জয়গাঁও টু কালচিনি ।। বিপুল রায়

 
টিভি ন্যাপটল কোম্পানীর ক্যুরিয়ার বয়ের কাজটা করোং সেলা। মাসিক বেতন সাত হাজার টাকা মাত্র। তবে, ইচ্ছা থাকিলে কমিশন সিস্টেমেও কাজ করা যায়। সেই ক্ষেত্রে পার্সেল ডেলিভারীর উপর কমিশন নির্ভর করিবে। ধরা-বান্দা সাত হাজার টাকা মাসিক বেতনের চাইতে কমিশন সিস্টেমে কাজ করা অনেক লাভ। কামাই ভালো হয়।... তার উপর এক্সট্রা কামাই তো আছেই– যদি করির ক্ষমতা থাকে তাহলে।

ন্যাপটল কোম্পানীত ক্যুরিয়ার বয়ের কাজ করার অসুবিধা একটায়– রুট অর্থাৎ পার্সেল ডেলিভারীর এড়িয়া বহুদূর পর্যন্ত হয়! কুনো কুনো দিন একশো কিলোমিটারের বেশী এড়িয়াতও পার্সেল ডেলিভারীর দায়িত্ব পড়ে! অর্থাৎ যাওয়া-আইসা মিলি প্রায় আড়াইশো কিলোমিটারের মতনও বাইক চালের নাগে! সেই ক্ষেত্রে ব্যস্ত হাইরোডোত প্রতিদিন বাইক চালা মানে জীবনটা হাতোত নিয়া কাজ করা!

মোর অফিস ছিল মাদরীহাটের দলদলিয়াত। বাড়ি থাকি যার দূরত্ব পাক্কা বিশ কিলোমিটার। সকাল আটটায় উপস্থিত হবার নাগিসে। আর রুট ছিলো জয়গাঁও টু কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, বারোবিশা, ফালাকাটা টু ধূপগুড়ি, বীড়পাড়া টু ওদলাবাড়ি (ক্রান্তি, লাটাগুড়ি) পর্যন্ত। এই এড়িয়াগিলাত মোক যাবারে নাগিসে পার্সেল ধরি। না গেইলেও না হয়!

সেদিন জয়গাঁও টু কালচিনি রুটের পার্সেল ডেলিভারী। অর্থাৎ একদিনেই জয়গাঁও আর কালচিনির সব পার্সেল ডেলিভারী করির নাগিবে। জলদাপাড়া অভয়ারণ্য পার করি তোর্ষা নদী, তারপর হাসিমারা। প্রথমে হাসিমারার পার্সেল ডেলিভারী করি চলি গেলুং দলসিংপাড়া চা বাগান। তারপর সোজা জয়গাঁও।

ঐন্যান্য শহরের থাকি জয়গাঁও শহরটা খানেক ছোটোয় মনে হইসে মোর। কারণ একপাখে উঁচা পাহাড়, একপাখে বড়ো নদী, আরেকপাখে ভুটান। যায় জয়গাঁও গেইসে বা যায় জয়গাঁওত থাকে তায় ইয়ার বর্ণনাটা ভালো দিবার পারিবে। তবে এই ছোট্ট শহরকেনাত যেদিনে যাং সেদিনে মাথা ঘুরে। অর্থাৎ জয়গাঁও শহরের বুকোত প্রচুর টোল আছে। এই ‘টোল’ যে কুন টোল (সম্ভবত টোল প্লাজা না হয়) তা মোর জানা নাই। কাস্টমারোক কল করিলেই কয় অমুক টোল আইসো তমুক টোল আইসো! ফম হারে যায় কুনটা কুন টোল!

রামগাঁও কলেজের বগোল যায়া প্রথম পার্সেলটা ডেলিভারী করির সমায়ে ঝামেলা! পার্সেল পুরা প্যাকিং করায় ছিলো, কুনো পাখে ছিঁড়া-ফাটা নাই। কিন্তু প্যাকেটের ভিতিরা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল! দেখিয়ায় তো কাস্টমারের মাথা খারাপ! মুইও অবাক! অনেক্ষণ জেরা করিল মোক! কত মানষির কত কথা! শুনির নাগে– উপায় নাই! প্যাটের দায়ে কাজ করা যেহেতু। প্যাকেট খুলি পার্সেল ডেলিভারী না হলে অফিসোত আসি শুনির নাগে উল্টাপাল্টা কথা! শ্যাষে শিলিগুড়ি ব্রাঞ্চ অফিসোত কল নাগে কাস্টমারের সাথে কথা কয়া দিলুং। নিজেও অফিসোত কল নাগে কথা কলুং। পরিস্থিতি খুব গরমাগরম হয়া গেইসে। কাজে ওটে আর দেড়ি না করি পার্সেলটা নিয়া চলি গেলুং গুয়াবাড়ি। জয়গাঁও গুয়াবাড়ি। সরু সরু গোলি রাস্তা। গুয়াবাড়িত ফির দুইটা মসজিদ– পুরান মসজিদ আর নতুন মসজিদ। কাস্টমার ঠিকিনা দিলে– হয় নতুন মসজিদ না হয় পুরান মসজিদের ঠিকিনা দ্যায়।

