এক
সে সময় পত্রমিতালির স্বর্ণযুগ। মোবাইল ফোন দূরে থাক ল্যান্ডফোনও ছিল দুর্লভ। ইয়াং জেনারেশন পড়াশুনার পাশাপাশি বিভোর হয়ে থাকতো পত্রমিতালীর নেশায়। অপেক্ষায় থাকতে দূর দূরান্তে অদেখা কোন কলমী বন্ধুর চিঠির অপেক্ষায়।
চিঠিতো না,এ ছিল ভাললাগার পূর্বরাগ। অপেক্ষার খামে মিশে থাকা কল্পনার মোহময়তা। শব্দের রঙিন সুতোয় বোনা হাজারো কথার বিন্যাস ভরিয়ে দিত উঠতি তারুণ্যের প্রহর।
পত্রিকায় ছাপা হোত পত্রমিতালী কর্ণার। হাজারো নামের ভিড়ে সুন্দর নামের ঠিকানায় হুমড়ি খেয়ে পড়তো হাজারো তরুণের চিঠি। যেন সুন্দর নামের আড়ালে থাকা মেয়েটি অতীব সুন্দরী। সে কারনে অনেকেই মেয়ে সেজে করতো পত্রমিতার অভিনয়। প্রেমে হাবুডুবু কখনো ছ্যাকাও জুটতো বুভুক্ষু প্রেমিকের কপালে।
রাজীব শহীদুল্লাহ কলাভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী হলের ৪৭৫ নং রুমে ঢুকতেই দেখে পড়ে আছে একটি বিষন্ন নীল খাম। এ খাম অতি পরিচিত, অতি প্রত্যাশিত। এসেছে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঢাকার আজিমপুর থেকে। গত একবছর সাত মাস ধরে তার আনাগোনা এই মতিহার চত্তরে।
পিওন চেনে, রুমমেট চেনে, চেনে গোটা ডাকবিভাগ।
এই খামের মালিক ইডেন কলেজের জনৈকা নীরা। বয়স আঠারো কিংবা উনিশ। বেশিও হতে পারে। কারন মেয়েরা সবকিছু বাড়িয়ে বললেও একমাত্র বয়সটা বাড়িয়ে বলতে পারে না।
নীরা গণিতের ছাত্রী। আজিমপুরের পাশে তাদের চারতলা বাড়ি। বেশ বড়লোক। নিউমার্কেটে দুই তিনটা দোকান । আরো হাবিজাবি অনেক কিছু আছে।
পত্রিকা থেকেই তার সাথে পরিচয়। নীরা নাম দেখে রাজীবই প্রথম চিঠি লিখেছিল। তার লেখার গুনে পরের সপ্তাহেই রাজীব পেয়ে যায় মেয়েলি হাতের প্রতিত্তর ।
ক্রমান্বয়ে সম্পর্কটা সোমত্ত হয়েছে। ঘনবদ্ধ হয়েছে।
তুই তোকারী থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সীমানার বেড়া ডিঙ্গিয়েছে।
ইদানীং নীরার মতিগতি অন্যরকম ঠেকে। কদিন আগে সে একটি ছবি কেটে তার চুলের অংশ পাঠিয়েছে। কয়েকদিন পর পাঠিয়েছে কপালের অংশ। তারপর কালো সানগ্লাস পড়া চোখ। হয়তো কোন ছবিতে এমন আছে। এভাবে প্রেরিত টুকরাগুলো জোঁড়া দিয়ে রাজীব উদ্ধার করে তার চেহারার আদল । তাতে মনে হয়েছে এক লাস্যময়ী তরুণীর রূপ যে কিনা রাজীবের লেখায় হাবুডুবু।
নীরা অনেকবার রাজীবের ছবি চেয়েছে। রাজীব এড়িয়ে গেছে নানা অজুহাতে। সে কখনোই ছবি পাঠায়নি। সে ভাবে তার মত কবির চেহারা কাগজে পাঠানোর মত এত সস্তা নয় ।
