পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য রক্তের সাগর গড়ে তুলেছিল। শত বাঁধা ডিঙিয়ে মাতৃভাষাকে আপন করে নিয়েছিল। বাঙালির স্কন্ধে স্কন্ধে বহু ত্যাগ আর তিতিক্ষা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে "জয় বাংলা" স্লোগান রক্তে রক্তে তরঙ্গিত হয়ে উঠেছিল। সালাম, রফিক, শফিক, বরকত আরও কত জনার প্রাণ ঝরে গেল। বাংলার মাটি রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। জননীর বুকে হাহুতাস তখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বাংলা ভাষা বাঁচানোর সংগ্রাম।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার হেতু বাংলার দামাল সন্তানেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। তাঁদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি। আজ বাংলা ভাষা বিশ্বের দ্বারে দ্বারে নন্দিত। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের অন্তরে কতটা ঠাঁই দিয়েছি? মাতৃভাষার আচ্ছাদনে কতটা নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছি? বুক ফুলিয়ে কতবার বাংলা ভাষায় কথা বলেছি? তা নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ! এমন একটা সময় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে বাংলায় কথা বলতে আমাদের লজ্জা হয়। কোথাও কোথাও আবার দেখা যাচ্ছে শহুরে ভাষার চত্ত্বরে গ্রামীণ স্বাদের মাটির ভাষা দিন দিন লুপ্ত প্রায়। মা- বাবা বলার যে, সুমিষ্ট ডাক সে সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। বাংলা ভাষা আজ এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যে, আমরা নিতান্তই ভুলে যাচ্ছি আমাদের পূর্বপুরুষ এই ভাষার জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছে। আমরা ভুলে যাই, একষট্টিতে শিলচরের বারাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিল এগারো জন তাগড়া জোয়ান। সেদিন শিলচরের মাটি রক্তে রক্তে লকলক করছিল। শিলচরের মাটিতে বাংলা ভাষা আবার বীজ বুনেছিল স্বপ্নের; মাতৃভাষায় কি মধু আছে যে, ঢাকায় এবং শিলচরের যুবকেরা ভাষায় জন্য বুক পেতে দাঁড়িয়েছিল, বায়ান্ন আর একষট্টিতে! আজ এই সুশীল সমাজের কাছ থেকে আমরা কি চাইব? বাংলা ভাষা দিন দিন বিকায়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে সেই, মাতৃক্রোড়ের স্নেহময় বুলি। জানিনা, আর কতবার জাগতে হবে বরকত, শফিক, রফিক আর কুমুদ, কানাই, সুরেশকে, কতবার মাতৃভাষার ধ্বজা মুখে মুখে ছড়িয়ে বলে দিতে হবে আমার ভাষা চির কিশোর মাতৃভাষা। বাংলা ভাষা নিয়ে কলকল অট্টহাস আর আমরা দেখতে চাই না। যে, বাংলা ভাষা মাতৃক্রোড় থেকে মরণের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। সে ভাষা সবার, মাথা উঁচু করে বিশ্বসভায় নন্দিত হবে বারংবার। ভীম তুফানে গর্জে উঠবে! সেই বাংলা ভাষাকে আমরা দিন দিন ভুলে যেতে চলেছি। সকল ক্ষেত্রে ইংরেজি, জাপানি, চিনা প্রভৃতি ভাষার মূল্যয়ন করছি। বিদেশী ভাষাকে অগ্রে স্থান দিয়ে ঢোল পিটিয়ে বেড়াচ্ছি। আর নিজেকে গর্বের সিঁড়িতে উঠায়ে ধন্য ধন্য বলে বুলি আওড়াচ্ছি, মিথ্যা লোলুপ আশায় দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছি, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হৃদয়ের প্রগাঢ় ব্যাঞ্জনা। আমাদের লক্ষ্য ঠিক নাই, মুখে বলি এক করি এক, কাজে হাত লাগানোর মতো কেউ নেই। নতুন প্রজন্ম যারা আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের গড়ে তুলতে গিয়ে নিজেকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছি। বাংলা ভাষা বলতে মুখে ফেনা উঠে! জীভ আঁতকে যায়। আজ বিদেশি ভাষার অগ্রাসনে মধুর সাধের মাতৃভাষা ঘোর বিপাকে ( বিপাকে বলা উচিৎ হবে না যদিও...) দেখা যাবে কয়েক বছর পর সবাই অন্যান্য একটি ভাষার দ্বারপ্রার্থী হয়েছে। যেমনটা হয়েছে গ্রামীণ সুরের ভাষার টান আর সেরকম ভাবে হৃদয়ে দোলা দেয় না। এখনকার প্রজন্ম গ্রামীণ ভাষাটাই ঠিকমতো বলতে পারে না। কোন শিক্ষিত পরিবেশে গিয়ে গ্রামীণ ভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। তাহলে, ধীর মস্তিষ্কে একবার ভেবে দেখুন, কোথায় তাঁদের আত্মত্যাগ? বাঙালির প্রাণের ধন প্রতিনিয়ত শুধু অবহেলার শিকার হবে। আর আমরা ঘরে বসে হাত গুটিয়ে সেসব দেখে যাব, তা হতে পারে না। জাগ্রত হতে হবে হৃদয়ের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হাতির মতো শক্তিশালী হতে হবে, তবেই না দুর্বলতা দূর হয়ে শক্তির সঞ্চার হবে। আমাদের আস্তা ক্রমশ গ্রাস করছে হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা দুর্বলতা। ক্ষ্যাপা বাউলের মতো একতারার তার ছিঁড়ে গর্জে উঠতে হবে। বাঙালি দুর্বা ঘাসে পা রাখলেও বুঝতে পারে প্রাণের স্পন্দন কিন্তু কোথায় সেই শক্তি সাহস। ক্রমশ গ্রাস করছে বিদেশি ভাষা জায়গা করে নিয়েছে আমাদের মুখে মুখে ঢাকা পড়ে গেছে বরকতের, কমলার সেই প্রাণের ভাষা।
