এ স্বপ্ন সত্যি হতে পারে ।। জরীফ উদ্দীন


তোফার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকের কল্যাণে। কত দিন আর হবে! মাত্র দুই বছর কিংবা তার একটু বেশি। আবার কমও হতে পারে। উত্তরবঙ্গের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের মিলন মেলা উলিপুর বই মেলা গেছি দুই একটা বই কেনা, পরিচিত লেখকদের সাথে আড্ডা দেওয়া এই আর কি! একেই বলে অভাগা যেদিকে চায় সমুদ্র শুকিয়ে যায়। মেলাতে গিয়ে পরিচিত কাউকে না পেয়ে ঘুরে ঘুরে কয়েকটা বই কিনলাম। হঠাৎ মনে হলো এই যুগে কারও দেখা পাব না এটা কি হয়! দিলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস-
“উলিপুর বই মেলায় আছি, বন্ধুরা আওয়াজ দিন।”
ক্ষণিকেই লাইক-কমেন্টসের সংখ্যা বেড়ে গেল। তা তো যাবেই। আজ মানুষের খেয়ে-দেয়ে কি আর কাজ-কাম আছে। সারাদিন কিছুক্ষণ পর পর ফেসবুকে আসা চাই। করতে হবে লাইক, দিতে হবে কমেন্টস আর ইনবক্সের কথা নাইবা বললাম। একটু আগে পরিচিত কারো সাথে দেখা না হলেও মার্ক জুকারের কল্যানে অনেকেই আসতে চাইছে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলতেছে। কি আর করা থেকে গেলাম। কিছুক্ষণে অনেক গুণি ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ, সাহিত্য-রাজনীতি-গণম্যাধ্যম দিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তা মুক্ত আলোচনায় রূপ নেয় সাথে চা চক্র। এরই মাঝে নেশার মতোই আমাকে ফেসবুক টানে আমি কিছুক্ষণ অফ লাইনে থাকার পর ফেসবুকে কমেন্টস এর রিপ্লে দিতে গিয়ে দেখি ‘মেঘলা মন’ নামে একটি আইডি থেকে কমেন্টস “আজই কি মেলা শেষ?” আমি দিলাম হুম আজই শেষ। রিপ্লে দিয়ে অবুঝ মনের কৌতহল মেটাতে মেয়েটিকে অপরিচিত মনে হওয়ায় ঘুরতে গেলাম প্রোফাইলে। মেয়েটি উলিপুর মহিলা কলেজে পড়ে। তারমানে আশেপাশের এলাকারই হবে। এর আগেও এই আইডিতে আমি ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম তার রিপ্লে দেয় না এক বছরেও। ছি! মেয়েদের এই অসৌজন্যতাবোধ আর গেল না। ইচ্ছে করে আবার ম্যাসেজ দিলাম অনেকটা বেহায়ার মতোই,
“কি ব্যাপার আমি সেই এক বছর আগে ম্যাসেজ দিছি তার রিপ্লে নাই? চিনতে পারছি না। কে?”
“আমি বুঝতে পারিনি আপনি ম্যাসেজ দিয়েছিলেন। আমিও আপনাকে চিনি না” মেঘলা মন আইডিতে তার সাথে আমার কথা বলা এই হলো শুরু। বললে কথা থামায় কে! এক বছর আগে যে মেয়েটি আমাকে ম্যাসেজ দেয়নি তার সাথে চলল সারা রাত ম্যাসেজ। সে কে? তার বাড়ি কোথায়? কি করে? শুধু কি তাই আর কত প্রশ্ন তার শেষ নেই। আর সে প্রশ্ন করে আমি উত্তর দেই। শুধু রাতই না দিনেরও অধিকাংশ সময় ম্যাসেজ চলত। কত কাল রাত না ঘুমে সকালে ফ্রেস হয়ে কোচিং যেতাম ক্লাস নিতে তার ইয়াত্তা নেই। যে মেয়ে সন্ধ্যায় ভাত খেয়ে ঘুমায় সেই সারা রাত জেগে সকালে কলেজ যায়।
