সেটা ১৯৪০ সাল। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের একটা ছোট্ট দ্বীপ নিকুমারোরোতে কয়েক জন গবেষক খুঁজে পেলেন একটা ভাঙাচোরা কঙ্কাল। কিন্তু কঙ্কালটার অবস্থা দেখে গবেষকরা রীতিমত অবাক হয়ে গেলেন। কঙ্কালটার সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের অংশগুলো ছেঁড়া-খোড়া অবস্থায় পড়েছিল, যেন কোন খুব শক্তিশালী কিছু প্রচন্ড বল প্রয়োগ করে কঙ্কালটাকে ছিঁড়েছে। এই ঘটনার কথা চাউর হতে অন্য একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল। সেই কঙ্কাল উদ্ধার হবার পর বোঝা গেল বছরখানেক আগে নিখোঁজ মার্কিন লেখক এবং বিমানচালক অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্টের অন্তিম পরিণতি কী হয়েছিল! অনেক ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশ গবেষক আজো বিশ্বাস করেন যে ওই ছেঁড়া-খোড়া কঙ্কালটা ছিল অ্যামিলিয়ার। ধারণা করা হয়, অ্যামিলিয়ার বিমানটা কোন কারণে এই দ্বীপে আছড়ে পড়ে। আহত অথবা মৃত অ্যামিলিয়ার দেহটাকে এই দ্বীপের অন্যতম অধিবাসী, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলচর অমেরুদন্ডী প্রাণীরা তাদের প্রচন্ড শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে নির্মমভাবে ছিঁড়ে ফেলেছিল। সেই অমেরুদন্ডী প্রাণীটার নাম, "কোকোনাট ক্রাব"।
কোকোনাট ক্রাব পৃথিবীর স্থলভাগে চরে বেড়ানো সবচেয়ে বড় অমেরুদন্ডী প্রাণী। ১৫৮০ সালে ফ্রান্সিস ড্রেক প্রথম এদের কথা মানুষকে জানান। এরপর ১৬৮৮ সালে উইলিয়াম ড্যাম্পিয়র এই প্রাণীর কথা আরো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আনেন।
"কোকোনাট ক্রাব" বা নারকুলে কাঁকড়া আসলে এক ধরনের 'হারমিট ক্রাব' বা সাধু কাঁকড়া। এরা সমুদ্রে জীবন শুরু করে আণুবীক্ষণিক লার্ভা হিসেবে। প্রায় একমাস সমুদ্রে থাকার পর এই লার্ভা গুলো মোটামুটি একটা এমন দশায় আসে যে তারা আর জলে ডুবে থাকতে পারে না। এরপর এদের শিশুরা ফাঁকা শামুকের খোলকগুলো ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করে এবং ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে। এরপর এরা পাকাপাকি ভাবে স্থলে বসবাস শুরু করে।
এই হারমিট ক্রাব বা কোকোনাট ক্রাব আমরা সচরাচর যে ধরনের কাঁকড়া দেখি তাদেরই একটা প্রজাতি। সমস্ত পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি ফ্যামিলিতে অন্তর্ভুক্ত থেকে কাঁকড়াদের প্রায় ৭০০০ প্রজাতি আছে। আমাদের পরিচিত কয়েকটা কাঁকড়া যেমন, ব্লু কাঁকড়া, ফিডলার কাঁকড়া, মাকড়সা কাঁকড়া, পাহাড়ি কাঁকড়া, ঘোস্ট কাঁকড়া, স্থলচর কাঁকড়া প্রভৃতি।
১০ কোটি বছর আগের একটা কাঁকড়ার জীবাশ্ম থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে কাঁকড়া তখনো ছিল। অর্থোপোডা পর্বের এই ক্রাস্টাসিয় প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এই কোকোনাট ক্রাব। অমর জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন যখন প্রথমবার এই কোকোনাট ক্রাব দেখেন, তখন তাঁর মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে এসেছিল একটা কথা,-- 'দৈত্যাকৃতি'!
