সুখ আসে সুখের সময়, কিন্তু দুঃখ থাকে সব সময়। দুঃখ, কষ্ট, হতাশা জীবনকে একচেটিয়াভাবে শাসন করে। কষ্টের চটেপেঘাত সহ্য করতে করতে জীবন বড় বিশ্বাদের হয়ে গেছে। জীবন মানে যদি উত্থান-পতন, দোষ-গুণের মিশ্রণ হত তবুও তো ক্ষণিকের জন্য শুকনো মনে সুখ উঁকি দিত।
মনের পুঞ্জীভূত বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যখন চোখ দুটি অশ্রুপ্লাবিত হয়। একা একা দূর দিগন্তে বসে কত না ভাবনায় ভেঙে পড়ে উপেন। তার মর্মান্তিক রোদনের আগাগোড়া ইতিহাস বেশিরভাগেরই অজানা।
সরোবরে ফোটা নাম না জানা ফুলকে রজনীগন্ধা ভেবে শিশুরা হয়ত ভুল করে, একটু বুদ্ধিদীপ্ত যারা তাদের ভুল হবে না। কিন্তু উপেনের বেড়ে উঠা দেখে ঐ একটু বুদ্ধিদীপ্তরাই বলত, ও অনেক বড় হবে, সমাজের শিরোমণি হবে। ওর কর্ম থেকে সমাজ রজনীগন্ধার সুবাস পাবে। ডানা নেই তাতে কি কত মানুষই সাফল্যের নীলকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, উপেন পড়ে থাকলো অতলে, খুব তলে। পেটে ভাতে বেঁচে আছে, অত্যাবশকটুকুর বাইরেও মানুষের অনেক কিছু করার থাকে। আকাশের সূর্যের প্রখরতায় পৃথিবী আলোকিত, কিন্তু উপেনের জীবন চলার পথে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
মানুষ কখন বলে ভালোবাসার দরকার নেই? জীবন চলার পথ যখন কণ্টকময়, দুর্গম, ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ তখন মানুষ অতুল্য অবয়বের প্রফুল্ল অষ্টহাস্যময়ী মানবীর থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোখে যার অনেক বড় স্বপ্নের মায়াঞ্জন আঁকা ছিলো সে এখন আশাহীন, স্বপ্নহীন। আশাহীন জীবনে, স্বপ্নহীন জীবনে থাকে শুধু অবসাদ।
সর্বোচ্চ চেষ্টা, শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েও যখন হয় না একটা চাকরি তখন সে জীবনে নামে দূর্বিষহ যন্ত্রণা। একটা অজানা হতাশা বুনো মোষের মত তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। মেধাবীদের ভীড়ে অনেক মেধাবী মেধাবী খেতাব হারিয়ে ফেলে। রত্নের আশায় রত্ন খুয়ে যায়, রত্ন আর মেলে না। জীবন থেকে যৌবন খসতে থাকে, সমাজ বলে বেকার। বুকটাকে সবাই ছাদজ্ঞান করে পিটাই মুখ দিয়ে প্রবাদ-প্রবচনে।
জীবনের ক্রিজে সেই বেশি রান পায় যার একটা চাকরি আছে। বাকিরা থাকে শূন্য রানে। কে না চায় নির্ভাবনায় থাকতে! তাই উপেনের ঘরে কেউ আসতে চায় না বৌ হয়ে। বাবা মায়ের অনেক চেষ্টা বৃথা যায়। উপেন বাবা মাকে ন্যূনতম চেষ্টাটুকুও করতে নিষেধ করেছিলো। আত্মবিশ্বাসহীনতায় সে মূহ্যমান থাকে। আশার সলতেতে আর আলো জ্বলে না। অর্থহীন মানুষ অর্থহীন। অর্থবিহীন মানুষকে কেউ সম্মান প্রদর্শন করে না, তা যতই শিক্ষিত হোক। উপেন ভেঙে পড়ে, অনেক না পাওয়া তার শুধু একটা চাকরি না পাওয়ার কারণে। অপ্রাপ্তি থেকে বিতৃষ্ণা জন্মায়। প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় উপেনের দিন কাটে।
যদিও বা কলেজে একটা চাকরি পেলো বেতন এতই নগণ্য কেউ জিজ্ঞাসা করলে উচ্চারণ করা যায় না। তবুও তাতে লেগে থাকলো, সময় কাটে। একটু ব্যস্ততা থাকলে অনেক যন্ত্রণা ভুলে থাকা যায়। তেমন অভাব নেই, তেমন অনটন নেই কিন্তু মনে শান্তি নেই। জমি আছে, বাড়ি আছে, ফল-ফলাদির গাছ আছে, পুকুর আছে কিন্তু মনে শুধুই হতাশা। যথাপোযুক্ত মানুষের কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত যা তা না পেলে অত্যন্ত যন্ত্রণায় অঙ্গার হয়।