হয়ত কোন মহামানুষই বলেছেন, মানুষ মানুষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করলে একবার না একবার তার প্রেমে পড়বে। অন্য কারো জন্য এই কথাটুকু সত্য কি না তা আমি কোন দিন বিচার করতে যাই নি কিন্তু আমি যে তোফার প্রেমে পড়েছি তা সত্য। তোফা আমার প্রেমে পড়ল কি না তা আমার জানার একান্ত বাসনা রয়ে গেল। আমি তোফার প্রতি দূর্বল হয়ে পরি; তাকে বুঝতে দেই না। যেমনটা সেও আমাকে বুঝতে দেয়নি, ভালোবাসলে তো এতদিনে আমাকে বলতে পারত। আবার এও মনে হয় মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। ততদিনে ফেইসবুক থেকে আমাদের আলাপ মুঠোফোনে শুরু হয়েছে। এবং এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফোনে কথা কম হত। ম্যাসেজ হত বেশি। এক সময় তার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। আমিও ব্যস্ত হয়ে যাই আমার লেখাপড়া নিয়ে। তোফার পরীক্ষার সময় ছাড়া তার সাথে প্রায় সময় ম্যাসেজ হত আমার। তোফার পরীক্ষা শেষ হলে আমাদের সম্ভবত গোসল ও ঘুমানো ছাড়া সব সময় চলত এক ম্যাসেজের মহা উৎসব। শুধু কথা-বার্তার মধ্যেই থাকলেই হয়ত যেদিন আমরা কথা বলা এবং ম্যাসেজ দেওয়া বন্ধ করতাম সেদিন এই গল্প সেখানেই শেষ হতে পারত। আমরা দেখা করতে লাগলাম পরিচিতদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন স্থানে।
একসময় মনে হয় সে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। আমি তোফাকে ম্যাসেজে জানিয়ে দেই আমার দুর্বলতার কথা। ভালোবাসার কথা। তোফা না বলে দেয়। তার কথা আমরা শুধুই বন্ধু। এর বাইরে কিছুই না। না বলার পরও আমাদের যোগাযোগ কমে না। আমাদের ম্যাসেজ না কমে বরং আরো বেড়ে গেল। দেখা করতাম কয়েকদিন পরপর। এক স্থান থেকে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম অনেক দূর। দেখা করার সাথে সাথে বাড়তে থাকল হৃদয়ের অন্তরঙ্গতাও। দেখার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও এতদিনে এক বার তোফার মুখটা দেখা হয়নি মোবাইলের স্কিনে ছাড়া। এভাবে চলতে থাকে আমাদের সম্পর্কহীন সম্পর্ক রমনা লোকাল কিংবা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের মতোই । এমন কি আমাদের সাদা-কালো কিংবা রঙিন দিন এবং রাতগুলো। যদিও দুজন দুই পথের পথিক ছিলাম কিভাবেই যেন আমরা একই পথে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছি তা বুঝতেই পারিনি দু’জনের কেউ। কিংবা বুঝতে পেয়েছিলাম আমলে নেইনি অথবা আমরা অবচেতন মতে তাই চেয়েছিলাম বলে। এমন কি যে ভালোবাসা থেকে দূরে থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম সেই ভালোবাসার মায়াজালে পড়ে যাই সচেতন ভাবে। তা কি আর ভাবার সময় আছে! 
