"একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার"
এই "বাংলাদেশ" নামক ভূখণ্ড পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিয়েছে কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, স্বজন, সম্পদ হারানোর মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারী-পুরুষ, কিশোর, যুবক, নাম জানা-অজানা নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে অসীম সাহসে পাক হায়েনাদের মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা বাঙালির অহংকার। তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী এই দুই বাহিনীতে ভাগ করা হয়েছিল। একজন গেরিলা হলেন একজন অর্ধ সামরিক বা বেসামরিক ব্যক্তি যে একটি ছোট দলের অংশ হিসেবে একটি বড় সরকারি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। গেরিলা শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ গুয়েরিলেরোস" শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ক্ষুদে যুদ্ধ। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম লিখিত নথি পাওয়া যায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বের চাইনিজ জেনারেল Sun Tzu-র "The Art of war" বইটিতে। সম্রাট হুয়াং এর বিরুদ্ধে মিয়াও সম্প্রদায়ের লোকদের গেরিলা যুদ্ধের বর্ণনা তাতে দেওয়া হয়।
গেরিলা যুদ্ধ এমন এক ধরণের যুদ্ধ পদ্ধতি যেখানে ভূমি এবং ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করা হয়। গেরিলারা যুদ্ধে জয় করার জন্য এবং সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য অতর্কিত আক্রমণ, ক্ষুদ্র যুদ্ধ, হিট এবং রান কৌশল ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের সামরিক কৌশল ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাপ্লাই লাইন, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টারগুলোকে ব্যাহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে, রাতের আঁধারে সাঁতরে
নদী পার হয়ে হামলা চালিয়ে অকুতোভয় গেরিলা যোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গ্রামের কৃষক, শ্রমিকরাই যাঁরা বেসামারিক মানুষ তাঁরাই গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন মূল সড়ক, জাহাজ ও শহরে আস্তানা গাড়তো, তখন গেরিলারা অস্ত্র আর গ্রেনেড হাতে লুকিয়ে থাকত নৌকার ছইয়ের ভেতর, রাতের আঁধারে মাইন নিয়ে সাঁতড়ে গিয়ে সেটা লাগিয়ে দিয়ে আসত পাকিস্তানিদের জাহাজে। অতর্কিত হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিত ব্রিজ, রেলপথ। তাঁরা বেশিরভাগ সময় দিনের বেলা ছদ্মবেশ নিয়ে থাকতো।
গেরিলা যোদ্ধাদের অনেকে পাকহানাদারের কাছে ধরা পড়ে মর্মান্তিক বর্বরোচিত পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি তাদের স্বজনদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। অনেকে নির্যাতন সহ্য করেও সহযোদ্ধাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করেননি।
সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ গেরিলাদের বেশিরভাগ ফিরে আসতে পারলেও ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বদি, শাফী ইমাম রুমি, মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ, আব্দুল হালিম জুয়েল, সৈয়দ হাফিজুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, আবু বকর, সাংবাদিক আবুল বাশার, আবুল বাসার, আবদুল্লাহ হিল বাকী, সেকান্দার হায়াত খানসহ মোট ১১ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের আর দেখা যায়নি। ধারণা করা হয় সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখের মধ্যেই এই দুর্ধর্ষ গেরিলাদের হত্যা করা হয়েছিল।বাংলাদেশের সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানও ছিল অপরিসীম। তাঁদের সহযোগিতার জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পেরেছেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের অণুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১০ নভেম্বর ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৭৮ জন বীর যোদ্ধা আগরতলা হয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দীঘির বেতিয়ারা এলাকায় প্রয়োজনীয় অস্ত্র, বুলেট, বিস্ফোরকের বিপুল বোঝা পিঠে বহন করে জমায়েত হয়েছিলেন। সেখানে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে ৯ জন শহীদ হয়েছিলেন। বাকি ৬৯ জন সাহসী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। নয়জন শহীদ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হলেন নিজামুদ্দিন আজাদ, মোঃ সিরাজুল মুনীর, জাহাঙ্গীর বশিরুল ইসলাম মাস্টার, শহীদুল্লাহ সাউদ, আওলাদ হোসেন, দুদু মিয়া, আবদুল কাইয়ুম, আব্দুল কাদের ও মোঃ শফিউল্লাহ। ১১ নভেম্বরে শহীদ গেরিলারা বেতিয়ারা ধান ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। সাত দিন পর স্থানীয় লোকজন ধান ক্ষেত থেকে শহীদদের গলিত মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়েছিলেন। ১১ নভেম্বর "বেতিয়ারা শহীদ দিবস" হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এরকম হাজারো ঘটনা ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। যার ইতিহাস কিছু জানা আর কিছু অজানা। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো জীবিত আছেন যাঁদেরকে হয়তো এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বা অনেকে চেনেনা। তাঁদের কথা হয়তো ইতিহাসে লেখাও হয়নি। কিন্তু তবুও নাম জানা-অজানা, জীবিত বা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুগে যুগে বাঙালিদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁদের আত্মত্যাগের ঋণ বাঙালি কখনোই শোধ করতে পারবেনা।
"এক নদী রক্ত পেরিয়ে
বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যাঁরা
তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।"