বন্ধু ।। দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


স্কুলে পৌঁছতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছিল উৎসার প্রার্থনা সেরে ক্লাসে ঢুকেই দেখে প্রথম বেঞ্চের কোনায় ওর জায়গায় বসে আছে একটা নতুন মেয়ে পাশ থেকে কেয়া বলল ওকে নাকি ক্লাস টিচার মলি দি বসিয়ে দিয়ে গেছেন ওখানে

উৎসা ওকে তুলেই দিত, কিন্তু ঠিক তক্ষুনি মলি দি এসে ঢুকলেন ক্লাসে আর উৎসাকে ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতে নতুন মেয়েটার সঙ্গে মলি দি সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন, তৃণা দে নতুন এসেছে শহরে তৃতীয় বেঞ্চে বসে উৎসার গা জ্বালা করছিল ভালো জায়গাটা এভাবে হাতছাড়া করা যাবে না পরের পিরিয়ডেই মেয়েটাকে তুলে দিতে হবে মলি দি ওদের ইংরেজি পদ্য পড়াচ্ছিলেন আজ কিছুই আর মাথায় ঢুকছিল না উৎসার

ক্লাস শেষ করে মলি দি বেরিয়ে যেতেই উঠে গেলো তৃণার কাছে বেশ গম্ভীর গলায় ওকে বলল -''এই সিটটা আমার, আজ আসতে একটু দেরি হয়েছিল বলে তুমি বসে পড়েছ এবার পেছনে গিয়ে বসো আমি আর কেয়া এখানে পাশাপাশি বসি রোজ ''

মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল -''কিন্তু মিস আমায় এখানেই বসতে বলেছেন, আমি তো নতুন ভর্তি হয়েছি এই স্কুলে ''

রেগে উৎসা দু কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তক্ষুনি রত্না দি ঢুকে পড়লেন অঙ্ক ক্লাস নিতে এমনিতেই রত্না দি বেশ রাগি উৎসা আবার অঙ্ক একটু ভয় পায়, তাই তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় ফিরে গেলো টিফিনে মেয়েটাকে তুলে দেবে ভাবল

পরের ক্লাস বাংলা, এটা উৎসার প্রিয় ক্লাস সব সময় বাংলা মিস সবিতা দি ওর লেখা রচনার প্রশংসা করেন আগের দিন জলই জীবন রচনা লিখতে দিয়েছিলেন সবিতা দি আজ ওদের খাতা না দেখে আগেই তৃণা নতুন বলেই বোধহয় ওকে ডেকে বললেন এই ব্যাপারে কিছু বলতে মেয়েটা বোধহয় মুখস্থ করেই এসেছিল বেশ সুন্দর গুছিয়ে বলে ফেলল বিষয়টা নিয়ে উৎসার রাগটা ধীরে ধীরে বাড়ছিল

টিফিন হতেই উঠে এসে তৃণাকে বলল -''এবার ওখানে গিয়ে বসো এটা আমার জায়গা ''

তৃণা একবার ওর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ব্যাগ নিয়ে পেছনে চলে গেলো

কিন্তু আজ উৎসার কপালটাই খারাপ, ইতিহাসের রমা দি আসেননি বলে আবার মলি দি এলেন পরের পিরিয়ডে আর তৃণাকে পেছনে দেখে বললেন -''একি, তুমি পেছনে গেছো কেন ? সামনে এসে বসো উৎসা তুমি ওকে তুলে দিয়েছ ? সেইম অন ইউ!!''

