নিয়ে নাকি বর্ণালীকে বায়োলজি পড়াতো। তাও আবার সন্ধ্যে রাতের বেলা।
একদিন সন্ধ্যে বেলা বর্ণালীর পথরোধ করে দাঁড়ালো প্রভাত। বর্ণালী প্রভাতকে দেখে বাঁকা হাসি দিলো। বর্ণালী যখন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো তখন জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার ক’য়েকটি লাইন পড়তে থাকে প্রভাত;
“সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি;
বলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের আগুন ভরা রাতে”।
বর্ণালীর সেই দিনের সেই ‘অসহ্য যন্ত্রণা’ উচ্চারণের কথাটি প্রভাত বুঝতে পেরেছিলো। নিজেকে শাণিত করেছিলো সে অসহ্য যন্ত্রণাকে শান্ত-শীতল নদী করে দেওয়ার কিন্তু কে জানতো যে বর্ণালী তার আগেই শান্ত হয়ে গিয়েছিলো। প্রভাতকে পাশ কাটিয়ে বর্ণালী সেইদিন চলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে আর তাদের মধ্যে কোনো সখ্যতা আর হলো না।
এরপর তাদের ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। পরীক্ষা শেষে ফলাফল পেয়ে শেষ হলো তাদের কলেজ জীবন। বর্ণালী ফিরে গেলো বরিশালে, প্রভাত চলে গেলো ঢাকাতে।
সেইবার উকিলপুর সরকারি কলেজ থেকে যে বিশ জন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলো সেই তালিকাতে বর্ণালীর নাম ছিলো। প্রভাত একটুর জন্যে ফঁসকে গিয়েছিলো জিপিএ-৫ থেকে।
এরপর স্নাতকে বর্ণালী কোথায় ভর্তি হয়েছিলো প্রভাত কোনো খবর পেলো না বা খবর নিলো না। প্রভাত ভর্তি হয়েছিলো ঢাকার একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখান থেকেই সে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে বিসিএস দিয়ে কলেজের শিক্ষক হয়েছিলো।
প্রভাত যখন তার একযুগ আগের জীবনের স্মৃতিচারণ করছে এমন সময় লীনা বললো, ‘প্রভাত তোমার ফোন এসেছে’।
একটা অপরিচিত নম্বর। প্রভাত রিসিভ করলো।
‘এখন মনে হয় আমাকে নিয়ে ভাবছো, না? পুরোনো দিনের কথা মনে করছো’? – ওপাশের অমন কথায় প্রভাত একটু থতোমতো খেয়ে প্রথমে হ্যাঁ। হ্যাঁ। তারপরে বললো না। না। এইবার ঐ পাশ থেকে যখন চওড়া একটা হাসি প্রভাতের কর্ণকুহরে ঝংকারের মতো বেঝে উঠলো - ফোন কলটা যে বর্ণালীর ছিলো তখন তার আর বুঝতে বাকি থাকলো না।
‘বেশ! তো। আসো না একদিন আমার বাসাতে। বরসহ আসবে কিন্তু। চায়ের দাওয়াত। সময় করে চলে এসো’ – বলে ফোন কাটলো প্রভাত।
ঠিক দুইদিন পরে সন্ধ্যে ঝিমিয়ে ওঠার পরপরই প্রভাতের বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। বর্ণালী আর তার হাজবেন্ড আবু কামাল আসলো। একে অপরের সাথে তারা পরিচিত হয়ে আলাপ করতে লাগলো কিছুক্ষণ।
‘ডিনারটা কিন্তু আমরা সবাই একসাথে করবো। আমার বাসাতে’ – লীনা এইভাবে বললে প্রভাতও সুর মেলালো। আবু কামাল আর বর্ণালীও জোরালো সাঁয় যোগালো।
বর্ণালী আর লীনা কিচেনে চলে গেলো। নিজের হাতেই রান্নাবান্না শুরু করলো লীনা। বাসার কাজের মেয়েটি মশলাপাতি বেটেবুটে দিলো। বর্ণালীও এই ফাঁকে লীনা আর প্রভাত দম্পতির একমাত্র ছেলে কিষাণের সাথে একটু ভাব জমিয়ে নিলো।
