৭ই মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণেই ছিল স্বাধীনতার ডাক ।। মো.সাজ্জাদ হোসেন

পাকিস্থানের ২৩ বছরের শোষণ জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিকামি মানুষের গণরায়ের প্রতিফলন ঘঠেছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। সত্তর সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। বাঙালি তার সমস্ত আবেগ ও ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিল গণরায়ের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের আস্থা ও ভালবাসার প্রতিফলন হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করেছিল। গণরায়ে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কল করার পরেও ১ লা মার্চ তা স্থগিত করেছিল। 

এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্থানের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পরেছিল। আইয়ুব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে যে জুলুমবাজ সরকার গঠিত হয়েছিল তার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল গণ আন্দোলন। বঞ্চিত মানুষের কষ্টের অবসানের জন্য আওয়ামী লীগের ডাকে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে পালিত হয়েছিল সর্বাত্মক হরতাল। সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছিল। কারফিউ জেনেও মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। সামরিক জান্তা বাংলার মানুষের উপর গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিল। সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল বাংলার মানুষ। 

মুক্তি পাগল জনতার মুক্তির নেশায় সাড়া জাগানো হরতাল শেষে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। হরতালের সফলতা ও অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বাংলার মানুষ চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পানে। এই পটভূমিতেই  ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ) জমায়েত হয়েছিল মুক্তিকামি জনতা। নেতার ডাকে সাড়া দিতে জেগে উঠেছিল কৃষক,শ্রমিক,ছাত্র জনতা।

 লোকে লোকারণ্য পুরো ময়দান পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। নিপিড়ীত নির্যাতিত মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঁশের লাঠি নিয়ে সেদিন জড়ো হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ,ছাত্র নেতাদের বক্তব্য ও স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল পুরো ময়দান। সকাল থেকে খন্ড খন্ড মিছিল এবং মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা স্লোগানে, স্লোগানে মুখরিত ময়দানে অপেক্ষার প্রহর ভেঙ্গে অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসে হাজির হলেন জনতার মঞ্চে।  তাইতো কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন-

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেঁটে,
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকজন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি;
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২.৪৫ মিনিট থেকে ৩.০৩ মিনিট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন তার অগ্নিঝরা ভাষণ। ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যেই ছিল স্বাধীনতার ডাক।

প্রত্যেক গ্রামে,প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরও দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা। 

২ মার্চ ছাত্র জনতার সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আ.স.ম আবদুর রবের মাধ্যমে পতাকা উত্তোলন এবং ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠের ভাষণের মাধ্যমেই বাংলার মানুষ জেগে উঠেছিল। ৭ মার্চের ভাষণ বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। জুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালি গর্জে উঠেছিল ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের হুংকার কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্থানি স্বৈরাচারী শাসকের মসনদ। সেইদিন ১০ লাখেরও বেশি  মানুষের কন্ঠে একসাথে উচ্চারিত হয়েছিল তোমার নেতা,আমার নেতা,শেখ মুজিব,শেখ মুজিব। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা,মেঘনা, যমুনা।স্বাধীনতা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বেছে নিয়েছিল সংলাপের অপকৌশল। কোন তালবাহানাই মুক্তিকামী মানুষকে রুখে দিতে পারেনি। সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে বীর বাঙালি শুরু করেছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আমি যদি হুকুম দিতে না পারি তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ভাষণ উজ্জীবিত করেছিল পুরো জাতিকে।৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার ডাক।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপোষহীন নেতৃত্বেই এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা। 

প্রভাষক,লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ

নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।