স্বল্পদৈর্ঘ্য নিশীথনাট্য ।। তফিল উদ্দিন মণ্ডল

 


দ্রুতযান ট্রেনটি সেদিন আর ধরা হল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলার পথে কত বন্ধু বান্ধব, পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা। সবার সাথে কথা বলতে, কুশল বিনময় করতে করতে কখন যে বেলা পড়ে এসেছে খেয়াল করি নি।
   বাড়ি থেকে পাক্কা পাঁচ মাইল রাস্তা ধর্মকুড়া রেল স্টেশন পর্যন্ত। যানবাহন বলতে কেবল গরুর গাড়ি। সেও আবার পাঁচজন একত্রিত হলে।কে বসে থাকে পাঁচজনের অপেক্ষায়। অগত্য হেঁটে পথ মাড়ানো।

  আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে পথ ঘাট একেবারে কর্দমাক্ত। হাঁটাও একেবারে সহজ কাজ নয়।পিচ্ছিল কর্দমাক্ত মাটিতে পা একবার ফসকালে মুহূর্তে পৈতৃক চেহারা পাল্টে যাবে।তাই অতি সন্তর্পনে রাধিকার অভিসার যাত্রায় হাঁটার মতই হাঁটতে হয়। অনেকটা "চলতহি অঙ্গুলি চাপি"।
    জুতো জোড়া হাতে,কাঁকালে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেলাম ধর্মকুড়া স্টেশনে। আমি পৌঁছাবার একঘন্টা আগেই দ্রুতযান চলে গেছে।

   অপ্রত্যাশিত ভাবে সন্ধ্যার লোকাল এসে দাঁড়াল। আমি খুশিতে ডগমগ হয়ে লোকালের থার্ডক্লাস কামরায় উঠে পড়লাম। মানুষের তত ভীড় নেই। যদিও দাগী স্টেশনে এসে প্রচণ্ড ভীড় হল।তাতে কি আমি তো থার্ডক্লাসের লম্বা বেঞ্চিতে বসে আছি।যদিও ছাড়পোকার নির্মম কামড়ে পশ্চাদ্দেশ উঠানামা করছিল।

   সিংহজানি স্টেশনে নামতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি একবার রুজু হলে তার শেষ হবার নাম নেই।অন্ধকারও জেকে বসছে ক্রমশ। বিদ্যুতের বাতিগুলো সেই যে শ্বশুর বাড়ি গেছে কবে ফিরবে কে জানে।
বৃষ্টি কখন থামল তা জানি নে।আমি একটা রিকশা পাঁচ টাকা ভাড়ায় সলেমান ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা হলাম।
  বাসায় পৌঁছে পড়লাম আর এক বিপাকে। সলেমান ভাই বাসা ভাড়া দিয়ে চলে গেছে। সেটা আমার জানা ছিল না। বারান্দায় উঠে দরজার কড়া নাড়তেই আমার চেয়ে কম বয়সী একটি মেয়ে দরজা খুলল। আমি তাকে বললাম, সলেমান ভাই বাসায় নেই?
--না, উনি তো এখানে থাকেন না
-- উনি কোথায় থাকেন?
-- তা তো জানি না।
-- উনি আপনার কে হন?
-- বড় ভাই।
মেয়েটি বলল, ভেতরে আসেন। আমি ভেতরে গেলাম।আগের মতই এ কক্ষে চৌকি পাতা রয়েছে। পাশে একটি টেবিল আর গোটা চারেক চেয়ার।
আমি বললাম, আপনারা কারা?
-- আমরা গত মাসে ভাড়া নিয়েছি।
আমি বললাম, ও আমি তো তা জানতাম না।দেখুন তো কেমন বিপদে পড়ে গেলাম।
মেয়েটি বলল, কেন?