প্রভাত আর আবু কামাল বাসার ছাদে চলে গেলো। চেয়ারে বসে দুইজনে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জীবন-সংসার, পেশা, সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে আলাপ করতে লাগলো।
বর্ণালী আর লীনার মধ্যে ভাব জমে গেলো। ‘যাক। অন্তত মন খুলে কথা বলার একজন মানুষ পাওয়া গেলো’ বর্ণালী এমন প্রকাশে লীনা সম্মতি জানালো, ‘অবশ্যই ভাবী’।
ডিনার শেষ হলো। আবু কামাল আর বর্ণালী বিদায় নিলো।
এরপর থেকে বর্ণালী আর প্রভাতের যোগাযোগ গাঢ় হতে থাকে। তারা ফোনে কথা বলে, একে অপরের বাসাতে যায়, রেষ্টুরেন্টে একসাথে খায়, বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে একসাথে হাঁটতে যায়।
‘আজ বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। গ্রাম থেকে আব্বা-মা আসবে’ – একদিন লীনা এমন করে প্রভাতকে বললে প্রভাত মনে রবী ঠাকুরের একটি কবিতা বাঁকা ঠোঁটের হাসি নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
“সে এলে সব আগল যাবে ছুটে
সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,
ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে
তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে”।
প্রভাত লীনাকে এটা বোঝাতে চাচ্ছিলো যে বর্ণালী যদি আজ বিকালে তাকে পার্কে যেতে বলে তাহলে সে সব বন্ধন ছেড়েছুড়ে সেখানে যাবেই। তবে এটা সে তার ভেতরেই রাখলো, প্রকাশ করলো না একবারের জন্যেও।
একদিন তো মেঘ ভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছিলো প্রভাত। বর্ণালীর আসার কথা ছিলো পার্কে। প্রভাত সেইদিন কবিতার বই বগলে করে পাকা একঘণ্টা পার্কের দারোয়ানের সাথে গল্প করে অপেক্ষা পার করেছিলো।
একঘণ্টা পরে বর্ণালী তার সামনে উপস্থিত হলে সে গীতাঞ্জলি থেকে আরেকটা কবিতার দু’য়েকটা লাইন মুখভার করে পাঠ করতে থাকে সে।
“মেঘের পরে মেঘ জমেছে
আঁধার করে আসে,
আমায় কেনো বসিয়ে রাখো
একা দ্বারের পাশে।“
আবার রবীন্দ্রণাথ! এই জীবনে তাকে আর মাফ করলে না।
বাংলার মাস্টর যে! এইসব ভাঙিয়েই তো খেয়ে পরে বেঁচে থাকি। ছাড়লে কি জীবন ঘড়ি টিকটিক করে বেজে চলবে আর?
প্রভাত আর বর্ণালীর মধ্যে মনের চুক্তি বেশ মাখো মাখো হয়েছে। লোকচক্ষু ছাপিয়ে তা উজানে বয়ে চলা ঢেউয়ের মতো চলতে শুরু করেছে। যে প্রেম তাদের দু’জনের মধ্যে জমে উঠেছে তা যেনো তাদের শরীরকে বিষ ব্যথার মতো পোড়াচ্ছে। নির্জলা আর নির্জনে এই বিষ ব্যথা সমাধিস্থ করতে না পারলে মনে হয় তাদের মনে আর শান্তি মিলবে না।
একদিন বিকেল বেলা বর্ণালী ফোন করে প্রভাতকে।
আবু কামাল সাতদিনের বিশেষ প্রশিক্ষণে লণ্ডনে গেছে। আমাকেও নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। আমি যায় নি। বাসায় শাশুড়ী আছে। আমার একটু অবসাদ চাই। একটু বেড়াতে যাবো।
বেশ তো। তুমিও যেতে সাথে। লণ্ডন দেখে আসতে। তো কোথায় বেড়াতে যাবে?
সিলেট যাবো। ওখানে একটা বড় চা বাগান আছে। কটেজও আছে রাত থাকার মতো। কাল পূর্ণিমা! তুমি যাবে তো?
সিলেট যাবে, তাইতো? আচ্ছা বেশ! ভরা পূর্ণিমার চাঁদ – চা বাগানের কটেজে কাটাতে খারাপ লাগবে না। তো কীভাবে যাবে?
