কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে যমুনা নদী । গভীর নয় শান্ত। দু'পাশে প্রচুর বড় বড় গাছের সমাবেশ। গ্রামের নাম চারঘাট । গ্রামের লোকেরা এই নদীর কাছে বড়ই ঋণী। জয়দীপ দে দের ছোট্ট ঘরটি এই নদীর পাশে । ছোট সংসার তাদের। মা বাবা জয়দেব ও ছোট বোন সোনাই । সোনাইয়ের ভালো নাম সোনালী ।জয়দেবের বাবা নদীতে মাছ ধরে,অতি কষ্টে সংসার চালান ; কিন্তু এত কষ্টের মধ্যেও জয়দেবের বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় গড়ে তুলবেন। সেই জন্যই তিনি গ্রামের কাছে গড়ে ওঠা নতুন স্কুলে জয়দেব কে ভর্তি করিয়ে দেন।
জয় সকাল বেলায় উঠে মাকে বলল ," মা আমাকে আজ তাড়াতাড়ি সাজিয়ে দাও , আমি আজ স্কুলে যাব ।" মা বললেন ," ও মা ছেলের কথা শোনো, এখন ক' টা বাজে ? স্কুল যাবি। দাড়া তোর জন্য ফেনা ভাত রান্না করে দিই। তাই খেয়ে যাবি।"
জয় বলে," তা তুমি ,একটু তাড়াতাড়ি করো মা স্কুলে দেরি হলে মাস্টারমশাই বকবেন কিনা ? "
সোনাই একপাশে চুপ করে বসে সে দাদাকে লক্ষ্য করছিল হঠাৎ এসে বলল, " ডাডা আমি তোমার সঙ্গে স্কুলে যাব।"
জয় বলে ওঠে ," এই মেরেছে তুই কোথায় যাবি ? এত ছোট , তুই যা বুড়ির সঙ্গে খেলা কর। তুই আমার মত বড় হ'। তখন স্কুলে যাবি ,যা খেলা করতে যা….. "
প্রতিদিন জয় নিজের বোনের সাথে খেলাধুলা করে । তাই বোনকে রেখে স্কুলে যেতে তার কষ্ট হচ্ছিল।তবুও স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা শিখে তাকে অনেক বড় হতে হবে। এখন জয়ের বয়স ছয়, সোনাইয়ের সাড়ে চার। একসময় মা ডাকলেন," জয় এদিকে আয় বাবা চানটা করিয়ে দিই।" তারপর মা নিজে হাতে করে খাইয়ে দিলেন। একটা কাপড়ের ব্যাগে বই শ্লেট ভরে ,হাত ধরে রাস্তা পার করে দিয়ে আসেন। যেতে যেতে বললেন," জয় মন দিয়ে পড়ালেখা করবে, মাস্টারমশাই যা বলবে তা মন দিয়ে শুনবে। দুষ্টুমি করবে না।
আজ স্কুলে যাচ্ছে , জয়ের মা অনেকক্ষণ সেই দিকেই
তাকিয়ে থাকে ।ছোট্ট জয় রাস্তার ধার ধরে এগিয়ে চলেছে। জয়ের মায়ের মনটা ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে চলেছে ,অপরদিকে জয়ের মনে নতুন স্কুল সম্পর্কে ধারণাটা যেমন আনন্দ দেয় আবার ভয়ের সৃষ্টি করে কিন্তু ভয় টা যে কি তা জয় অনুভব করতে পারল না। তবুও ভয় মিশ্রিত আনন্দ নিয়ে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার বহু আকাঙ্ক্ষিত স্কুলের ভেতরে ঢুকতে ভয় করছিল । সেই সময় হঠাৎ তরুণ যুবক এক মাস্টার মশাই শতদল গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায় । একটি ছয় বছরের বালক কে স্কুলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি আস্তে আস্তে বালকটির পাশে এসে বললেন," তুমি বুঝি নতুন ভর্তি হয়েছো ?" জয় বলে ওঠে," হ্যাঁ কিন্তু আপনি ….আমাদের স্কুলের মাস্টার মশাই ? " জয়ের হঠাৎ
মায়ের কথা মনে পড়ে যায়, বলেছিল " মাস্টার মশাই কে দেখে প্রথমে করবে । " কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সুদীর্ঘ বাবরি চুলে দন্ডায়মান মাষ্টারমশাইকে সে প্রণাম করে। তরুণ মাস্টারমশাই সস্নেহে জয় কে কোলে তুলে নেয়। পদ্মের পাপড়ির মত পবিত্র সুন্দর গালে চুমু খেয়ে, বলে ওঠেন " কি নাম তোমার ? "
― " আমার নাম জয়দীপ মন্ডল ।"
শতদল বলে ওঠে," বাহ সুন্দর তো তোমার নাম! চলো ক্লাসে চলো।" বলেই মাস্টারমশাই কোলে করে ক্লাসে ঢুকে পড়লেন। জয় বলে ," মাস্টারমশাই আমাকে নামিয়ে দিন, সবাই দেখে নেবে তো!"