গুয়াবাড়ি থাকি বিরি বৌ বাজারের পাখে আগে গেলুং। খুব জ্যাম রাস্তা। প্রচুর পরিমানে অটোরিক্সা। সহজে আগে যাওয়া মুশকিল! যাই হউক, কুনোমতনে পৌঁছালুং গেটের গোর। গেট মানে– ভারত-ভুটান বর্ডারের গেট। একজন এস.এস.বি জওয়ানের একটা পার্সেল ছিলো। আসিতে খানেক দেড়ি হবে বুলি বড়ো হনুমান মন্দিরের সিঁড়িত বসি আধাঘন্টা মতন বাচ্চে নলুং। কিছুক্ষণ পর কল আসিল, “স্যার জি, আজ হাম নেহি আ পায়েঙ্গে। হো সাকে তো পার্সেল কো আপ দুসরা দিন লেকে আইয়ে।”... এতক্ষণ বাচ্চে থাকি যুদি পার্সেল ডেলিভারী না হয়, মাথা গরম হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যপার। মুই কলুং, স্যার, আপকা কৈ বান্দা হ্যায় তো ভেজ দিজিয়ে। কৈ ভি আকে পার্সেলকো রিসিভ কর সাকতা হ্যায়।
“প্যায়সা নেহি দেনেছে ভি হোগা?”
প্যায়সা দেকার ভেজ দিজিয়ে।
“প্যায়সা তো এ.টি.এম. ছে উঠানা হোগা ভাই। অর হামলোক আভি ইধারছে হিল ভি নেহি সাকতে। আপ দুসরা দিন আইয়ে।”... ফোনটা কাটি গেইল। মোরও মাথাটা গরম হয়া গেইল! কি আর করা যাবে– চলি আসির নাগিল।

এবারে ধরিলুং কালচিনির ঘাটা। ভুলান টার্নিং পর্যন্ত আগেয়া দ্যাখোং রাস্তা বন্ধ। কিছু একটা সমস্যার কারণে এলাকার থানীয় লোকগিলা রাস্তার মইধ্যত বসি ধর্মঘাট করিসে।... কাজেই বাইধ্য হয়া বস্তির রাস্তা ধরিলুং– যেই রাস্তাটা লোকালয়ের ভিতর দিয়া একটা নদী পার হয়া সোজা পাসাখা যাওয়ার রাস্তাত নাগিসে। ঐ বস্তিরও একটা পার্সেল ছিলো, কিন্তু কাস্টমার সেদিন নিবে না বুলি জানাইসে। বাইক থামে আরেকবার কাস্টমারোক কল করিলুং। কাস্টমারের ঐ একে কথা– সেদিন নিবে না। পুরানা টেকনিক কাজোত নাগে কলুং, দেখিয়ে স্যার, আজ আগার আপ আপকা পার্সেল রিসিভ করেঙ্গে, তো হাম আপকো চারশো রুপিয়া কা ডিসকাউন্ট দেঙ্গে...। লেকিন, আপকো থোরাসা আগে আনা হোগা।... আর কি– কাস্টমারের মনত বোধায় লাড্ডু ফুটিল ডিসকাউন্টের কথা শুনি। কিছুদূর আগে আসিবে কইল, নদীর পার পর্যন্ত। কিন্তু নদীর পারের কুন জাগাত আসিবে– সেইটা বুঝির পালুং না। একজন নেপালি ভদ্রলোকেরটে ঠিকিনাটা পুছি নিলুং। তার উত্তরে যা পালুং, সেই জাগাত একেলায় যাওয়া মোর পক্ষে অসম্ভব ব্যপার! অর্থাৎ শুকান নদীটার মইধ্য দিয়া প্রায় দুই কিলোমিটারের মতন উজিবার নাগিবে। নদীর মইধ্যত বাইক চালা কি মুখের কথা! তাছাড়াও নদীর ধারি ধারি ঘন জঙ্গল! না যাবার সিদ্ধান্ত নিলুং। জীবনের ঝুঁকি নিয়া কাজ করার চাইতে না করায় ভালো। কিন্তু নেপালী ভদ্রলোক মোক কইল, “চলিয়ে ভাইয়া, হাম আপকো লে যায়েঙ্গে উস জাগা।” মোর মনত সন্দেহ ঘুটঘুটিবার ধরিল– ভদ্রলোকের কি এমন ঠেকা পড়িসে যে মোক রাস্তা দ্যাখের বাদে অতদূর ধরি যাবে! লোকটা আরও কইল, “আরে ভাই, ইসমে সোসনেবালি ক্যেয়া বাত হ্যায়! চলিয়ে। মেরা ভি কাম হ্যায় উধার।”... মুই দোমোখোমো মন ধরি ভদ্রলোকোক সাথে নিয়া রওনা দিলুং।