মোবাইলের স্কিনে সার্বক্ষণিক চোখ রাখার কারণে তোফার চোখের সমস্যা দেখা দেয়। তোফাকে চোখের ডাক্তার দেখানো জন্য আমি  মরিয়ম চক্ষু হাসপাতাল যাওয়ার পরামর্শ দেই। সে একদিন চোখ দেখাতে আসলে সকল ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে আমিও যাই সেখানে আর একদিন তার সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে প্রথম তোফাকে দেখি হিজাব ছাড়া।
ততদিনে তোফার এইচএসসির রেজাল্ট হয়। কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও মেধা তালিকায় না থাকায় কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয় সে। কারমাইকেল কলেজ পড়ার ইচ্ছে থাকলেও আমি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ পড়ি জন্য তোফা আবেদন করেনি কারমাইকেল কলেজে। অপরপক্ষে আমার অনার্স শেষ হলেও আমিও আর বাইরে কোথাও না গিয়ে মাস্টার্স কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে পড়া শুরু করি তোফার জন্যই।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে আমাদের প্রতিদিন দেখা হত। কেটে যেত ৬/৭ ঘন্টা কিংবা তারও বেশি। কখনো আমাদের সাথে যোগ দিত আমার ও তার বন্ধুরা। আমাদের ভালোবাসার এভাবে ডালপালা বাড়তে থাকে শিরিশ কিংবা দেবদারুর মতো। বাড়তে থাকে শিকড় এবং তা ছড়িয়ে পরে অন্তর থেকে অতলে এবং আরও অতলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের মতোই। প্রাকৃতির এক অখন্ডনীয় বাস্তবতায় ঠিক সেই সময় বাজে আমাদের বিদায়ের ঘন্টা ধ্বনি।
তোফার বিয়ের কথা চলতে থাকে। পাত্র সরকারি চাকুরি করে। পাত্র সরকারি চাকুরি করলে আমাদের দেশে কন্যার বাবার পছন্দ পাত্র না দেখেই। স্বভাব চরিত্র যেমনই হউক মেনে নেয় বিয়ের পর সব ঠিক হবে ভেবে। যে সময়ে গার্মেন্টসে চাকুরি পাওয়া কঠিন সেখানে সরকারি! হউক তা পিয়ন কিংবা মালি। হাতি বেঁচে থাকলেও লাখ; মারা গেলেও।
মেয়েকে দেখে পাত্রপক্ষ পছন্দ করায় প্রজাপতির দুই পক্ষ আর দেরি করতে চায়নি।
আমি এবং তোফা ডাক দেই জরুরী মিটিংএর। ভালোবাসা দূরে চলে যায় গাঙচিলের মতো। কিংবা যায় না থাকে মনের গহীনে। কিন্তু বুঝতে পারি না আমি। আমরা সরকারি ও বিরোধী দলের সংলাপের মতো বসে পড়ি গোল টেবিলে। টেবিলটা গোল না হতেও পারে। মিটিং এ আমরা সীধান্ত নেই। আমি আমার বাড়িতে জানাব। আমাদের বাড়ি থেকে তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। তারপর দেখি কি হয়? এরপর আমাদের সংলাপের দ্বিতীয় অধিবেশন বসবে। আমাদের বাড়ি থেকে তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে বেকার থাকার কারণে স্বভাবতই তাদের বাড়ি না করে দেয়। আর জানিয়েদেয় তোফার পছন্দ করা ছেলে যেই হউক তার সাথে তোফার বিয়ে হবে না। আর তাছাড়া কোন বেকার ছেলের সাথে তো নয়ই। আমি ভালো করেই জানি মেয়ের বাবা যত বুজুর্গ হউক না কেন তার মেয়ের রিজিকের ব্যাপারে আল্লাহর উপর ভরসা না করে চাকুরিজীবীদের উপর ভরসা করেন। কারণ তিনি জানেন তাদের এই হাতিটাকে খাওয়াতে সরকারি কলার গাছই লাগবে। অপরপক্ষে মেয়ে যে ছেলেকে ভালোবাসবে সেই মেয়ের বাবার চোখে পৃথিবীর সব চেয়ে খারাপ এবং অযোগ্য ছেলে।
