আমাদের কবিতায় বর্ষাময়তা ।। মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ

 


 মাথার ওপরে মেঘলা আকাশ।মনের আকাশ মেঘলা করতে কার মনে চায়?মেঘমেদুর বর্ষার দিনরাত আবহটা যে সঙ্গীন।জলের 'পরে জলের অবাধ প্রপাতে শুষ্কতার অবসান।তবে একঘেঁয়েমির চরম মূল্য দিয়ে সাধারণ মানুষের যাপনীয় সময়টাকে সতেজ আলোচনার নিগূঢ়তম চর্চাগুলো পাতায় পাতায় ভরে যায়,এটাই স্বভাবিক।নগর-সভ্যতায় দ্রুততম সময়ে বিস্তারনের লড়াইয়ে এসব জীবনের গান কখনো কখনো বড্ড ক্লান্তিকর। যদিও আবেগ নামক জটিল নিয়ম, তাকে হাতছানি দেয়।প্রলুব্ধ করে কবিতার নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে।আমাদের দেশ,প্রাণবৈচিত্রে মানুষের জীবনবোধের গভীর সংযুক্তিতে নিবদ্ধ। এই গূঢ়ৈষা নিরাভরণ মনে হলেও যথেষ্ট আন্তরিক। যথেষ্ট প্রকাশিত। 
বর্ষণের বাস্তবতার ছবি আঁকতে গিয়ে কবি মুহম্মদ  নূরুল হুদা বলে যান"-----
এ,সমুদ্র বাষ্পমেঘ,মেঘের বর্ষণে,
যদি সব একাকার............জলপুত্র,,জলকন্যা,
আমাদের অস্ত্রে জ্বলে জলের হুংকার.....।
(এ বর্ষণ,ঐ গর্জন।মুহম্মদ নুরুল হুদা)
মননে শক্তিশালী উচ্চারণের মতো শব্দের বর্ষণ আমাদের আরো শাণিত করে।মনের ভেতরের দহনকালটাকে আপোষহীন করে রাখে।

কবি কামাল চৌধুরীর হৃদয়ের স্বচ্ছ  করিডোরে  জন্মানো লেখায় বরষার নিষ্কলুষ  বন্দনা,তিনি হাত পাতেন নতুনতর বরিষনের অধ্যায়ে, উপচে পড়ে তার ভাষার বর্ষাজল।তিনি বাঙময় ক্যানভাসে সচকিত বারবার----
হাত পেতেছি বর্তমানে উপচে পড়ে তীর্থ ভাষা
রাত বিরেতে পালের নেশা ভাসিয়ে রাখে কীর্তিনাশা ছায়া।

ময়মসিংহের পাললিক কবি প্রিয়জন,ফরিদ আহমদ দুলালের অস্থিরতা দেখতেই পারি সহজে তিনি বর্ষা স্নাত এক শীতল সলীলি কবি।অবগাহন করেন একা মায়াবী অন্তঃপুরে।

তরুণ কবিতার কবিদের একজন মুহতাসিন ত্বকী তার 'প্রিয় চোখ কিংবা বর্ষা'র শব্দগুচ্ছ সাজান---
এ-ই শহরের প্রতি বর্ষায় আমি প্রেমে পরি।
আমি প্রেমে পরি এক জোড়া কাজল চোখের।
ঠিক সন্ধ্যা বেলায় ঝুম বৃষ্টি হলে
আমি দাঁড়িয়ে যাই নীল জানালায়--।
বর্ষা যাপন হয়ে ওঠে উদযাপনের সজল সতেজ মুহূর্ত। জানালায় দাঁড়িয়ে সাধারণ চোখে বৃষ্টির উপভোগ তখন চিরায়ত আবেগের নাম।

সাহিত্যের দিকপাল লেখকের কল্পনার চিরন্তন রূপ সবাই জ্ঞাত। আমাদের শৈশব, কৈশোরের দুরন্তপনায় বর্ষার তাবৎ ছেলেমীপনা।
কবি সুকুমার রায়ের কৈশোর ভাবনায় 'বর্ষার কবিতা' এরকমই একটা কাব্যিক আবহে বর্ষণসিক্ত কৈশোর  ---

সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে
ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখখানা ফ্যাকাসে।

বাংলা-ভারতের আবহাওয়ার নৈমিত্তিক  অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ষা এসেছে বারবার। নানান চিন্তা-চেতনার সার্বজনীন সন্তরণ যেন বৃহত্তর সাহিত্যের জলাশয়টা ফেনিল করে রেখেছে।কোনো কবি বর্ষা-বিমুখ থেকেছেন তার সংখ্যা নিশ্চিত বলা যাবেনা।কবি নজরুলের 'চক্রবাকে' বিরহের সংবেদিত কাব্য ধারায় বর্ষা যেমন 'কেতকী পাতার তরী,তাকে উন্মনা করেছে --
ওগো বাদলের পরী,
যাবে কোন দূরে,ঘাটে বাঁধা তব
কেতকী পাতার তরী।

