সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীরা বিশ্বের গভীরতম গিরিখাতে এশিয়ার সবচেয়ে লম্বা গাছের আবাসস্থল খুঁজে পেয়েছেন ৷ ৩৩৫ ফুট (১০২ মিটার) উচ্চতার নতুন আবিষ্কৃত এক বিশাল সাইপ্রেস গাছ (Cypress tree) চীনের তিব্বত অঞ্চলের একটি জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছে, যেটি স্ট্যাচু অফ লিবার্টি (Statue of Liberty) থেকেও উচ্চ হয়ে উঠেছে । এটি একটি সরলবর্গীয় চিরহরিৎ বৃক্ষ । চীনে আবিষ্কৃত সাইপ্রেস গাছটি এশিয়ার সবচেয়ে লম্বা গাছ । এ আশ্চর্যজনক গাছটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গাছ বলেও বিশ্বাস করা হয় । বিস্ময়কর যে, এ উচ্চতায় গাছটি স্ট্যাচু অফ লিবার্টির (৩০৫ ফুট বা ৯৩ মিটার) চেয়েও উঁচু । চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত এক বিবৃতি অনুসারে জানা যায় যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক বা অনুসন্ধানিক দল গত মে মাসে অতিকায় সাইপ্রেস গাছটি হিমালয়ের উত্তর দিকে সুউচ্চ ‘পৃথিবীর ছাদ’ খ্যাত তিব্বত মালভূমিতে অবস্থিত চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নিইংচি শহরের (Nyingchi City) বোমে বিভাগ বা জেলার (Bome County) ইয়ারলুং জাংবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন জাতীয় প্রকৃতি সংরক্ষিত (Yarlung Zangbo Grand Canyon National Nature Reserve) ভূমিতে আবিষ্কার করে । এ স্থানটি বিশ্বের গভীরতম স্থলজ গিরিখাত বলে মনে করা হয় । কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে ইয়ারলুং জাংবো নদী দ্বারা এটি গঠিত হয়েছে । যেখানে প্রকৃতি সংরক্ষণের গড় গভীরতা ১৬০০০ ফুট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১৯৭১৪ ফুট । এ ঘন বনাঞ্চল থেকে গাছের উচ্চতা অনুমান করা সহজ ছিল না এবং উপত্যকায় অবস্থানের কারণে এ গাছের উচ্চতা এক নজরে বোঝা খুব কঠিন । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিব্বতের বনভূমি সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি । এ কারণেই গবেষকরা এখন এ অঞ্চলে উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্যের একটি বিশদ গবেষণা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এ সমস্ত লম্বা গাছ একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ভাগ করে । এগুলো সবই নিইংচি শহরের মধ্যে বিশেষত মেডগ কাউন্টি (Medog County), জায়ু কাউন্টি (Zayu County) এবং বোমে কাউন্টিতে (Bome County) আবিষ্কৃত হয়েছে । দেশের এ অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক বিশালাকার গাছ রয়েছে । সাইপ্রেস গাছটি কোন প্রজাতির অন্তর্গত তা স্পষ্ট নয়, যদিও চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে এটি হয় হিমালয়ান সাইপ্রেস (Himalayan cypress, বৈজ্ঞানিক নাম: Cupressus torulosa) কিংবা একটি তিব্বতি সাইপ্রেস (Tibetan cypress, বৈজ্ঞানিক নাম: Cupressus gigantea) প্রজাতি ৷ হিমালয় এবং তিব্বতীয় সাইপ্রেস প্রজাতিগুলো বন্য অঞ্চলে বিরল প্রজাতি এবং মাত্র কয়েকটি ইয়ারলুং জাংবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন জাতীয় প্রকৃতি সংরক্ষিত ভূমিতে পাওয়া যায় । এ গাছগুলো চীনের প্রথম শ্রেণীর সংরক্ষিত উদ্ভিদ প্রজাতির অন্তর্গত । রাষ্ট্র পরিচালিত চীনা প্রকাশনা পিপলস ডেইলি অনলাইন অনুসারে গাছটির ব্যাস হচ্ছে ৯.