ফাগুন এসেছে ধরায়। প্রকৃতি সেজেছে তার নতুন সাজে। প্রকৃতির রুপ বৈচিত্রতা পরিপূর্ণতা পাই বসন্তকালে। বসন্ত ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্ত ঋতু। শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে উঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা। সবুজের সমারোহে কবি মনে প্রেম জেগে উঠে। তাই বেগম সুফিয়া কামাল বলেছেন,
ফাল্গুনের আগমনে পলাশ,শিমুল গাছে লেগেছে আগুনের খেলা।
আবার বসন্ত রাত্রি আমাদের দুয়ারে দিল হানাউন্মনা ছিলাম আমি তবু সে আমারে ভুলিল না
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা,গান,নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা উপমায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাউল কবির মনকেও দোলা দিয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত।
ওরে ভাই ফাল্গুন লেগেছে বনে বনে,ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।
বসন্তের মাতাল হাওয়া দোলা দিয়ে যায় প্রেমিক মনকে। কোকিলের মিষ্টি মধুর সুর শুনে প্রেমিক মন গেয়ে চলেছে শাহ আবদুল করিমের-
বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে,বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে,সই গো আমার বাড়ি আসে।
পহেলা ফাল্গুন সাজবে প্রকৃতি, সাজবে ললনা হলুদ শাড়িতে। তাই কাজী নররুল ইসলামের আমন্ত্রণ
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজেবনভূমি সুন্দরী; চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি।
এমন ফাল্গুনেই,বায়ান্নর আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের শব্দ বিপ্লব সাহসী উচ্ছ্বাস ও বাঁধভাঙা আবেগে বাংলা একাকার হয়েছিল। বসন্তে ফিরে পেয়েছিল বাঙালি তার ভাষার অধিকার। বসন্তে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আন্দোলন। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার দীপ্ত শপথ। ছাত্র সমাজের বজ্রকঠিন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল সারা বাংলার রাজপথ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,বাংলা চাই। প্রতিবাদী স্লোগান আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়েছিল। ভেঙ্গে পরেছিল পাকিস্থানি শাসক গোষ্ঠীর অহংকারের দেয়াল।
পলাশ,শিমূল,কৃষ্ণচূড়া রঙে রাঙিয়ে ছিল প্রকৃতি। সালাম,বরকত,রফিক,জব্বার,শফিউরের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। শহীদের আত্মত্যাগ হবেনা মলিন। শহীদেরা বেঁচে থাকবে স্মৃতির পাতায়। বাঙালি গাইবে শহীদের গান।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানোএকুশে ফেব্রুয়ারিআমি কি ভুলিতে পারি।
মায়ের ভাষা,মায়ের শেখানো বুলি কত সুমধুর। বাঙালির মনের ভাব প্রকাশের প্রকৃত তৃপ্তি মাতৃভাষায়। মা,মাটি আমাদের বাঙালির শ্রেষ্ঠ উপহার।
একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আট ফাল্গুন একই সূত্রে গাঁথা। ফেব্রুয়ারি এবং ফাল্গুন বাংলা ভাষাকে মহিমান্বিত করেছে। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিশ্বদরবারে বাঙালির সম্মান ও মর্যাদাকে নতুন একমাত্রা দান করেছে। বাংলা ভাষা বিশ্বস্বীকৃত ভাষা।
বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে ফাল্গুন। বসন্ত এনে দিয়েছে মাতৃভাষা, বসন্তে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা।
তাইতো কবি শামসুর রহমান বলেছেন-
আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথেকেবল নিবিড় হয়ে কখনও মিছিলে কখনও বাএকা হেঁটে যেতে মনে হয়,ফুল নয় ওরাশহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ,স্মৃতি-গন্ধে ভরপুরএকুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।
বসন্তে ফুল ফল প্রকৃতির সমারোহে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বাংলার সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক। বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। ঋতুচক্রের আবর্তন আবহমানকাল থেকে বহমান। প্রকৃতি শিখিয়েছে বিকাশ। বিনাশ ডেকে নিয়ে আসে ধ্বংসের পথ। গাছে গাছে ফুটবে ফুল,কোকিল গাইবে মিষ্টি মধুর গান। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হবে প্রকৃতি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মত করে আমরা বলতে চাই-
ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।
ফাগুন হাওয়ায় আবার জাগ্রত হোক বাঙালির চেতনা। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে আমরা গাইব বাংলার জয়গান। মনের মাধুরী মিশিয়ে গাইব অতুল প্রসাদ সেনের মাতৃভাষার গান।
মোদের গরব,মোদের আশা,আমরি বাংলা ভাষা!তোমার কোলে তোমার বোলে,কতই শান্তি ভালোবাসা!
প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান
লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ
নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।