শাওন রাত কবিকে বিরহী বিধুর করে তোলে।নিশীথের স্বপনের মতো স্মৃতিগুলো প্রিয়াকে ভুলে যেতে তার সরল আকুতি।বাহিরে যখন ঝড় বয়ে যায়,কবি নজরুল ভেতরে ভেতরে বর্ষণে সিক্ত। 

রবীন্দ্রনাথের বর্ষা বহুমাত্রিক,আয়ত চিন্তার বিন্যাস।বর্ষার বাস্তব ছবিতে রবীন্দ্রনাথ উদ্ভাসিত হবার কৃতিত্বে ভাস্বর--

বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর
আউশের খেত জলে ভর ভর
কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার 
ঘনায়েছে দেখ চাহিরে।
(আষাঢ়) 
এটা তো কেবল খণ্ডিত একটা ছবি নয়।ব্যক্তিক,সামষ্টিক।আমাদের সমাজজীবনের অনিবার্য পরিচয়।
সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষাণের ধানকাটার আনন্দের সাথে বর্ষার সংযোজন দেখি সোনার তরীতে।
মেঘে ঢাকা একটি পল্লীর নিভৃতে সচকিত প্রভাতে তিনি ফসলে ভরা বাংলার রূপ কল্পনা করেছেন।

শামসুর রাহমানের নাগরিক মনে, নাগরিক চোখে বর্ষার রূপায়িত প্রচ্ছদ আমাদের নতুন নতুন জলসিক্ত মননের সরোবরে সাঁতার কাটায়।তার অমিয় সৃষ্টি 'আকাশ আসবে নেমে'র 'নিঝুম বৃষ্টির সুর' কে না শুনেছে? তিনি সাগ্রহে শব্দশৈলীর নতুন পরিচয়ে বর্ষাকে উপস্থিত করেছেন---
সাঁওতাল রমণীর মতো যে অন্ধকার
দিগন্তে স্তব্ধ
তা এখন শহরের ওপর খুব নীচু হয়ে
ঝুঁকে পড়েছে, ওপর নিঃশ্বাস
অনুভব করি ত্বকে।
বর্ষা আসে তীব্র গ্রীষ্মের খাণ্ডব দাহনের পর।বাঙ্গালির মনের ভেতরের সুদীর্ঘকালের শোষন বঞ্চনার প্রতীক হিসেব গ্রীষ্মের খরতাপের পরে মৌসুমি বায়ুর কল্যানে গাঙ্গেয় বদ্বীপের কোমল পললে অনিবার্য অধ্যায়,বৃষ্টির ধোঁয়াশা। আমাদের উজ্জীবনের বহুমাত্রিক ধারা।এখানকার সাহিত্যের নানান আঙ্গিকে বর্ষা জড়িয়ে আাছে।সংস্কৃতি, অর্থনীতিতেও বর্ষা কাঙ্খিত।এ-ই বর্ষাকে কবিদের হৃদপিণ্ডে সহজলভ্য।তাদের বুকের মধ্যে বেজে চলে  অবিরাম বর্ষার কবিতা।

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাই প্রিয়তমাকে কেবল 'প্রাণের বর্ষা ঋতু'টাকেই উপহার দেন বারবার। বর্ষাকে দিয়ে নিজে এখন রিক্ত।তার ভেতরে কেবল 'রৌদ্রদহন'
তাই নিজেকেই প্রশ্ন করেন--

কখনো কি আর সবার মরুতে বাঁধবে সেতু
মেঘ যবনিকা ছিঁড়ে ফেলে তুমি ছুঁয়ে যাবে মন?
(বিচ্ছেদ)
 
বৃষ্টি, বর্ষা, মেঘ,জলে একাকার কবির তৃষিত মাটি।যুগে যুগে এই আবহমান ধারায় বৃহত্তর সমাবেশ। সমাবেশ প্রেমের,সমাবেশ কল্যাণের, সমাবেশ শান্তির সজল চোখে সতেজ অনুভবের।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আলোকায়নে আবারও চিরায়ত বর্ষাভাবনা--
শতেক যুগের কবি দলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্ত মদির বাতাসে 
শতেক যুগের গীতিকা
শত শত গীত মুখরিত বন-বীথিকা।
(কল্পনা,বর্ষা-মঙ্গল কাব্য)

********
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ 
লেখক,গল্পকার,প্রাবন্ধিক।
ঠিকানা--
প্রগতি হোমিও ফার্মেসী
শ্যামগঞ্জ বাজার 
ময়মনসিংহ

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।