শতদল বলে," তাতে কি হয়েছে ?" জয়দেব কে কোলে নিয়ে ক্লাস ঘরে ঢুকতেই আরেকটি সাত বছরের গোলাপি জামা পরা মেয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরে বলে উঠে ," বাপি আমাকে কোলে নাও "
জয় প্রশ্ন করে," মাস্টারমশাই এ কে ? "
শতদল বলে ," এ তোমার বন্ধু ,আমার মেয়ে সরস্বতী।" জয় বলে ওঠে, " বন্ধু কে ও কোলে নিন।"
এমন সময় ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং শব্দে ঘন্টা বেজে ওঠে শতদল বাবু সরস্বতী ও জয়কে নামিয়ে দিয়ে বলে,
" তোমরা তোমাদের জায়গায় গিয়ে বসো।কিছুক্ষণ বাদে সারিবদ্ধ ভাবে মাস্টার মশাইয়ের নির্দেশ মত ছেলেদর লাইনের প্রথমে জয় মেয়েদের লাইনের প্রথমে সরস্বতী , দাঁড়িয়ে প্রার্থনা শুরু করে -
" শিক্ষার আলো দাও হে প্রভু
দীনতাকে যেন ভুলিনা কভু
নানা কষ্ট দুঃখে তবু
সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসবো …."
কয়েক বছর পর পর কয়েক বছর সরস্বতী বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছিল । সেখানে জয় এক থেকে দশের এর মধ্যেই থাকতো কিন্তু প্রথম হয়নি।
এখন জয় ও সরস্বতী পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী ।
আজ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলঘোষণার দিন। একসময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা এবং শতদল বাবু ক্লাসে প্রবেশ করলেন প্রতিবারের মত এবারও জয় ওই দিনটিতে রেজাল্ট বেরোনোর সময় স্বরস্বতীর ফলাফল এবং কৃতিত্ব শুনে মনে হল যে মাস্টার মশাই নিজের মেয়ে বলে সহযোগিতা করে নইলে প্রতিবছর প্রথম হয় কি করে এবার জয়ের পরীক্ষা ভালো হয়েছে সুতরাং 10 এর মধ্যেই তার স্থান থাকবে হয় তৃতীয় অথবা চতুর্থ প্রত্যেকে উদ্বিগ্ন চিত্তে প্রধান শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে শুরু হলো ফলাফল ঘোষণা কৃষ্ণ বাবু একসময় বলে ওঠেন এবার তোমাদের এই ক্লাসে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে এই ক্লাসের কৃতিমান ছাত্র জয়দেব মণ্ডল সে এবার অষ্টম স্থান থেকে সাতজনকে টপকে প্রথম হয়েছে দ্বিতীয় হয়েছে সরস্বতী জয়দেবের মনটা আনন্দে নেচে ওঠে আনন্দ ভরা দুটি চোখে প্রিয় বান্ধবীর দিকে তাকায় কেমন যেন লাল ঘোলাটে হয়ে আছে সরস্বতী কে সহজে সরস্বতী কে সহজে সহজ করতে চোখে চোখ রেখে জয়দেব হেসে আনন্দ দেবার চেষ্টা করে সরস্বতী রাগে ও লজ্জায় মাথা নীচু করে কেঁদে ফেলে সকলের হাতে রেজাল্ট দিয়ে সব মাস্টারমশাইরা অন্য ঘরের দিকে রওনা হলেন ছুটি ঘোষণা হয়ে যায় কেউ উল্লাসে কেউ দুঃখে ধীর পদক্ষেপে ক্লাস ছেড়ে বের হয় জয়ের মনে এতদিনে একটা ভুল ধারণা ভেঙে গিয়ে সে আনন্দ করতে থাকে সে মনে মনে পড়লে আর কোনদিন এ মাস্টার মশাই দের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করবে না জয়ের হঠাৎ খেয়াল হয় ক্লাস ঘর ফাঁকা সে দাঁড়িয়ে ছিল যার জন্য সে তো নেই সরস্বতী কখন চলে গেছে দ্রুতগতিতে ক্লাস ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় সরস্বতী কে দেখতে পেয়ে ডাক দেয় এই শুনছিস বারকয়েক ডাকার পরও সরস্বতী তাকায় না জয়ের মনে খুব রাগ হয় সারা দেহ একটা গরম ভাব অনুভূত হতে থাকে মেয়েরা এত অভিমানী প্রত্যেকবারই তো প্রথম হয় আমি কি রাগ করে ওর সাথে কোন মুহূর্ত কথা বলিনি আমি তো রাগ করিনি যাও যাও বন্ধু তোমাকে আমার চাই না তোমার চেয়ে অনেক ভালো বন্ধু আমি পাবো আমি তোমার সাথে কথা বলবো না আমার সাথে অনেকেই বন্ধুত্ব করতে চায় তোমার জন্যই আমি তাদের সাথে কথা বলিনা তোমার ঝগড়া তেই আমি তাদের সাথে ঝগড়া করি অনিতা জয়া কবিতা সুচরিতার সাথে কথা বলি না আমি আজ থেকে ওদের সাথে খেলবো তোমরা বড়লোক কিনা তাই এত অভিমান আমাদের অর্থনীতিকে কিন্তু হৃদয়ে ভালোবাসা আছে গরিব হয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে না গরিব মানুষ আমার মা সব জানে তিনি আমাকে বলেছেন তুমিও মানুষ আমিও মানুষ পার্থক্য কোথায় সেই দিনই অভাব শিকারির হাতে আহত জয়ের আহত জয় প্রথম হয়েও কেঁদে ফেলল কিন্তু কেন ?
------
স্বপন জায়দার।
রবীন্দ্রনগর ,চুঁচুড়া
হুগলী