লক্ষী ভান্ডার ।। স্বপন জায়দার


হুগলী মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে রুচিরার তার সাথে প্রায়ই দেখা হয়। দু'জনের দেখা হলে হাত ধরাধরি করে সেই ছোটবেলার মতোই বাড়ি ফেরে । যদি কারোর স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয় তাহলে একে অপরের জন্য  অপেক্ষা করে। মাদ্রাসা পথ দিয়ে ফেরার পথে সেদিন মনিরুলের সাথে দেখা মনিরুল রুচিরার চাচার ছেলে অর্থাৎ ভাই। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,"  কি রে রুচিরা এখানে দাঁড়িয়ে?  কখন বাড়ি যাবি চল্ । "

 রুচিরা বলে ওঠে,"  সময় হলেই যাব আর তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে না কি? 

মনিরুল রেগে যায় রেগে গিয়ে বলে, " আজ চাচাকে গিয়ে বলে আসবো। তুমি রোজ মাদ্রাসার ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকো । 

রুচিরা হেসে ওঠে বলে," যা যা বল্   বাড়ির সবাই জানে, আমি কার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। কোন লাভ হবে না।" মনিরুল অপমানিত হয়ে চলে যায়।

         কিছুক্ষণ বাদে রুচিরা  কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ, রুচিরর চোখ দুটো আটকে দেয়। সাথে সাথে রুচিরা বলে ওঠে, " ছেড়ে দে ছেড়ে দে আমি তোর হাতের গন্ধে আমি বুঝতে পেরেছি।" 

চোখের উপর থেকে আঙ্গুলগুলো সরে যেতে উত্তর দেয় রুচিরা ," কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্য। "

-" কি করব বল?  আমার ইচ্ছা মতন তোর ইচ্ছা মতন তো স্কুল ছুটি হয় না। কুত্তা। সরি কুত্তি হবে ।" 

রুচিরা কৃত্রিম ভালোবাসা বাগান মাখানো রাগ করে বলে ওঠে ,"তুই আমাকে কুকুর বললি ?"

সে বলে ওঠে, " বেশ করেছি। তুই গন্ধ শুকে বুঝতে পারিস আমি এসেছি তাহলে তুই কুকুর না তো  কি ? "

কৃত্রিম রাগারাগি অভিমানের পর দুজনে হাঁটতে শুরু করে। দুই বান্ধবী, রুচিরা ও অঞ্জনা।

যে  মেয়েটির নাম অঞ্জনা,   সে মাদ্রাসা থেকে একটু দূরের স্কুলে পড়ে বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়।

অঞ্জনা  নবম শ্রেণীর ছাত্রী । দুজনেই হেঁটে হেঁটে বাড়ির পথে আসে । বাড়ি বলতে ছোট্ট চালা ঘর ।

 দুই বান্ধবীরই অভাবের সংসার। অঞ্জনার বাবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আখের রস বিক্রি করে। এখন যে ইঞ্জিন লাগানো গাড়িগুলো বেরিয়েছে তা কেনার ক্ষমতা তার নেই। তাই সে ট্রলি ভ্যান এর উপর হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেশিন দিয়ে মানুষের হাতে তুলে দেয় আখের রস। মা বাবা ঠাকুমা আর ছোট ভাইকে নিয়ে অঞ্জনাদের সংসার অপরদিকে রুচিরা একমাত্র মেয়ে তার বাবা জুট মিলে কাজ করেন । 

দুই বান্ধবী চলতে থাকে  হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অঞ্জনা তুই রোজা রাখিস? রোজা জিনিসটা কিরে? জানতে চায় অঞ্জনা ।

রুচিরা বলে ওঠে এই এখন অর্থাৎ  এখন চলছে রমজান মাস। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মাস। এই সময়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রোজা অর্থাত্‍ উপবাস রাখেন। একমাস ব্যাপী উপবাস শেষ হয় চাঁদের দেখা পেলে। দীর্ঘ রমজান মাস অন্তে পালিত অনুষ্ঠানটি হল ইদ-উল-ফিতর। এদিন নানা ধরনের আকর্ষণীয় খাবার খাওয়া, নতুন পোশাকের সঙ্গে আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়।

