আহ্, খুব খারাপ লাগছে। শরীরটা তুলতে পারছি না। মাথা ব্যথা করছে খুব। আর জলপট্টি দিস না মা, আমাকে উঠে কাজে যেতে হবে। বিছানায় শুয়ে শেলীর মা কথাগুলো বলল। দশ বছরের শেলী একটা বাটিতে পানি নিয়ে ছোট কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে মায়ের মাথার উপর দিয়ে বলল, মা, আজ তোমার কাজে গিয়ে লাভ নেই। তোমার গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ছোট ভাই সাত বছরের রকি মায়ের পা মুছে দিচ্ছে ঠান্ডা পানি দিয়ে। শেলী ওকে বলেছে। মা ওদের এই সেবা দেখে তার চোখে জল চলে এলো। বলল, শেলী একটা কাজ কর মা। টেবিলে জ্বরের ওষুধ আছে। আমাকে একটু পানি দে ওষুধ খাব। শেলী মাকে দুটো বিস্কুট, পানি আর ওষুধ এনে দিলো। তারপর বলল, মা এবার একটু ঘুমাও। আমি ভাত রান্না করে তোমাকে কিছু ভাজি করে খেতে দেব। মা হেসে বলল, আমার শেলী মা কতো বড় হয়ে গেছে। রকি, বাবা ফোনটা একটু দে। ওখানে জানিয়ে দি। আজ শরীর খারাপ যেতে পারব না।
হ্যালো, ম্যাডাম, আমার খুব জ্বর। তাই আজ যেতে পারছিনা। শেলীর মা বলল।
ঐদিক থেকে কড়াভাবে ম্যাডাম বললেন, কাজের সময় তোমাদের নানা তাল বাহানা। এখন রোজার মাস কাজের চাপ বেশি। কাপড় গুলো ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে হবে।
শেলীর মা কাশতে কাশতে বলল, ম্যাডাম আমি বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করে সব পুষিয়ে দেব।
ম্যাডাম বকা দিয়ে বলল, আরে ছাড় তো, সে দেখা যাবে। বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
শেলী বলল, মা কি বলেছেন উনি। তুমি এতো চিন্তা করো না। একটু বিশ্রাম নাও। মা ওদেরকে বুঝতে দেয় নি। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
তিনদিন পর শেলীর মা কাজে আসলো। ম্যাডাম তো রেগে আগুন। শেলীর মাকে বলল, শোন, তুমি যে তিনদিন আসনি তার বেতন কাটা যাবে। শেলীর মা হাত জোড় করে বলল, ম্যাডাম এটা করবেন না। আমার ছেলে মেয়ে দুটো না খেতে পেয়ে কষ্ট পাবে। ম্যাডাম বলল, ঠিক আছে। তাহলে তোমাকে রাত জেগে কাজ শেষ করতে হবে। আজ আর বাড়ি যেতে পারবে না। তোমার সাথে এই দুইটা মেয়েও থাকবে। আমি আসছি। এই তোমরা সবাই ঠিকঠাক মতো কাজ কর। সামনের সপ্তাহে কাপড় ভেলিভারি দেব। কথাটা যেন সবার মনে থাকে। বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল।
উনি যাওয়ার পর একটি মেয়ে বললো, জানেন দিদি, আমি কাজ ফেলে একটু ফোন করেছি তাই শাস্তি হিসেবে আমাকেও রাতে কাজ দিলো। আরেকজন বলল, আমি দেরি করে এসেছি আমারও একই অবস্থা। শেলীর মা বলল, হ্যাঁ, তোমরা তো নতুন। এখানে আমরা যারা পুরনো আছি এরকম ডিউটি অনেক বার করেছি। মালতী মাসী তুমি তো সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে চলে যাবে। রাতে একটু আমার ছেলে মেয়ের সাথে থেকো। মালতী মাসী পান চিবোতে চিবোতে বলল, তুই চিন্তা করিস না। আমি থাকব। রান্না বান্না তো করা আছে, তাই না? তাছাড়া তোর মেয়ে তো টুকিটাকি কাজ পারে। শেলীর মা বলল, হ্যাঁ মাসী, আমি তো জানতাম, এরকম কিছু হবে তাই মেয়েকে বলে রেখেছিলাম।
শেলীর মা এক ম্যাডামের একটা ছোট কাপড়ের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। ঐ ম্যাডাম একে তো বড়লোক আবার অহংকারীও। নুন থেকে পান খসলেই কর্মীদের দিয়ে বাড়তি কাজ করায়। না হলে টাকা কেটে রাখার ভয় দেখায়। ব্যবহারও তেমন ভালো করে না।কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম বাইরে থেকে এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। তোমরা তাড়াতাড়ি হাত চালাও। এতো আস্তে করলে চলবে না। আমি পাশের রুমে গেলাম। এই রুমি, আমার জন্য কফি নিয়ে এসো। সবাই উনার ভয়ে আড়ষ্ট থাকে। কারণ উনার কথা মতো কাজ না করলে চাকরি চলে যায়। সবাই এখানে পেটের দায়ে কাজ করে।
দুই দিন পর শেলীর মা ঘরে এলো। ছেলে মেয়ে দুটো মাকে জড়িয়ে ধরলো যেন কতোদিন দেখেনি। মা বলল, তোরা ঠিক আছিস? শেলী বলল, মা আমরা ঠিক আছি। তোমার মুখ এতো শুকনো কেন? মা কাপড় বদলে মুখ হাত ধুয়ে বিছানায় বসে বলল, না রে মা, ঘুম হয়নি তো তাই এরকম দেখাচ্ছে। রকি, বাবা আমাকে এক গ্লাস পানি দে তো। বিকেলে আবার যেতে হবে। কিছুক্ষণ কাজ করে রাতে চলে আসব।
দুপুরে খেয়ে তিনজন যখন ঘুমাতে এলো তখন রকি বলছে, মা ঐ ম্যাডাম তোমাকে এতো খাটায় কেন? উনার কি দয়ামায়া নাই? মা রকিকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি করব বল, বাবা । আমরা যে নিচু তলার মানুষ। আর ওরা যে ওপর তলায় থাকে! আমরা ওদের কথা শুনে কাজ না করলে খাব কি? রকি বলল, ঠিক আছে মা, আর একটু কষ্ট করো, আমি বড় হয়ে চাকরি করব, ওখানে আর তোমার কাজ করতে হবে না মা। শেলী হেসে বলল, হ্যাঁ রে ভাই, তুই একদম ঠিক বলেছিস। আমরা বড় হয়ে চাকরি করে মাকে আর কষ্ট করতে দেব না। মা দুজনকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো। আর মনে মনে বলল, আমি আশীর্বাদ করি, তোরা বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবি।