"সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে,সতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে"
ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে যশোর জেলার সাগরদাড়ীতে তার জন্মভূমির পাশে বয়ে যাওয়া 'কপোতাক্ষ নদ' স্মরণে কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত এ কবিতা লিখেছিলেন।জীবনের অপরাহ্নবেলায় এসে আমারও সতত মনে পড়ে খুলনা জেলায় আমার জন্মভূমি রাড়ুলি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ,পাশে গ্রামের বারোয়ারিতলা,আমার ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়,আমাদের চকমিলানো দোতলা পুরোনো জমিদার বাড়ী আর উত্তরের কোঠায় বেশ বড় চন্ডীমন্ডপ,গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজো সেখানে হত,সমস্ত গ্রামবাসী তাতে অংশগ্রহন করতেনএবং পুজোর সময় গ্রামে উৎসবের, আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত।
চারশো বছরেরও আগে দেওয়ান মানিকলাল রায়চৌধুরী বাংলার নবাবের থেকে খুলনা সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে কিছু তালুক পেয়ে বন জঙ্গল সাফ করে 'রায়ের আল বা আলি' থেকে 'রাড়ুলি' গ্রামে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। চুন সুড়কি কড়ি বরগা দিয়ে একটি বড় দ্বিতল অন্দরমহল ও জমিদারি পরিচালনার জন্য আরও একটি বড় দ্বিতল বহির্মহল তৈরি করান।তার পুত্র আনন্দলাল রায়চৌধুরীও কিছুটা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেন।আনন্দলালের পুত্র হরিশচন্দ্রের চার ছেলে--জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র, নলিনীকান্ত,প্রফুল্লচন্দ্র ও পুর্ণচন্দ্র। সেজ আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় দেশবরেন্য বিজ্ঞানী ও ছোট পুর্ণচন্দ্র আমার ঠাকুর্দা। জমিদারি প্রথা বাতিল হলেও এই পরিবারের গ্রামের কল্যাণকর কাজের জন্য গ্রামবাসীরা ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত।
আমার বাবা চারুচন্দ্র রায়চৌধুরি,তার সেজ জ্যাঠামশায় বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন।আচার্য্যদেব তার জন্মভুমি রাড়ুলি গ্রামে তার বাবা ও মায়ের নামে একটি ছেলেদের ও একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি তার ছাত্র,আমার বাবাকে, ছেলেদের হাইস্কুল হরিশচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের দায়িত্বভার অর্পন করেন।সেজন্য সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেও অন্যান্য আত্মীয়রা এপার বাংলায় চলে এলেও তিনি বাড়ী ছেড়ে যান নি এবং আজীবন ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।
গ্রামের সবাই তাদের প্রিয় 'চারুবাবু স্যার'কে ভালবাসতেন ও মান্য করতেন। অন্য শরিকেরা চলে যাওয়াতে এতবড় দুর্গাপুজার খরচ দেওয়া আমার বাবার একার পক্ষে সম্ভব হত না। তিনি অর্ধেক খরচ দিতেন আর সমস্ত গ্রামবাসীরা মিলে বাকি খরচের অর্ধেক দেওয়া হত। আমাদের বাইরের বাড়ীর বিশাল চাতালে আমার বাবা ও গ্রামবাসীরা মিলে মিটিং এ বসতেন।একটা বড় খাতায় সমস্ত খরচের হিসাব লেখা হত।পুজোর চারদিন পুবদিকের কাছারির সামনের দরজা ও দক্ষিণের বিশাল সিংহ দরজা সবসময় খোলা থাকত।গ্রামবাসীদের পুজোর চন্ডীমন্ডপে ও সামনের বড় উঠোনে ছিল অবাধ আনাগোনা। এমনিতেও আমাদের প্রাচীন বনেদী জমিদারবাড়ীতে গ্রামের লোকের সহজ যাতায়াত ছিল। এ সবই ছিল আমার নিতান্ত বালিকাবেলার কথা।
"এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই, নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ঐ ঘরে, নন্দীবাড়ীর আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে, মন বসে কি আর? "
রেডিওতে সনৎ সিংহের গান শুনতে শুনতে আমাদের ভাইবোনদেরও আর পড়ায় মন বসত না। স্কুল থেকে এসে প্রথমেই চলে যেতাম আমাদের বাড়ির চন্ডীমন্ডপে। সেখানে বদ্দ্যে বৈরাগী বড় চালচিত্রের একচালায় ঠাকুর গড়ছেন। খড়ের ঠাকুরের উপর একমাটি দেওয়া হয়েছে। আজ নিশ্চয়ই দোমাটি পড়বে। তারপর চকমাটিতে ঠাকুরের রঙ সাদা হবে। অবশেষে ম্যাজিক! রঙ করলেই দারুণ সুন্দর প্রতিমা। শেষে গর্জন তেল টানলে ঠাকুর একেবারে ঝলমল করে উঠবে।
ছয়ের দশকের শেষের দিকে আমাদের বালিকাবেলায় বিনোদনের উপকরণ বলতে ছিল রেডিও। গ্রামের মধ্যে শুধু আমাদের বাড়িতে ছিল ঐ আশ্চর্য জিনিস। আমার মা ছিলেন শহরের মেয়ে, আধুনিকমনস্কা। সে যুগে তিনি খুলনা করোনেশন গার্লস হাইস্কুলে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনিই বাবাকে দিয়ে আনিয়েছিলেন মারফি রেডিও। বুধবার আকাশবাণী কোলকাতা "ক" এ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় "মজদুরমন্ডলী" অনুষ্ঠানে যাত্রাপালা হত। গ্রামের লোক সব চলে আসত। দোতলার চওড়া বারান্দায় সতরঞ্চি পেতে দেওয়া হত বসবার জন্যে।
মহালয়ার ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙতে চাইত না। বাবা যত্ন করে উঠিয়ে দিতেন। রেডিওতে গমগম করত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলা, "আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমন্জীর-- । বাবা বলতেন "ঐ দেখো পূব আকাশ লাল হচ্ছে, দেবী আসছেন"। আমাদের মধ্যে একটা আনন্দের শিহরণ খেলে যেত।
আমরা মোটেই শান্তশিষ্ট ছিলাম না। স্কুল আর পড়ার সময় ছাড়া বাকি সময় আমাদের জল কাদামাটি মেখে খেলেধুলে, পুকুরে ঝাঁপিয়ে কাটত। এমনিতে আমার ভূবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে ভালই লাগত। কেমন বন্ধুদের সাথে গল্প হয়। কিন্তু পুজোর সময় মন উড়ু উড়ু। কবে যে পুজোর পড়া দিয়ে পুজোর ছুটি ঘোষনা হবে। পঞ্চমীর দিন স্কুল করে তবে পুজোর ছুটি হত। আমরা একছুটে চন্ডীমন্ডপে। আজ প্রতিমায় গর্জন তেল টানা হয়েছে। ঠাকুরের কি জেল্লা! কাল ষষ্ঠীর বোধন। আমাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী যিনি ঠাকুর গড়েছেন তিনিই মায়ের চক্ষুদান করবেন। ঐ সময় অনেক গ্রামবাসীও উপস্থিত থাকতেন কারন গ্রামে এই একটিই পুজো হত।
পুজোর দু মাস আগে থেকে মা সিঙ্গার সেলাই মেশিনে আমাদের দুটো করে জামাপ্যান্ট বানিয়ে দিতেন। খুব খুশি হয়ে আমরা ঐ দুটো জামা চারদিনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরতাম। গ্রামের ছেলেমেয়েদের একটা করে পুজোর জামা ছিল দস্তুর। তারা আমাদের দেখে অবাক হত। দুটো জামা!
