কেতুগ্রামে আলকাপ গানে অধীর মন্ডল এক কিংবদন্তি নাম। তিনি দলের সরকার বা প্রধান। দশ বারোজন সদস্য নিয়ে ডুগি, তবলা, হারমোনিয়াম সহযোগে লোক হাসানো তাদের প্রধান কাজ। তাদের অভিনয়ে খিস্তি, খেউর থাকে। শতকরা সত্তরভাগ লোক গ্রামাঞ্চলে এই গান শোনে। ভদ্রলোকেরা রাতে লুকিয়ে চুরিয়ে চাদরের আড়ালে থেকে এই বিনোদনে অংশ নিয়ে থাকেন। আল, শব্দের অর্থ "কাব্যের অংশ" এবং "কাপ, শব্দের অর্থ "কাব্য"। আবার, 'আল' শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে একটি হল 'তীক্ষ্ণ', 'তীব্র' বা 'ধারালো'। অপরদিকে, 'কাপ' শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে একটি হল ’সং’ — রঙ্গস্থলে বিকৃত আকারে বা অঙ্গভঙ্গিতে দর্শকের কৌতুককর হাস্যোদ্দীপক বিষয়ের বা সামাজিক কুৎসিত বিষয়ের প্রতিমূর্তি বা চিত্র।আলকাপে নাচ, গান এবং এই হাস্য-কৌতুকোদ্দীপক অভিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এক-একটি আলকাপ দলে দশ থেকে বারো জন শিল্পী থাকেন। এঁদের নেতাকে বলে "সরদার" বা "গুরু"। দু বা তিন জন অল্পবয়সী শিল্পী থাকে, যাদের "ছোকরা" বলা হয়। এছাড়া এক বা দুই জন করে "গায়েন" (গায়ক), "দোহার", সম্মেলক গায়ক, বাজনাদার থাকে। আলকাপের পাঁচটি অংশ, "আসর বন্দনা", "ছড়া", "কাপ", "বৈঠকী গান ও "খেমটা পালা। অনুষ্ঠানগুলিতে গ্রাম্য সমাজ এবং সেই সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়।আলকাপ গানে সরকারকে অনেক শিক্ষিত হিসেবে ধরা হয় । আসলেই সরকার যিনি হন তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ । কারণ তাকে অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয় । আর তার সাথে তার ভাই হিসেবে থাকে সেই ভাঁড় যে কাপ্যাল নামে পরিচিত। এই কাপ্যালকেও অনেক বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান হতে হয়। তার কাজ দর্শককে হাসানো এবং সমাজের বিভিন্নও অসংগতিকে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসে এবং সেগুলো বর্জন করে ভালো কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে এই গান চলার সময় কোন একটি পালা পরিবেশন করা হয় । আলকাপ গানের ভাষা মূলত আঞ্চলিক। এই ক্ষেত্রে রাজশাহীর চাপাই নবাবগঞ্জ অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করা হয়। তবে গানের সরকার শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কারণ তাকে শিক্ষিত হিসেবে দেখানো হয় আর তার ভাইকে অশিক্ষিত হিসেবে দেখানো হয়। মূলত সরকার কাপ্যালকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে নিয়ে এসে সেগুলো সমাধানে দিক নির্দেশনা দেয়। গানের সময় কাপ্যালকে তার ভাই চোদনা,খেপা এমন বিশেষ ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকে। এই গানে দর্শকেরাও গানের দলের সাথে দোহার একজন গানের কলি গাওয়ার পর সেটা সমবেতভাব গান ধরে। এই গানে মূলত গানের দল আর দর্শক দুই দলই বিনোদন লাভ করে। গানের সময় সরকারের হাতে একটি মোটা কাগজ সিলিন্ডারের মত করে প্যাঁচানো থাকে যেটা সরকার লাঠি হিসেবে ব্যবহার করে কাপ্যালকে পেটায়। আর কাপ্যালের হাতে চিকন ও পাতলা বাঁশের তৈরি একটা লাঠি থাকে যেটা সে সব সময় নিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে আসরের ব্যবহৃত টিনের ছাওনিতে আঘাত করে শব্দ করে। তবে এইভাবে টিনে আঘাত করার মধ্যেও এক ধরনের আর্ট বা শিল্প আছে। গানের শুরু ছোকরাদের নৃত্তের মাধ্যমে। ছোকরারা খেমটা ও ঝুমুর জাতীয় নাচ-গানে বেশ দক্ষ। তাদের এত সুন্দর নাচ দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করে যে মাঝে তারা ছোকরাদের প্রতি বিশেষ ধরনের শব্দ নিক্ষেপ করে, যেমন- “ বাহ !! রে কইট্যামুখী (কৌটামুখী) !!” , “ও !! রে সায়লার মাও (শায়লার মা)!!” আসলে আলকাপ গান এত হাসি আর বিনোদনমূলক যে আমি এই লেখাটি লিখতে লিখতেই গানের আসরের কথাগুলো মনে করে হাসছি। দর্শকদের বাক্যবানে সাড়া দিয়ে ছোকরাও নাচতে নাচতে দর্শকদের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। মহিলা দর্শকেরা কেউ কেউ লাজ্জায় মুখে কাপড় দেয়। ছোকরারা এবং কাপ্যাল সহ যারা গান পরিবেশন করেন তারা কেউ কেউ পুরাতন হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির গান গায় ও নৃত্য পরিবেশন করে। গানের সাথে নাচের যা কম্বিনেশন সেটা সত্যিই দেখার মত তার সাথে দর্শকদের উত্তেজনা। সবকিছু মিলে ব্যপারটা এমন যে সরাসরি আসরে না গিয়ে দেখলে আমার এই লেখায় খুব একটা বিনোদন পাবেননা। তবে আমার কাছে ছোকরাদের খেমটা নাচ অসাধারণ লাগে। সবাই এমন নাচ নাচতে পারেনা।প্রথম নাচের শেষে সরকার মঞ্চে উঠে বোল বা ছড়া কাটে । যা সত্যি অসাধারণ ! ছড়া কাটার পর কাপ্যাল কে ডাকে, কইরে পটলা কথায় আছিস, এইরকম করে কাপ্যাল তখন দর্শকের মধ্যে কোথাও দূর থেকে বিভিন্নভাবে ভাড়ামু করে উত্তর দেয়। আর বলে, আসছি দাদা । এসে দাদাকে প্রণাম করে। প্রণামের ভঙ্গিটাও দেখার মত। মাঝে সরকার তার হাতে থাকা সিলিন্ডার আকৃতির মোটা কাগজ দিয়ে কাপ্যালকে তার বেয়াদবির জন্য ঠাস ঠাস করে বাড়ি দেই। কাপ্যাল কখনও লাফায় আবার দর্শকের মধ্যে দৌড় দেয়। সরকার ও কাপ্যালের স্ত্রী থাকে। ছোকরারা তাদের স্ত্রী সেজে অভিনয় করে। তাদের রঙ্গরস আসরে জমে উঠে। তাদের রঙ্গরসের গানগুলো অত্যন্ত সুন্দর আর বিনোদনমূলক। যেমন- “তুই যে আমার, তুই যে আমার নতুন রেডিও” অথবা “তুই যে আমার নতুন নতুন ট্রানজিস্টার” । এইগানগুলো কাপ্যাল তার স্ত্রীর সাথে গায়। আর সরকারের সাথে গানের মধ্যমেও মনের ভাব প্রকাশ করে। যেমন- “কি আর বলিব দাদা প্রাণে লাগে ভয়”। আর সরকারের ছড়া গান অতুলনীয় । ছড়া গানের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরে। এই ভাবে রাত গভীর হয়। গান চলতেই থাকে। কেউ ঢুলে, কেউ ঘুমায়। এইভাবে সারারাত পাড়ি দিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে। একসময় রাজশাহী অঞ্চলে এই গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এই গানের দলে যারা থাকেন তারা এই গানের উপরই নির্ভর করে থাকেনা। কারণ সারা বছর এই গানের আয়োজন করা হয়না। তবে গানের মৌসুমগুলোতে এরা বিভিন্ন জায়গায় গান করার জন্য যায়। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা এই পেশা বাদেও অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই গান মূলত টাকা উপার্জনের মানুষজনদের বিনোদন দেওয়ার জন্যই বেশি প্রচলিত। এরা নিজে হাসে অপরকে হাসায়। তবে যারা এই পেশার সাথে অনেকদিন ধরে যুক্ত ছিলেন তারা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছেন তাদের বয়সের ভারে। আর আমাদের ঐতিহ্যগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন যারা এইসব গানের সাথে যুক্ত আছেন তারা হয়ত একদিন হারিয়ে যাবেন। তাদের সাথে এই ঐতিহ্যবাহী আলকাপ গান। কারণ কেউ থাকবে না এই গান করার জন্য। কোন গ্রামে হয়ত বসবেনা আলকাপ গানের আসর। আলকাপ গানের একটা আসরে কুড়ি থেকে তিরিশ হাজার টাকার রোজগার হয়ে থাকে।গ্রামবাংলার এক বিনোদনের নাম, আলকাপের গান।
সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ব বর্ধমান।