এই একমাস মুসলিমরা দিনের বেলা কোনও খাবার বা পানীয় গ্রহণ করতে পারবেন না। ধূমপান করা ও এই সময় সম্পূর্ণ বর্জনীয়। অর্থাত্‍ এই একমাস শুদ্ধ পবিত্র ভাবে সময় কাটিয়ে অতীতের যাবতীয় পাপ, কর্মফল মুছে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানান ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। এই সময় খারাপ কথা, খারাপ চিন্তা করাও বারন কোরাণে। এই সময় ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এমনকি মিথ্যে কথা পর্যন্ত বলেন না।

রমজান মাসের প্রতি দিন সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত - এই সময়টা সম্পূর্ণ উপবাস করাই ধর্মীয় প্রথা ইসলামে। খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই সারাদিনের মতো খাওয়া-দাওয়া করে নেন মুসলিমরা। একে বলে শুহুর। আবার সূর্যাস্তের পর যে খাদ্য গ্রহণ করা হয়, ইসলামি মতে তাঁকে ইফতার বলা হয়। ইফতারে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে অনেক সময় একসঙ্গে খাবার খেয়ে থাকেন মুসলিমরা। ইফতার উপলক্ষ্যে এই এক মাস নানা রকম স্পেশাল ডিশ রান্না করা হয়ে থাকে।

হঠাৎ রুচিরা তার কথা থামিয়ে বলে ওঠে," শোন এবার একটা ইফতার পার্টিতে তোকে আসতে হবে,কিন্তু  …. তাছাড়া পরবের দিনও  তোর নেমন্তন্ন রইল."

আবেগের বশে কথাটা বলে রুচিরা থমকে যায় । মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা রমজান মাস শুরুর ঠিক তিন চার দিন আগে বাবা হঠাৎ আব্বা। কাজ থেকে ফিরে এলেন আম্মা জিজ্ঞেস করল,"  কি হয়েছে,? "

 আব্বা বলে ওঠেন,"  ভালোই হলো আমিনা , কাল থেকে আর যেতে হবে না ছুটি রমজান মাসে উপোস থাকতে হয় ফলে কোন অসুবিধাই হবে না।"  রুচিরার আম্মা বোকার মতো প্রশ্ন করে। " মানে ?"

আব্বা বলে ওঠে ধর্মঘট জুটমিল ধর্মঘট।

হঠাৎ রুজিরার কথায় ভাবনায় বিকট শব্দ দানব ডিজে বক্স  বাজাতে বাজাতে একদল লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ভেসে আসছে বিকট শব্দ দানব ডিজে বক্স বাজানোর শব্দ।  একটা মিছিল। তাদের দিকে এগিয়ে আসছে । অঞ্জনা রুচিরার হাতটা শক্ত করে ধরল। সামনে দিয়ে কতগুলো পুলিশ আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল । একজন পুলিশ কাকু বলল," তোমরা স্কুল থেকে ফিরছো একটু দাঁড়িয়ে যাও। শোভা যাত্রা টা চলে যাক । তারপর রাস্তা পার হয়ে

 যেও "

ওরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দুইজন।

শোভাযাত্রার  সামনে কত গুলো পবিত্র পোষাক পরা নেতা গোছের লোক ধীর পায়ে  এগিয়ে চলেছে পেছনে শব্দ দানব বেজে চলেছে, পুলিশ দু পাশে পাহারা দিচ্ছে আর বক্সের পেছনে বেশ কিছু উন্মুক্ত ছেলেরদল  চোখে কালো চশমা, মাথায় ফেট্টি , হাতে গদা, তরবারি, ত্রিশূল,  বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলছে আর জয়ধ্বনি দিচ্ছে। 

