অবহেলা ।। আফছানা খানম অথৈ


আরিফ  বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। লেখাপড়া শেষ করেছে সবেমাত্র।বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।গ্রামের কলেজে আজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে।স্টেজে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করলো অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী জারা। আরিফ  মুগ্ধ নয়নে তা দেখল।জারা দেখতে খুব সুন্দরী, তার উপরে বোরকা পরে হিজাব পরেছে।তাকে খুব সুন্দর লাগছে।অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে সে।অনুষ্ঠান শেষ হলো।জারা বাড়ির দিকে রওয়ানা করলো।তার পিছু নিলো আরিফ।কিছুদূর যাবার পর দুজন যোগ হলো।কুশল বিনিময় পর্ব শেষ করে,দুজন পরিচিত হলো।আরিফ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।তাই কোনকিছু না ভেবে সরাসরি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো।জারা সরাসরি না করে।দিলো।পরক্ষণে আরিফ বলল,
জারা আমি কী তোমার অযোগ্য?
আপনি আযোগ্য হতে যাবেন কেনো?বরং আমি অযোগ্য।
কেনো?
কারণ আমি বিধবা।
মানে...।
মানে হলো,আমার বিয়ের এক মাসের মাথায় আমার স্বামী গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়।
ওহ্ কিছু না।আমি সেটা মেনে নেবো।
আপনি না হয় মানলেন,আপনার ফ্যামিলির লোকজন  মানলে তো?
সেটা আমি ম্যানেজ করবো।
আপনি রাজী থাকলে আজই আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
সত্যি বলছেন?
হুম সত্যি।
ঠিক আছে,আমার বাবার কাছে বিয়ের  প্রস্তাব পাঠান।

আরিফ তার বন্ধু অভিকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল।ফারুক মাস্টার প্রথমে রাজী না হলেও পরে আরিফের আগ্রহ দেখে ঠিক রাজী হয়ে গেলেন।তারপর আরিফ জারার বিয়ে দিলেন।আরিফ জারাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে অবস্থান করলো।তাকে দেখে পরিবারের লোকজন সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠল।কোথাকার কোন মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসল, এটা কী করে হয়?কেউ তাকে মেনে নিতে পারছে না।একমাত্র আরিফের বাবা গাফফার মাস্টার জারাকে বউ হিসেবে মেনে নিলেন।আদরের সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
মা তোমার নাম কী?
নাইমা খানম জারা
পড়ালেখা কতদূর করেছে?
বি এ অনার্স।
মাসআল্লাহ ভালো।মা তুমি ভিতরে যাও।
জারা কিছুটা স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলল।যাক অন্তত একজন হলেও তাকে মেনে নিয়েছে।
সত্য কোনদিন চাপা থাকে না।আপনা আপনি বেজে উঠে।জারা বিধবা এ কথাটা আরিফের পরিবারের লোকজন সবাই জেনে গেছে।তখনি এক তাল তুমুল কাণ্ড...।
আরিফের মা মাথা ঠুকে ঠুকে বলছে,
হায় হায় সর্বনাশ হয়ে গেল।এ কী করলো আরিফ!এমন একটা অলুক্ষণে মেয়েকে বিয়ে করলো।যার মুখ দেখা...।
গাফফার মাস্টার এগিয়ে এসে বলল,
কেনো কী হয়েছে?
কী হয়নি বলো?এই মেয়ে নাকি বিধবা।তার প্রথম স্বামী গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
তাতে কী হয়েছে?
কী হয়েছে মানে,আর রক্ষা নেই,এই মেয়ে প্রথম স্বামী খেয়েছে।এবার আমার ছেলেকেও খাবে।এই মেয়ে অপয়া,অলক্ষণে স্বামী খেকো,এর মুখ দেখাও পাপ।