প্রত্যেক রামের জীবনে একজন সীতা আছে। উপেনের জীবনের সীতা যেন আজো জন্ম নেয়নি। রাত বাড়লেই মনের ঘরে জোনাকীরা দ্বীপ জ্বালায়। জানালা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি মেরে রঙিনতার গল্প শুনিয়ে যায়। ফাগুনের মিষ্টি হাওয়া জানালায় দোলা দিয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়ে। একরাশ আঁধার মনের মধ্যে ভর করে। উপেন আর হাসেও না, কান্নাও করে না। বিনা মেঘে ঝড় বয়ে যায় বুকের মধ্যে।
আঁখিজুড়ে ছিলো রঙিন রঙিন স্বপ্ন। ভালো একটা চাকরি পাবে সে, ভালো একটা সঙ্গিনী পাবে সে। বিরামহীন ভালোবাসি বলে বলে ভালোবাসার মানুষটাকে রাঙিয়ে দেবে। ভালোবাসার মানুষটা হাসনাহেনা হয়ে নিশুতি রাতে মন মাতানো সুবাস ছড়াবে। ওষ্ঠ্যপ্রান্তের এক চিলতে মায়াবী হাসি দিয়ে অভিমান ভাঙাবে। হৃদয়ের সবটুকু অনুরাগ দিয়ে, কমনীয় বাচনভঙ্গি দিয়ে হার মানাবে। সব যেন অলীক লাগে তার কাছে, জলন্ত লাভার মাঝে যেন। অসীম সমুদ্রের মাঝে যেন, সমুদ্রে ঘর বাঁধা যায় না।
মেয়ে দেখতে গেলে মেয়েপক্ষের থেকে নানা প্রশ্নে অপমানিত হয় সে। অথচ ও চেয়েছিলো ভালো চাকরি পেয়ে মাথা উঁচু করে আর মেয়েপক্ষের প্রতি প্রশ্নের সমোচিত জবাব দিয়ে বিয়ে করবে। চাহিদা ছেটে ফেলে তদাপেক্ষা কম উন্নত ঘরে মেয়ে দেখতে যায় তার আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু মেয়েপক্ষ চাহিদার ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকে। একটিও কম পেলে না করে দেয়। অথচ তার বাবা নিজের দুটি মেয়েকে যে যখন যেমন ঘর থেকে এসেছে না বিবেচনা করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আর সে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাঠ চুকিয়ে শুধু ভালো চাকরি না পাওয়ার কারণে যত্রতত্র আর যার তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। চরিত্রহীন কিন্তু চাকরি করে বলে বিয়ের বাজারে তাদের কাটতি খুব ভালো।
প্রত্যেক মানুষের প্রাপ্তির একটা খাতা থাকে। সেই প্রাপ্তির খাতায় যদি শুধুই শূন্যতা থাকে তবে কি করে হয়! থমকে যাওয়া জীবনে যদি এমন কেউ এসে চমকে না দেয় তবে জীবনের মানে কী!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা জীবন জড়িয়ে গেলো উপেনের জীবনে। দরিদ্র পিতা-মাতা উপেনের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পেরে অত্যন্ত খুশি। বিয়ে করছিস না কেন? এই প্রশ্নের হাত থেকে উপেন যেন বাঁচলো। এত বয়সে বিয়ে করেছে উপেন! বৌ দেখবে গ্রামের মানুষজন, হই-হট্টগোল পড়ে গেলো। নামমাত্র শিক্ষিত বৌয়ের সাথে উপেন কথা বলে না। শুধু নিজের স্বপ্নগুলোর খুন হয়ে যাওয়া ভাবতে থাকে সে। জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজন একজন প্রিয়জন, যার কাছে সব বলা যাবে, যার বুকে মাথা রেখে স্বর্গে বিচরণ করা যাবে। উপেন স্ত্রীর দিকে একবার তাকায় আর অরুচির সংগা মনে মনে আওড়ায়। এই বৌ না তার শিক্ষার কদর দিতে জানবে, না সে কি কোন কালে বুঝে উঠবে!
