পনেরো বছরের সুরভীর জীবনের এক একটা মূহুর্ত যেনো বাস্তবতার এক একটা বড় বড় গল্প কাহীনি। তার কাছে জীবন মানে সীমাহীন এক যন্ত্রনার সমুদ্র । এখন সুরভীর জীবন সুখের স্বর্গ তারপর ও ভুলতে পারে না অতীত।
আজ লেখিকা আপুকে পেয়ে সুরভী বলা শুরু করলো তার জীবনের আড়ালে সবার অজানা গল্প গুলো।
মানুষের জীবন কবে কি হয়ে যায় তার ই বাস্তব চিত্র সুরভীর জীবন। জীবন বদলায় ভাগ্য বদলায় প্রয়োজন সততা ও সিঁড়ি।
আপু আমি বলছি আপনি লিখুন--
সারাদিন কাজ আর রাতে বাড়ির কর্তা জব্বার ও তার খিটখিটে বয়স্ক বউ এর অমানুষিক অত্যাচার। মাঝ রাতে আমি ঘুমুতেও পারতাম না অনৈতিক কাজে রাজী না হওয়ায় খুব মারধর করতো,ঘৃণায় যন্ত্রনায় সুরভী মরতে পারে না, পৃথিবীর কাছে একমুটো ভাতের জন্য কতো লাঞ্চনার জীবন তাকে সইতে হয় সে দরিদ্র এতিম পথ শিশুরাই জানে।
সেই বাড়ি হতে ওদেরই এক আত্বীয়ের সহযোগিতায় আরেক বাড়িতে কাজ হয় ঐখানে বাড়ির ছেলের কাছে প্রথম ধষির্ত হই, বাড়ির সাহেব বিদেশ থাকতো,মেম সাহেবা আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় কাদতেঁ দেখে ঔষধ এনে দেয় । বললাম আপনার ছেলে আমার এই সর্বনাশ করছে আমাকে অত্যাচার করছে আমি ব্যথায় থাকতে পারতেছি না মেমসাহেবা।
মেম সাহেব উল্টা আমাকে দোষারোপ কইরা ধমক দিয়া বলে খবরদার এসব কথা আর বলবি না কাউকে ।বললে তোকে পুলিশের হাতে তুলে দিবো । দুইদিন পর আমাকে ঘর থেকে বাইর করে দিলো।
কতো কাঁদছি কেউ শুনে নাই পায়ে ধরে কইলাম মেম গো এতো বড় দুনিয়ার মাঝে আমার তো কেউ নাই কই যামু।মা বাপ ওরা দুই জন দুইদিকে বিয়া বইয়া চইল্যা গেছে, একবার ও আমার কথা ভাবে নাই।
গেইট এর পাশে বসে কাঁদতে দেখে আরেক মহিলা হাতে একশ টাকা দিয়া আমারে আরেক বাড়িতে দিয়া গেলো।কইলো যা বলে চুপচাপ সহ্য করবি না হয় রাস্তায় থাকবি ঘর জুটবো না।
সেদিন থেইক্যা বুঝে গেছিলাম আমার বাঁচাটা কুকুরের মতন হবে।আমি নিজেরে আর মানুষ মনে করি না তখন।
সেই বাড়িতে মালিকদের আমি চাচা চাচী ডাকতাম খুব ভালোই ছিলো দিন গুলো। উনাদের একমাএ মেয়ে বীথি আপু আমাকে খুব স্নেহ করতো। বয়সের দোষে ঐ বাড়ির দারোয়ানের প্রেমে পড়ি মনে হইতো এই বুঝি জীবনের একটা গতি হইলো কতো স্বপ্ন দেখতাম। সেও কতো আশার কথা বলতো।
বলতো তোরে পাইলে আমার আর কিছু ই লাগবে না আমি ও তারে মন প্রান দিয়ে ভালোবাসতাম একদিন ওরা সবাই গ্রামের বাড়িতে যায়।