-''না মিস, আমি নিজেই এখানে বসেছি প্রথম ক্লাসগুলো তো সামনে বসলাম এবার বসুক '' তৃণার উত্তর শুনে উৎসার রাগটা আরও বেড়ে যায় মেয়েটা বড্ড চালাক তো!! খালি মিসের কাছে ভালো সাজতে এসব বলছে

-''তোমার চোখে মোটা চশমা রয়েছে, তুমি সামনে এসে বসো '' মলি দির কথায় তৃণা আবার ব্যাগ নিয়ে উঠে আসল উৎসা নিজের ব্যাগ নিয়ে লাস্ট বেঞ্চে চলে গেলো মলি দি একবার আগুন ঝরা চোখে ওকে দেখে পড়ানো শুরু করলেন কোনও পড়াই উৎসার কানে ঢোকে না আর

 ক্লাস শেষে মলি দি তৃণাকে বললেন-" এটাই তোমার বসার পার্মানেন্ট জায়গা কেউ জোর করে তুলে দিলেও উঠবে না, বুঝেছ'' আরেকবার জ্বলন্ত চোখে উৎসাকে দেখে মলি দি বেরিয়ে গেলেন উৎসার আর ক্লাস করতে ভালো লাগছিল না

কয়েকদিনের মধ্যেই উৎসা দেখল তৃণা পড়াশোনাতেও বেশ এগিয়ে গেছে বাঁকুড়া থেকে এসেছে মেয়েটা চটপট সব পড়া ধরতে পারে সব মিসেরাই ওকে পছন্দ করছে ওকে টেক্কা দিতেই আজকাল উৎসা একটু বেশি পড়াশোনা করছে তবে তৃণা খুব শান্ত, দৌড়াদৌড়ি করে খেলে না, গল্পের বই পড়ে সময় কাটায় ওর বিশেষ বন্ধুও হয়নি কেউ উৎসা আজকাল ওধারের প্রথম বেঞ্চটায় বসে কেয়ার পাশের জায়গাটায় তৃণাই বসে উৎসা বরাবর ভালো টিফিন আনে, ওরা চার পাঁচ জন একসঙ্গে বসে টিফিন খায় ওদিকে তৃণা স্কুলের মিড ডে মিলে খেতে যায় বলে ওরা হাসাহাসি করে সুযোগ পেলেই ওরা তৃণার পেছনে লাগে

কবিগুরুর জন্মদিন পালন হবে বলে ওরা সবাই টিফিনের পর বাকি ক্লাসগুলো রিহার্সাল দিচ্ছিল উৎসা, কেয়া সবাই চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য করবে তবে তৃণাকে ওরা নেয়নি দলে একাই একধারে বসে ওদের প্র্যাকটিস দেখে উৎসা ভালো নাচ করে বলে প্রকৃতির ভূমিকা বেছে নিয়েছে, কেয়ার ভারি চেহারা বলে মায়ের রোল করছে বাকিরা পার্ট ভাগ করে নিয়েছে উৎসার বেশ আনন্দ হয়েছে, এবার দেখিয়ে দেবে তৃণার থেকে ওর মধ্যে অনেক বেশি গুন আছে যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা নিজেকে প্রমাণ করার প্রকৃতির নাচগুলো উৎসা খুব খেটে তৈরি করছে তবুও নাচের মিস মধুরাদি ওকে সেদিন সবার সামনে বলল -''উৎসা, মনের আনন্দ ফুটিয়ে তোলো তুমি নাচছ সুন্দর, কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে যে উচ্ছল ব্যাপারটা সেটা চোখে মুখে ফুটাতে হবে সেটাই মিসিং একজনকে জল খাইয়ে ওর মধ্যে যে তৃপ্ততা যে পুর্ণতা এসেছে সেটা দেখাও নাচ তুমি ভালো করো সবাই জানে ''

উৎসার গাল অপমানে লাল হয়ে ওঠে, আবার চেষ্টা করে কিন্তু মধুরাদির ঠোঁট কামড়ানো আর কুঞ্চিত ভ্রু দেখেই বোঝে হচ্ছে না দিন এগিয়ে আসছে

সেদিন রিহার্সাল রুমে গিয়ে দেখল তৃণা কবিতা বলছে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল তৃণার প্রতিটা উচ্চারণে প্রতিটা শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ পাচ্ছিল ওদের রাশভারী বড়দি কবিতা শেষে তৃণাকে জড়িয়ে ধরলেন  সবাই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ

চণ্ডালিকার দৃশ্যে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েও উৎসা তেমন কোনও প্রংশসা পেলো না সেদিন আর মাত্র দুদিন বাকি অনুষ্ঠানের উৎসা ভাবতে থাকে কি করে সবার সেরা হয়ে উঠবে কিছু একটা করতেই হবে ওকে বার বার বাড়িতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচগুলো করে কিন্তু মন পড়ে থাকে স্কুলের রিহার্সাল রুমে তৃণার থেকে বেশি ভালো কিছু করতে হবে ওকে এই চিন্তায় আর প্রকৃতি হয়ে উঠতে পারে না প্রকৃতির সরলতা ওর চেহারায় ফুটে ওঠে না কিছুতেই

অবশেষে অনুষ্ঠানের দিন চলে এলো সকাল থেকেই স্কুল সেজে উঠেছে ফুলে ফুলে বড় হলের মাঝে স্টেইজ, কবিগুরুর বড় ছবির সামনে খুব সুন্দর করে আলপোনা দিয়েছে কেয়া আর উৎসা ওরা দেখে তৃণা নিজে হাতে বেলকুড়ির মালা গেঁথে এনেছে কবিগুরুর জন্য ছবিতেও খুব সুন্দর করে চন্দন পরিয়েছে রাগ চেপে নিজে সাজতে যায় উৎসা জংলা ছাপার শাড়ি পরে উঁচু করে, মাথায় বুনো ফুলের মালা, খোপায় পালক গোঁজে রাংতার গহনা পরে ওকে একদম আদিবাসী মেয়ে মনে হচ্ছে বাহুতে উল্কি, চোখের কোনে কাজল এঁকে তৃপ্ত হয়ে নিজেকে দেখে গ্ৰীনরুমের আয়নায়

তারপর চুপচাপ এসে দাঁড়ায় স্টেইজের পাশের ঘেরা জায়গায় সব দিদিমণিরা ওর সাজের প্রশংসা করেছে ওকে দেখে এবার স্টেইজে নেচে দেখিয়ে দেবে সবার সেরা উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইছে ক্লাস সেভেনের মেয়েরা এরপর ফাইবের মেয়েদের একটা উদ্বোধনী নৃত্য তারপর বড়দির ভাষণ চণ্ডালিকা হবে সবার শেষে ঘেরা জায়গার একপাশে মাইকের তার, সাউন্ড বক্সের তার, লাইটের তার সব জটলা পাকিয়ে রয়েছে সেদিকে তাকিয়ে উৎসা একটু হাসে ওদের স্কুলের ক্লার্ক রবিদা ওসব দেখছে মাইকের বেস বাড়ানো কমানো, স্টেইজ খালি করা এসবের দিকে রবিদার কড়া নজর

বেশ সুন্দর এগোচ্ছে অনুষ্ঠান তৃণা এসে দাঁড়িয়েছে স্টেইজের পাশে স্কুল ড্রেস সাদা সালোয়ার পরা, চোখে সেই মোটা চশমা উৎসা মুখ ঘুরিয়ে নেয়

ক্লাস নাইনের দিদিদের পরিবেশনায় গীতিআলেখ্য শেষ হতেই মলি দি ঘোষণা করলেন -''এবার আপনাদের সামনে বিশ্বকবির একটি কবিতা আবৃতি করতে আসছে স্কুলের নবাগতা ছাত্রী তৃণা দে তৃণা নতুন এসেছে এই বিদ্যালয়ে আসুন ওর গলায় আমরা এখন শুনবো নির্জরের স্বপ্ন ভঙ্গ ''

 

তৃণা এগিয়ে গেলো স্টেইজে রবিটা ওর জন্য মাইকস্ট্যান্ড ঠিক করতে গেলেন উত্তেজনায় উৎসা উঠে দাঁড়িয়েছে কেয়া আর বাকি নাচের মেয়েরা স্টেইজের পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখছে উৎসা আড় চোখে দেখে ওকে কেউ লক্ষ্য করছে না, তৃণার গলা ভেসে আসছে মাইকে...... আস্তে আস্তে গলার জোর বাড়ছে, উৎসা একপা দু পা করে এগিয়ে গেছে মাইকের তার যেখানে গোঁজা সেখানে নবগুলো ঘুরিয়ে আওয়াজ বাড়াতে কমাতে দেখেছে এতক্ষণ তারটা খুলে দিলেই তৃণার গলা আর দর্শক শুনতে পাবে না একটানে তারটা খুলে দিতে হবে একবার ভরা হলে মাঝ মঞ্চে এভাবে কবিতা বন্ধ হলেই ওর মনোবল ভেঙ্গে যাবে