রিগ্নির মা বাবা রিগ্নিকে বুঝিয়েছে, তোর স্বামী অনেক শিক্ষিত। কথা বলবি বুঝে। আর কাজ করবি, কাজ করলে সকলের প্রিয় হয়ে উঠবি।
রিগ্নি সংসারের কাজ করে খুব মমতা ঢেলে। স্বামীর কাছে যেতে ভয় ভয় করে। স্বামী তার সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে প্রত্যক্ষ করে সে। অল্প বয়স কি বলবে ভেবে পায় না। কিন্তু কেন এত দুশ্চিন্তায় থাকে বুঝে উঠে না। স্বামী তার চাকরি করে, তার এত দুশ্চিন্তা থাকবে কেন?
কলেজে যাবে প্রস্তুত হতে থাকে উপেন, দরজাতে হেলান দিয়ে দেবতাতুল্য স্বামীকে দেখে রিগ্নি, দেবতাতুল্য নয়, দেবতায়। রিগ্নির উৎসুক চোখের দিকে চেয়ে উপেন বলে, যেভাবে দেখছো শহরের মানুষ গ্রামে গেলে গ্রামের মানুষ গাছে হেলান দিয়ে এভাবেই দেখে।
রিগ্নি সরে যায়। বুঝে পারে না, কি বলবে, কি করবে! জোড় জীবনে এত বেশি অসমতা থাকলে সুখ থাকে না। একজন পাহাড়ে অন্যজন সমতলে, পাহাড় আর সমতলের মিলন কখনো হয় না যদিও কখনো কখনো পাহাড় ধ্বসে নেমে সমতলে মিশে যায়।
আহা, কি স্বপ্ন দেখতো সে; আশাহত জীবনে কেউ একজন আশার প্রদীপ হয়ে এসে আলো ছড়াবে। যার অকৃত্রিম হাসির কাছে হতাশার হৃদয় হার মেনে যাবে। পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে অবাক বিস্ময়ে সময় কাটাবে। তা না তার পাশে দুর্ভিক্ষফণায় আহত শীর্ণকায় দেহ পড়ে থাকে। সর্ব অবয়বে একবার তাকালে তাচ্ছিল্য ভাব জাগে, যার হাসি দেখলে অস্থিকঙ্কালসার লাগে। সব ভাবতে ভাবতে সে অসীম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এত অন্ধকারে সে ডুবে গেছে প্রজাপতির পাখার হাওয়ায় বিমল পৃথিবীতে কত না আনন্দের ঝড় আছে তা দেখার ইচ্ছাটুকুও নেই। বুকে সাহস সঞ্চার করে রিগ্নি বলে, আপনি এত বিমর্ষ থাকেন কেন?
প্রতিউত্তরে উপেন বলে, আমাকে নিয়ে ভাববে না, আমাকে নিয়ে তোমার ভাবনা আকাশ কুসুম ভাবনা।
রিগ্নি থেমে যায়, কিছুক্ষণ পরে আবার বলে, সারাক্ষণ একা থাকেন, কথা বলেন না। কিসের এত একাকিত্ব? আপনার তো সব আছে। কোন অভাব নেই!