সেদিন বাড়ি ফাঁকা পেয়ে আমাকে দারোয়ান ভালোবাসার দোহাই দিয়ে বললো তোকে আমি আগামী সপ্তাহেই বিয়ে করবো মালিক কে বলে একটা থাকার ব্যবস্থা করে নিবো।
আমি তার কথায় বিশ্বাস করে ফেলি।সে বললো আমার উপর বিশ্বাস রাখ আমাদের কোল জুড়ে বাচ্চা হবে, সংসার হবে । একটু ধৈয্য ধরো আমি তোকে সম্মান দিয়ে বউ করবো।
হায়রে পুরুষ জাত কে জানতো ম্যাডাম, সে আমাকে ধোঁকা দিবে।
তারপর কি হলো বলো--সুরভীর চোখে এতোক্ষন ঘৃনা ছিলো মানুষের প্রতি, কান্না ছিলো না হঠাৎ সে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো।
সুরভীর কান্না দেখে বুঝতে পারলাম পৃথিবীতে ভালবাসার জায়গাটা সম্পূর্ণ আলাদা।সে এখনো মানুষ ভালোবাসে বলেই তার চোখে এতোজল তার কান্না দেখে আমার ওচোখে জল চলে আসলো।
বললো আমি যারে এত ভালবাসলাম বিশ্বাস করলাম তারে দিয়ে আমি আমার নিরাপদ আশ্রয় টা হারালাম।
হ্যা বলো --তারপর থেকে সে আমারে সুযোগ পাইলে ব্যবহার করতো যেখানে সেখানে নিয়ে ভোগ করতো দেহটা। এই ভাবে একমাস পার হলে সে আমারে বলে তুমি একটা কাজ করবা।মন দিয়ে শোনো মূল্যবান যা পাও তা নিয়ে আমার সাথে চলে আসবা।কালকে আমি বাড়ি যাচ্ছি তোমাকে বিয়ে করে এখান থেকে পালিয়ে যাবো আসলে সবটাই মিথ্যা ছিলো আমি বললাম পালাই যাবো কেন?
আমাদের বিয়ের কথা বললেই তো মালিক মেনে নিবে।আমাদেরকে এখানে থাকতে দিবে । সে আমারে বললো তুমি আমার চেয়ে বেশি বোঝার চেষ্টা করিস না।
আমি তার কথায় রাজী হই, নিজের বোধশক্তি হারিয়ে তার কথা মতো আপামনির যা কিছু পাইছি অলংকার টাকা পয়সা কাপড়-চোপড় সবকিছু আমি ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে তার সাথে চলে যাই সে পথের মধ্যে আমাকে বলে তুমি এখানে একটু বসো আমি তোমার জন্য খাবারটা নিয়ে আসি।
বসতে বসতে দুপুর বেলায় একটা মহিলা এসে বলে চলো তোমার স্বামী আমাকে পাঠাইছে। বললাম কই উনি বললো এইতো হোটেলে চলো আগে খাই তারপর সব বলবো।সে বিরিয়ানি খাওয়াইলোমহিলা দেখতে শুনতে ভদ্র মনে হলো সে আমাকে বললো তোমার স্বামী আমার ভাই আমার নাম সালমা রানী তোমাকে ওর বাড়ীতে নিয়ে যাবো।
আমি কিছু বুঝতে পারলাম নাপরে দেখি একটা চারতলা ভবন ঢাকায় পরে জানলাম এটা একটা পতিতা পল্পী।
আপামণি আমি কোনদিনও ভাবতে পারি নাই সে আমার সাথে এত বড় ধোঁকাবাজি করবে। আমাকে বিক্রি করে দিয়ে সে ফায়দা লুটলো। বুঝলো না একদিন কর্মফল তাকে পেতেই হবে।
সুরভীর কস্ট চোখের পানি আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম নাবললাম কি সব বলছিস!
