জানালা দিয়ে দূর আকাশে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে কল্যাণী। মাঝে মাঝে চোখের পাতা ডিঙিয়ে জল নেমে আসে। খুব কষ্ট মনের মধ্যে, যে কষ্টের কথা কাউকেই বলা যায় না। আয়নায় মুখ দেখে, আয়না সরিয়ে ফেলে। উড়নায় মুখ ঢেকে রাখে। নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। হাতের দিকে তাকায়, হাত ঢেকে ফেলে। পায়ের দিকে তাকায়, পা ঢেকে ফেলে। এক পলক তাকে কেউ দেখলেই এক সেকেন্ডেই বলে বসে, এত কালো!
বুঝতে শেখেনি যতদিন ততদিনই ভালো ছিলো। বুঝতে শেখার পর থেকেই অন্যদের মতো সে বাইরে ঘোরে না, কারণ বান্ধবীভাগ্য মন্দ। বান্ধবীরা কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করলেও বান্ধবীমহলে বড় বেমানান সে। সাদা চামড়ার মেয়েরা বুঝতে শেখার আগে থেকেই বুঝে ফেলে সে সুন্দরী। পা তাদের মাটিতে পড়ে না। কোথাও ঘুরতে গেলে কল্যাণীকে সাথে নেয় না। আর তাই এখন কল্যাণী নিজেও তাদের সাথে দূরত্ব রেখে চলে।
একা থাকে, একা থাকলেই কান্না করে। কল্যাণীর মা প্রায় প্রায় কল্যাণীর বাবাকে বলে, তোমার কারণে আমার বড় মেয়ে কালো হয়েছে। মেয়েরা মায়ের রং পায়, আমার দুর্ভাগ্য।
কল্যাণীর বাবা বলে, মেয়ে আমার। তার মেধা আছে। রূপে জগৎ চলে না। মেধায় জগৎ চলে। নিজের আত্মজাকে নিয়ে আক্ষেপ করবে না।
কল্যাণীর ছোট বোন ফাল্গুনী। সে হয়েছে মায়ের মতো। দুধে আলতা গায়ের রং। তবুও তিনবেলা সাজে। দেখতে পরির মতো লাগে। সারা তল্লাট ঘুরে বেড়ায়। ঘরে মন বসেই না। রূপ থাকলে উচ্ছলতা থাকে। উচ্ছ্বাস থাকে জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রবল। মনে থাকে রূপের অহম। ফাল্গুনীর কথা ভাবে আর নিজেকে ধিক্কার দেয় কল্যাণী। মনের মধ্যে খুব ক্ষোভ কাজ করে। একটু সুন্দর হলেও তো বাকিটুকু কসমেটিকস মেখে সুন্দর হতে পারতো। সুন্দর চেহারার মানুষ সবখানে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মতো। সুন্দর চেহারার মানুষ সবখানে সাদরে গৃহীত হয়। সুন্দর যে তার দিকে সব আলো। সুন্দর যে সৌন্দর্যের সংগায় এগিয়ে সে। সুন্দর যে তার কদর সবাই করে, তার কদর সবার কাছে। চোখ সুন্দর যার তাকে নিয়ে গান লেখে কেউ, কবিতা লেখে কেউ, কেউ উপন্যাসও লেখে। নাকটা যার একটু লম্বা দুনিয়ার যত প্রশংসা সব তার। ঠোঁট সুন্দর যার তাকে সরাসরি বলে প্রশংসা না করলেও দেখে দেখে মানুষ নয়নের তৃপ্তি নেয়। আর সাইজে একটু লম্বা হলে তো কথায় নেই। সবচেয়ে দামি আর পছন্দের শীর্ষে। কেউ একটু কথা বলতে চাইলেই ভেবে নেয়, সুন্দর বলে কথা বলতে চায়। হঠাৎ চোখে চোখ পড়লেই ভেবে নেয়, সুন্দর বলে মানুষ তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেই ভেবে নেয়, দেখে চোখে ধাঁধা লেগেছেরে। সুন্দরীদের মনের এই ভাবনা সব সুন্দরীদের জন্য সমান। অধিকাংশ সুন্দর চামড়ার মেয়েদের মস্তিষ্ক বড় অনুর্বর। পরীক্ষায় খারাপ করলেও ভাইভায় রেজাল্ট ভালো করে। পড়া না পারলেও স্যারেরা বকেন না। রেজাল্ট ভালো না করলেও মা বাবা বকেন না। সুন্দরের কান্না, অভিমান, রাগ কেউ সহ্য করতে পারে না। সুন্দরের রোগ, শোক, ব্যাধি কেউ মেনে নিতে পারে না। সুন্দরীদের সব মাফ, সুন্দর যে!
মুগ্ধ করার ন্যূনতম ক্ষমতা থাকলেই মোহিত হয়ে যায় পুরুষ পঙ্গপাল সুন্দরী নারীর প্রেমে। মেধার সূক্ষ্মতা না থাকলেও মনোমুগ্ধ পুরুষ সুন্দরী নারীর সাহচর্য পেলে। বুক ফুলিয়ে রজত বলে, তোমার কাঁচা কাঁচা কথাও আমার বড্ড মিষ্টি লাগে।
শুনে হাসে, না বুঝে হাসে, না জেনে হাসে ফাল্গুনী। আর বলে, তাই!