ডারউইনের সময়ে একটা গুজব ছিল, যে কাঁকড়ারা গাছে উঠতে পারে এবং শুধুমাত্র একটা দাঁড়া দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গাছ থেকে ঝুলে থাকতে পারে। কাঁকড়ারা তাদরে দাঁড়ার মতই প্রায় মাকড়সার পা গোছের পা গুলোকে ব্যবহার করে ঝুলে থাকতে পারে। এমনটাও শোনা যেত, যে ওই কাঁকড়াগুলো তাদের শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে নারকেল ও ভেঙে ফেলতে পারে। এটাও শোনা যেত যে এই কাঁকড়ারা মানুষের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। যদিও ডারউইন এই ধরনের গুজব গুলোকে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রমাণ হয়েছিল, ওই সব গুজব গুলোয় কোন অতিরঞ্জন ছিল না, এই গুজব গুলোর অধিকাংশই সত্য ছিল।
বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় নারকেল গাছের ফাঁক-ফোকরে বাস করা কোকোনাট ক্রাবই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও হিংস্র কাঁকড়া। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের অসংখ্য দ্বীপে এই দানবাকৃতি কাঁকড়া গুলোর বাস। এরা লম্বায় প্রায় ১ মিটার এবং ওজনে প্রায় সাড়ে চার কেজির মতো হয়। এরা নিজেদের দেহের চেয়ে ছয়-গুণ বেশি ওজন তুলতে পারে। পরিণত বয়সের এই কোকোনাট ক্রাব হাল্কা বেগুনী থেকে বাদামী রঙের বা গাঢ় বেগুনী রঙের হয়। তরুণ পুরুষরা হয় বাদামী এদের খোলকের উপরে কালো ডোরা দাগ থাকে।
এরা এতটাই শক্তিশালী যে কোন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই নিজেরাই নারকেল ভেঙ্গে খতে পারে। এদের দাঁড়া বা চিমটা দিয়ে এরা প্রায় ১৫০০ নিউটন বল প্রয়োগ করতে পারে। যা সিংহের কামড়ের সমতুল্য। অধিকাংশ প্রাণীর আর হাড় দুইভাগ করার জন্য এই বলে যথেষ্ট। প্রধান খাদ্য নারকেল হলেও পৃথিবীর প্রায় সব ধরনের খাবার খেয়ে থাকে। এরা পাখি শিকার করে আবার জ্যান্ত শুকর ও ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। এমনকি এরা নিজেদের প্রজাতির মৃতদেহ ও খেয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, এরা নিজেদের ছেড়ে ফেলা শুকনো খোলকটাকেও খেয়ে ফেলে।
কোকোনাট ক্রাব যেটা খায়, সেটা পুরোটাই খেয়ে ফেলে এবং খাবারটাকে এরা ধীরে ধীরে চিবিয়ে খায়। এদের নারকেল খাওয়ার পদ্ধতিটাও বেশ অদ্ভুত। একটা নারকেলের শাঁস পর্যন্ত পৌঁছাতে এদের বেশ কয়েকটা দিন লেগে যায়। গাছে চড়তে বেশ দক্ষ এই বৃহদাকার কাঁকড়ারা মাটিতে পড়ে থাকা ছোবড়া সমেত নারকেল নিয়ে ৩৩ ফুট বা ১০ মিটার উঁচু গাছে উঠে পড়ে। তারপর গাছের উপর থেকে সেই ছোবড়া সমেত নারকেলটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ে নারকেলটা যায় ভেঙে, আর সেই ভাঙা নারকেলটা খেতে গাছ থেকে তরতর করে নেমে আসে কোকোনাট ক্রাব। গাছ থেকে নেমে কোকোনাট ক্রাব নারকেলের শাঁসটাকে তৃপ্তি করে খায়। আর গাছ থেকে তাড়াতাড়ি নামার জন্য কাঁকড়াটা অনেক সময়ই গাছের উপর, প্রায় ৪.৫ মিটার বা ১৫ ফুট উপর থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে। গাছে চড়ায় এরা যেমন দক্ষ তেমনি এরা এদের শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে গাছের কোন শাখা বা লোহার রড বা শিকল অথবা বাড়ির চারধারের দেওয়াল ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝুলে থাকতে পারে।