অঞ্জনার মনে পড়ে গেল আজ রাম নবমী তারই শোভাযাত্রা এটা। মিনিট দশের বাদ সবকিছু শান্ত হয়ে এলো রুচিরা বলে ওঠে আমাদেরও এরকম একটা অনুষ্ঠান হয়। হাসান হোসেন । তারপর তারা দুই বান্ধবী মিলে বাড়ির পথে পা বাড়ায় ।  বাড়ির সামনে গিয়ে অঞ্জনা থমকে যায় একি একটা এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে কেন ? অবাক হয়ে যায় অঞ্জনা ও রুচিরা ।   দৌড়ে ঘরে ঢুকে যায় অঞ্জনা । মাকে প্রশ্ন করে। কি ব্যাপার মা?    মা কেদে বলে ওঠেন ,"তোমার ঠাকুমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে" তোমার বাবা আর আমি যাচ্ছি। তুমি আর ভাই ঘরে থেকো। "

রুচিরার  আব্বা  দৌড়ে চলে আসে বলে ওঠে,  " কি হয়েছে বৌদি?"  

ব্যাপারটা বুঝে বলে ওঠে আপনারা হাসপাতালে যান আমি আসছি , দূরে আজানের সুর ভেসে ওঠে বাতাসে । নামাজ শেষ করেই হন্তদন্ত হয়ে সাইকেল নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় রুজিরার আব্বা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।



                           (২)


অঞ্জনা ঠকঠক করে দরজায় শব্দ করে দরজা খুলে যায়। দরজার ভিতর প্রান্তে দাঁড়িয়ে রুচিরার মা, আম্মা।তিনি বলেন, "আরে অঞ্জনা এসো …এসো। রুচিরা দেখ কে এসেছে! এসো , তারপর তোমার ঠাকুমা এখন কেমন আছেন ? অঞ্জনা বলে ওঠে ,"ভালো  ভালোই আছেন । ৭-৮ দিন হলো । সময় পাচ্ছি না রুচিরার সাথে দেখা করার , তাই চলে এলাম। বেশ করেছি তোমাকে আবার সময় করে আসতে হবে কেন, যখনই  ইচ্ছে আসবে। "

অঞ্জনা বলে ওঠে , সত্যি কাকিমা সেদিন যদি কাকু না হাসপাতালে সঠিক সময় পৌঁছাতেন। তাহলে হয়তো ঠাম্মাকে আর ফিরেই পেতাম  না। "

রুচিরার মা বলে ওঠেন ," ছি ছি ও কথা বলছ কেন?  মানুষেরই কর্তব্য মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। 

এমন সময় নিজের আব্বা একটা ছোট্ট প্লাস্টিকে পড়ে সামান্য কিছু ফল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে । রীতি মতন অঞ্জনা কে দেখে একটু ঘাবড়ে যান, লজ্জাও পান তবুও তার দারিদ্রতা কে ঢেকে হাসিমুখে বলে ওঠে আজকে তোমাকে কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট ইফতার পার্টিতে বসতে হবে। বসো। আমরা আজকে ইফতার করব। 

আস্তে করে অঞ্জনা তার ব্যাগ থেকে খেজুর ,আপেল আর কিছু সামান্য ফল বাগান বের করে রুচিরার মার হাতে দিয়ে বলে রুচিরা আমাকে অনেক আগে ই আসতে বলে ছিল। রুচিরার মা ফলের প্লাস্টিক গুলো নিয়ে অন্য ঘরে দিকে  পা বাড়ায়।

        

                             (৩)