সুন্দরীর হাসি দেখে পতঙ্গের মতো দিগভ্রান্ত হয় রজত। বলে, তুমি হাসলেই আকাশটা যেন ঝিকমিক করে উঠে মেঘ ভাঙা রোদ্দুরে।
শুনে আবার হাসে ফাল্গুনী। সুন্দরীরা সব সময় হাসে বেশি। হাসি দিয়ে পাগল করে আশপাশের মূর্খ থেকে গ্রাজুয়েট সবাইকে। আর মানুষও হাসিপ্রিয়। হাসি দেখলেই অবাক হয়ে দেখে। রজত আবার বলে, তোমার হাসি দেখলেই আমার সাজানো-গোছানো ভাবনাজাল উলোট-পালোট হয়ে যায়।
প্রতিউত্তরে কি বলবে বুঝতে পারে না ফাল্গুনী। রজত আবার বলে, তুমি ডাকলেই বুকের বরফ গলে সহজেই ঝর্ণা হয়ে যায়।
ভীষণ আশ্চর্য হয় ফাল্গুনী। সুন্দরীরা শুধু প্রশংসা শুনতে চায়। অস্ত্র হিসেবে সেটায় ব্যবহার করে রজত। রজত আবারও বললো, বুকের ভেতরের কোকিলটা তোমাকে দেখলেই ডেকে উঠে।
শুনে কেবলই হাসে ফাল্গুনী। বলে কম কারণ জানে কম। বলেও বেশি কারণ জানেও না কিছু। মেধাবীরা ভবিষ্যৎ বুঝতে পারে। মেধাবীরা আসন্ন বিপদও বুঝতে পারে।
হাসিতে সন্তুষ্ট রজত ফাল্গুনীর হাসি দেখে, না কি দেখে রজতই ভালো জানে। ফাল্গুনীও যে শুধু রজতকে পেলে হাসে, না অন্যদের দেখলেও হাসে সেটা ফাল্গুনীই জানে। সুন্দরীদের মনে কিসের বাস তারা নিজেও জানে না, পুরুষ জানবে কি করে? ওরা কিসে খুশী, কিসে বশে তাও অনির্ণয়ে। লোভী রজত টোপ দিতেই থাকে, টোপ ফাল্গুনী ধরেও৷ লোভীরা ফাঁদ পাতে, মূর্খরা নিশ্চিন্তে ফাঁদে পা দেয়। রজত ফাঁদ কষে পাতেনি। চতুর চাতুরীও দেখাচ্ছে না, মূর্খও মূর্খামি করছে না। একে অপরের অন্তরের চাওয়াতে একে অপর লীন হয়ে গেলো। হিংস্র প্রাণীর হিংস্রতা কমে গেলো অতীব সুন্দরীর সরলতায়।
রজতের পরিবার ফাল্গুনীকে দেখতে ফাল্গুনীদের বাড়ি এলেন। বড় মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়েকে বিয়ে দেবেন না পরিষ্কার বলে দিলেন কার্তিক বাবু। কল্যাণীও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পেয়ে বিয়ে করবে না। ফাল্গুনী কল্যাণীর এমন সিদ্ধান্ত শুনে হতবাক হয়ে নানা কথা শোনায়। মেধাবীরা পড়াশোনা করতে চায়, সুন্দরীরা প্রেম-বিয়ে এগুলোই করতে চায়। মেধাবীরা চাকরি করতে চায়, প্রজন্মকে এক ধাপ উপরে উঠাতে চায়। সুন্দরীরা বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করতে চায়, নিজ প্রজন্মের আশা ছেড়ে পরের প্রজন্মকাতর হয়।
বাধ্য হয়ে কার্তিক বাবু বড় মেয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে লেগে গেলেন। ছেলেপক্ষ দেখতে এলে ফাল্গুনীকে লুকিয়ে রাখেন। ফাল্গুনীকে দেখলে কল্যাণীকে কেউ পছন্দ করবে না। কারণ সমাজ রূপ দেখে, গুণ দেখে না। যখন রূপের ভেতর গুণ খোঁজে তখন ভুলটা বোঝে। কল্যাণীকে তাঁরা অপছন্দ করে চলে গেলেন। কল্যাণী ঘরের কোণে বসে কান্না করতে থাকে। তার সৌন্দর্য না থাকার কারণে তাকে মানুষ অপছন্দ করছে। তার চেহারা ভালো না বলে মানুষ তাকে গ্রহণ করছে না। তাকে কেউ প্রশংসা করে না। তাকে দেখে কৌণিক চোখে দেখে সবাই। নাক সিটকায় কেউ কেউ। তার মায়ের সন্তান না বলেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করে। এসব ভাবে আর কাদে সে। নিজেকে ভীষণ ঘৃণা করে। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে।
আরো এক ছেলেপক্ষ তাকে অপছন্দ করে চলে গেলেন। এরি মধ্যে মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয়েছে তার। এবার সে জব সেক্টরে ঢুকবে। চাকরি করা মেয়েদের রূপের দিকে কোন ছেলেপক্ষ তাকায় না।