তবে মাঝেমধ্যে কবিতা পাঠায় রাজীব। নীরার অনুরোধ ফেলতে পারে না। অবশ্য তার সাধারণ লেখাই কবিতা হয়ে ওঠে। গণিতের ছাত্রী নীরা মুগ্ধ হয়ে পড়ে বাংলা কবির এই নান্দনিকতা। নীরা জানে রাজশাহীর স্হানীয় পত্রিকায় ছাপা হয় রাজীবের কবিতা। ঢাকার দৈনিকেও আসে কালেভদ্রে।
নীরাদের বাসায় রাখা হয় ইত্তেফাক ও অবজারভার। নীরা শুক্রবার রাজীবের কবিতা খোঁজে। পায় না। সে মনে মনে বলে একদিন ঠিকই ইত্তেফাকে তোমার কবিতা ছাপা হবে।
রাজীব কেন অপেক্ষা করে নীরার চিঠির সে নিজেও জানে না। নীরা রাজীবের মত লিখতে না পারলেও লেখায় অন্যধরণের মাদকতা আছে। তাছাড়া মেয়েদের চিঠি লেখায় সহজাত একটা ক্ষমতা আছে যা ছেলেদের চুম্বকের মত টানে।
নীরার চিঠিতে কোথায় যেন এক শূণ্যতা । সে অনেক কিছু বলতে চায়, বলে না। সে সুন্দরী হলেও ঘরের অনেক কাজ করে। সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত কাজ বিমুখ হয় কিন্তু নীরা ঘরের কাজও সামলায়। তার মায়ের ভালবাসা পেতে সে ঘর পর্যন্ত মোছে। থালাবাসন মাজে।
তার নিজের মা আছে কিনা-জিজ্ঞেস করলেও সে কোনদিন উত্তর দেয়নি। তবে বাবা যে তাকে অসম্ভব ভালবাসে তা সে চিঠিতে লিখে। ছোট বোন ইরা তার অন্ধ ভক্ত। রাজীবের সাথে তার বায়ুবীয় বন্ধুত্ব সেটাও সে জানে।
নীরা রাজীবকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায়। নীরা বলে,
দেখা হলে মন্দ হোত না। কবিতার পিছনের কারিগরটাকে দেখতে ইচ্ছা করে। কোন সে কুশলী যে এমন হিরন্ময় শব্দের জাল বোনে।
রাজীব চিঠির উত্তরে বলে, কল্পনার কবির সাথে বাস্তবের কবির কখনোই মিল হয় না। এটা রাতের স্বপ্ন আর দিনের রৌদ্রের মতই বৈপরীত্য। তারচে এই ভাল কবিতা আর কল্পনার আবছায়ায় লুকিয়ে থাকুক এই কৌতুহল।
তারপরও নীরা হাল ছাড়েনি।
কিন্তু রাজীব কখনোই আগ্রহ দেখায়নি।
যখন শুনেছে সে বড়লোকের মেয়ে তারউপর সুন্দরী তখন তার ইচ্ছাটা আরো কমে গেছে। ফর্সা সুন্দরী মেয়ে কখনোই রাজীবকে টানেনি।
এক চিঠিতে রাজীব নীরাকে লিখেও ফেলে, দোস্ত, ফর্সা ও বড়লোক মেয়ে আমার অসহ্য। সেজন্য আমাদের দেখা না হলেই ভাল।
নীরা জানতে চেয়েছিল, তা জনাবের কেমন মেয়ে পছন্দ?
শ্যামলা মেয়ে। পিঠ ভরা চুল, অতলান্তিক গভীর চোখে দোল খায় ভালবাসার ঢেউ । এমন কোনো গার্হস্হ্য মেয়ে যে নির্দ্বিধায় সহ্য করবে তার আগোছাল রূপ।
নীরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, গভীর চোখ, গার্হস্হ্য মেয়ে !