বললাম, সকালে ট্রেন ধরে ঢাকায় যেতে হবে। ইউনিভার্সিটি খোলা।বাড়িতে এসে আটকে পড়েছিলাম।এখন বলুন তো রাতে কোথায় থাকি।
মেয়েটি বলল, তাতে কি হয়েছে। আমরা আছি না? আপনি এখানে থেকেই সকালে ট্রেন ধরতে পারবেন।
আমি বললাম, তার আর দরকার নেই।আমি রাতটা কোন এক হোটেলে কাটিয়ে সকালে ট্রেন ধরতে পারব।
আমি ব্যাগটা নিয়ে উঠার উদ্যোগ করতেই মেয়েটি একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল।
বলল, না না না। কী বলছেন আপনি। সলেমান ভাই শুনলে আমাদের মাথা কাটা যাবে। এখানে হয়ত আপনার কষ্ট হবে। না হয় একরাত একটু কষ্ট করলেনই।
  আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় ১৪/১৫ বছরের একটি মেয়ে এসে মেয়েটিকে বলল,বুবু,একটু ভেতরে আসো না।
  এতক্ষণ ধরে কথা হলেও মেয়েটির পারিবারিক বিষয়ে আমার কিছুই জানা হয় নি।এমনিতে আমি মেয়েদের সাথে  কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। কেমন যেন শরম শরম লাগে। চোখে চোখ রেখে তাকানোর তো প্রশ্নই আসে না।
  কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আবার ঘরে প্রবেশ করে আমাকে একটা গামছা দিয়ে বলল,ভাই,যান মুখ হাত ধোয়ে একটু বিশ্রাম করুন।ততক্ষণে আমি রান্নাটা সেরে নিই।
  আমি বললাম, আচ্ছা, আপনাদের পরিবারে কে কে আছে?
সে বলল, আমার পরিবার খুবই ছোট। আমার হাজব্যান্ড আমি আর আমার ছোট বোন।
আমি বললাম, তা ভাই সাহেবকে তো দেখছি না।
-- আসলে উনি পুলিশে চাকরি করেন। এ শহরেই তার পোস্টিং ছিল। বছর দেড়েক হল আমাদের বিয়ে হয়েছে।বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যে  তিনি আমাকে নিয়ে এ বাসায় উঠেন। আমি বাসায় একা থাকি বলে আমার ছোট বোনকে এনে এখানে স্কুলে ভর্তি করেছেন।
হঠাৎ করে ক'মাস আগে আমার হাজব্যান্ড বদলি হয়ে দিনাজপুর চলে যান। আমিও এখানে কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছি। তাই সহসা দিনাজপুর নিয়ে যেতে পারছেন না।আপাততঃ আমরা দুবোনই বাসায় থাকি।প্রতি সপ্তাহে বাবা আসেন। বাড়ি থেকে চাল ডাল তরিতরকারি দিয়ে যান।
  আমি বললাম, এখানে আপনাদের কোন কষ্ট হচ্ছে  না তো?
মেয়েটি বলল, কী যে বলেন।কষ্ট হবে কেন। এত বড় বাসা। এই রুমটা কোন গেস্ট না এলে খালিই পড়ে থাকে।পাশের ঘরে আমি থাকি আর বারান্দার কোঠায় আমার ছোট বোন থাকে।আমরা সব সময় আনন্দেই থাকি।
  এতক্ষণ কথাবার্তা হলেও মেয়েটির নাম আমি জানতে পারি নি। আর তাকে নাম জিজ্ঞেস করাটাও আমার কাছে অশোভন ঠেকছিল।
   সে আমাকে বলল, আসুন।মুখ হাত ধোবেন।
আমি বললাম , ভাবছেন পাতকুয়ো কোথায়? আমি এ বাসায়  নতুন নই। পাতকুয়ো কোথায় তা আমি জানি।
মেয়েটি বলল, তা আপনি যতই জানেন।এখন আপনি আমার অতিথি।
  সে এক রকম জোর করেই আমার সাথে সাথে পাতকুয়োর ধারে গেল। নিজ হাতে পানি তুলতে তুলতে বলল, আপনার নামটা তো জানা হল না।
আমি বললাম, আমার নাম আবুল বাশার মহম্মদ মঈনুদ্দিন। সে হেসে বলল, বাবা রে, এত বড় নাম? এরপর সে নিজে থেকেই বলল, আমার নাম রুবি আর ছোট বোনের নাম, চপলা। খুব দুষ্ট কী না তাই এমন নাম।

  আমার শরীরে পথচলার ক্লান্তি ছিল।ঘরে এসে আমি ক্লান্ত দেহখানা বিছানায় এলিয়ে দিলাম।রুবি বলল, আপনি বিশ্রাম করুন। আমি রান্নাটা সেরে আসি।
    আমি বিছানায় গড়িয়ে পড়ার পর খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ হাঁটার ক্লান্তি আমার স্নায়ু সমূহকে শিথিল করে ফেলেছিল।তাই আমার কাছে পৃথিবীর সব চাইতে প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল ঘুম।
    ঘরে বাতি জ্বালানোর সাথে সাথেই আমার চোখে আলোর ঝলকানি এসে আঘাত করল।আমি বুঝলাম কেউ হয়তো বাতি জ্বালিয়েছে কিন্তু ঘুমের তীব্রটানে চোখ খোলার ইচ্ছে  হল না।
  রুবি আমাকে ডাকছে। ভাইজান ও ভাইজান!
