আবুল এবং বাবুল দুইজন ব্যক্তি। আবুল হতদরিদ্র একজন দিনমজুর। আবুলকে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। আবুলের এক ছেলে তিন মেয়ে। বড় সন্তান রহিম। স্ত্রীকে নিয়ে আবুলের ছয় সদস্যের পরিবার। পড়ালেখার পাশাপাশি সাংসারিক কাজে রহিম বাবাকে সহযোগীতা করে। বাবুল গ্রামের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং কৃষক। পৈতৃক সূত্রে বাবুলের অনেক সম্পদ। ব্যবসায়ের পাশাপাশি বাবুলের সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাবুলের একমাত্র সন্তান রকিব। রকিব ও রহিম একই ক্লাশে পড়ালেখা করে। দুইজনই সমান মেধাবী। তাদের মধ্যে পড়ালেখার তীব্র প্রতিযোগীতা। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে কখনও রহিম এগিয়ে যায়,আবার পরের বছর হয়তবা রকিব এগিয়ে যায়। দুজন সমান মেধাবী । গ্রামের মানুষের বিচার বিশ্লেষণে রকিবের তুলনায় রহিম এগিয়ে। কেননা রহিম সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করে। দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়াটা রহিমের জন্য অনেক কঠিন। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় রহিম ও রকিব নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে।
আবুলের আর্থিক অসচ্ছলতা। পড়ালেখার খরচ যোগান দেওয়াটা আবুলের পক্ষে একেবারে অসম্ভব। রহিম বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা জেনেও শিক্ষকদের উৎসাহে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে। রকিবের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা নেই। পরিবারে কোন পিছুটান নেই। সার্বক্ষণিক পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারে। বাবা মায়ের স্বপ্ন রকিবকে ডাক্তার হতে হবে। রহিম কে কেউ কোনদিন স্বপ্নের কথা বলেনি। সংসারের অভাব অনটন,অতিরিক্ত খাটুনিতে বাবার অসুস্থতা সবকিছু মিলিয়ে রহিমের প্রতিদিন স্কুলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর। ইদানিং বাবার শরীরটা বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংসারের জন্য রহিমকে কাজেও যেতে হয়। নিয়মমিত স্কুলে না যেতে পারা ও পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে স্যারদের বকুনির পাশাপাশি কটু কথাও শুনতে হয়।
রহিম তোর দ্বারা সাইন্স পড়া হবেনা। নিয়মিত স্কুলে না এসে কেউ সাইন্স পড়তে পারেনা।
স্যার আমি কি করব? আব্বুর শরীর খারাপ থাকলে আমাকে কাজে যেতে হয়।
সমাজের মানুষের বাঁকা চোখের চাহনি। গরীবের ছেলেদের কাজ করে খেতে হয়। পড়ালেখা করলে গরীবের সংসার চলেনা। বন্ধুদের উপদেশ তোকে আগেই বলেছিলাম সাইন্স নেওয়ার দরকার নেই। তুই আমাদের সাথে মানবিকে পড়ালেখা কর। তুই আমাদের কথা শুনলি না।
রকিবের পড়ালেখা পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার কারণে রকিব শিক্ষকদের চোখের মণি। কোন পিছুটান নেই। শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগীতায় চলছে রকিবের পড়ালেখা। ডাক্তার তাকে হতেই হবে।
রহিম কেরোসিন জ্বালিয়ে পড়ালেখার দরকার নেই বাবা শুয়ে পর। সকালে উঠে আমার সাথে কাজে যেতে হবে। গরীবের ছেলের এত পড়ালেখার দরকার নেই।
ছেলেটা একটু পড়তে বসেছে ওকে পড়তে দিনতো। সারাদিন কি খাটুনিটাই না খাটে ছেলেটা। দিনের আলোতে একটু পড়বে সেইসুযোগতো ছেলেটা পাইনা। পড়তে বসেছে ওকে পড়তে দিন।
পড়ালেখার খরচ কি তোর বাপ এনে দিবে।
বাপ তুলে কথা বলবেননা। আমার বাপ আপনার সংসারের জন্য কম কিছু করেনি। আপনি জীবনে কি করতে পেরেছেন। তিনবেলা তোদের মুখে খাবার তুলে দেয় কে?।
তিনবেলা খাবারটুকু ছাড়া আর কি দিতে পেরেছেন? সেটাওতো ঠিকমত দিতে পারেননা। নুন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থা।
তুই চুপ করে শুয়ে থাক। ওকে আর পড়তে হবেনা। কাজ করে খেতে হবে ওকে।
আম্মু তোমরা আর ঝগড়া করোনা। আমি আর পড়ালেখা করব না।
ছেলেটা পড়তে বসল আর আপনি ওকে পড়তে দিলেননা। আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই করেন।
নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার আগেই রহিমের পড়ালেখার পাঠ শেষ। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে ফিরতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারেনি। এসএসসি পরীক্ষাটাও দিতে পারেনি।
রহিম এখন মৌসুমি শ্রমিক। যখন যে কাজ পাওয়া যায় সেটা করেই সংসার চলছে রহিমের। রকিব এসএসসিতে ভালো ফলাফল করে শহরের ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলেই ডাক্তারি পড়ালেখা শুরু হবে। সরকারিতে চান্স না পেলেও বেসরকারিতে পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য বাবুল সাহেবর আছে। একমাত্র সন্তান ডাক্তার হবে এটাই বাবুল সাহেবের স্বপ্ন।