রজত ও রজতের পরিবারের পীড়াপীড়িতে ছোট মেয়ের বিয়ে কার্তিক বাবু আগেই দিয়ে দিলেন। মেয়ে নষ্ট হওয়ার চেয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়া বাবা মা মেনে নেয়। মেয়ে নষ্ট হওয়ার চেয়ে মেয়ের জীবন নষ্ট হওয়া বাবা মা মেনে নেয়। একটি সুন্দরী মেয়ের সর্বশেষ গন্তব্য স্বামীর গৃহ, এটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে। মেয়ে সুন্দর হয়েছে, বিয়ে নিয়ে চিন্তা নেই। মেয়ে দেখতে সুন্দর, ভালো স্বামী পাবে এই সুচিন্তা প্রতি বাবা মায়ের মধ্যে।
কল্যাণী পরীক্ষায় টেকে, কিন্তু চাকরি হয় না। চাকরি না হওয়ার কারণ ঐ অসুন্দর চেহারা। মেধা হেরে যায় সুন্দর চেহারার কাছে। কল্যাণীর আত্মবিশ্বাস শূন্যে ঠেকেছে। পরীক্ষা দিতে চায় না। একা থাকে, মনটা সাজতে চায়, সাজে না। অসুন্দরদের সাজতেও মানা, সাজলে পারিপার্শ্বিকের মানুষ হা করে দেখে। একটি ফুল ছিড়ে খোঁপায় গোঁজে না। অথচ একটি ফুল খোঁপায় গোঁজার তার কত শখ। মানুষের আড়চোখের চাহনিতে সে পড়তে চায় না।
মা রিতিমা এসে বলেন, তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত, মা।
কার্তিক বাবু শুনে বলেন, ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করো না। ফাল্গুনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করো। নেশাখোরের ঘরে মেয়ে বিয়ে দিয়ে কিভাবে বিনাশঙ্কায় থাকো?
রিতিমা বলেন, বিয়ে তো দিতে পেরেছো! কল্যাণীর ক্ষেত্রে সেটাও পারবে না।
কার্তিক বাবু বলেন, আর কয়টা মাস অপেক্ষা করো, কল্যাণী সফলতা থেকে একটু দূরে।
বাবার কথায় কল্যাণী আবার পড়তে বসে। পড়তে হয় জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য। পড়তে হয় সব সমালোচনার জবাব দিতে। পড়তে হয় নিজেকে জানাতে। পড়তে হয় সামনের সারিতে থাকতে। পড়তে হয় কালো রঙের অভিশাপ ঘোচাতে।
না, পড়লেও হয় না। কল্যাণী সফলতা থেকে অনেক দূরেই। পরীক্ষায় টেকে ভাইভায় টেকে না। কারণ হিসেবে কল্যাণী তার বাবাকে বললো, বাবা, আমি কালো এটাই সমস্যা। বাবা, তুমি না বলেছিলে আমি লেখাপড়া শিখলে আমার কালোত্ব ঘুচবে! বলেছিলে না, শিক্ষিত হলে আমার কালোকে কেউ কালো বলবে না! বাবা, চেহারা আর গুণ দুটো ভিন্ন জিনিস। দুটোই দরকার।
রিতিমা বললেন, পড়াতে পড়াতে মেয়ের বয়সও বাড়িয়ে দিয়েছো। ওর বিয়েও হবে না।
কার্তিক বাবু ঠাঁই দাঁড়িয়ে কেদে দিলেন, তারপর বললেন, মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবো না কেন? আমার জমিজমা সব বিক্রি করে দেবো৷
ভালো রেজাল্ট করা একটি শিক্ষিত মেয়ের বিয়ে দিতেও বাবাকে জমিজমা বিক্রির কথা ভাবতে হয়, কোন সমাজে বাস আমাদের! এই সমাজ বর্ণবাদবিরোধী। কিন্তু সবাই বর্ণবাদকে লালন করে। যোগ্যতায় জিতে যায়, বর্ণে হেরে যায়। যোগ্যতায় এগিয়ে যায়, বর্ণবাদের সাথে পেরে উঠে না।
জানালায় বসে খোলা আকাশের দিকে তাকায় কল্যাণী। জায়গাটা খুব প্রিয়। এখানে বসে ইচ্ছামত কাদলেও কেউ দেখে না। সব সময় ইচ্ছামত কান্না করা যায়। কিন্তু হৃদয়ভার কমে না। বেশিরভাগ সময় সে ভুলে যায় যে সে কালো। কিন্তু এই সমাজ আঙুল উঁচিয়ে জানিয়ে দেয়, তুমি কালো। তুমি মেধাবী তাতে কি, তুমি উপরে উঠার স্বপ্ন দেখো না।
আহা, এত বছর লেখাপড়া না করে যদি এত বছর রূপ চর্চাও করতো, তবে সমাজে তার একটা জায়গা হতো, কিছু না হলেও বিয়েটা হতো।