পুজোর এই চারটে দিন কোন বাঁধা নিষেধ থাকত না। বাড়ির চন্ডীমন্ন্ডপে , উঠোনে, বাইরের মাঠে বন্ধুদের সাথে মিলে দারুণ আনন্দ হত। ষষ্ঠী ,অষ্টমীর দিন আসল ঘিয়ে ভাজা লুচি, ছোলার ডাল হত। বিশাল কাঠের বারকোষে ডাই করে লুচি ভোগপ্রসাদ হিসাবে দেওয়া হত। অষ্টমীর দিন সকালে মা জেঠিমারা শুদ্ধবস্ত্র পরে পুজোর জোগাড় দিতেন,একশো আটটা প্রদীপ জ্বালাতেন। স্নান করে নতুন জামা পরে আমার কাজ ছিল একশো আটটা পদ্মকুড়িকে হালকা হাতে ফুটিয়ে রাখা। পুজোর পরে সবাই মিলে একসাথে অঞ্জলি দিয়ে শান্তিজল নেওয়া হত। নবমীতে পাঠা বলি হত কিন্তু মা আমাদের কোনদিন তা দেখতে দেন নি, বলতেন বাচ্চাদের মনে এই নিষ্ঠুরতার ছাপ পড়বে। সপ্তমী অষ্টমী নবমীর রাত্রে আমাদের চন্ডীমন্ডপের সামনে বিশাল উঠোনে যাত্রাপালা হত। প্রথম দু'দিন ভাড়া করা যাত্রাদল আসত।মহিলা চরিত্রেও পুরুষেরা মহিলা সেজে অভিনয় করত। তিন বার কনসার্ট এর পর হত ছোট করে রাধাকৃষ্ণের মানভঞ্জন পালা।তারপর আসল যাত্রাপালা।কি সব নাম!রূপবান,সোনাই দীঘি, মলুয়াসুন্দরী, এইসব। ঝলমলে পোষাকে চেঁচিয়ে সংলাপ বলত।আমরা চমৎকৃত হয়ে দেখতাম। শেষদিন গ্রামের ছেলেরা একটা যাত্রাপালা করত।একমাস আগে থেকে তার রিহারসাল চলত। প্রাচীন জমিদারবাড়ী হওয়াতে, আমাদের বাড়িটা ছিল চকমিলানো । উত্তরে চন্ডীমন্ডপ ,দক্ষিণে লোহার পাত লাগানো কাঠের বিশাল সিংহদরজা ,পূবে সার দেওয়া একতলার কাছারির ঘরগুলি আর পশ্চিমে দোতলা বাড়ী। মাঝখানে বড় উঠোন। কাতারে কাতারে গ্রামবাসী যাত্রা দেখতে উঠোনে এসে বসে পড়তেন। মহিলারা দোতলার লম্বা বারান্দায় আমার মা ঠাকুরমার সাথে বসে যাত্রা দেখতেন।
অবশেষে আসত বিদায়ের দিন। দশমীর সকালে ঠাকুরমশাই একটা জলপাত্রে দর্পণ বিসর্জন দিতেন। প্রতিমা প্রদক্ষিণ করে যাত্রামঙ্গল পড়ে বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠান পালন করা হত। মা দুর্গা চলে যাচ্ছেন। আমার মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ত।
বিকালে গ্রামবাসীরা আমাদের একচালা প্রতিমা কাধে করে নিয়ে নদীতে জোড়া নৌকার পরে রাখতেন। ঠাকুরমশাই ধুপধুনা ধুনুচি দিয়ে ঐ নৌকার পরেই আরতি করতেন। আমরাও জোড়ানৌকোয় থাকতাম। নৌকো নদী দিয়ে দুই তিন গ্রাম ঘুরে আসত। শুধু সাত বার ঘুরিয়ে দেবীপ্রতিমা বিসর্জনের সময় আমরা অন্য একটি নৌকোয় চলে যেতাম। বিসর্জনের পরে ঘাটে উঠেই আমরা মা বাবাকে প্রণাম করতাম। বাবা বাড়ির জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতেন। আর বাড়িতে ঠাকুরমা আর মায়ের তৈরি চন্দ্রপুলি, নারকোল নাড়ু, ছাঁচে তোলা কষীরের সন্দেশ তো ছিলই।
আসলে কপোতাক্ষ নদের বালুকাবেলায় ফেলে এসেছি আমার বালিকাবেলা।আমার সেজঠাকুর্দামশায় আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বিজ্ঞানীর বাড়ি হিসাবে বাংলাদেশ সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছেন কিন্তু কোন সংস্কার করেন নি। ইউটিউবে স্যার পি সি রায়ের বাড়ি হিসাবে দেখানো হয় কিন্তু তার ভগ্নদশা দেখলে চোখে জল আসে। তবে খবর পেয়েছি গ্রামবাসীরা এখনও সমাদরের সাথে ঐ চন্ডীমন্ডপে দুর্গাপূজা করেন। আমরা না থাকলেও গ্রামবাসীরা ভালবেসে আমাদের বাড়ীর পুজোর ট্রাডিশন বজায় রেখেছেন। সেটি এখন সার্বজনীন দুর্গাপুজা।