ছবি : যুগান্তর
তখন গ্রামগুলোতে যুবকেরা নাটক করত। মাস ব্যাপী রিহার্সাল হত।আমরা রাত জেগে জেগে সেই সব রিহার্সাল দেখতাম। আমাদের দেখার বিষয় ছিল একটাই। তখনও গ্রামের শীতকালীন নাটকগুলিতে প্রিন্সেসদের আমদানি হয় নি। সুদর্শন তরুনেরাই মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করত।এজন্য মেয়েদের কণ্ঠ অনুশীলন করতে হত।আমাদের দেখার বিষয় ছিল ওটাই। কে কীভাবে মেয়েদের অভিনয় করে।
আমাদের বন্ধু আবদুল আজিজ সেবার দরবার এ আম নাটকে রওশনআরা চরিত্রে অভিনয় করছিল।আমরা সন্ধ্যা হতেই মাটির সানকিতে ভাত খেয়ে স্কুলের মাঠে চলে যেতাম রিহার্সাল দেখতে। সে নাটকের পরিচালক ছিল শামছুল হক আর প্রমটার ছিল সাদা মিয়া।
আবদুল আজিজকে পরিচালক বলত,মেয়েরা শুধু বাম হাত নেড়ে কথা কয়।মেয়েদের সারা শরীর কথা কয়।মেয়েদের চোখও কথা কয়।নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে পরিচালক সেগুলো দেখাত।আবদুল আজিজ কথা শুরু করতেই তার ডান হাত নাড়াতে থাকত।আর তার ফাটা বাঁশের মত গলায় অদ্ভুত আওয়াজ করে সংলাপ বলত।এটাই ছিল আমাদের আমোদের মূল কারণ।
যা হোক সাতাশে পৌষ বৃহস্পতিবার মণ্ডলবাড়ির আঙিনায় দরবার এ আম মঞ্চস্থ করার দিনক্ষণ ঠিক হল।ভাদুমিয়া কেরোসিনের টিন পিটিয়ে হাটে বাজারে প্রচারে নেমে পড়ল। নির্ধারিত দিনের আগে থেকেই মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় ফকির পাড়া থেকে মেক আপ ম্যান বাঁশি মিয়া চলে এসেছে।এসেছে হ্যাজাক বাতির কারিগর মুক্তার আলি।আর ইসলামপুর থেকে চলে এসেছে ব্যান্ড পার্টি।
হ্যাজাকের ঝকঝকে আলোয় মঞ্চ মাতোয়ারা। কালো কালো লোকগুলোকে ফকফকা সাদা দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকে বাঁশের বাউন্ডারি দিয়ে মেয়ে দর্শকের জায়গা আলাদা করে রাখা হয়েছে।
রাত দশটা নাগাদ নাটক শুরু হবে।আমরা আটটার মধ্যেই তাড়াতাড়ি করে চলে যেতাম।সেটা নাটকের প্রতি আগ্রহ নয়।লোকে বলে নয়া জোয়ারের পানির তেজই থাকে অন্যরকম। তখন আমাদের মনে শরীরে নয়া জোয়ারের পানি ঢুকেছে। তাই মেয়েদের আসনের কাছাকাছি বসার বাসনা সন্ধ্যা হতেই মনে তীব্রতর হত। তড়িঘড়ি করে গিয়ে মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত আসনের কাছাকাছি করে বসে পড়তাম।
রাত দশটায় ব্যান্ডপার্টি বেজে উঠল।হাওয়ামে উড়তা যায়ে,মেরে লাল দোপাট্টা গানের সুরে কনসার্ট। আমাদের মন ফুরফুরে। আমাদের সহপাঠিনীরা এসে সবাই বসে পড়েছে।প্রতিদিন একসাথে স্কুলে গেলেও ওদের ভাল করে দেখার সৌভাগ্য হয় নি।আজ হ্যাজাক বাতির ধবধবে আলোতে আমাদের আলকাতরা মর্জিনাকেও ফর্সা দেখা যাচ্ছে। কী তেলেসমাতি এই হ্যাজাক বাতির।
রাত কাঁটায় কাঁটায় দশটায় নাটক শুরু হল।আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত নাটক দেখছি আর আড়চোখে মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছি। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে এই মাট্যমঞ্চের বাইরে আর কিছু নেই।আছে শুধু নাটকের আনন্দ আর আমাদের মুগ্ধতা।
হ্যাজাক বাতি হঠাৎ বিগড়ে গেল।রাজ্যের অন্ধকার নেমে এলো।তখনও দর্শকরা অসভ্যের মত চিল্লাচিল্লির রুচি রপ্ত করে নি। এখন যেমন কারেন্ট চলে গেলেই ধুন্ধুমার অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন দর্শকরা জানতো হ্যাজাক বাতি নামিয়ে পাম্প করতে হয়।স্বল্প সময়ের জন্য বসে তাই ধৈর্যের সাথে সবাই বিড়ি চুরুট টানত।খুচরো গালগপ্পো করতো।
এই অন্ধকারের মধ্যে কার যেন একটা নরম হাত এসে আমার কাঁধ স্পর্শ করল।আমি ফিরে বসতেই আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে লাগল।আমি কোন কিছু না বুঝেই তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।অন্ধকারে কাচারি ঘরের ধার দিয়ে পূর্ব দিকে ফজলু মিয়ার গোয়াল ঘরের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
-- কে? আমাকে এখানে টেনে আনলে কেন?