কিছুদূর আগে যায়া মোর চিচিং ফাক! এই জাগাত যুদি কিছু একটা অঘটন ঘটে, চিকিরিয়া মরি গেইলেও শুনিবার মানষি নাই! জনহীন জাগা! দুই ধারিত জঙ্গল আর জঙ্গল!... ভদ্রলোক উয়ার কথা রাখিল। ঠিক জাগা মতন মোক ধরি গেইল। অনেক ধৈন্যবাদ জানালুং লোকটাক। কাস্টমারের পার্সেল ক্যাশ অন ডেলিভারী করি সোজা রাস্তা ধরিলুং, যেই রাস্তাটা মঙ্গলবাড়ি বাজার পৌঁছাইসে। মঙ্গলবাড়ি বাজার মানেই জয়গাঁও। অর্থাৎ ঘুরি-ফিরি মুই আরও জয়গাঁও আসিলুং।

তারপর আরও কালচিনির ঘাটা ধরিলুং। বস্তির রাস্তা ধরিই সোজা পাসাখা রোড পার হলুং। আগপাখে সেই কালজানি নদী (বর্ষা নদী)। ব্রিজ নাই। আয়নার মতন ঝকঝকা এক হাঁটু জল। এই নদীর পারোত বসিলে অনায়াসে কবির মনোত কবিতার উব্জন হইতে বাইধ্য। যাই হউক, কালজানি পার হয়া কিছুদূর আগালেই রাঙ্গামাটি চা বাগান। যুদিও জয়গাঁও টু কালচিনি যাওয়া-আইসা করির এইটা একটা সর্টকাট রাস্তা– তাও এই রাস্তায় লোক খুব একটা যাতায়ত করে না কইলেও চলে!

সেই রাস্তাটা ধরিই খাল-খন্দর পার হয়া কুনোমতনে পৌঁছালুং সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা বাগান। জাগাখানের অপরূপ রূপ একেবারেই মন কাড়ার মতন। ওটেকার একটা পার্সেল ডেলিভারী করি আরও কালচিনির ঘাটা ধরিলুং। কিছুদূর আগেয়া একখান ফরেস্ট– তার ভিতিরা রাস্তা! একেবারেই নির্জন এলাকা! বুকের ভিতিরাখান ধকধক করিতে আছে। না জানোং কতক্ষণ যে কি হয়! নাগাল পালুং নাম না জানা আর একটা নদী। ভালোয় চ্যাওরা। শিল-বালাউ ছাড়া এক বিন্দু জল নাই! তার উপুরা খুব সুন্দর একখান ব্রিজ। ব্রিজখানোত দাঁড়াইলে পুরা এলাকার সৌন্দর্য্য চখুর আগালোত ফুটি উঠে। আহাঃ, কি অপরূপ রূপ! পিটি থাকি ব্যাগটা নামে, কিছুক্ষণ দাঁড়ালুং ব্রিজের উপুরা। জিরালুং। মনে হইল যুনি একমাত্র কাশ্মীরে না হয়, সেন্ট্রাল ডুয়র্স’কও ‘ভূস্বর্গ’ কইলে বোধায় ভুল হবে না। কাজের ফাকে এমন অপরূপ রূপ দেখিলে আত্মাটা শান্তি পায়।