বাসার গাড়িটি নিবো। ড্রাইভার নিবো না। আমি নিজেই ড্রাইভ করবো।
আচ্ছা। বেশ! আমি নিজেও একটু একটু গাড়ি ড্রাইভ করতে পারি। দু’জনে মিলেই না হয় চালালাম।
পরের দিন সকালে সিলেটের উদ্দেশ্যে বের হলো তারা। বিকেল গড়ালে তারা গন্তব্যে পৌছালো। দুপুরের খাবার যাত্রা পথেই খেয়ে নিয়েছিলো।
সন্ধ্যে গড়ানোর কালে তারা টিলার গাঁ বেঁয়ে বেড়ে ওঠা সবুজ চা বাগানে প্রবেশ করলো। টিলার ঠিক মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টিনের ছাউনির কটেজে উঠে রুম বুঝে নিয়ে ফ্রেশ হলো তারা।
রাত নামতে শুরু করেছে। উঁচু টিলার উপরে দু’খানা চেয়ার পেতে একের পর এক গল্প বলা শুরু করলো তারা।
আকাশের পূর্বদিকে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের জ্যোস্নাতে নীলাকাশের আধছায়া নীলে ছেয়ে আসছে সবুজ চা বাগানের বুকে, বর্ণালীর কালো চুলে, নীল শাড়ীর আঁচলে, ভ্রুযুগলে, চিবুকের চওড়াতে আর থুতনির উঁচুতে। এমন ভরা পূর্ণিমার চাঁদে বর্ণালীকে চাঁদের থেকেও বেশি যৌবনা মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো গলধ নেই তার। একেবারে অঙ্গে অঙ্গে যৌবনে খাসা সে। কাপের পর কাপ চা শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের। একের পর এক সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছে প্রভাত।
কবিতার শ্লোক আর তাদের গল্পে ভেসে যাচ্ছে চা বাগান, চাঁদের আলোয় ঝলমলে কটেজটি আর তারা নিজেরা।
রাত যেই গভীর হলো বর্ণালী গাড়ি থেকে দুই বোতল রেড লেভেল নামালো। আর প্রভাত হাতে নিলো কবিতার বই।
মদ, নারী আর কবিতা - একসাথে পাওয়া যেনো এক ঐশ্বরিক ব্যাপার। পরনারী নিষিদ্ধ পরপুরুষের জন্যে, পরপুরুষ নিষিদ্ধ পরনারীর জন্যে, আর কবিতা – তাও নিষিদ্ধ হয় সময়ে সময়ে আর কালের ঘূর্ণিপাকে। এই মহা মূল্যবান ত্রিসম্পদ যেনো ঈশ্বরের যোজ্ঞের মতো করে প্রভাতের হাতে এলো আজ। আর বর্ণালীও যেনো পেলো পুলকের অবসাদ তাড়ানোর বিশাল সমাহারে সাজানো এক চাঁদ রাত।
মদের নেশা পুরোপুরি পেয়েছে বসেছে প্রভাতকে। টাল হয়ে হেলে দুলে পড়ছে। মাল জাতে মাতাল হলে কি হবে? তালে কিন্তু পুরোপুরি ঠিক আছে। কবিতা পড়তে তার ক্লান্তি নেই একদম। মাতাল হলে কবিতা আরও বেশি পড়ে সে। রবী ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা পড়া শুরু করলো সে;
“আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়- উৎস হতে।“
মদের নেশা বর্ণালীর ধরে গিয়েছে। প্রভাতের হাত থেকে বই কেঁড়ে নিয়ে সেও রবী ঠাকুরের আরেকটি কবিতার দুই চরণ পাঠ করতে থাকে টলতে টলতে।
“যাক ছিঁড়ে, যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যের জাল।
দুঃখের প্রসাদে এলো আজি মুক্তিরকাল।“
রাত বাড়ছে। ভরা চাঁদ যেনো উনুন ভরে আলো দিচ্ছে। মহাদূরের নীলাকাশ যেনো মাটিতে নেমে আসছে।
এতোদিন কোথায় ছিলে প্রভাত? কেনো দূরে সরে ছিলে? এমনও চাঁদ ভরা আকাশ রেখে।
বর্ণালী নেশার চোখের চাহনী তীর ছুঁড়তে শুরু করেছে। তার পাখির নীড়ের মতো চোখের দিকে চোখ তুলে প্রভাত রবী ঠাকুরের আরেকটি কবিতা থেকে ক’য়েকটা লাইন বলে,
“নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছো নয়নে নয়নে
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছো গোপনে।“
আবারও রবীন্দ্রণাথ! বুঝিয়ে বলো। সহজ করে বলো। কবিতার মতো এতো দুর্বোদ্ধ কেনো হচ্ছো প্রভাত? সহজে দেখো আমার চোখ। দেখো কতো সরল!