উপেন বলে, চোখ আছে, দৃষ্টি নেই; বোঝো কিন্তু বুদ্ধি নেই, আর তাই দেখো-বোঝো কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারো না। দেখা হয় আপাতত, বোঝা হয় আপাতত। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসছি, তুমি দেখছো প্রমোদভ্রমণ।
রিগ্নি আর কিছু বলে না। স্বামীর উচ্চমার্গীয় কথার মাথামুণ্ডু বোঝে না সে। তবে বুঝতে পারে তার স্বামী তাকে অর্থপ্রযুক্ত কথা বলছে, যার অর্থ সে উদ্ধারে অত্যন্ত ব্যর্থ। বাবা মা বলেছে কাজ করতে। সে কাজে মন দেয়। হরিণীনয়না, হৃদয়হরণা রূপটি যে আদিকাল থেকে মনের কুঠিরে স্থাপন করেছে সে কি অবহেলিত এই ক্ষুদ্র নিরতিশয় লতাগুল্মের এহেন হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে দেখে সন্তুষ্ট হবে? কলিকালের বনবিহারী একদিন শখের বশে বনে গেলে বনফুলে আকৃষ্ট হয় বটে, কিন্তু বনফুল বরাবরই সবার অনাগ্রহেই থাকে। বস্তীর বুভুক্ষু থেকে সর্বোচ্চের সর্বভূক সবারই গোলাপ, রজনীগন্ধাতে মন মাতে।
ছেলের কাছে মা বাবার কোন চাহিদা নেই, বাবা মা বোঝে। বাবা এই বৃদ্ধকালেও মাঠে খাটে। খাটারাম খেটে গেল জীবন ভর। জীবনের ঊষালগ্ন থেকে আজকের এই অস্তপ্রায় পর্যন্ত একটা মানুষের দেহ থেকে শুধু ঘামই ঝরেছে, সুখের পবন দেহে শীতলতা আর দেইনি। এসব কষ্ট দেখলে উপেন আগ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভার মধ্যে গিয়ে পড়ে। দুটি সচল হাত ও পা কোন কাজেই লাগলো না। নিয়তির নক্ষত্র জ্বলে না। নিজেকে একা করতে করতে নিভৃতচারী হয়ে গেলো সে। একেবারে একা সে, নিঃসঙ্গ বিরহী নক্ষত্রের মত। তার কষ্ট তার একার, তার পাশে সমব্যথী নেই কেউ, তার দুঃখে সমদুখী নেই কেউ, তাকে সান্ত্বনা দেয়ার সমচিন্তার মানুষটাও নেই।
রিগ্নি দিনে দিনে বুঝে ফেলে তার প্রতি তার স্বামীর অনাগ্রহ প্রবল। বিতৃষ্ণা চরম। দায়িত্ব নেয় না। স্বামীকে বললো, আমার প্রতি আপনি উদাসীন। আমার অধিকার থেকে আমি বঞ্চিত কেন?
পদ্মের মুখ থেকে যা আশা করা যায় বনফুলের মুখ থেকে তা ঝরলে কেমন লাগে? অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উপেন বললো, অধিকার নিয়ে ভেবো না, দায়িত্ব পালন করো।
রিগ্নি ছেড়ে কথা বলে না, বলে, আমার প্রতি আপনার কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন? আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছেন? আমাকে কসমেটিকস কিনে দিয়েছেন? আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়েছেন? কখনো আমাকে কথা বলার সুযোগটুকুও দিয়েছেন? আপনার মত পাথর মানুষ আমি আর দেখিনি। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রেমশ্রদ্ধা না থাকলে স্ত্রীর হাজার গুণও চোখে পড়ে না।
উপেন থমকে যায় রিগ্নির কথা শুনে। রিগ্নির প্রচ্ছন্ন উপহাস উপেনের পৌরুষে প্রচণ্ড আঘাত করলো। তার সাহসী আর দ্বিধাহীন উচ্চারণ উপেনকে নতুন ভাবনাতে ফেললো। একরত্তি মেয়ের থেকে এভাবে অপ্রত্যাশিত বাক্যবাণ পাবে ভাবেনি ও।
বাইরে চলে গেলো উপেন। চৈত্রের ঝরাপাতার মত ঘূর্ণি হাওয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে ও। জমাট মেঘের শোভাযাত্রা পুরো মনের আকাশ জুড়ে। বুকের ভেতরের কোকিলটা যক্ষ্মা রোগীর মত শুধু কাঁশে, আর সুস্বরে ডাকে না। বাড়ি ফেরার কালে রিগ্নির জন্য ও শাড়ি কিনে আনলো। একটা শাড়ির দাম এত হতে পারে ও আজ প্রথম জানলো। অর্ধমাসের বেতনের সমান।