পাখি শিকারের এরা দারুণভাবে দক্ষ। সহজাতভাবেই এরা খুবই ভালো বৃক্ষচারী। তাই রাতের বেলায় এরা গাছের চূড়ায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে।কোন পাখি এদের আশে-পাশে আসলে আর রক্ষা নেই।এদের শক্তিশালী চিমটা থেকে রেহাই পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা অধিকাংশ পাখিরই নেই। জীববিজ্ঞানী মার্ক লেইডার, বহুদিন যাবৎ অত্যন্ত নিষ্ঠা আর পরিশ্রম দিয়ে কোকোনাট ক্রাব নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁর একটি অভিজ্ঞতা তিনি জানান এভাবে, -- " মাঝ রাতে আমি একটা কোকোনাট ক্রাব কে দেখেছি একটা 'লাল পা বুবি' পাখিকে আক্রমণ করতে এবং সেটাকে হত্যা করতে। বুবিটা একটা গাছের একটা নিচু ডালের উপর ঘুমাচ্ছিল। ডালটা মাটি থেকে মিটার খানেক উঁচুতে ছিল। ক্রাবটা ধীরে ধীরে গাছে উঠলো এবং বুবিটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে পাখিটার ডানাটা চেপে ধরল। এভাবে পাখিটার হাড় ভেঙে তাকে মাটিতে আছড়ে ফেললো। তারপর কাঁকড়াটা গাছ থেকে নেমে এসে পাখিটার আর একটা ডানা চেপে ধরলো। পাখিটা বাঁচার জন্য খুব ঝটপটাপটি করছিল কিন্তু তাতে কোকোনাট ক্রাবটার আক্রমণের কিছুই খামতি দেখা গেল না। এরপর যেটা হল, মিনিট কুড়ির মধ্যে রক্তের গন্ধে আরও পাঁচটা কোকোনাট ক্রাব সেখানে উপস্থিত হল। ততক্ষণে পাখিটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আর ক্রাব গুলো পুরোপুরি সেই সুযোগটা নিল। তারা সবাই মিলে পাখিটাকে তাদের শক্তিশালী দাঁড়া দিয়ে টানাটানি করে যে যার মত করে ছিঁড়ে নিল। এরপর তারা প্রত্যেকে যে যে অংশটা পেল সেটা নিয়ে মাটির নিচে নিজেদের বাসায় চলে গেল এবং সেই মাংসের টুকরোটাকে খেয়ে ফেললো।
২০০৭ সালে কয়েকজন বিজ্ঞানী অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের যেখানে মৃত্যু হয়েছিল বলে ধরা হয়, সেই অকুস্থলে একটা শুকরের মৃতদেহ রেখে দেখেছেন, ক্রাবগুলো সেই শুকরের মৃতদেহটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নিয়ে নিজেদের গোপন গহ্বরগুলোতে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
প্রাণীবিজ্ঞানী সিন-ইচহিরো ওকা জানান, তাঁরা গবেষণার জন্য জাপানের ওকিনাওয়ার একটি দ্বীপ থেকে ২৯টি কোকোনাট ক্রাব নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলোর শক্তি পরীক্ষার জন্য তারা কাঁকড়াগুলোর সব পা বেঁধে শুধু লম্বা চোয়ালের সঙ্গে ‘প্রেশার সেন্সর’ লাগিয়ে দেন। দেখা গেছে, সে অবস্থাতেই কাঁকড়াগুলো চোয়াল দিয়ে স্টিলের ভারী পাতও ওঠাতে সক্ষম। এছাড়া পাতগুলোতে কামড়ে ধরতে কাকড়াগুলো অবিশ্বাস্য শক্তি ব্যবহার করেছে। এমনকি, এই কাঁকড়া এক কামড়ে ছোট আকৃতির কচ্ছপ ও অন্যান্য কাঁকড়ার খোলস গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
মধ্য যুগে নাবিকদের মাঝে এই দানবাকৃতির কাঁকড়া নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। অনেক গল্পেই বলা হত, এরা মানুষকে আক্রমণ করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করে ফেলতে সক্ষম। তবে অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্টের মত কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মানুষকে আক্রমণের তেমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। স্থানীয়রা অনেক সময় নারকেলের ছোবড়া সংগ্রহের সময় এদের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দেয়। ফলে, আত্মরক্ষার জন্য এরা অনেক সময় আক্রমণ করে বসে। তবে, এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল। তাই, দেখতে ভীতিকর হলেও এদের ভয় পাওয়া নিষ্প্রয়োজন।
অনিন্দ্য পাল।