রিইউনিয়ন
সুমিতা চৌধুরী
বহু বহু বছর পর জীবনের সায়াহ্নে এসে এই প্রথম রিইউনিয়নে স্কুলে আসা মিতার। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ইতিমধ্যে স্কুলের অন্দর ও বহিরঙ্গে। তবু মনের টান আজও একই আছে তার স্কুলের প্রতি।
ফেসবুকের দৌলতে দু'বছর হলো স্কুলের প্রায় সব বান্ধবীদের ফিরে পাওয়া, সাথে অনেক দিদিমণিদের সাথেও নতুন করে যোগাযোগ। সেই সূত্রেই এতো বছর পর আবার স্কুলে পদার্পণ। ভীষণরকম উত্তেজনা কাজ করছিল কদিন ধরেই। কতোই না প্ল্যানিং চলেছে বন্ধুদের মধ্যে এই দিনটাকে ঘিরে। আজ সেই অপেক্ষার অবসান।
নতুন দিদিমণিরা সবাই একেবারেই অপরিচিত। তবে পুরোনো দিদিমণিদের মাধ্যমে তাদের সাথেও আলাপ হলো। মিতার প্রতি দিদিমণিরা সবসময়ই সদয় ছিলেন, শুধু পড়াশুনার জন্য নয়, নানারকম কালচারাল অ্যাকটিভিটি, আর মিষ্টি ব্যবহারও তার জন্য সমান দায়ী। সব দিদিরাই চাইতেন, মিতাকে তাদের স্কুলের নবীন শিক্ষিকা হিসেবে দেখতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাদের সাথে মিতারও সেই একই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় শুধু নয়, মিতাকে মাধ্যমিকের মুখেই অসুস্থতায় প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়া ছাড়তে হয়। নিজের এই স্বপ্নভঙ্গ কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি মিতা। তাই স্কুলের সঙ্গে শত ইচ্ছে হলেও আর যোগাযোগ করেনি , কষ্টটা যে তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সর্বক্ষণ। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা আর হয়নি, হয়নি সাধের লেখাপড়াও। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়ে যায়, তারপর সংসার, স্বামী, কন্যা, এই ছিল জগৎ।
হঠাৎ মেয়ের হাত ধরেই অবসরে খোলা ফেসবুকের মাধ্যমে অদ্ভুত ভাবেই কিছু কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগ আর তাদের উপর্যুপরি অনুরোধে স্কুলজীবনের সেই অবদমিত ইচ্ছেগুলো যেন ডানা মেলে। আবার সেই কবিতা, গল্প লেখা শুরু হয়। হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই, স্বনামধন্য না হলেও, আজ সে লেখিকা। নিজের স্বয়ংসম্পূর্ণ দুটি বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। আর বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে তার নিয়মিত লেখা ছাপা হয় এখন।
মিতা চিরদিনই নিজের ব্যাপারে মুখচোরা। আজকের দিনেও নিজের ঢাক নিজে পেটানোকে সে মানহীনতার চোখেই দেখে। তাই বহুবছরের বিস্মৃত স্মৃতি টাটকা করতে মিতার বন্ধুরা এভাবেই পরিচয় করাচ্ছিল তার সঙ্গে পুরোনো স্কুলের দিদিদের। সঙ্গে নতুন দিদিরাই শুধু নয়, অধুনা ছাত্রীরাও জানছিল সবটা। অপর্ণাদি বলে উঠলেন," দেখেছিস, আমরা ঠিকই বলেছিলাম তখনই। আরে আমাদের হাতেই যে বেড়ে উঠেছিস তুই, আমরা বুঝবো না। তোর মধ্যে তখনই সেই প্রতিভাকে চাক্ষুষ করেছিলাম আমরা। শিক্ষিকা হোসনি তো কি হয়েছে? লেখিকা তো হয়েছিস। এ কি কম পাওয়া? মন খারাপ করিস না। জানি তোর অনেক দূর পড়াশুনা করার খুব ইচ্ছে ছিল। অসুস্থতার জন্য তা হয়নি। কিন্তু প্রথাগত পড়াশুনোই একমাত্র পড়াশুনো জানা তো নয়, সেটা তুই নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছিস। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও, তুই তোর নিজস্ব শিক্ষার সুস্পষ্ট ছাপ রেখে দিয়েছিস তোর কাজের মাধ্যমে। এই তো চাই। তাই কখনোই মন খারাপ করবি না, অন্যদের থেকে নিজেকে ছোটো মনে করে আড়ালে থাকবি না। তোর বন্ধুরা যেমন কেউ টিচার, কেউ ডাক্তার, কেউ চাকুরিরতা, তুইও তেমনি তোর নিজ ক্ষেত্রে একশো শতাংশ সফল। সত্যিই আজ আমাদের গর্ব হচ্ছে। তোদের ব্যাচটাকে নিয়ে যে স্বপ্ন আমাদের ছিল, তা সফল হতে দেখে। তোরা আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, সফল। এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার থাকতেই পারে না আমাদের শিক্ষিকা হিসেবে। তোদের মাধ্যমে আমরাও যে আজ সফল, আমাদের সব আশা আজ পূর্ণ হয়েছে বলে।" অপর্ণাদির কথাকে শুধু প্রাক্তন দিদিরাই নয়, নতুন দিদিরাও সমর্থন করলেন। আর মিতার সংক্ষিপ্ত জীবনী শুনে নতুন দিনের ছাত্রীরা শুধু অবাকই হলো না, একটু শোরগোলও পড়ে গেল নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে। তাদের কাছে হয়তো কিছুটা গল্পকথার মতোই শোনাচ্ছিল, যা তারা শুনেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। তবে মিতার দেওয়া স্কুলের লাইব্রেরিকে নিজের লেখা বইটা একটু হলেও নাড়াচাড়া করে দেখার অদম্য কৌতুহল দমন করতে পারছিল না। যদিও এখনকার দিনের ছাত্রীদের কাছে বই এক বিভীষিকা। পাঠ্য বইয়ের এতো বোঝার পর আর অন্য বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না কখনোই তাদের। তারপর আছে এখন হাতে হাতে মোবাইল। বিনোদন বলতে তো এখন সবারই সবটা এই মোবাইল নির্ভরই। তাই কেউ কেউ এলো অতি উৎসাহে মিতার সঙ্গে সেলফি তুলতে। মিতা না করলো না, তবে একাও তুললো না। কখনো বন্ধুদের সাথে, কখনো দিদিদের সাথে ছবি তুললো।
এরপর দিদিদের দেওয়া স্পেশাল লাঞ্চ, গল্প, হাসি-ঠাট্টায়, কোথা দিয়ে সময় বয়ে যেতে লাগল। মিতারা এই বিশেষ দিনের স্মৃতি হিসেবে স্কুলের দিদিদের সাথে, বন্ধুদের সাথে, সারা স্কুলবাড়ি ঘুরে ঘুরে প্রচুর ছবি তুললো নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য। এরপর দেদার আড্ডা চলল সেই আগের দিনের মতোই স্কুলের মাঠে বসে। আর তখনই এ প্রজন্ম আর ঐ প্রজন্মের ফারাকটা ভীষণভাবে চোখে পড়লো সবার। যদিও সবার হাতেই সুদৃশ্য আধুনিক মোবাইল ফোন আছে। কিন্তু মিতারা সব বন্ধুরা মিলে একত্ম হয়ে গল্পে মশগুল আর নতুন ছাত্রীরা বসে আছে একত্রেই, কিন্তু বাক্যালাপের সময় বড়োই সংক্ষিপ্ত। তার থেকে তারা নিজের নিজের মোবাইলের প্রতি অনেক বেশী আগ্রহী।
একটা দিন সম্পূর্ণ ভাবে নতুন করে সর্বাঙ্গসুন্দর ভাবে বেঁচে, অনেকটা আয়ূ বেড়ে গেল যেন মিতাদের। আর মনের বয়স? তা অবশ্য অনেকটাই কমে গিয়েছে, আর এই বিশেষদিনে তো সেটা সেই কিশোরী বয়সেই নেমে এসেছিল বোধহয়। সবার কথা শুনে, বিশেষ করে দিদিদের কথা শুনে আজ মিতা মন থেকে অনকটা কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। নিজেকে অনেকটা ভারমুক্ত মনে হচ্ছে আজ। সত্যি, বহুযুগ পর এই দিনটা তাকে নতুন করে প্রাণবায়ু ফিরিয়ে দিল। নতুন করে বাঁচতে শেখালো আবারও নিজের প্রতি একমুঠো বিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে। রিইউনিয়ন মানে যেমন নতুন করে দলবদ্ধ সাক্ষাৎ, তেমনই বোধহয় নতুন করে বাঁচার আশ্বাসও বটে। অন্তত মিতার তাই মনে হলো।