বয়স বিশ পেরনোর আগেই বন্ধুদের পরামর্শে রহিম বিয়ে করেছে। বন্ধুদের যুক্তি আমরা কর্ম করে খাই । আমাদেরকে বিয়ে করে সংসারি হতে হবে। বয়স বাড়ানোর দরকার নাই। বেশি বয়সে বিয়ে করলে ছেলে মেয়ে মানুষ হবেনা। তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে শেষ বয়সে ছেলে মেয়ের কামাই খাওয়া যাবে।
রকিব সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। মেধা বুদ্ধির পুরোটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে।
বিয়ের একবছর পেরোতেই রহিমের ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। বাবা গত হয়েছে। বাবা জীবিত থাকতেই ছোট একবোনের বিয়ে দিতে পেরেছে। বোনরা রহিমের মত মেধাবী না। যত তাড়াতাড়ি বিদেয় করা যায় ততই সংসারের জন্য মঙ্গল। রহিমের সংসারে ছয়জন সদস্য। আবার ছোট বোনদের বিয়ে সাধি। কঠিন জীবন সংসার রহিমের। দুবেলা দু মুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রহিমের মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে।
প্রায় দশ বছর পরে বাল্যবন্ধু রকিবের সাথে রহিমের দেখা। রকিব রহিমকে চিনতে পারেনি। চিনতে পারার কথাও না। অতিরিক্ত কাজের চাপে শরীর ভেঙ্গে পরেছে। রহিমের চোখে মুখে বয়সের ছাপ। মেয়ের বাবা হওয়ার কারণে গালভর্তি দাঁড়ি গোঁফ। মনে হয় যৌবন পেরিয়ে এখন মধ্যবয়সী এক মানুষ । রহিমকে সংসারের প্রয়োজনে রিক্সাও চালাতে হচ্ছে। রিক্স না চালিয়ে উপায় কি। শেষ সম্বল যা কিছু ছিল সব বিক্রি করে ছোট দুবোনের বিয়ে দিতে হয়েছে। এখন রিক্সায় তার একমাত্র সম্বল। বাড়ি ফেরার পথে রকিব উঠে বসেছে রহিমের রিক্সায়। একি আমি কাকে আমার রিক্সায় তুলেছি। ছাত্র জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি সকল কাজে যাকে আমি পিছনে ফেলেছি আজ তাকেই বহন করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। পরিচয় গোপন রাখার শত চেষ্টা করেও মনের অজান্তে রহিম রকিবের কাছে জানতে চাইল বন্ধু কেমন আছো। রকিব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে রিক্সা চালকের দিকে।
ভালো আছি আপনি কে?
আমাকে চিনতে পারবেনা তুমি।
নাম বললে হয়তবা চিনতে পারব। আমি এই গ্রামেরই সন্তান।
মনে করে দেখতো বন্ধু কাকে পিছনে ফেলে তুমি নবম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলে।
তুমি রহিম!
হ্যাঁ,বন্ধু আমি রহিম।
বন্ধু তুমি কেমন আছো?
এইযে আমাকে যেমন দেখছ তুমি।
একি হাল হয়েছে তোমার বন্ধু। পড়ালেখার চাপে তোমাদের কোন খবর নিতে পারিনি বন্ধু। তুমি আর পড়ালেখায় ফিরতে পারনি এটা আমি শুনেছিলাম। এখন আর কি করছ বন্ধু।
এইতো সংসার ধর্ম পালন করছি। মেয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা করে।
তুমি বিয়ে করেছ! আবার তোমার মেয়ে হয়েছে! মেয়ে প্রাইমারিতে পড়ালেখা করছে। কি বলছ বন্ধু।
বিয়ে করে সংসারি হয়ে গেলাম। তোমার কি খবর রকিব।
সবেমাত্র এমবিবিএস পরীক্ষা শেষ করলাম। আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করতে এসেছি। দুদিন বাড়িতে থাকব।
চাকুরী,ঘর সংসারের কি খবর বল।
বিসিএস দিয়ে ভালো জায়গায় পোস্টিং পাওয়ার পরে ঘর সংসার নিয়ে ভাবব বন্ধু।
রহিম বিসিএস এর মানে না বুঝলেও বুঝেছে ভালো চাকুরী পেলে তবেই সংসারি হবে রকিব।
বাসায় এসো বন্ধু।
রহিমের মেয়ে প্রাইমারি পাস করে গ্রামের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। চমকপ্রদ ফলাফলে সবার নজর কেড়েছে। সরকারি বৃত্তিও পেয়েছে। সবার একই কথা মেয়েটা বাপের মতই মেধাবী হয়েছে। মেয়ের এতকিছু অর্জন,এত প্রশংসা রহিমের মনকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা। রিক্সা চালকের মেয়ের আাবার কিসের ফলাফল,কিসের সাফল্য।
রকিব বিসিএস দিয়ে ডাক্তার হয়েছে। ভালো জায়গায় পোস্টিং। বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। স্ত্রীও ডাক্তার।
নবম শ্রেণিতে ভর্তির আগেই রহিম তার মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে নিরুদ্দেশে। কোন এক অজানা গন্তব্যে।
বাবুল সাহেবদের ছেলে ময়ে নাতি নাতনি ডাক্তার হবে। আবুলের স্বপ্ন ছেলে মেয়ে,নাতি নাতনি দুবেলা দু মুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই জীবনের সার্থকতা। জীবিত থাকাকালীন এই স্বপ্নটুকুই মনেপ্রাণে লালন করেছে। রহিম নিজেকে নিয়ে আর কোন স্বপ্ন দেখেনা। স্বপ্ন দেখা,স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা রহিমদের জন্য নয়। রহিম করিমদের জীবনের ইতিহাস বড় নির্মম বড়ই কঠিন।
প্রভাষক, লাউর ফতেহ্পুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ
নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।