কত শত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠেছে কিন্তু আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না শুদ্ধ বাংলা ভাষা শিখার স্কুল। সম্ভবত, হাতে গোনা কয়েকটি পেতে পারেন। সেগুলোও ঠিকমতো চলছে না। শিশু -কিশোরকে সবসময় ইংরেজি চর্চার জন্য চাপ দেই। এক সময় দেখা যায় সেই শিশু আস্তে আস্তে বাবা-মা ডাকটি পর্যন্ত ভুলে নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দেন। আজ আমরা বাংলা ভাষাকে কতটা সম্মানের চোখে দেখি? ভদ্র সমাজে বাংলা ভাষা উচ্চারণে চোখ মুখ ঢাকতে হয়। সেদিনের সেই রক্ত মিছিলের কথা এত সহজেই ভুলে গেলাম। ভাবতেই লজ্জা লাগে, এমন এক সময়ে এসে আজ দাঁড়িয়েছি, দেখা যাচ্ছে, আমরা যতটা না এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের অন্তরে ঘুণ ধরেছে। কবি দেবব্রত সিংহ যথার্থই বলেছেন..."বাংলা ভাষার পিঠ ঠেকে গেছে দিয়ালে/ তুই কোনও খবরাখবর রাখিস,/ আখন দুনিয়াজুড়ে হাট বসেছে ভুবনগাঁয়ের/ সেই হাটে বিকাই যাচ্ছে/ লস্টঅ হইয়ে যাচ্ছে সব / তোদের যত মাটির ভাষা মাটির গান/ কিছু কি আর থাকবেক মনে করিস?" আমাদের নিজস্ব সত্ত্বা যতদিন না সক্রিয় হয়ে উঠেছে, ঠিক ততদিন মানুষ গড়ার কারিগরগুলো অচেতন অবগুণ্ঠন হয়ে পড়ে রইবে। আধুনিক সৃষ্টিশীল যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে নিজের আত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। বাংলা ভাষাকে পুঁজি করে কেউ কখনো বাঁচাতে পারেনি আর পারবেও না। এ ভাষার দরদ জননীর কোল থেকে একে নষ্ট করা কার বাপের সাধ্য।
আজ যদি আপনি কাউকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বলেন, "বাংলা মাসের কত তারিখ?" আমার বিশ্বাস একশো ভাগের মধ্যে এক ভাগ লোক ছাড়া নিরানব্বই ভাগ মানুষ বলতে পারবে না। বাঙালির ঐতিহ্য দুর্বল হয়ে পড়েনি। আমরা নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়েছি। বাংলা চর্চা থেকে দিনদিন বিরত থাকছি। যা কখনোই ঠিক নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে দেখা যায় দেশজুড়ে নানা আয়োজনে রেলি থেকে শুরু করে গান-বাজনায় মেতে উঠি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যাই। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেই তারপর কিছুদিন পর দেখা যায় অযতনে পড়ে থাকে সেই স্মৃতি; কিন্তু ক জন আছি সেই শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের বুকে স্থান দিয়ে ভালোবাসার পরিধি বৃদ্ধি করি এবং সুকুমার শিল্পের মাধ্যমে স্ব সংস্কৃতির মান উজ্জ্বল করি।
আমি মনে করি, বাংলা ভাষা তাঁর স্ব মহিমায় নীলাম্বরের মতো অনন্ত বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তাঁর মহত্ত্ব ব্যক্ত করবে আর আমাদের শুদ্ধ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রগাঢ় করতে হবে এবং স্ব সংস্কৃতির উপর আস্থা রেখে তাঁর গভীর ভালোবাসায় মগ্ন হতে হবে। একদিন দেখা যাবে সর্বত্র বাংলা ভাষার চর্চা থেকে শুরু করে বাংলার নিগূঢ়তম মধু পান করার জন্য সারা বিশ্ব মতোয়ারা হয়ে যাবে। আমাদের গোঁড়ার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, গোঁড়া শক্ত করতে পারলে একদিন মহাকাশ পর্যন্ত গবেষণা হবে বাংলা ভাষায় যেখানে বাঙালি তাঁর স্ব সত্ত্বাকে জাগ্রত হওয়ার লুব্ধ প্রেরণা পাবে। বিশ্বের বুকে ছাপ রেখে যাবে বাঙালির প্রচেষ্টা। শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ানোর আহ্বান জানাই সবাইকে যাতে করে গর্ব করে বলতে পারি পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ বাঙালি যারা তাঁদের ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও রাজি। এই আত্মত্যাগ বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় শক্তি, সাহস আর প্রগাঢ় ভবিষ্যতের প্রেরণা। হৃদয়কে বারংবার আন্দোলিত করে রুখে দাঁড়ায় সমস্ত বাঁধা পিছনে ফেলে। বাঙালির প্রাণের স্পন্দন জাগ্রত হয়।
তাই আমার ভাষায় বলতে হয়,
"হামার ভাষা হামার গান
নাড়ি পোতা টান,
বাংলা মাওয়ের ছাওয়া বোঝে
ভাষার কত মান।"