শোকতপ্ত পথের মিছিলে সারা নগরী
যখন ভেঙে পড়েছে শ্রদ্ধা জানাতে
ফুলমালা ঢাকা মানুষকে
সেই মুহূর্তে শীর্ণ হাত খানা নিয়ে নিভৃতে ফুটপাতে
এক কিশোরের প্রতীক্ষার বিরক্তি নেই
পাশেই বসে থাকা,
এক নারী চুপসে যাওয়া গালে বাষ্পীভূত নোনতা জলের
ছেঁড়া কাপড়ে ঢাকা স্বামীর প্রাণহীন দেহে
প্রেমের সৌধ গড়তে
মৃতের সৎকারে নিষ্ফল আবেদন
অসহায় জীবনের প্রতিধ্বনি'
নেই কালো অক্ষর আর ঘামে ভেজানোর
রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ….
হৃদয় রূপচাঁদ সভ্যতার জানেনা ।
কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত কবিতাটা পড়তে পড়তে চোখে জল চলে আসে। সম্পূর্ণ অনিরুদ্ধ দের 'এর ছন্ন ছাড়া সংসারের সুন্দর রঙিন ছবি। ছোট্ট, সুন্দর সুখের সংসার টা ভেঙে পড়ল। স্টেট বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। তাকালো শুভ্র।ভেঙে কয়েক মিনিট আগে মহানগরী কলকাতার বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবার সূর্য হেসে উঠেছে। বাসে ছিটকানো কাদা-জল সুন্দর পোশাক পরা বাঙালি কে যেমন বিরক্তির এবং অস্বস্তির হয় , তেমনি ধর্মতলার মোড়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে সবাই স্থানে স্থানে জমা জল বাঁচিয়ে লোকেরা গন্তব্যস্থলের দিকে যেতে শুরু করেছে। ফুটপাতে একটা আট - দশ বছরের ছেলে দাড়িয়ে । পরনের সাদা থান,গুরু দশার কাপড়। মাথার চুল গুলো উস্কোখুস্কো দেখে বোঝা যায়, ওর বাবা মারা গেছে কদিন আগে। কারণ পাশেই দাঁড়িয়ে বিধবা মা। ছেলেটির নাম অনিরুদ্ধ । ফাঁকা হাত, অনিরুদ্ধ কেঁদে ওঠে একদিন এরকম ভাবে তাকে হাত পাতর দরকার ছিল না কিন্তু আজ কেন এ অবস্থা….
বাবা আজ বেশ মনে পড়ে ,― সে, বাবা , মা মিলে বাবার ছুটির দিনে তারা কলকাতার চিড়িয়াখানায় গিয়ে ছিল। চিড়িয়াখানার গেটের পাশে একটা বারো -তের বছরের ছেলে খুব জোরে জোরে কাঁদছিল । তাকে ভিক্ষা দিয়ে ছিল , দু টাকা।
ফেরার সময় বলে ছিল , " জানতো খোকা,ঐ যে ছেলেটা'কে তুমি পয়সা দিলে ওরা কিন্তু সবাই সত্যি সত্যি নয়। অনেকে অভিনয় করে পয়সা আয় করে।
যারা প্রকৃত তারা মানুষের কাছে হাত ই বাড়াতে সংকোচ করে।"
অনিরুদ্ধর তখন বাবাকে ভালো লাগে নি। আজ বুঝতে পারছে বাবা ঠিকই বলেছিল। হঠাৎ তার ফাঁকা হাতে এক ফোঁটা জল পড়তেই সম্বিৎ ফিরে আসে। পাশে বসে থাকা বিধবা মায়ের চোখের জল ।
সে দিনটা আজো অনির মনে পড়ে , অন্য দিনের সকালের মতোই বাবাকে রোগের মতো কাজে বেরোতে বাধ্য হয়েছিল। কাজে যেতে মন চাইছিলো না বাবার। সেটা বাবাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। কারণ বাড়িতে বোন অজান্ত 'র শরীর অসুস্থ।বিছানায় শয্যাশায়ী।
ডিউটিতে না গেলে পয়সা কাটা যাবে। ওর বাবা আট নং রুটের বাস ড্রাইভার , কাজে না গেলে হয়তো মনটা মানবে মেয়ের পাশে বসে কিন্তু পেট তো মানবে না । বাধ্য হয়ে কাজে বেরিয়েছিল অসুস্থ মেয়ের ডাক শুনে সেটাকে অগ্রাহ্য করতে হয়েছিল বাবাকে ; এমনই সময় দুই তিনশ প্রায় যাত্রীর জীবন দায়িত্ব বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি পিছন থেকে যেন শুনলেন," বাপি তুমি আমার কাছে থাকো….…….এইতো আমি তোমার কাছে বলে," ওঠে বাবা । হঠাৎ স্টিয়ারিং অসাবধানতায় ঘুরে যায় বাসটা গিয়ে ধাক্কা মারলো একটা কঙ্কাল বেরনো কৃষ্ণচূড়া গাছের গোড়ায়। কারো তেমন কিছু ক্ষতি হলো না। সহসা মোড়ের মাথা থেকে হৈ হৈ করে ছুটে এলো কিছু লোকের দল । নিয়ম অনুসারে খোঁজ করলো ড্রাইভার কন্টাকটার কন্টাকটার তখন পলাতক নামিয়ে নিয়ে এল ওর বাবাকে ফুটপাতে ক্ষুব্ধ জনতা শুরু করল অবর্ণনীয় মার ।
বাবার জ্ঞান হারায়, সেই অবস্থাতে ও তখন তিনি শুনছেন সেই অসুস্থ মেয়ের ডাক। " তুমি চলে যাচ্ছো …?"
হ্যাঁ, চলে ই গেল বাবা ।
হঠাৎ অনিরুদ্ধর প্রাণের আবার আশার আলো জ্বলে উঠে দেখল নিঃশব্দ প্রচুর লোক আসছে একটা মৃতদেহ বহন করে । হয় তো তার হাতে পূর্ণ হবে এবার। নিঃশব্দে এগিয়ে চলল সবাই। শূণ্য হাত শূন্যই রইল ।
সকালে এই মহান ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ হয়তো কালো অক্ষরে ছাপা হবে। রেডিওর খবরে কেউ কাঁদবেন , দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে ওদিকে অনিরুদ্ধ রা দিনের-পর-দিন হাত পেতে দাঁড়াবে ফুটপাতে , এই সভ্যতার মুখোশে ঢাকা মহানগরীর বুকে।
―――
স্বপন জায়দার।
2নং রবীন্দ্রনগর চুঁচুড়া
হুগলী 712103