কিন্তু তারটা টানতে গিয়ে কি যে হল.... একটা জোরে ঝটকা, উৎসা ছাড়াতে পারে না নিজেকে ওদিকে বিকট একটা আওয়াজ হয়ে স্টেইজের আলোগুলো নিবে গেলো, তৃণার কবিতা চলাকালীন মাইক বন্ধ হতেই সবাই এদিকে তাকিয়ে দেখে উৎসা কারেন্ট খেয়েছে হাই ভোল্ট ওকে টেনে ধরেছে, কাঁপছে থরথর করে সবাই চিৎকার করে কিন্তু ওকে বাঁচাতে ছুটে আসে না কেউ রবিদা ছুটেছে মেইন অফ করতে অফিস ঘরে হঠাৎ তৃণা ছুটে এসে একটা জোরে লাথি মারে উৎসাকে, উৎসা ছিটকে পড়ে ওধারে মুহূর্তের মধ্যে হতচকিত সবাই কথা বলতেও ভুলে গেছে তৃণাই ছুটে গিয়ে উৎসাকে তোলে ভয়ে মেয়েটা তখনো কাঁপছে ততক্ষণে দর্শকদের ভেতর থেকে দুজন ডাক্তার ছুটে এসেছেন সবাই তৃণার দিকে তাকিয়ে, রত্নাদি বলেন -''তৃণা, তুমি ওকে ছাড়ালে কি করে? তোমার কারেন্ট লাগল না?''

 তৃণা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, তারপর নিজের ডান পায়ের সালোয়ারটা উঁচু করে তুলে ধরে বলে -''আমার এই পাটা এতদিন আমার দুর্বলতা ছিল এই পাটা দু বছর আগের একটা দুর্ঘটনায় বাদ যায় তার সঙ্গে আমার নাচ, খেলাধুলা সব শেষ হয়ে যায় আজ এই কাঠের পাটার জন্য আমি আমার বন্ধুকে বাঁচাতে পারলাম কাঠের পা বিদ্যুৎ কুপরিবাহী''

ওর উপস্থিত বুদ্ধিতে সবাই অবাক ততক্ষণে উৎসার বাবা মা এগিয়ে এসেছে উৎসার দু চোখে জল, লজ্জায় তাকাতে পারছে না কারোর দিকে

তৃণা বলে -''সরি উৎসা, লাথিটা বোধহয় খুব জোরেই মেরেছিলাম আমি আসলে কি করবো বুঝতে পারিনি তখন ''

 উৎসা ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়, বলে -'' আজ থেকে তুই আমার প্রিয় বন্ধু তোর লাথিটাই আমায় আজ নতুন জীবন দিয়েছে তার সঙ্গে অনেক কিছু শিখিয়েছে ''

-" আমি এই পাটা দেখাতে লজ্জা পেতাম এই পাটাকে লুকিয়ে রাখতাম, আজ এই পাটা কাজে লাগল '' তৃণার চোখেও জল

সব গুঞ্জন ছাপিয়ে বড়দির গলা ভেসে আসে, -''তাহলে এই আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য আমি কি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবো ? ''

-''না মিস, আমার একার জন্য কেন বন্ধ হবে অনুষ্ঠান আমি ঠিক আছি, আমি এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি প্রকৃতির অন্তরের আনন্দ আমি পারবো সেটা ফুটিয়ে তুলতে আরেক বার তৃণার আবৃতিটা হোক '' দৃঢ় গলায় বলে উৎসা মধুরাদি লক্ষ্য করেন মেয়েটার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে উচ্ছলতার রেশ, ব্যথা ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা

কবিগুরু তখন সবার অলক্ষ্যে মিটিমিটি হাসছেন।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।