হ্যা, আপামনি এরপর আমি প্রায় তিনমাস পর বুঝতে পারি আমি মা হতে চলেছি।ওদের এই নরক ভবনের কঠিন নিয়মে শত শত নারীর কান্না বেদনার কাহীনি আছে।আমার এক একটা মুহূর্ত কাটতো বিভীষিকাময় জোয়ান বৃদ্ধ সব ছিলো অমানুষ পশুর মতো।
একসময় আমি খুব অসুস্থ হয়ে গেলে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি দেয়। আমি অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে বাচ্চাটাকে হারাই।বুঝলাম একজন নারীর সন্তান হারানোর এমন নির্মম কস্ট নিয়ে সুরভীর কেমন লেগেছে যার হয় সেই বুঝে।
আসলে সুরভী তোমার গোটা জীবনটা অমানুষদের জন্যই বিষাক্ত হয়েছে।অথচ সেই দারোয়ান চাইলেই তোমাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারতো।
"মানুষ কেনো বুঝে না প্রান তো প্রানই মানুষ কখনো পুরাতন হয় না। সে জেগে উঠতে পারে, শেষ হতে শুরু করতে পারে, পরিবেশ পেলে সে অনন্য হয়ে উঠতে পারে"তারপর বলো সুরভী--বাচ্চাটা আমার ভালোবাসা ছিলো তার ছবিটা আজো বুকের ভেতরে আছে,বলেই আবার হুহু করে কান্না।বললাম কেঁদে ফেলো আগে।
ড্রাইভারকে বললাম, একটা পানতা আর সমুচা নিয়ে আসো সুরডীর জন্য।নাস্তা খাবার পর আবার শুরু হলো সুরভীর বলা,,,,
ডাক্তার যখন আমাকে বললো তোমার বাচ্চা বেঁচে নেই আমি উনার হাতটা ধরে বললাম দয়াকরে আমাকে বাঁচান আমাকে মৃত ঘোষনা করেন অজ্ঞান করেন ওরা আমাকে নিয়ে বন্দী করে ফেলবে আমি বাচঁতে চাই।
বড় ভালো মহিলা ডাক্তার আপা আমাকে অজ্ঞানের ঔষধ দিয়ে বললো এই রোগী মারা গেছে পুলিশ কেইস হবে। ওকে তদন্তের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে শুনেই ওরা আর আসেনি।
এই সুযোগে রাতেই আমাকে লাশের ঘরের পাশ হতে ডাক্তার আপার গাড়ীতে করে উনার বাসায় নিয়ে আসে। আমি সেই বাসায় কাজ করা শুরু করি ডাক্তার আপা আমার কাজে কর্মে খুব খুশি হয়ে সাধারণ নার্স ট্রেনিং দিয়ে উনার সাথেই রাখেন।হাসপাতালে শুরু হয় নতুন পরিচয় নতুন পোষাক আষাক সম্পূর্ণ নতুন এক আমি যার সবটাই ডাক্তার আপার অবদান আমি সুযোগ পেলেই ডাক্তার আপার সেবায় থাকতাম।
এক সময় এক ডাক্তার আমার প্রেমে পড়ে আমার ডাক্তার আপাকে খুব করে বলে আমার কথা।আপাকে বললাম না আপা জান সমস্ত জীবন আপনার সাথে কাটাবো তবুও আমাকে দুরে ঠেলে দেবেন না।
ডাক্তার আপা আমাকে এতো ভালোবাসতেন বললো পাগলী আমি চাই তুমি সুখী হও আর তোমার নিজের একটা পরিচিতি হউকডাঃ বিনয় প্রায় আসতো। আজকেও আসলো,
বিনয়কে গরম গরম সিংঙ্গারা দিয়ে চা দিলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে সিংঙ্গারাটা দুইভাগ করলো ছোট্ট টুকরো মুখে দিলো গরম গরম ধোঁয়া বের হচ্ছিলো বললো তুমি বানিয়েছো?