ওর কণ্ঠস্বর আমার কানে পৌঁছছে কিন্তু জবাব দেবার ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি শুধু পাশ ফিরে আবারও ঘুমকে জাপটে ধরছি।
রুবি আমার পিঠে হাত দিয়ে আস্তে করে ডাকছে, ভাইজান  ও ভাইজান।
আমি পাশ ফিরে  চোখ খুললাম।
-- কষ্ট করে একটু উঠুন। খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে সারারাত ঘুমোতে পারবেন।
আমি উঠে বসলাম।দেখি সে টেবিলে খাবার দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি বললাম, তোমরা খেয়েছ?
-- সে কী!অতিথিকে না খাওয়ায়ে কি খাওয়া যায়?
-- দুঃখিত, আমি অসময়ে ঘুমিয়ে তোমাদের কষ্ট দিলাম।
-- রাখেন তো ও সব কথা। আসুন খাবেন।
সত্যি বলতে কি আমি খুব ক্ষুধার্তও ছিলাম। সেই পৌণে দুপুর বেলা খেয়ে বেরিয়েছি তারপর পানি আর সিগারেটের ধুঁয়া ছাড়া উদরে আর কিছুই ঢুকে নি।
রুবিকে বললাম, ঠিক আছে। আমি খাই তোমরাও গিয়ে খেয়ে নাও।
-- না না, আমাদের খাওয়া নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
বলেই সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগল। বিনয়ের সাথে বলল, ভাইজান, একটু কষ্ট করে খেয়ে নিন।ভাল না লাগলে কাউকে বলবেন না। নতুন সংসারে নতুন গিন্নিপনা তা ও আবার গুছিয়ে উঠতে পারি নি।এরই মাঝে হাজব্যান্ড গেলেন বদলি হয়ে।
আমি বললাম, অন্য কিছু বলুন।এ সব ফর্মালিটির কোন দরকার নেই।
হঠাৎ রুবি  আমাকে বলল, কী আপনি আপনি করছেন। আমি তো আপনার ছোট।আমাকে তুমি বলবেন প্লিজ।
রুবির এ কথায় বোধ করি আমার মুখে এক ঝলক লাজসম্পাৎ হয়েছিল। এ সব বিষয়ে মেয়েদের ধারণা ছেলেদের চাইতে অগ্রবর্তী।  মনে হয় সে কারণেই রুবি হেসে হেসে বলল, ভাইজান বুঝি খুব লাজুক?
আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললাম, কে বলল তোমাকে।
-- না, আসছেন থেকে এত কথা হল।আপনি কিন্তু  একবারও আমার চোখের দিকে তাকান নি। হতে পারে সেটা লজ্জায় নয় তো আমি সুন্দর  নই তাই।
এবার খেতে খেতেই আমি লজ্জাকে হালকা করে রুবির মুখের দিকে তাকালাম। সে মুখ যেন বরফের কুচির মত শীতল অথচ চোখ দুটোর মাঝে মেঘের প্রতি উত্তপ্ত ক্রোধ। কেন যে অনাকাঙ্ক্ষিত মেঘরাশি তার দৃষ্টিতে বাঁধা দেয়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য সে প্রাণভরে দেখতে পায় না।উপভোগ করার স্বচ্ছন্দ গতি সে হারিয়ে ফেলে।
কালিদাসের কাব্যে তরঙ্গ দোলায়িত মন্দাক্রান্তা ছন্দের মতই রুবির চোখের নীরব অথচ রহস্যময় ভাষা।
  আমার খাওয়া শেষ। রুবি বলল, আপনি বিশ্রাম নিন।আমি খেয়ে এসে আপনার মশারি টানিয়ে দিয়ে যাব।
আমি বলি, আরে না না।মশারি আমি নিজেই টানিয়ে নিতে পারব।তোমার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
-- তা বললে কি হয়? অতিথির কষ্ট হলে অকল্যাণ হয়। আচ্ছা, আপনি বিশ্রাম করুন।
রুবি  ভেতরে চলে গেল।
   এখন আমার মাথা চিন্তামুক্ত। একটানা ঘুমিয়ে সকালে সোজা স্টেশনে। আরামসে এক কাঠি কিংট্রক ধ্বংস করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
  রাত তখন কত হবে ঠিক বুঝতে পারি নি।ঘড়ি হাতে রাখার অভ্যেস আমার কখনও ছিল না কাঁচাঘুম থেকে হঠাৎ  জেগে উঠলে তালকানা হয়ে যায়। আমি অনুভব করছি খাট যেন নড়ছে।কেমন শব্দও করছে। আর সেই নড়াচড়া আর শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি রুবি মশারি টানানোর চেষ্টা করছে।
  আমি বললাম, আরে করছ কি? বললাম তো আমি মশারি টানিয়ে নেব।
সে বাজখাঁই গলায় বলল, কখন আর টানাবেন।শরীরের রক্ত সব মশার পেটে গেলে?
রুবির দুটো হাত আমার সামনে মেলে ধরল।বলল,এই দেখুন।
আমি দেখলাম ওর হাত দুটি রক্তাক্ত। আমি বললাম, এ কী! রক্ত এলো কোত্থেকে?
-- মশার পেট থেকে। শুয়ে তো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন।এসে দেখি মশা রক্ত খেয়ে আর নড়তে পারে না। সেগুলো সব হাত দিয়ে মেরেছি আর মশার পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে হাত লাল হয়ে গেছে।
  বিস্মিত হলাম। কে এই মেয়েটি? কোনদিন দেখি নি, চিনি না জানি না,অথচ সে পরম আদরে যত্নে মুহূর্তেই আমাকে আপন করে নিয়েছে।
রুবি আমার হাতে, মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাকে শাসন করছে।
আমি মশারি টানানোর জন্য উঠলাম। রুবি আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, অবাধ্য হবেন না বললাম।
আমিও সাহস করে বললাম, অবাধ্য হলে কী করবে শুনি?
-- আপনাকে মারব।
-- বেশ! তাহলে মশারি টানিয়ে গিয়ে শুয়ে ঘুমাও।
রুবি মশারি টানাল।এতক্ষণে আমি কোন অপর মেয়ে মানুষের সাথে একই ঘরে নির্জন রাতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আমার অনুভবে নতুন অজানা কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
রুবির মশারি টানানো শেষ হল।আমি যদিও ওকে যাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছি কিন্তু মনের মনে চাইছি সে আরো কিছুক্ষণ থাক। জানিনে রুবির মনে কি ভাবনা ঘুরে ফিরছে।
সে চলে গেল।আমিও শুয়ে পড়ব ভাবছি।
কিছুক্ষণ পর রুবি জগভর্তি পানি আর গ্লাস নিয়ে এলো।আমার শিয়রের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তর উপর জগ গ্লাস রাখল। বলল, ভাইজান,রাতে যদি পানি লাগে এজন্য রেখে গেলাম।
রুবি তার ঘরে চলে গেল। আমিও শুয়ে পড়লাম। আমার শরীর ক্লান্ত। আমি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে কিছুতেই দুচোখে ঘুম আসছে না।
কেবল এপাশ ওপাশ করছি।কেন এমন করছি তাও বুঝতে পাচ্ছি না।
  গির্জার ঘড়িতে রাত দুটের ঘন্টা বাজল।আমি উঠে বাতি জ্বালালাম।বাতি জ্বালিয়ে দু গ্লাস পানি পান করে একটা সিগারেট ধরালাম। মশারির নিচে থেকে বেরিয়ে চেয়ারে বসলাম।কী এক অবোধ ভাবনায় নিমজ্জিত হয়েছি জানি না।
  মাঝের দরজা খোলার শব্দ হল। চেয়ে দেখলাম রুবি আসছে।ওর হাতে একটি তেলের শিশি। আমি ওকে দেখে বললাম, কি গো,তুমি এখনও ঘুমোও নি।
-- না ভাইজান।আপনার জন্যে খারাপ লাগছিল। আমি বুঝতে পাচ্ছিলাম আপনি ঘুমোতে পাচ্ছেন না।তাই এই তেল নিয়ে এলাম।
-- তেল দিয়ে কি হবে?
কেন? মশার কামড়ের জায়গাগুলো ফুলে আছে।তেল মালিশ করে দিলে খানিকটা কমবে আর তাতে আরাম পাবেন। নিন্ গেঞ্জিটা খুলেন তো?
আমি আর কি খুলব।রুবি নিজেই আমার গেঞ্জি খুলতে শুরু করেছে। সে আমার দুই বাহুতে,পিঠে তেল মালিশ করছে।
  আমার মা ছাড়া অন্য কোন মেয়ে মানুষের এটাই প্রথম স্পর্শ। সে স্পর্শে মনে হচ্ছে  আমার সারা গায়ে নয় সমস্ত অস্তিত্বে বিছুটি পাতার চুলকানি শুরু হয়ে গেছে।কী নরম দুটো হাতের স্পর্শ। একেবারে  নিকট থেকে নিঃশ্বাসে ভেসে আসা মাদকতাময় ধ্বনি। শরীরের নিশ্চতন করা গন্ধ। আমি রুবিকে বলছি, রুবি এবার তুমি যাও। চপলা ঘুমিয়েছে কি?
- সে তো সন্ধ্যারাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই রুবি বলে, আচ্ছা  ভাইজান, আপনি কি কখনও কোন মেয়েকে ভালবেসেছেন?
আমি বললাম, রুবি অনেক রাত হয়েছে এবার গিয়ে শুয়ে।পড়ো।
-- আমার তো যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনার সাথে বসে বসে শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
-- না না, তা হয় না।এটা খুব ভাল দেখা যায় না। হঠাৎ কেউ যদি দুটো কথাই শুনে ফেলে তাহলে কেলেঙ্কারির আর সীমা থাকবে না।
--কেলেঙ্কারি!  আহা কেলেঙ্কারি। গৈ গেরামে বড় হয়েছি। মা বাবা পাছে কোন কেলেংকারি হয় সেই ভয়ে পনেরো পেরোতেই বিয়ে দিয়ে দিলেন। যাকে চিনি না,জানি না জোর করে ধরে তার শয্যাসঙ্গিনী হবার বৈধতা দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বিশ্বাস করেন,আজ কিছুক্ষণের জন্যে আপনার সাথে কথা বলতে পেরে মনটা কী যে ভারমুক্ত লাগছে তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না।
   আমি বললাম, রুবি, তুমি কি দাম্পত্য জীবনে সুখী  নও?
-- কেউ কি কখনো জানতে চায় যে আমরা মেয়েরা যারা স্বামীর সংসার করি তারা কতটুকু সুখী আর কতটা অসুখী। আমাদের জীবন হুকুম তামিল করার জীবন। বাবার সংসারে থাকতে বাপ ভাইয়ের হুকুম আর স্বামীর সংসারে স্বামীর হুকুম তামিল করতেই জীবনটা কেটে যায়।আমাদের ইচ্ছে  অনিচ্ছে,সাধ আহ্লাদের কোন মূল্যই কারো কাছে নই। আমরা মনের সকল সুখদুঃখ মনে চাপা দিয়ে স্বামীর সংসার করি,মনোরঞ্জন করি আর তার ইচ্ছে মত সন্তান উপহার দিই ।আমাদের পা আছে কিন্তু  সে পায়ে ভর করে নিজের ইচ্ছে মত দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকু নেই।
  আমি লক্ষ্য করলাম কথাগুলো বলার সময় রুবির কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠছে। তার দুচোখ ছলছল করছে। আমি প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য রুবিকে বললাম, রুবি এবার যাও। অনেক রাত হয়েছে।ঘুমোবে না?
রুবি বলল, ভাইজান, জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু  আমার মন চাইছে সারারাত আপনার সাথে কথা বলি।আপনার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভাল লাগছে।
আমি রুবিকে কী বলব জানি নে।ওর যন্ত্রণার মেঘে ঢাকা সফেদ মুখটা আমার কাছে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। আমার মনের ভিতরে পৌরুষের প্রবৃত্তিতাড়িত বুনো ষাঁড় নিজের অজান্তেই বপ্রক্রীড়ায় মেতে উঠছে। আমি ওর উপস্থিতি আর মেনে নিতে পাচ্ছি না। অথচ ওকে চলেও যেতে পাচ্ছি না।
    রুবিই মূলতঃ কথা বলছে।আমি শুনছি।রুবির অল্প বয়সের কোমল বুকে যত দুঃখ বেদনা,সুখ কল্পনা আমার সামনে অবারিত তুলে ধরছে। যা শুনে রুবির প্রতি মানবিক সহানুভূতি আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।কিন্তু  আমার শোনে লাভ কী? এই পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের বুকে মানুষ হিসেবে জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কত স্মৃতিসৌধ তারা তৈরি করে। সামাজিক বাস্তবতার অভিঘাতে সে সব কল্পনার স্মৃতিসৌধ প্রতিনিয়ত ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ।
  আমি রুবিকে কথা বলতে আর বাঁধা দিচ্ছি না। সে তার মনের গোপন দরজা জানালা আমার কাছে একের পর এক উন্মুক্ত করছে। আমি অভিভূত হচ্ছি,আতঙ্কিত হচ্ছি।পুরুষ হিসেবে নিজের মধ্যে  লুকিয়ে থাকা দানবীয় সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করছি।
মসজিদে আজান পড়ে গেল।রুবি বলল, কী হল ভাইজান?
রুবির সাথে সময় খুবই অল্পই কেটেছিল।কিন্তু তার মনের কথাগুলোর মধ্যে আমি নারী সমাজের হৃদয়বৃত্তির একটি বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আর কী কী হয়েছিল সেই স্বল্পদৈর্ঘ নিশীথনাট্যে তা ভাষার বাঁধনে বাঁধা অশেভন।
আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। বেরিয়ে পড়েছি।রুবি বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। সে দুচোখে বিষন্নতার অশ্রু ধারাতেও ছলছল করছে এক পরম তৃপ্তিময় প্রশান্তি।
চৈত্র সংক্রান্তি,১৪২৯
ময়মনসিংহ।


 পরিচিতিঃ
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
জন্মঃ ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৮
অনার্স, মাস্টার্স, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্মজীবনঃ  শহীদ স্মৃতি আদর্শ কলেজ,নান্দাইল, ময়মনসিংহ। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা।
অধ্যক্ষ,কাঁচকুড়া ডিগ্রি কলেজ, উত্তরা,ঢাকা।
রচনাঃ রম্যগ্রন্থ ১. সেইসব মজার মানুষ ২. বাহিরে যার হাসির ছটা

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।