‘আচ্ছা, কউ আমারে, পোলাডার মইদ্যে কি কোন খুঁত আছে? সরকারী ইঞ্জিনিয়ার, ফর্সা, লম্বা চওড়া, ভাল বংশ - আর কী কী লlগবো তোমাগো কও?” সালাম সাহেব যখন কথাগুলো বলছিলেন, তার কপালের শিরা ফুলে উঠছিল, পুরো মুখ লাল হয়ে উঠছিল।
‘আর কিছু লাগবো না, তয় এট্রু খোঁজখবর করন লাগবো।“ – চিচিঙ্গাগুলি নিরীক্ষা করতে করতে বললেন রওশানারা। বাছাই করতে জান বেরিয়ে যাচ্ছিল তার, প্রতিদিনই এই করে মানুষটা, হাবিজাবি দিয়ে ঘর ভরে ফেলে। বাজারে গেলেই লম্বা লম্বা কথা বলতে থাকে, আর সেই ফাঁকে যা-তা জিনিস ঢুকায় দেয় দোকানিরা থলের মধ্যে।
‘ খোঁজ-খবর তো কম করলা না, পুলা তো তোমাগো ঐদিকেরই, কিছু পাইলো তোমার ভাই-ব্রাদাররা?’- সালাম সাহেবের কণ্ঠে এবার মৃদু টিটকারির গন্ধ। মেয়ের বিয়ের আলোচনা রূপান্তরিত হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে।
‘ আমার ভাইয়েরা কিছু পায় না বইলাই তো বেবাক সহি হইয়া যাইতেছে না। শরীরের মইদ্যে রোগ-বালাই থাকবার পারে! হেইডা তো আর বাইরে থোন দেহন যায় না।‘ রওশানারা একটা পচা চিচিঙ্গা পাশের ছালাটাতে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলেন।
‘তাইলে আর কি! সরকারের কাছ থিকা ভাড়া কইরা গোয়েন্দা লাগায় দেও’ সালাম সাহেবের গলা আগের থেকেও চড়ে যায়।
রওশানারা জবাব দেন না, এক মনে বাজার-সদাই বাছতে থাকেন, আর ফাঁকে ফাঁকে বাতাসে সরে যাওয়া ঘোমটাখানি টেনে তোলেন। সরকারী গোয়েন্দা তার দরকার নেই, তার নিজেরই ভাতিজি আছে। একদিন কথায় কথায় বের হয়ে পড়েছিল যে, রোজিনা ছেলের বড় ভাবীর সাথে ক্লাস করেছে একই স্কুলে। আর তখনি এমনকি পাত্রের খাটের তলায় কী কী আছে, তাও খুঁড়ে আনার দায়িত্ব অর্পিত হয় রোজিনার উপর।
দুইদিন পর রোজিনা আচলের কাপড় ঘঁষতে ঘঁষতে যখন ছেলের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণনা করা শুরু করলো, রওশানারা তাকে থামিয়ে দিয়ে কণ্ঠটা চিকুন করে জানতে চাইলেন, “আগে ক, পোলার কুনো ব্যারাম আছেনি?” এক গাল হেসে দিয়ে রোজিনা মোটা কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিল, “ যেই হারে ব্যায়াম করে, ব্যারাম আইবো কোথ থনে? নিশ্চিন্ত থাহেন ফুবুয়াম্মা, পোলারে একটা কাশি দিতেও হুনে নাই কেউ কহনো। ‘’
এরপর রওশানারা রোজিনার সাথে আর কথা বাড়াননি, সোজা চলে গিয়েছিলেন শোবার ঘরে সালাম সাহেবের কাছে, আর আলনার কাপড় গোছাতে গোছাতে বলছিলেন “অহন কি হওনের বেলা? মাইয়ার বিয়া পাকাপাকি কেডায় করবো?”
এরপর ধুমধাম করে বিয়েটা হওয়ার মাত্র মাস তিনেক পার হয়েছে, রওশানারার কাছে খবর আসে, জামাই নাকি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বুকের ব্যথায় বেঁহুশ হয়ে। ঘরবাড়ি তালা দিয়ে সে সালাম সাহেবের হাত ধরে দৌড়ে যখন হাসপাতালটাতে পড়ে, তখন ডাক্তার রোগী পরিদর্শনে এসেছিলেন। জরুরী বিভাগের চিকিৎসা শেষে জামাই ততক্ষণে কেবিনে স্থানান্তরিত হয়েছে। ডাক্তার যতই দুশ্চিন্তা না করতে না বলেন, ডাক্তারকে তিনি আরো বেশী করে ধরে রাখেন, “কিন্ত তার বাড়ির লোকজন যে বিয়ার আগে কইছিল, অসুখ-বিসুখ তো দূরের কথা, কোন লক্ষণও দেখা যায় নাই কহনো।“
“ লক্ষণ না থাকলে যে অসুখ হবে না, তা নয়। কোন উপসর্গ না থাকাটাই বরং বিপদজনক। অসুখ থেকে বাঁচতে হলে তাই লক্ষণের অপেক্ষায় থাকা যাবে না, শুরু থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আচ্ছা, আপনার জামাই কি কোন কারণে মানসিক চাপে ছিলেন? মানে, অফিসের প্রেসার? কারো সাথে কোন দ্বন্দ্ব?”