এর একদিন পর তোফার ফোন অফ থাকে সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত। আমি তাকে ফোনে না পেয়ে প্রায় একশটা ম্যাসেজ পাঠাই। এক সময় মনে হয় তার আজ হয়ত বিয়ে এই জন্য ফোন অফ করেছে। খুব খারাপ লাগে। জীবনের একটি কঠিন সীধান্ত নেই কিন্তু নিজেকে খুব ভীত মনে হয় আমাকে। অপেক্ষা করতে থাকি। শুধু একটি কথা বলব তার সাথে আর না। তারপর...........! নির্ঘুম রাত লম্বা হয় চাঁদের বুড়ির কাটা সুতার মতোই। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কিংবা রুমে পায়চারি করে। ২.৩০  তার ফোনটা অন হয়। ম্যাসেজ তার মোবাইলে যাওয়া শুরু করলে সে আমাকে কল দেয়। মধ্যরাতে সেদিনই প্রথম সে তার বাড়িতে থেকে আমার সাথে কথা বলে। জানতে পারি ফোনে চার্জ ছিল না। আর চার্জে দিয়ে তোফা ঘুমিয়ে পরেছিল। সে যাত্রায় দুঃস্বপ্নটা কেটে যায় রাত পালিয়ে ভোর হওয়ার মতোই।
তার পরের দিন তোফা বাড়িতে জানিয়ে দেয় বিয়ে করলে আমাকেই বিয়ে করবে অন্য কাউকে নয়। তার বাবাও বাংলা ছবির ভিলেনের মতো তাকে ব্লাকমেইল করে যদি বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে না করে তাহলে তার মাকে রাখবে না। মায়ের বাবার বাড়িতে পাঠায় দিবে চিরদিনের জন্য। তোফাকেও মেয়ে হিসেবে রাখবে না। ছিন্ন হবে সম্পর্ক। তোফা আমাকে এসব কিছুই জানায় না। আমি কিছু জিজ্ঞাস করলে বলে সব ঠিক আছে। আমার মনের মাঝে সংশয় থাকে। আমি তোফাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। তার সাথে ফোনে কথা না হলে, তার সাথে দেখা না হলে আমার মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়। যার ফলে আমার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া শুরু করল। আমার এই অবস্থা দেখে বাবা-মা সঙ্কিত হন। তোফার সাথে ফোনে কথা বলেন বাবা। বাবা তোফাকে বলেন, তোফা যদি সব ছেড়ে আসে তাহলে আমার বৌ হিসেবে মেনে নিবেন। আর কি হবে নিজে দেখবেন। তোফা বাবাকে চিন্তা করতে মানা করেন। বলেন, সে বাড়িতে ম্যানেজ করার ট্রাই করবে। আমি তোফাকে বুঝাই তোমার সামনে দুটো পথ। একটি পথে গেলে সবাইকে পাবে। সেটা হলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করলে আজ হউক কাল তোমাদের বাড়িতে মেনে নিবে। আর অন্য পথ আমাকে ছেড়ে যাওয়া যাতে চিরদিনের জন্য আমাকে হারালে। সে এক সময় সীধান্ত নেয় আমাকেই বিয়ে করবে। সে যাত্রায় যে কোন কারণে তার বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। আমাদের আকাশের কালো মেঘ উড়ে যায়। ভাসতে থাকে সারি সারি হংস বলাকা। আমি তোফাকে বিয়ের চাপ সৃষ্টি করি যে আমরা বিয়েটা গোপনে করে রাখি। ও রাজি হয় না। বলে সব ঠিক হবে। তুমি একটা চাকরী কর আগে। সে আমাকে হলফ করায় কোন কারণে আমাদের বিয়ে না হলে যেন আমি অন্য কোথায় বিয়ে করে সংসারী হই। যেন আত্মহত্যা না করি। তার সুখের জন্য, শান্তির জন্য, হাসি মুখের জন্য যেন বেঁচে থাকি। তাকে সত্যিই সেই সময়টা খুশি রাখতে আমি কথা দেই। কথা দেওয়ার পর আমার কেন যেন মনে হয় আমি ভুল করলাম। আর সে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এই কথা হওয়ার পর থেকে সে আর আমার সাথে দেখা করে না। বিভিন্ন কারণ দেখানো শুরু করল। ফোন প্রায় বন্ধ করে রাখত। ফোন ওয়েটিং থাকলে সে বিষয়ে বলত তারও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমি তাকে হারানো প্রস্তুতি নেই। এমন কি নিজেকেও হারাতে। যে জীবন সুতায় মিশে গিয়েও সুতা খুলতে থাকে। চাঁদের আলো হয়ে জীবনে এসে মেঘ সৃষ্টি  করে তাকে জোড় করা নিছক। যে যেতে চায় তাকে যেতে দিতে হয়। এই কথাগুলো ভেবে আমিও তাকে ফোন দেওয়া করা বন্ধ করি। মোবাইলে এসএমএস দেই না। কোন প্রয়োজনে সে দেখা করতে চাইলেও আমি দেখা করি। এভাবে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। সম্পর্কে মাঝে গড়ে ওঠে দেয়াল। দেয়াল আসতে আসতে রূপ নেয় চীনের মহাপ্রাচীরের। আমার জীবনের রুটিনটা হয়ে যায় এলোমেলো। হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে যাই মৃত্যুর দরজা অভিমুখে। 