তুমি এই মনে ছিলে বর্ণালী। এইখানে। তোমাকে এতোদিন খুব গোপনে আগলে রেখেছিলাম। লীনার থেকে লুকিয়ে। হৃদয়ে আছো বলেই তো এই ভরা চাঁদে দেখা দিলে।
রাত দীর্ঘ হচ্ছে। শান্ত হয়ে আসছে চারপাশ। কেবল শুধু অশান্ত বিলাপে ভরে উঠছে এই চা বাগান। এইবার আগের থেকে একটু বেশিই ঢুলে টলে প্রভাত পড়তে শুরু করে জীবনানন্দ দাশের কবিতা।
“পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনের মনে
আকাশ জড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।“
উহ! কতো সহজ দেখেছো জীবনানন্দের কবিতা। প্রভাত তুমি শান্তির আকাশ। আমিও শান্তির আকাশ। এসো জড়িয়ে যায়, এসো মিলে যায়। আকাশে আকাশ মিলিয়ে মেঘ উড়িয়ে দিই। এসো। তুমি এসো।
সেইদিন সেই কলেজের দিনে আমাকে কেনো ওভাবে ভুলে গিয়েছিলে? কেনো ব্যথার বিষাদ আমার হৃদয়ে পুরে দিলে?
টলকাতে টলকাতে বর্ণালীকে নিয়ে কটেজের রুমে চলে আসে প্রভাত। বোধহীন শিশুর মতো প্রলাপে প্রভাত বলে, ‘কেনো অমন করে আমায় ব্যথা দিলে, সেই কলেজের দিনে’?
নিজেকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে শক্ত করে প্রভাতের মুখখানা বুকের নরমে চেপে বর্ণালী বলে,
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানে রাখি এ হৃদয়”।
জীবনানন্দ পড়ছো তাই না বর্ণালী।
হুম। প্রভাত।
বর্ণালীর কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতা অমৃত বাণীর মতো শোনায় প্রভাতের কাছে। মদ, নারী, কবিতা, আর চাঁদ রাত - একসাথে পেয়ে পৃথিবীর সৌভাগ্যবান প্রেমিকের মতো বুক উঁচিয়ে উঁচিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে প্রভাত।
একটু পরেই দূর আকাশের পশ্চিম কোণে খসে পড়ে শুকতারা। খসে পড়ে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পরে প্রভাতও। অন্যদিকে শান্ত নদীর মতো পড়ে থাকে বর্ণালী প্রভাতের বুকের উপর। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ রাত আর ভরা যৌবনের বর্ণালী যেনো বিলীন হলো রাত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই।
সকাল হলো। ঘুম ভাঙলো। কেউ কারোর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। দু’জনকেই বডড অসহায় দেখাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে যে ওরা মরে গিয়েছে। গতরাতে তাদের ভেতরে যে তীব্রতা ছিলো সকাল আসতে না আসতেই তেজহীন হয়ে গিয়েছে। প্রেম মনে হয় এমনই - রতিতে পূর্ণ হলেই প্রেম মরে যায়।
সকাল নয়টা বাজলেই তারা বাড়ি ফেরার জন্যে গাড়িতে ওঠে। প্রভাত কবিতা পড়তে থাকে। জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাটি যেটা সে বর্ণালীকে সকালে বলবে বলে কথা দিয়েছিলো;
“একদিন – একরাত করেছি
প্রেমের সাথে খেলা।
একরাত – একদিন করেছি
মৃত্যুর অবহেলা।
একদিন – একরাত তারপর
প্রেম গেছে চলে –
সবাই চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে”।
গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বর্ণালী বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“প্রেম ধীরে ধীরে মুছে যায়,
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…”
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার চরণযুগল উচ্চারণ করেই বর্ণালী যা বলার বলে দিলো, বুঝে নিলো প্রভাতও। তারপর আধছায়া নীল চোখে নিয়ে যে যার গন্তব্যে আগের মতো মিশে গেলো।
লেখকঃ আসিফ ইকবাল আরিফ
শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।