-- বুদ্ধু,আমি ঝর্ণা। খুব তো চিঠি লিখিস।কোন দিন তো একটা কথাও কস না?
সত্যি বলতে কি আমি মাঝ রাতে পড়া শেষ করে ছন্দমালা পড়তাম।সেগুলো উপযুক্ত জায়গায় ব্যবহার করার জন্য সংকেত দিয়ে চিঠি লেখতাম।যেমন প্রিয় ঝ,। আর শেষ করতাম ছন্দ মালার ছন্দ দিয়ে।
তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা তেঁতুল বড় টক
তোমার সাথে প্রেম করা আমার বড় শখ।
এরূপ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমার হাঁটু,বুকের মধ্যে কলিজা এমনভাবে কাঁপতে লাগল যে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল ঘটনা না আবার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।
ঝর্ণার মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম।আসলে জীবনের প্রভাত বেলায় এত সহজে এমন অমূল্য প্রাপ্তিতে আমি দিশেহারা। ঝর্ণার সাথে কথা বলতে আমার জিহ্বা শুকিয়ে যাচ্ছিল। শব্দ উচ্চারণ করতে পাচ্ছিলাম না। আমার এই দিশেহারা অবস্থায় ঝর্ণা আবার আমার হাত ধরল।সে কোন কথা না বলে আমাকে পগাড়ের মধ্যে দিয়ে পূর্ব দিকে আখ খেতের ধারে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।আমিও অন্ধের মত তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।
আখ খেতের ধারে এসে ঝর্ণা দাঁড়াল।তখন হ্যাজাক বাতি ঠিক হয়ে গেছে। আর আমার কানে ভেসে আসছে রওশন আরার ডায়লগ। আখের পাতা থেকে শিশির কণা ঝরে গায়ের কাপড়ে এসে পড়ছে।আমার কাছে ঝর্ণার সঙ্গ অপেক্ষা নাটকের আকর্ষণ তীব্রতর হচ্ছে।
শীতসিক্ত কুয়াশায় দাঁড়িয়ে ঝর্ণার অস্তিত্ব কতক্ষণের জন্য বিস্মৃত হয়েছিলাম।হঠাৎ যখন পূর্ব দিক থেকে কিসের একটা ঝনঝন শব্দ শুনতে পেলাম তখন আমি উচ্চস্বরে ঝর্ণাকে ডাকলাম।আশ্চর্য, আমি যতই জোরে জোরে ঝর্ণাকে ডাকছি ততই আমার কণ্ঠ কে যেন চেপে ধরছে।আমার কণ্ঠ থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম না কী হচ্ছে। আমি কী শীতে আড়ষ্ট হয়ে গেছি? না কি ভয় পাচ্ছি। ভয় তো আমি কখনোই পাই না।সেই ছোট বেলায় আমাকে পরীর দল যে রাতে অপহরণ করেছিল সেদিন হতেই আমার মন থেকে ভয় তিরোহিত হয়েছে। কিন্তু ঝর্ণা! কোথায় গেল সে।
আমি পশ্চিম দিকে হাটতে চেষ্টা করলাম।হাঁটতে পাচ্ছি না। পা দুটো মনে হয় কিছু একটার সাথে আটকে রয়েছে।
আচমকা গরম বাতাসের হল্কা এসে লাগল গায়ে। সাথে সাথে সাত আটটি মুখ আমার চারদিকে দেখতে পেলাম।জটাজুটধারী মাথা।প্রলম্বিত কেশরাশি মেঘের মত অগোছালোভাবে মাতাল।বিশ্রী রকম নাসিকার উপর এক জোড়া চোখ।চোখ থেকে তীব্র লাল আলো ঠিকরে পড়ছে। মুলার মত ধবধবে সাদা দাঁতগুলো বিকৃত করে হাসছে।এই সাত আট জনের চোখের আলো আমার চোখে পড়ছিল।আমি আলোর তীব্রতায় বেদিশা হয়ে যাচ্ছিলাম। তাদের দাঁত বের করা বিশ্রী হাসি আর কর্কশ শব্দে মনে হচ্ছিল ইসরাফিলের শিঙা বুঝি বেজে উঠেছে।
ওরা আমাকে বেষ্টনী দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ছে।কেউ কেউ আমার একেবারে কাছে এসে ভেংচি কাটছে।কেউ বা আমাকে নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করছে।আবার কেউ বা গান করছে। আর তাদের গানের সুরে আমার হৃদপিণ্ডে ভূমিকম্প হয়ে যাচ্ছে।
ওদের একজন আমাকে পাজাকোলে তুলে কোনদিকে যে যেতে লাগল আমি ঠাহর করতে পাচ্ছি না। এ পর্যন্ত আমি টের পাচ্ছিলাম কী হচ্ছে। এরপর আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে যাই।পৃথিবীতে কি হচ্ছে না হচ্ছে আমি তার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছি।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল বা ঘুম ভাঙল তখন দেখতে পেলাম আমি বহুপ্রাচীণ একটি ভাঙা বাড়ির ভেতরে।আমাকে একটা কক্ষে স্যাঁতস্যাঁতে ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়েছে।আমার চারপাশে পাঁচটি জীবিত কঙ্কাল আমাকে পাহারা দিচ্ছে। জীবিত বলছি এ জন্য যে, কঙ্কাল গুলোর চোখে আগুনের মত পুত্তলি। জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। দাঁতগুলো ভয়াবহ রকমের বিশৃঙ্খল। ওরা নিজেরা মুখ না নেড়েই দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে।আমার কাছে মনে হল ওটা প্রেতলোকের নিজস্ব ভাষা।
কঙ্কালগুলো শুধু আমাকে পাহারাই দিচ্ছিল। আমার সাথে কোন দুর্ব্যবহার করছে না।আমাকে ভয় দেখানোর কোন চেষ্টা করছে না।
কেমন যেন একটা শব্দ হল।সাথে ছড়িয়ে পড়ল উৎকট গন্ধ। কঙ্কালগুলো সহসা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর ঘরে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল একটি সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটিকে দেখেই আমি দরাজ গলায় ডাকলাম, ঝর্ণা!