শাড়ি দেখে রিগ্নি ঝর্ণার মত উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লো। এত অল্পে একটা মানুষ এত খুশি হতে পারে উপেনের জানা ছিলো না। এত অল্প চাওয়া একটা মানুষের সাথে আয়বিহীন একটা মানুষের দুরত্ব থাকা ঠিক না। যার চোখে মালিন্য নেই, যার চোখে হিংসার অগ্নি নেই, যে একটু কিছু দেখলে অজানা আনন্দে বিস্মিত হয়, মুগ্ধতায় রেঙে উঠে তাকে নিয়ে বিনা পয়সাতেও অনেক পথ পাড়ি দেয়া যায়। পদ্মার জলের মত বৌর এমন উচ্ছ্বলতা দেখে নিতান্ত অকারণ নয়, কারণেই নিজের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ আরক্ত হাসির আভা ফুটলো। এক অজানা ভালো লাগার উপলব্ধিতে কষ্টের তৃণগুলো স্রোতধারায় যেন ভেসে যেতে শুরু করলো। উপেন তবুও দূরে থাকে, রিগ্নি দুরত্বের গায়ে আগুন লাগিয়ে ভস্ম করে দিয়েছে। অগ্নি যেমন দাহ্য বস্তুর অভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে পারে না, রিগ্নিও তেমনি উপেনের একটু সদিচ্ছার অভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে পারছিলো না। এখন রিগ্নি উপেনের সদিচ্ছার উপরে নির্ভর করে থাকে না, নিজের থেকেই উপেনের ধারে ঘেঁষে। হৃদয় প্রসন্ন তাই চেহারায় প্রফুল্লতা, চলনে ঈষৎ চপলতা।
উপেন প্রখরতা দেখিয়ে দুর্বলতা ঢেকে রাখত। কাছে আসার যে আসবেই, ধারে ঘেঁষার যে ঘেঁষবেই। চোখে চোখ রাখার যে চোখে চোখ রাখবেই। হাতে হাত ধরার যে হাতে হাত ধরবেই। রিগ্নি থেকে উপেন এখন পালাতে পারে না। উপেনের কঠোরতাকে রিগ্নি গায়েও মাখে না। রিগ্নি বলে, যমদূত তো নও যে ডর দেখালে ডরবো। সাথে না নাও, সঙ্গিনী আমি হবোই। ধার দেখিয়ে ধারে না নাও, ধার ধারি না, ধারে আমি থাকবোই।
উপেন রিগ্নির দিকে তাকায়, একটা সহজ মেয়ে, একটা সরল মেয়ে। অনাঘাত ফুল, হোক সে অনাদরের বনফুল, অনাঘাত পুষ্প সবারই আকাঙ্ক্ষার বস্তু। ভাবে সে, রূপ ক'দিনই বা থাকে! মনের লাবণ্যই স্থায়ী।
উপেনের চিন্তায় নতুনত্ব যোগ হতে থাকে। সক্ষমতাহীন মানুষকে বাড়-বাড়ন্ত চাহিদার ডালপালাকে কেটে ফেলতে হয়। সে অতি আকাঙ্ক্ষার অতি কেটে দিলো, অতি চাহিদার অতি কেটে দিলো, অপ্রাপ্তির অ কেটে দিলো, বিতৃষ্ণার বি কেটে দিলো, উচ্চাশার উচ্চ কেটে দিয়ে দেখলো রিগ্নিই তার উপযোগী। রিগ্নি নিখুঁত নয়, কিন্তু রিগ্নিই তার জন্য স্রষ্টার যথাচিত সৃষ্টি। কারণ রিগ্নির চেয়ে উন্নত পেতে যে উপেন দরকার সে উপেন সে না। মানুষ অনেক কিছু চায়, অনেক কিছু পায়; কিন্তু সব পাবে না। ঘোরের মধ্যে থাকলে মানুষ নিজেকে চিনতে পারে না, বাস্তবতা নিজেকে চিনিয়ে দেয়।
সংসারে রিগ্নির প্রভাব বেড়েছে। কিন্তু রিগ্নির বোধে ভীষণ দ্বিধা। একটা মানুষ চাকরি করে, কিন্তু সংসারের কোন কাজে তার ভূমিকা নেই। রিগ্নি দ্বিধান্বিত মনে বললো, আপনি চাকরি করেন, বাবা কেন এখনো মাঠে কাজ করবেন?
সহজে উত্তর দেয়া গেলেও উপেন বললো, হাঁড়ি হেশেল নিয়ে থাকো।
রিগ্নি বললো, না সন্তান হিসেবে দায়িত্ববান, না স্বামী হিসেবে। কেমন শিক্ষক আপনি?