অবাক হয় এমন ভাললাগার ফর্দে। ফর্সা বাদ দিয়ে কোনো ছেলে শ্যামলা মেয়েতে মুগ্ধ হয় ,বড় অদ্ভূত লাগে তার কাছে। তাকে মনে হয় অনেকটা তার কবিতার মতই দূর্বোধ্য ।
নীরা লেখে, তোমাকে আর ছবি পাঠাতে হবে না, আসতেও হবে না। তোমাকে এমনিতে আমি দেখতে পাই। একটা টিংটিং এ ছেলে। মাথাভর্তি চুল, বিষন্নতায় ভরপুর।
দুই
ঢাকায় শুরু হয় আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। দেশ বিদেশের হাজারো কবির কলতানে মুখর টিএসসির সড়ক সংগম। রাজীবও যোগ দেয়। তবে পাঠক হিসেবে নয় ,দর্শক হিসেবে।
নীরাকে জানায় সে আসছে।
তার আসার খবরে চঞ্চল হয়ে ওঠে নীরা। পরক্ষনেই হয়ে পড়ে আতংকিত। হঠাৎ অনীহা পেয়ে বসে। নীরা তাকে দেখতে চেয়েছে কিন্তু সত্যি সত্যি সে যে চলে আসবে এটা তার কল্পনাতীত ।
নীরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে তার সামনে যাবে কিনা। যা চিঠিতে প্রকাশযোগ্য তা বাস্তবে অলংঘনীয়। কল্পনা আর বাস্তব যে দ্বিমুখী স্রোতের বৈপরীত্য। তার চেয়ে এই ভাল, এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি---
পরক্ষণে নীরা কল্পনায় গা ভাসিয়ে দেয়। পেয়ে বসে এক গোপন দূর্বলতা। উপেক্ষা করতে পারে না এক গহীন সুদূরের ডাক।
তার কবি আসছে। যার কবিতায় আটকে যায় তার শ্বাস প্রশ্বাস। সেই প্রাণহারী ভোমরা আসছে তার অনুভবের বারান্দায় । নীরা ছুঁয়ে দেখতে চায় সেই স্বপ্ন বিলাস। সেই উড়ন্ত শব্দের নীল জোনাক।
দেখা হবে টিএসসিতে। সবুজ ঘাসের ঘন গালিচায়। যেখানে কপোত কপোতী খুঁটে খুঁটে খায় ভালবাসার চোরকাঁটা ।
এত লোকের ভিড়ে চিনবে কিভাবে ? দ্বিধাগ্রস্ত হয় রাজীব। যে ছবি পাঠিয়েছে নীরা সেটা তো গবেষণালব্ধ। হাজারো ছলাকলার পরিপূর্ণ ।
নীরা জানায় সে সাদা ড্রেস পড়ে আসবে। চোখে কালো সানগ্লাস। সংগে ছোটবোন ইরা যে তাকে চোখে চোখ পাহারা দেয় দারোগার মত।
কবিতা উপলক্ষ্যে টিএসসির চত্তর হয়ে ওঠে যেন উষ্ণতার অভয়ারণ্য। চারিদিকে যৌবনের উত্তাপে ভরপুর। জুটিবদ্ধ তরুণ তরুণীর জটলায় রোদ পোহায় সহস্র কবিতার ঢেউ ।
রাজীব দ্বিধান্বিত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নিজেকে কিন্চিত আনস্মার্ট লাগে। জার্নি করে আসাতে পোশাক আশাক অনেকটা এলোমেলো। তার মনে হয় সবাই যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে পরীক্ষা করে, নাহ কেউ তাকে দেখছে না, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এটা তার মনের ভুল।
ভিতরে বসেছে অখন্ড রূপের পসরা। মেধা আর ফ্যাশানের শৈল্পিক কারুকাজ। এখানে কত নীরা, কোনটা তার কবিতাভূখ আদিখ্যেতা ?