মেয়েটি হাতের ইশারায় কঙ্কাল গুলোকে চলে যেতে বলল।মুহুর্তে কঙ্কালগুলো উধাও হয়ে গেল। তখন মেয়েটি এসে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম এ তো ঝর্ণা নয়। এ যেন এক মোমের পুতুল। মনে পড়ল পোদ্দার পাড়া সরস্বতী পূজো দেখতে গিয়েছিলাম। সরস্বতী মূর্তির পাশে এক তরুণী দাঁড়িয়েছিল।বোঝার উপায় ছিল না কোনটি আসল সরস্বতী। এ যেন সেই রকম। আমি মুগ্ধতা নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে কোন কথা বলছে না।মৃদু মৃদু হাসছে।তার হাসির মৃদুমন্দ অধরোষ্ঠ তাড়নায় আমার হৃৎকম্প বেড়েই চলছে। এমনি কম্পনের মাঝে হঠাৎ মিহি সুরে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ঝর্ণা কে?
আমি কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, ঝর্ণা কে?
আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ঝর্ণা আমার বান্ধবী। সে আমাকে নাটকের আসর থেকে ডেকে এনেছে। তারপর যে সে কোথায় চলে গেল আমি বুঝতে পাচ্ছি না।
এবার সে খিল খিল করে হেসে উঠলো। রাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে সে হাসির ছটা যেন নিমেষে দিক বিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।আমার জীবনে এমন লাস্য জড়ানো হাসি আর কখনও শুনি নি।
মেয়েটি আমাকে বলল,ঝর্ণাকে বুঝি তুমি খুব ভালবাস?
আমি লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে কাছে এসে আস্তে করে আমার ডান হাতটা ধরে বলল,এসো।
আমি কলের পুতুলের মত তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।
একটি সুগোছালো পরিচ্ছন্ন ঘর।সে ঘরে ঢুকেই আমাকে খাটের উপর বসাল।তারপর বলল,ঝর্ণা তো তোমাকে নাটকের আসর থেকে ডেকে আনে নি।আমিই নিয়ে এসেছি।আমি প্রেতলোকের রাজকন্যা। এখানে ভয়ানক সব রাক্ষুসে প্রেতদের নিবাস। কিন্তু তারা আমার হাতের ইশারায় চলে।বিনা বাক্য ব্যয়ে আমার হুকুম তামিল করে।আমি যদি বলি তাহলে এখনই তারা এসে তোমার কচিকচি মাংস পরম উল্লাসে ভক্ষণ করবে।আমি নিজেও নরমাংস ভক্ষণ করি।তবে তোমার মাংস ভক্ষণ করব না। কারণ আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।তুমি আর একবার যদি ঝর্ণার নাম উচ্চারণ করেছ তো তোমাকে আস্তা চিবিয়ে খাব।
সে এসে আমার কাছে বসল। বাহুযুগল প্রসারিত করে আমাকে বেষ্টন করল।এত সুন্দরী মেয়ের গতর থেকে যে এমন উৎকট দুর্গন্ধ বেরোতে পারে তা আমার কল্পনাতীত।বমি আসছিল। তার শরীরের ছোঁয়া বরফের মত শীতল।আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ক্রমশ তার আকৃতি বদলে যাচ্ছে। তার চুলগুলো কলাগাছের আঁশের মত খসখসে হয়ে উঠছে।পৈশাচিক প্রেম তার দুচোখ বেয়ে আগুনের লেলিহান শিখার মত উদীরিত হচ্ছে। তার দন্তপাটি দাঁতাল।