উপেন রিগ্নিকে চোখ দিয়ে শাসায়, রিগ্নি চোখ রাঙানিতে না দমে বলে, অভ্যাসের বশে না, সংসারের তাগিদে বিয়ে করতে হয়। বিবাহিত পুরুষ এত অকর্মণ্য না।
কথাগুলো প্রচণ্ড বেগে ঘা মারলো উপেনকে। ঘোমটা ভেঙে নারী কথা বললে ডানা ঝাপটেও বাঁচা দায়। রোজগারহীন পুরুষ না বলতে পারে নিজের মনের কথা, না কেউ পারে তাকে বুঝতে, না কেউ চায় তাকে বুঝতে। কটাক্ষাঘাতে উত্তপ্ত লোহার মত অগ্নিময় হয়ে উঠলেও যুৎসই জবাব দেয়া হয়ে উঠে না।
সাংসারিক এই ডামাডোলের মাঝে একদিন রিগ্নি জেনে গেলো তার স্বামীর বেতন কত? রিগ্নি আকাশ থেকে পড়লো। তার মত অশিক্ষিতের মাথায় খেলে না একটা মানুষের বেতন কি করে পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট হয়। ওর নিজের ভাই-ই এক মুদি দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে। তারও বেতন দশ। রিগ্নি রাগতস্বরে বললো, এই আপনার চাকরি? এই চাকরি করে বিয়ে করেছেন? আবার ইন করে যাওয়া লাগে?
উপেন রিগ্নির কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। নিজেকে সরিয়ে নিলো। দূরে চলে গেলো। নিজেকে একা সময় দিলে, নিজেকে নিজের সাথে কথা বলার সুযোগ দিলে নিজেকে হালকা করা যায়। শুধু ভাবে, যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারলাম না বলে অযোগ্যদের একেবারে নিম্ন কাতারে ঠাঁই হলো? এতই কি সে নিম্ন মানের ছিলো? মস্তিষ্ক কি এতই দুর্বলতায় ভরা ছিলো যে এত এত দূর্বিষহ যন্ত্রণা জীবন জুড়ে ক্রীড়া করবে?
দিনশেষে বাড়ি এলো। উপেনের প্রভাব ছুটে গেছে, আধিপত্য এখন রিগ্নির। নারীর আধিপত্য, তার উপর অশিক্ষিত নারীর আধিপত্য উপেন মানতেই পারে না। মেধার পরিচয় দিতে না পারলেও নিজেকে মেধাবীদের মতই ভাবে, যার কারণে যার তার থেকে যা তা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। রামের ধনুক সে সহ্য করতে পারে কিন্তু হনুমানের দাঁত মিচকিনি সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সেই দাঁত মিচকিনি, সেই দাঁত সিটকানিই তাকে দেখতে হচ্ছে। স্বামীর উত্তরোত্তর সাফল্য প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য অহংকারের। আর স্বামীর নিরন্তর বিপর্যয় স্ত্রীর হতাশার। এখন রিগ্নির উপদেশ শুনতে হয় উপেনের। রিগ্নি বলে, কতটা পথ হেটেছেন? হাটলে হোঁচট খেতে হয়। হাটতে হাটতে থেমেছেন বলেই আর হাটার পথ নেই। আরে, খোঁড়া মানুষ, অন্ধ মানুষও পা মেফে ফেলে ফেলে গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
গুণমুগ্ধ স্তবকগুলো উপেন শোনে আর রাগে ফোঁসে। বিপদে পড়লে যে কেউ মনীষী সেজে সম্মুখে আসে। আর এমন বাণী শোনায়। ছোট্ট হাড়িতে এক বালতি বিশুদ্ধ দুধ ঢাললে হাড়ির ধারণ ক্ষমতার বাইরের বাকি দুধ মাটিতেই পড়ে যায়, তারমানে বাকি দুধ কি বিশুদ্ধ ছিলো না? হাড়িতে ঠাঁই পাওয়া দুধটুকুই বিশুদ্ধ? হাড়িতে ঠাঁই পাওয়া দুধটুকুই পৃথিবীতে বাঁচার স্বাদ পাবে? উপেনের মত যারা হাড়িতে ঠাঁই না পেয়ে মাটিতে পড়েছে তারা কি নিষ্পেষিত হতেই থাকবে?