মেয়ে বড় হলে পাড়াপড়শির একটু ঘুম কম হয়। এর ভাই, ওর ভাতিজা-ভাগনা বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় চাকরী করে। তার সাথে সেই মেয়েকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লাগে। ঠিক তেমনি একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসে তোফাদের বাড়িতে। তোফার বাবা তাদের এমন এক আত্মীয় সাথে তোফার বিয়ে ঠিক করে। ছেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরী করে। তোফাকে চিনে। তাই মেয়ে দেখা পর্ব ছাড়াই বিয়ের সব প্রস্তুতি নেন। তোফাকে কিছুই জানতে দেয় না। তোফাকে মেস থেকে ডেকে এনে অনেকটা জোড় করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসায় দেন। তোফা বাবার সম্মান-সমাজের মুখের দিকে চেয়ে বাধ্য অনুগত মেয়ের মতো বিয়েতে রাজি হন। একটি সুন্দরতম ভবিষ্যতের জন্য। একটি সুন্দর সংসারে স্বপ্নে বিভোর হয়ে। আমার ছবি আবছা হয় তার মানসপটে। সেখানে সূর্যর মতো উজ্জল হয়ে ওঠে অন্য এক জনের মুখ।
তার বিয়ের খবর জানতে আমার দেরি হয় না। খবর শুনেই দপ করে নিভে যায় বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকু।  তোফাকে দেওয়া কথা আমার মারা যাওয়া থামাতে পারে না। মানুষ কথা দেয় মানুষের মন রাখার জন্য কথা রাখার জন্য নয়। সেও তো বলেছিল আমাকে রেখে অন্য কাউকে কখনো বিয়ে করবে না। সে কথা রাখেনি। আমি কেন রাখব? ভালো থেক তোফা, ভালো থাকুক তোমার বাবা-মা, তোমার সমাজ, তোমার পৃথিবী।

এই গল্পের এই অংশ নিছক! কিংবা এটিই মূলগল্প উপরে ছিল প্রারম্ভিকা।
আমি চলে যাচ্ছি এক ভিন্ন জগতে। যে জগতে গেলে ফিরে আসে না। ফিরে আসার পথও থাকে না। মহাভারতে কে যেন ফিরে এসেছিল তা এই সময়ে মনে পড়ছে না। আজকাল অনেক কথাই মনে থাকে না।
তোফা বিয়ের পরে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করে। হয়ত কিছু সস্তা উপদেশ দেওয়ার জন্য। “তুমি টেনশন করবা না। আত্মহত্যা করার কথা মাথায় আনবা না। আব্বু আম্মু তোমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে তাদের মুখের দিকে চেয়ে হলেও বেঁচে থাকতে হবে। সত্যিই যদি ভালবাসো তাহলে আমাকে দেখাও দাও তুমি পার। আমি তো তোমাকে শুধু পেইন দেই, তুমি আমার থেকে অনেক সুন্দরী মেয়ে পাবা, যে তোমাকে অনেক ভালবাসবে, কেয়ায় করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।” উপদেশগুলো হয়ত এমনই হবে। তোফা হয়ত জানে না প্রিয় মানুষ চলে গেলে তার আদেশ কিংবা উপদেশের প্রয়োজন হয় না। এগুলো ভেবে তোফার বিয়ের আগের দিন আমি আমার ফোনটার সুইচ অফ করি চিরদিনের জন্য। যে ভাবে আমার নিজেরই সুইচ অফ হয়। কিংবা তোফা চেষ্টাও করেনি কল দেওয়ার। কিংবা চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তোফার চোখের সামনে ভেসেছে বাবা-মা-বরের ছবি। একটা নতুন দিগন্তের ছবি। মানুষ আজীবন আদিগন্তের দিকেই ছুটে যেতে পছন্দ করে।
দিন যায় দিন আসে। মানুষ বেঁচে থাকে সম্পর্কটাকে আকড়ে ধরে। তোফাও তাই। তার কোল জুড়ে আলো দেয় চাঁদ-সূর্যরা। তাদেরকে ঘিরে তোফার জীবন। তোফার বেঁচে থাকা। তোফার বাবা মা ভাবে তোফা আজ কত সুখি। হয়ত আমার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটা দুঃখের সাগরে এতদিন হাবুডুবু খেত। 

অনেক দিন পর...................