কী সব আবল তাবল বলছ।
আবল তাবল নয়,সত্যি বলছি,এ মেয়ে আমার ছেলেকেও খাবে।আমি আজই তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব।
তিনি টেনে হেঁছড়ে জারাকে ঘর থেকে বের করে দিতে চাইছেন।তার সাথে যোগ হলো অন্য দুবউ তার মেয়ে জামাই।সবার এককথা জারা এ পরিবারে থাকলে সবার অমঙ্গল হবে।
একজন নারীর স্বামী মারা গেলে তাকে বিধবা বলে।শুধু তাই নয়, তাকে সবাই ঘৃণা করে,হেয় করে,ছোট করে কথা বলে।এমন কী কোন শুভকাজে যেতে তার মুখ পর্যন্ত দর্শন করা হয় না।করলে নাকি অমঙ্গল হবে এই ভয়ে।আর একজন পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে তাকে কোন উপাধি দেয়া হয় না।বরং তাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে সবাই।আর বিধবা নারীর বিয়ের কথাতো কেউ ভাবে না।কোথাও কোথাও যদি বিধবা নারী দ্বিতীয় বিয়ে করে সমাজের চোখে সে বিরাট অপরাধী হয়ে যায়।এই নিয়ে নানা জন নানান কথাবার্তা বলে।
অথচ ইসলামে বিধবা নারীদের বিয়ের কথা স্পস্টভাবে ঘোষণা করেছেন।চাইলে তারা সংসার করতে পারবে।এতে পাপ হবে না।বরং পূণ্য হবে।
আজ জারা বিধবা তাকে কেউ মানতে পারছে না।সবাই তাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখছে।কিন্তু গাফফার মাস্টার এসব মানছেন না।কারণ এসব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার।এসব মানা গুনাহের কাজ।হায়াত মউত আল্লাহপাকের হাতে। এতে মানুষের কোন হাত নেই।তাই তিনি গর্জে উঠে বললেন,
স্টপ আর একটা বাজে কথা কেউ বলবে না।জারা এ বাড়িতে থাকবে।সে এখান থেকে কোথাও যাবে না।
জারা বিধবা হয়েছে তো কী হয়েছে।সে খুব ভালো মেয়ে  রুপবতী,গুণবতী, নামাজী পর্দানশীন। আরিফ তাকে বিয়ে করে ভালো করেছে,খারাপ করেনি।
ভালো না ছাই।সে এ পরিবারে থাকলে সবার অমঙ্গল হবে।
দিন বদলে গেছে।এসব এখন কেউ বিশ্বাস করে না।তাছাড়া এসব কোরান হাদিসে নেই।সব মিথ্যে বানোয়াট গল্প।
জারার শ্বাশুড়ি কিছুতেই তা মানতে রাজী না।তার সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছে,অন্য দুবউ ও মেয়ে জামাই।সবাই এক সঙ্গে বলছে,
না না জারা কিছুতেই এ পরিবারে থাকতে পারবে না।
বড় বউ তুমি একথা বলতে পারো না। জারার জাগায় যদি আজ তুমি হতে তাহলে কী করতে?সাবধান এই নিয়ে আর কেউ বাড়াবাড়ি করবে না।বউ মা তুমি মন খারাপ করো না।আমি আছি তোমার পাশে।
জারার মনে কোন শান্তি নেই।সবাই তাকে অবহেলা করে চলেছে।কেউ তাকে ভালোবাসে না।খারাপ চোখে দেখে হেয় করে কথা বলে।কথায় কথায় বিধবা অপয়া বলে খোটা দেয়।সংসারের কাজকর্ম খুব গুছিয়ে করছে।তবুও কারো মন পাচ্ছে না।আজ তার বাসুরের মেয়ের বার্ষিক পরীক্ষা।সে সবাইকে সালাম করেছে।শুধু জারাকে ছাড়া।কারণ তাকে সালাম করলে,মুখ দর্শন করলে তার পরীক্ষা খারাপ হবে এইজন্য।অথচ জারা নামাজ পড়ে তার পরীক্ষা যাতে ভালো হয় এজন্য দোয়া করেছে।এমনিভাবে সংসারে কোন ভালো কাজের পূর্বে জারার মুখ দর্শন করা হতো না।তবুও সে মন খারাপ করতো না।সবাইর সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতো।শ্বাশুড়ি তাকে একটু ও ভালো চোখে দেখতে পারতেন না।সামনে পড়লে তাকে দূরদূর করতেন।একদিন জারা তার শ্বাশুড়ির জন্য চা বানিয়ে নিয়ে গেলেন।তিনি চা তো খেলেন না।চা সহ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন।চা পড়লো তার গায়ে।তার গা ফুড়ে গেল।সে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে।শ্বাশুড়িতো ধরলো না।বরং কটাক্ষ করে বলে,
মর পোড়ামুখি,অলক্ষণে অপয়া,তুই মরলে আমি বাঁচি।
জারা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।আর শ্বাশুড়ি মজা করছে।তার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য লোকজন ও তাল মেলাচ্ছে।
আরিফ এসে দেখে জারা মেঝেতে গড়াগড়ি করছে।কী  হয়েছে জিজ্ঞেস করতে মা বলল,
কিচ্ছু হয়নি,একটু চা পড়েছে।
তার মানে জারা পুড়ে গেছে।
তো কী হয়েছে।নো টেনশন, এক বউ মারা গেলে আরেক বউ পাওয়া যাবে।
কী বলছ মা।
ঠিক বলেছি।একটু ফুড়ে গেছে ভালো হয়ে যাবে।এ আর এমন কী?তুমি তাকে ধরবে না।
আরিফ মায়ের কথায় সাড়া না দিয়ে জারাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন।সে ঔষধপথ্য নিয়ে বাড়ি আসলো।
এভাবে জারাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে চলেছে আরিফের পরিবারের লোকজন।আরিফ এখনো বেকার। তাই অন্যায় জেনেও কোন প্রতিবাদ করতে পারছে না।তার দুভাবি ইচ্ছেমতো জারাকে অপমান করছে।শুধু তাই নয় তাড়িয়ে দেয়ার প্ল্যান করছে।
কানপড়া দিয়ে আরিফের মন ভারী করছে।আরিফ কিন্ত কারো কানপড়া আমলে নিচ্ছে না।সে জারাকে ভালোবাসে,এবং মৃত্যু পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকার ওয়াদা করেছে। জারাকে বুঝাচ্ছে,
জারা মন খারাপ করো না।আমি সুখে দু:খে তোমার পাশে আছি।মায়ের এই ব্যবহারের জন্য মাফ চাইছি।আমাকে ক্ষমা করে দাও।
প্লিজ আমার কাছে মাফ চেয়ে গুনাগার বানাবেন না।
গুনাগার হবে কেনো?
বলো আমাকে ক্ষমা করেছ?
আপনার উপর আমার কোন রাগ নেই।
সত্যি বলছ?
হুম সত্যি।
জারা একটু সহ্য কর,আমার চাকরীটা হয়ে যাক,আমরা  আলাদা বাসা নেব।এরপর আর কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলতে পারবে না।
অন্যায় জেনেও জারা কোন প্রতিবাদ করছে না।স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু হজম করে চলেছে।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে,
হে মহান রাব্বুল আলামীন,আমি পাপি বান্দা আপনার দরবারে দুহাত তুলেছি,
আমার সকল দোয়া কবুল করে নিন।আমার সকল দু:খ দূর্দশা দূর করে দিন।সবার মিথ্যে অপবাদ সহ্য করার ক্ষমতা দিন।হে রাব্বুল আলামিন আমি জানি না কিসে আমার মঙ্গল হবে,আপনি জানেন,আপনি যা ভালো মনে করেন আমাকে তাই দিন।আমাকে সুখী করুন।এই পরিবারের লোকজনকে হেদায়েত দান করুন।নামাজি বানিয়ে দিন।আমিন।।
এরফাঁকে কিছু সময় পার হলো।জারা মা হতে চলেছে।এসময় তার দেখভাল করার প্রয়োজন।পরিবারের লোকজনের উচিৎ তার দেখভাল করে।কিন্তু না সবাই তার বিপক্ষে।তার মা হওয়া কেউ মেনে নিতে পারছে না।সবাই তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপমান করে কথা বলছে।ঠিকমতো খেতে পরতে দিচ্ছে না।স্বামী বেকার তাই উঠতে বসতে সবাই ভাতের খোটা দিচ্ছে।যার কারণে জারার শরীর স্বাস্থ্য ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না।টাকার জন্য ভালো ডাক্তার দেখাতে পারছে না।সরকারী হাসপাতালে পাঁচ টাকার টিকেট দিয়ে কোন রকমে চেকাপ করাচ্ছে।ডাক্তার ভালো খেতে বলেছে,দুধ, ডিম, ফল, শাক সবজি।কিন্তু এসব পাবে কোথায়?
যেখানে পরিবারে টিকা থাকাটা অসম্ভব, সেখানে এসব পাওয়া দুষ্কর। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটে চলেছে জারার দিনগুলো।