‘না, আমার জামাইয়ের তো আত্মীয়-স্বজন সবার লগেই সুসম্পর্ক…অফিসেও হুনছি, বেক্কলেরই প্রিয়।‘ উত্তরটা দিতে দিতে প্রমাদ গণেন রওশানারা। সম্বন্ধটা পাকা হওয়ার পরেই টের পেতে শুরু করছিলেন, তার জামাইয়ের আত্মীয়ের বহর অনেক লম্বাচওড়া। কথাটা আগে খোলসা করে নাই বলে রোজিনার দিকে যখন তেড়ে গিয়েছিলেন, খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সে, “আত্মীয়স্বজন বেশী থাকা তো ভালা, ফুবুয়াম্মা! আমার বইনের সেবাযত্নের অভাব হইব না। আপনি একদম চিন্তা কইরেন না, জামাইয়ের ঘরে যাওয়ার আগেই নিয়ম- কানুন বেবাগ হিগাই দিমুনে!“
ডাক্তার কোন কথা না বলে প্রেসক্রিপশান লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নীরবতা ভেঙে দেন রওশানারা, “ব্যাধিডা কি ধরতে পারছেন, স্যার?”
‘ব্যাধি-ট্যাধি কিছু না। উপসর্গ বলতে পারেন। তবে কেয়ার না নিলে বিপদ হতে পারে। জামাই যেন মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলবেন আপনার মেয়েকে।“
ডাক্তারের রুম থেকে ‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ কথাটা ঘুরছিল রওশানার মাথায়। সালাম সাহেবকে বিষয়টা পাড়তেই, পত্রিকার পাতাটা থেকে মাথাটা বের করে সোৎসাহে বলতে লাগলেন, “হেইডা বুঝতে হইলে একটা অসুখের লক্ষণ-আলা পোলার লগে তোমার ছোড মাইয়াডার বিয়া দিতে হইব। দেখবা যত্নের চোডে রোগ ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবো না, আর লক্ষণ লক্ষণই থাইকা যাইবো!”
স্বামীর দিকে একটা কঠোর দৃষ্টি হেনে যখন জামাইয়ের কেবিনে ঢুকলেন রওশানারা, বড় মেয়ে সুমি কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। মেয়ের চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে , “আরে বলদা না কি? ডাক্তারই তো কইল, জামাইয়ের কোন অসুখ নাই। একটা উপসর্গ খালি!“ হঠাৎই একটা কাশি বিষ্ফোরণ ঘরটাতে। প্রথমে কিছুটা কেঁপে উঠলেও দ্রুতই সামলে নেন রওশানারা, আর হাসিমুখে বলতে থাকেন মেয়েকে, “ কি চেতা, তেজা জামাই আমার দেখছস্!! বাবাজির এক কাশিতে শুধু কেবিন না, হাসপাতাল সুইদ্ধা কেমনে কাঁইপা উঠলো!“
সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
মোহাম্মদ কাজী মামুন, জন্ম ফরিদপুরে। পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা। তবে মাদারিপুর জেলার শিবচর উপজেলায় অবস্থিত নানাবাড়ি্তেই শৈশবের আনন্দমুখর সময় বেশী কেটেছে। এসএসসি আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, এইচএসসি ঢাকা কলেজ, বিবিএ ও এমবিএ (অনার্স) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং ডিপার্ট্মেন্ট থেকে সম্পন্ন হয়েছে। এমবিএ পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই একটি প্রাইভেট ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগদান, বর্তমানে একটি ব্যাংকের শাখা-প্রধান হিসেবে কর্মরত। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আর্থিক বিষয়াদির উপর আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় কিছু ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বাবা জাজিরা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বাবার একটি ব্যক্তিগত ছোট লাইব্রেরী ছিল যার বই-পাঠ শৈশবেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে, আর কৈশোরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যোগযোগ সেই সাহিত্যপ্রেমকে আরো উস্কে দেয়। এখন পর্যন্ত কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। দিবারাত্র নানান ভাবনা মস্তিষ্ককে আলোড়িত করে রাখে, লেখালিখির মাধ্যমে যাপিত সমাজ-জীবনে যৎসামান্য ভূমিকা রাখার আকাঙ্ক্ষা বাসা বেঁধে থাকে মনের গহীনে।