আকাশে গোল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আজ  । কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। বাতাসে ভাসছে নারকোল   নাড়ুর গন্ধ । বাড়ির উঠানে দরজায় সাদা রঙের আল্পনায় ভরে উঠেছে বাড়ি  গুলো। লক্ষ্মী পূজার আয়োজন । দশমীর পর বাঙালির আর এক উৎসব  কোজাগরী লক্ষ্মী পূজো। অঞ্জনা দে বাড়ি কোন নারকেল গাছ নেই তাই প্রতি বছর লক্ষ্মী পূজার পর একটা মাটির লক্ষ্মী ভান্ডার কিনে যাবে তাতে বেশ কিছু পয়সা রাখা হয়। এবং পুজোর দিন সেটা ভেঙে নারকোল কিনে নিয়ে আসা হয়। এটাই দীর্ঘদিনের রীতি চলে আসছে। এমন সময় ঠাকুরমার চিৎকার করতে করতে অঞ্জনার বাবা নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে এলেন," এত বড় সর্বনাশ অঘটন ঘটালে কে আমি জানতে চাই ? হাত দেওয়ার আগে আমাকে একবার জানালি না তোরা"।

 অঞ্জনা অবাক হয়ে যায় প্রশ্ন করে," কি হয়েছে ঠাম্মা ?"

আমি জানতে চাই আমার অনুমতি ছাড়া লক্ষ্মীর ভান্ডার কে ভেঙেছে?"

 অঞ্জনার মাথা নিচু করে বলে ওঠে," আমি ভেঙেছি ঠাম্মা। আমার দরকার ছিল তাই। আমি ওই পয়সা দিয়ে কিছু ফল কিনেছিলাম, একদিন। তখন তুমি হাসপাতাল থেকে ফিরেছো সবে মাত্র

 বলবো বলবো করে আর বলা হয়নি , বাবার কোন দোষ নেই। আমাকে যা বলার বলো।"

 ঠাকুমা চুপ করে গিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে," এখন নারকোল টা কেনা হবে কোথা থেকে? নাড়ু বানাবো কি দিয়ে?"

 এমন সময় অঞ্জনাদের দরজায় আওয়াজ হয়। অঞ্জনা দৌড়ে গিয়ে দেখে রুচিরা দাঁড়িয়ে। হাতে একটা ব্যাগ। ভেতরে আয় বলে ডেকে নিয়ে যায়। রুজিরা আজ লক্ষ্মীপূজো পুজো হবে প্রসাদ খাবি তারপর যাবি। রুজিরা কেমন কিন্তু কিন্তু করে ওঠে। অঞ্জনা বলে ,"তোদের পরবে তোদের ইফতার পার্টিতে আমি যাই তুই কেন আমাদের লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ খাবি না।

রুজিরা বলে ওঠে ," না আমি সেজন্য আসিনি এই …."

বলে প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দেয় ।প্যাকেটের ভেতর থেকে চার-পাঁচটা নারকোল তখন উঁকি মারছে। ঠাকুমাকে নারকেলগুলো  দিতে যায়। ঠাকমা বলে ওঠেন, ওগুলো বাইরে রাখ ওটা মুসলমানের হাত ছোঁয়া  ফল পুজো হবে না। " অঞ্জনা বলে ওঠে, ঠাকুমা বাজার থেকে তো ফুল কিনে আনি আমরা সে ফুলকে কোথা থেকে এনে দিচ্ছে কার হাত হয়ে আছে তুমি জানো ? যে ধুপকাঠি মোমবাতি ব্যবহার করছি সেটা কে বানিয়েছে ? তুমি জানো কার হাতের ছোঁয়া আছে তাতে ? 

আজকে তুমি এই যে হেঁটে চলে পুজো করছো সেদিন যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলে সারাদিন রোজা রেখেও উপোস থেকেও তোমাকে এ পজেটিভ রক্ত রক্ত দিয়েছিল কে জানো ওই মুসলিম কাকু রুচিরার  বাবা ,আব্বা। 

 ঠাকুরমা নারকোল গুলো নিয়ে কোন কথা না বলে ঠাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে যায় গঙ্গা জলের শিশিটা খুঁজতে থাকেন।



স্বপন জায়দার

রবীন্দ্রনগর, চুঁচুড়া, হুগলী ।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।