এদিকে আরিফ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে,একটা চাকরীর জন্য।দিনের পর দিন ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে।কিন্তু তার চাকরী হচ্ছে না।কারণ আজকাল চাকরী হতে ঘুষ লাগে হ্যালো হ্যালো লাগে।আরিফের এসব নেই,তাই তার চাকরী হচ্ছে না।আজ ও একটা ইন্টারভিউ দিয়ে বাসায় ফিরেছে।এমন সময় বাবার ফোন এসেছে।সে রিসিভ করে সালাম দিতেই বাবা বলল,
আরিফ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আস?
কেনো বাবা?
বউ মার অবস্থা ভালো না।তাকে হাসপাতালে এনেছি।
আরিফ আর দেরী করলো না।ছুটে আসলো হাসপাতালে।ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেল।জারা ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান প্রসব করে মারা গেছে।আরিফ এসব সহ্য করতে পারলো না।কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছিত হয়ে পড়লো।
একজন নারী যখন গর্ভবতী হয়,তখন পরিবারের লোকজনের উচিৎ তার পাশে থাকে।তার দেখভাল করা,মানসিক সাপোর্ট দেয়া।আজ জারার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো। সবাই তাকে সাপোর্ট দেয়াতো দূরের কথা,তাকে "অবহেলা" করেছে প্রতিনিয়ত।যা সে সহ্য করতে পারেনি।যার কারণে তার অকাল মৃত্যু হয়েছে।শুধু জারার ক্ষেত্রে নয়, এমন দৃশ্য আমরা প্রায় পরিবারে দেখে থাকি।

1 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. Sottie amader somajer ei obostha😢😢

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।