৬ ফুট (২.৯ মিটার) । এটি আবিষ্কারের আগে এশিয়ার সবচেয়ে লম্বা গাছটি ছিল ৩৩১ ফুট লম্বা (১০০.৮ মিটার) হলুদ মেরান্টি (Yellow Meranti, বৈজ্ঞানিক নাম: Shorea faguetiana), যেটি মালয়েশিয়ার সাবাহ (Sabah) এর ড্যানুম উপত্যকা সংরক্ষিত এলাকায় (Danum Valley Conservation Area) অবস্থিত । তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি অনন্য বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) রয়েছে যা ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে । উল্লেখ্য যে: বাস্তুতন্ত্র হচ্ছে জৈব, অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে । যাইহোক, এলাকাটি বিশেষ করে নিইংচি শহর সম্প্রতি উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতকে রক্ষা করার জন্য সংরক্ষণ প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে । বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এলাকার পরিবেশগত বৈচিত্র্যকে আরো ভালোভাবে বুঝতে এবং পরিবেশগত সুরক্ষা প্রচেষ্টায় সাহায্য করার জন্য এ অঞ্চলে লম্বা গাছের নথিভুক্ত করেছেন । গত বছরের মে মাসে গবেষক দলটি দক্ষিণ-পশ্চিম চীনে ২৭২ ফুট লম্বা (৮৩ মিটার) প্রাচীনতম একটি ফার গাছ (Fir tree) খুঁজে পেয়েছিল, যেটিকে তারা প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে এটিই চীনের বৃহত্তম গাছ । এছাড়াও দলটি এক মাস আগে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আবহাওয়া প্রতিকূল ও বিপদসঙ্কুল মেডগ বিভাগ বা জেলাতে (Medog County) ২৫২ ফুট (৭৭ মিটার) উচ্চতার আরেকটি গাছ উদ্ঘাটিত বা উন্মোচন করেছিল । এ বছর গবেষকরা তাদের জরিপ অব্যাহত রেখে ড্রোন, লেজার এবং রাডার সরঞ্জাম ব্যবহার করে এলাকার গাছের মানচিত্র তৈরি করেন এবং মাটি থেকে তাদের উচ্চতা চিহ্নিত করেছেন । কয়েকদিনের মাঠ জরিপের পর দৈত্যাকার সাইপ্রেস গাছটি পাওয়া গেছে ৷ তারা ড্রোন (Drone) ব্যবহার করে একটি থ্রিডি লেজার স্ক্যানার (3D laser scanner) এবং লিডার প্রযুক্তি (Lidar technology) দ্বারা যা দূরত্ব পরিমাপ প্রদান করতে হালকা মরীচি বা রশ্মি (Beam) ব্যবহার করেন । গবেষক দলটি সঠিক মাত্রা প্রদান করে এ বিশাল গাছের একটি থ্রিডি মডেল তৈরি করেছে । এটি ব্যবহার করে তারা নিশ্চিত করেছেন যে, এটিই এশিয়ার সবচেয়ে লম্বা গাছ । ক্রিমানা ফর্মটিও (Krimana form) প্রকৃত গাছের সঠিক মাত্রা অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয় । গবেষকরা আশা করছেন যে, এ ত্রিমাত্রিক মডেল তাদের একই প্রজাতির অন্যান্য গাছ সম্পর্কে আরো বুঝতে সাহায্য করবে । পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রিমোট সেন্সিং ইনস্টিটিউটের (Institute of Remote Sensing) অধ্যাপক গুও কিংহুয়া (Guo Qinghua) রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন যে, এ গাছের বিশেষত্ব হচ্ছে এর সহায়ক শিকড় সম্পূর্ণরূপে মাটির নিচে থাকে না । অনেক বিরল উদ্ভিদ প্রজাতিও ছড়িয়ে থাকা শিকড়ের নিচে বাস করে । গাছটির একটি জটিল শাখা ব্যবস্থাও রয়েছে যা “কিছু বিপন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের জন্য আদর্শ স্বল্প জলবায়ু এবং স্বাভাবিক আবাসস্থল” প্রদান করে । বর্তমানে ৩৮১ ফুট (১১৬ মিটার) উচ্চতার বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা উপকূলীয় রেডউড (Coastal redwood, বৈজ্ঞানিক নাম: Sequoia