ব্রিজের উপুরা দশ-পনেরো মিনিট বিতিয়া আরও কালচিনির ঘাটা ধরিলুং। রাধারানী চা বাগান পার হয়া বাইক ধরি পৌঁছালুং চুয়াপাড়া চা বাগান।... হাসিমারা থাকি হ্যামিলটনগঞ্জ পার হয়া কালচিনি পৌঁছালেই মোক চুয়াপাড়া চা বাগান যাবার নাগে। তবে, চুয়াপাড়া থাকি বেশীদূর আগেবার অনুমতি নাই। যুদিও রাধারানী চা বাগান বা সেন্ট্রাল ডুয়ার্স চা বাগানের পার্সেল থাকে– কাস্টমারোক যে কুনো প্রকারেই হউক চুয়াপাড়া পর্যন্ত আগে আসি পার্সেল রিসিভ করির নাগিসে।

চুয়াপাড়া চা ফ্যাক্টরির গোরত ছোট্ট একটা হোটেল ঢুকি দুপুরের ভোজনটা সারিলুং। বগলোত বসি থাকা বয়স তিরিশের মতন একজন নেপালি দাদা মোর পাখে দেখিয়া কিছু একটা কইল। নেপালি ভাষা বুঝোং না। কলুং, হিন্দি মে বোলিয়ে, ভাইয়া।
নেপালি দাদা খানেক হাসিয়া কইল, “কাঁহা সে আ রহে হো?”
জয়গাঁও সে সিধা সেন্ট্রাল ডুয়ার্স হোকে আ রহা হু...।
“অফিস কাঁহা হ্যায় আপকা?”
মাদারী হাট, ভাইয়া।
“মাদারী সে এতনা দূর আ রহে হো! ইধার আশ-পাশ কৈ অফিস নেহি হ্যায় ক্যেয়া?”
নেহি হ্যায়, ভাইয়া। ইস লিয়ে তো আনা পার রহা হ্যায় হামকো।
“শুনো ভাইয়া, আপকো ম্যায় এক বাত বাতাতা হুঁ– চুয়াপাড়া তক আও ঠিক হ্যায়। লেকিন উসকে আগে কাভি ভি মত জানা। বহুত খতারনাগ এড়িয়া হ্যায়। আপ এতনা দূর সে আ রহে হো, ইস লিয়ে ম্যায় আপকো ইয়ে বাত বাতা রহা হুঁ। খুলেয়াম মার্ডার হোতা হ্যায়, কৈ কুছ নেহি বোলতা হ্যায়। পুলিশ ভি আয়ে না– তো এক সাথ চার ইয়া পাঁচ গাড়ি আতা হ্যায়। আকেলে কৈ ভি নেহি আতা হ্যায়। গলতি সে ভি কাভি ভি আগে মত জানা।”... নেপালি দাদার কথা শুনি মোর টুটি-মুখ শুকি গেইল। যেহেতু ঐ এলাকা নিয়া মোর বেশী একটা জ্ঞান নাই, কাজে দাদার কথা অবিশ্বাস করিবারও পালুং না। ভাবেছোং, তাহলে কি মুই মরণের মুখ থাকি ফিরি আসিলুং...!

ভাত পাড়া চা বাগান পার হয়া কালচিনি পৌঁছালুং। বুকের ভিতিরাখান সেলাও ধকধক করেছে। বারবার ভাবেছোং, কেনে ঐ রাস্তাটা ধরিলুং! যুদি কিছু একটা হয়া গেইল হয়, মানষি তো দূরের কথা কাউয়া-চিলাও খবর পাইল না হয়!... সেদিন মাত্র কিছুক্ষণের মইধ্যেই কালচিনির সব পার্সেল ডেলিভারী করা শ্যাষ।

অফিসের ঘাটা ধরিলুং। কিছুদূর আগে আসি হ্যামিলটনগঞ্জ পার হয়া বর্ষা ব্রিজের মাথাত পুলিশ চেকপোষ্ট বসিসে। মোর সব কাগজপাতি টনটনা। কাজে ওটে বেশীক্ষণ সমায় নাগিল না।... হাসিমারা ছাড়ি, জলদাপাড়া অভয়ারণ্য (মাদারীহাট) পার হয়া সোজা দলদলিয়া পৌঁছালুং– মোর অফিস।

তারপর আর কুনোদিন চুয়াপাড়া পার হয়া সেন্ট্রাল ডুয়ার্সের পাখে আগে যাং নাই। কিন্তু, তার সেই অপরূপ রূপ আজিও মোর চোখুত ভাসি উঠে।

তারিখ: 19.11.2021

1 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. ভয়ংকর কিন্তু দারুণ একটা গল্প।

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।