আমি নামের অভ্র কেউ যে এই পৃথিবী নামক গ্রহে ছিলাম তা ভুলেই গেছে বুদ্ধিমান গ্রহবাসীরা। ভুলে গেছে যার সাথে যত স্মৃতি ছিল। কিংবা না ভুলতে পারে। একান্তে অনেকে ভাবে। এদের দলের বাইরে নয় তোফাও। তবুও আমি চেয়ে থাকি এই গ্রহের দিকে বড় আশা করে কেউ যদি সামান্য সময়ের জন্য চলার পথে থমকে গিয়ে আমাকে স্মরণ করে। আমার দিকে তাকায় আকাশ পানে।
একদিন বৃষ্টির রাতে তোফার স্বামী ছিল না বাসায়। ছেলে মেয়েরা তাদের দাদীর সাথে গল্প করছিল কোন রূপকথার। রাজকন্যা-রাজপুত্রের গল্প, লাল-নীল পরীর গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, ঈশপের নীতির গল্প। এসব নিয়ে তারা মেতে থাকে। অন্য রুমে তোফার একা ভালো লাগছিল না। তার স্বামীকে ফোন দেয় রিসিভ করে না। আমার নাম্বারে ফোন দেয় ফোন দেয় ফোন বন্ধ। অনিচ্ছাতে ফেইসবুকের নতুন আইডিতে লগ ইন করে। আগের আইডি নষ্ট করে জীবনের চরম বাস্তবতায়। সার্চবক্সে আমার নাম লিখে সার্চ দেয়। এখনো সবার উপরের আমার আইডি আসে। এর আগে সে আমার আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে ছিল কিন্তু তা এখনো একসেপ্ট হয়নি ক্যানসেলও হয়নি। হবেই বা কি করে! মৃত্যু মানুষ তো আর ফেইসবুক চালায় না। সে আমার টাইমলাইনে যায়। আমার পোস্ট মনে করে দেয় তাকে তার বিয়ের দিনের কথা।
“এই পৃথিবীতে যে সকল মানুষ কথা রাখতে পারে না আমি তাদের দলে। সত্যি বলতে কি সব কথা রাখতে নেই। মানুষ কথা দেয় কথা না রাখার জন্য। ভালো থেক পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ।”
চোখ ছলছল করে তোফার। সে কিছুই ভাবতে পারে না। ঘোরের মাঝে নিচের পোস্ট পড়তে শুরু করে।
“তোমার বেনারশীর শখ পূরণ না করতেই
আমার সাদা কাপরের হঠাৎ আমন্ত্রণ
কোন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার।
তারপর সব ভুলে যাওয়া আমার;
জলজান্ত একটা জীবনের গল্প,
যে গল্প বংশ পরস্পরায় হেঁটে এসেছে।”
অশ্রুসিক্ত হয় তোফার চোখ। মানুষের জীবনের গল্পগুলো কি অদ্ভুদ। পূর্বে যা ঘটেছিল তাই ঘটে চক্রাকারে। পৃথিবী মঞ্চ হিসাবে থেকেই যায়, পাল্টে শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী। পাল্টে যেতে হয় জীবনের প্রয়োজনে। সত্যিই তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। চোখ থেকে অশ্রুর ঢল নামে তোফার। তোফা ঢুকরে কেঁদে উঠে। তার কান্না আমার কাছে পরম বেদনাদায়ক খুশি বয়ে আনে। বেদনা এই জন্য যে সে আমার জন্য কাঁদছে আর খুশি এই জন্য আজও আমাকে ভুলতে পারেনি। আচ্ছা আমি তাহলে সেদিন ভুল করেছি আত্মহত্যা করে? হয়তো করেছি। কারণ বেঁচে থাকলে তার হাসি মুখটা দূর থেকেই দেখতে পেতাম। সে আমাকেও দেখতে পেত। তার কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে। আমিও কাঁদতে শুরু করি। মরা মানুষ কি কাঁদে?
আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় ফোনের তীব্র আওয়াজে। তোফা আমাকে কল করেছে সতের বার। কেটে দিয়ে কল ব্যাক করতেই বলি ভালোবাসি ভালোবাসা। তোমাকে চাই না হারাতে। জানি স্বপ্নটা সত্যি হতে পারে। কিন্তু আমি তা চাই না। 

‘ছোটনদী’ জুলাই-২০২২ এ প্রকাশিত

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।