রিগ্নি আবার বলে, স্বপ্নকে শুধু মনসচক্ষে না দেখে এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতেন, এত কষ্ট হতো না।
আয়হীন মানুষ কথা বলতে জানে, কথা বলতে পারে না। দু পয়সা সমাজ সংসারে তার মূল্য নেই। শুভ বলে তার জীবনে কোন দিন নেই। রংধনু, নীলাকাশ, শেষ বিকেলের সূর্য, মেঘে ঢাকা চাঁদের উঁকি কোন কিছুই মনকে আপ্লুত করে না। 'বিয়ে করছিস না কেন' বলা মানুষগুলোকে দেখলে এখন পালাতে ইচ্ছা করে না তার, তবে তারা এখন বলে, ওর ছেলে পুলিশ, ওর ছেলে ডাক্তার, তাদের কি দাপট। তুই কেন এমন নিষ্প্রভ থাকিস, কলেজের শিক্ষক! উপেন ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি জাগিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। দিনমজুর মানুষটাও ঘর পাকা করে ফেললো, উপেনের ইট কেনার সামর্থ্য নেই। লোকে ভাবে, টাকা আছে, কৃপণ। কিন্তু জীবন ডায়েরিতে যে শুধু দুঃখ, কান্না, হতাশা, না পাওয়া, ব্যর্থতার চিত্র তা কেউ জানলোও না। আত্মীয়র বাসায় যাওয়া যায় না, খরচের ভয়ে। আত্মীয়তা রক্ষা করা যায় না, খরচের ভয়ে। নিজের অভিরুচি পূরণ করা যায় না, অন্যের একটু সহায় হওয়া যায় না। এই তিক্ততা জীবনকে দেয় মৃত্যুর স্বাদ। ঘরে ফেরা নিরাসক্তে পরিণত হয়েছে। কারো চাহিদা পূরণ করার এতটুকু সামর্থ্য আজো তার হয়ে উঠলো না। তাই যে যা বলে মুখ বুঝে সহ্য করে। বেকাররা সহ্যহীন হলে বাঁচতে পারে না। তাদের নীরব শ্রোতা হতে হয়। যে যা বলবে শুনতে হয়। রাতে রিগ্নি বললো, বুঝলাম আপনার বেতন পাঁচ হাজার। মাস শেষে পকেটে একটি টাকাও দেখি না। কেমন পুরুষ আপনি!
পুরুষত্ব নিয়ে কথা বললে পুরুষ বিদগ্ধ হয়। বিদগ্ধ পুরুষ থেকে অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটার সম্ভাবনাও প্রবল থাকে। কিন্তু নারীর স্বভাবসুলভ আচরণ পুরুষের রক্তচক্ষুর ক্ষিপ্রতায় কমে না, বরং বাড়ে। ফলশ্রুতিতে নারী আঘাত পেয়ে শান্ত হয়, মরিচ সড়ো শীলে বৌ সড়ো কিলে। আঘাত হজম করে রিগ্নি বলতে থাকে, রোজগার করার মুরদ নেই মিনসে কিল মারার গোঁসাই।
এমন অকাম্য ঘটনা নিত্য ঘটে। এত এত ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, সহকর্মীরা তাকে কত কত সম্মান করেন আর বাড়ি এলে একটা ক্ষেতমার্কা নারীর কাছে কতভাবে অপমানিত হয় সে। সে বুঝতে পারছে সম্মান, ভালোবাসায় পেট ভরে না, সংসারের চাকা ঘোরে না। পেট ভরতে টাকা লাগবে, সংসারের রশি টানতে টাকা লাগবে। রিগ্নি শাণিতস্বরে বলে, আমাকে বিয়ে করে আপনি আমাকে হীন ভাবতেন, অবহেলার চোখে দেখতেন। নিজেকে ভাবতেন অনেক কিছু। কিসের কি আপনি? আপনি আমারও যোগ্য না। নিজেকে যোগ্য ভাবার কিছু নেই, আপনি চাকরি পাননি আপনার অযোগ্যতার জন্যই। মনে মনে সবাই নিজেকে যোগ্য ভাবে, যোগ্য তারায় যারা পেরেছে, পেরে দেখিয়েছে।
উপেন চুপ থাকে। চুপ না থেকে পারে না। ক্ষমতাহীন মানুষকে চুপ থাকতে হয়, শুনে যেতে হয়।