sempervirens) গাছটির অবস্থান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড ন্যাশনাল পার্কে । এ প্রাচীন গাছটি ৬০০ থেকে ৮০০ বছরের মধ্যে পুরোনো বলে মনে করা হয় এবং গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে টাইটানদের একজনের নাম অনুসারে এর ডাকনাম হাইপেরিয়ন (Hyperion), এটি ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয়েছে । গত বছর ইউ. এস. পার্ক সার্ভিস (U.S. Park Service) হাইপারিয়নে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয় কারণ দর্শনার্থীদেরকে গাছে আরোহণ এবং এলাকায় বর্জ্য ফেলতে দেখা যায়, ফলে আশেপাশের নিচের পুষ্টি বা ক্রমবিকাশকে (Undergrowth) ক্ষতিগ্রস্ত করে । বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম গাছ হওয়ার রেকর্ড মালয়েশিয়ার ৩৩১ ফুট (১০০.৮ মিটার) হলুদ মেরান্টি গাছটি । চতুর্থ স্থান অস্ট্রেলিয়ার পর্বত ছাইকে (Mountain Ash) দেয়া হয়েছে যার পরিমাপ ৩২৯.৭ ফুট (১০০.৫ মিটার) । বিশ্বের পঞ্চম স্থানের অধিকারী গাছটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের প্রেইরি ক্রিক রেডউডস স্টেট পার্কের ৩২৯ ফুট (১০০.২ মিটার) Sitka spruce (Picea sitchensis) । এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের রাজ্য ওরেগন এর ব্রুমিট ক্রিক, কুস কাউন্টিতে ৩২৭ ফুট (৯৯.৭ মিটার) Coast Douglas-fir (Pseudotsuga menziesii var. menziesii) গাছটি বিশ্বের ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে । সাইপ্রেস বলতে ১২ প্রজাতির আলংকারিক এবং কাঠ চিরসবুজ শঙ্কুযুক্ত উদ্ভিদের যে কোনো একটিকে বোঝায়, যা Cupressus গণের অন্তর্গত । এগুলো এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা বিশেষত উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে । সাইপ্রেস গাছগুলো তাদের অদ্ভুত এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত । এ গাছগুলো মানুষ এবং পরিবেশের জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে । মাথাব্যথা, প্রদাহ এবং কাশি চিকিৎসার জন্য ঐতিহ্যগত ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় । যেহেতু এগুলোতে একটি সক্রিয় উপাদান রয়েছে যা উইপোকা বিকর্ষণ করে, তাই এগুলো পোকামাকড় তাড়ানোর বৈশিষ্ট্যযুক্ত পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় । সর্বোপরি সাইপ্রাস গাছগুলো নির্মাণ সামগ্রীর একটি ভালো উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় । বিশেষ করে মেঝে, দরজা এবং স্থাপত্য কাঠের কাজ তৈরিতে । তারা ৫০ থেকে ১৫০ ফুট পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ১০০ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বাঁচতে পারে । দীর্ঘমেয়াদে গবেষকরা গিরিখাতের সাইপ্রাস গাছগুলোকে তাদের বৈশিষ্ট্য যেমন জনসংখ্যা, বন্টন ঘনত্ব এবং বয়স সম্পর্কে গবেষণা বা অধ্যয়ন করার জন্য নিরীক্ষণ করার পরিকল্পনা করেছেন । তারা ইয়ারলুং জাংবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের জীববৈচিত্র্য এবং অনাবিষ্কৃত গাছগুলো বিশ্লেষণ করতে আরো অনেকাংশে অন্বেষণ করার লক্ষ্য রাখে ।
তথ্যসূত্র: livescience.com (by science writer Lydia Smith), https://www.
আমার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ায় সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ।
ReplyDelete