বললাম হ্যা প্রতি শুক্রবারই বানাই পিয়াজু সিংঙ্গারা মুড়ি চা।হ্যা আপনার পিয়াঁজুটা সবচেয়ে সেরা, প্রেমে পড়ে গেলাম।বললাম -আচ্ছা তোমরা কারনে অকারনে এতো প্রেমে পড়ো কেনো?আজকাল আবার নতুন টেকনিক শিখেছো মোবাইলে ফিসফিসিয়ে কথা বলা, যত্তসব! এসব কারনেই সাধের সংসার গুলো ভাঙ্গছে।
বিনয় বললো --আরে আমি এক্ষেত্রে একদম দোষী না ,আটারো বছর সংসার করার পর তার নাকি আমাকে আর পছন্দ হয় না।
আপোষে যেতে দিলাম কারন তার বয় ফ্রেন্ড তাকে এমনিতেই পাচ্ছে । স্বামীরা বরং মনে মনে খুশি হয় পুরাতন বউ যদি নতুনের জন্য জায়গা করে দেয় হা হা হা।
সুরভী বিনয়কে হাসতে দেখে বললো উপরে থাকা হচ্ছে তাই না?যদিও জানি ভাবী তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
বিনয় বললো -তোমার কাছে মন খুলে হাসতে পারি বলতে পারি বলেই তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব টা দিলাম।তুমি ভেবে দেখো ।
ডাক্তার আপা বললো শোনো সুরভী আমার স্বামী ও বড় ডাক্তার পি এইচ ডি করতে দেশের বাহিরে গেছে।তোমার কোন সমস্যা হলে আমি তো আছি।বিনয়কে বিয়ে করো সুখী হবে।
ডাক্তার আপা আমাকে নিজে দাড়িয়ে খুব ধুমধাম করে বিয়ে দিলো আমার অতীত নিয়ে কখনো জানতে চাইতো না আমার স্বামী বিনয়।আমি বার বার বলতাম আচ্ছা আমার তো একটা অতীত থাকতে পারে তুমি তা জানতে চাও না কেনো?সে হেসে বলতো কেনো তুমি একটা জলজ্যান্ত মানুষ আমার সাথে আছো সেটার চেয়ে বাস্তব আর কি হতে পারে কি জানার আছে।মানুষকে বিচার করার বা পরীক্ষা করার কি আছে?মানুষ কখনো পুরনো হয় না অশিক্ষা কুশিক্ষা গুলো আমাদের সমাজে কুসংস্কার তৈরী করে।তুমি অসম্ভব একজন ভালো মানুষ তোমাকে পেয়ে সুখী আমি যার তুলনা নেই।
সুরভী নিজের কাজে মন দেয় ইতিমধ্যে বেশ নাম খ্যাতি ও অর্জন করে।হাসপাতালে এক রোগীর করুন চিৎকার চেঁচামেচি কানে এলে সুরভী সেদিকে গিয়ে দেখলো রোড় এক্সিডেন্ট করে এক লোক পা হারিয়েছে।কাছে গিয়ে বিস্মিত হলো চিনলো সেই দারোয়ান যাকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলো আর আজ সে নিজের অবস্থান ভেবে সুখী অনুভব করলো।
বাসায় ফিরে দেখলো বিনয় তার অপেক্ষায় একি তুমি এতো তাড়াতাড়ি? সুরভী জানো আজ কয়েক দিন ধরে মনটা খারাপ বললাম কেনো?সে বললো সিফা আর বেঁচে নেই তার নতুন স্বামী তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ধোঁকা দিয়ে চলে গেলে সে আত্মহত্যা করেছে। আমরা মানুষেরা বুঝি না নদীর সব পাড় সমান দুর হতে সুখ মনে হয়, আসলে সুখ নিজ সৎ কর্মে, কেউ কাউকে ধোকাঁ দিয়ে সুখী হতে পারে না।