রাজীব ঘুরে ঘুরে খোঁজে নীরাকে। পায়ের চেয়ে দ্রুত চলছে তার নিঃশ্বাসের ওঠা নামা। দেড় বছর ধরে যে কল্পনায় সঙ্গ দিয়ে চলেছে তার সাথে আজ বাস্তবে হবে মুখোমুখি । সে দূরপাল্লার দৃষ্টিতে খোঁজে নীরাকে। কিন্তু চারিদিকে কেবল অচেনা লতাগুল্মের ভিড়।
আরো কিছুক্ষণ হাটে রাজীব। দু'একজনের সাথে ধাক্কাও খেয়ে বসে। সরি বলে আবার খুজতে থাকে।
কোথায় নীরা ? কোথায় সেই সাদা ড্রেস,ইডেন কলেজের কালো সানগ্লাস ?
তবে কী আসেনি ?
সেতো কথা না রাখার মত মেয়ে নয়। খুবই সেনসিবল। এতদূর থেকে এসেছি, নিশ্চয় আমাকে বোকা বানাবে না। রাজীব ভাবে।
সে গেটের বাইরে এসে দাড়ায়।রাস্তায় উন্মুক্ত জনস্রোত। সেখানে খুজে পাওয়া দুঃস্কর। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আবার টিএসসির ভিতরে প্রবেশ করে রাজীব।
কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়ে একজোড়া সম্ভাব্য তরুণীর উপস্হিতি। বসে আছে মাঠের কর্ণারে। সাদা পোষাকে কালো সানগ্লাস। উৎসুক দৃষ্টি কারো সন্ধানে যেন ধাবমান ।
কাছে আসতেই পাঠানো ছবির সাথে মিল খুজে পায় রাজীব। এটাইতো নীরা। এই সেই শব্দভূক সিম্ফনি।
রাজীব ভাবে, সেতো ছবির চেয়ে অতিরিক্ত। কি কারনে সে গণিত পড়তে গেছে? অবিলম্বে তার বাংলা সাহিত্যে চলে আসা উচিৎ । সে হতে পারে শত কবির নান্দনিক অর্ঘ।
পিঠ ভরা কালো জলস্রোত তাকে দান করেছে ভিন্নতা। কেবল সমস্যা করেছে কালো সানগ্লাস যা আড়াল করে রেখেছে তার অতলান্তিক দৃষ্টি।
ইরা নীরা কোনদিন রাজীবকে দেখেনি। রাজীব দুষ্টুমি করে তাদের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। পর্যবেক্ষণ করে তাদের ভাবভঙ্গি। শোনে দুই বোনের খুনসুটি, দ্বৈত আলাপচারিতা।
আশেপাশে অনেক ছেলের ভিড়। কোনো ছেলে এগিয়ে এলে ইরা বলে ওঠে, ঐ যে আসছে। কিন্তু শেষমেশ ছেলের গন্তব্য অন্যদিকে। ইরা অধৈর্য্য হয়ে বলে, তার ছবি নাওনি কেন ? প্রেম করতে এসেছো অথচ তাকে চিনো না।
এ কথা শুনতে সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যায় রাজীবের। তাহলে কি নীরা তাকে ভালবাসে ? পছন্দ করে? কোনদিন তো সে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। সবকিছুই রেখেছে কথামালার অন্তরালে। তবুও কেন জানি অন্যরকম দোলা লাগে রাজীবের। নীরার মত মেয়ে তাকে ভালবাসে ! ভীষণ এলোমেলো লাগে।
নীরা ইরাকে বলে, আহ্ কি ঠোট কাটার মত কথা বলছিস, শুনতে পাবে তো।
----তোমার হাবলুস এলেতো শুনতে পাবে। এসব কবিরা বজ্জাতের হাড্ডি হয়। এরা যেখানে যায় সেখানে একটা করে জুটিয়ে ফেলে।
----এসব কী, সে অমন ছেলে নয়। সেতো দেখাই করতে চায়নি,আমিই তাকে আসতে বলেছি। সুন্দরী মেয়ে তার দু'চোখের বিষ।
-----এটাইতো ধান্দাবাজ ছেলেদের কৌশল। এসব বলে বলে মেয়েদের আগে দূর্বল করে,তারপর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। চল যাই, ঐ হাবলুস আর আসবে না।
---অমন করছিস কেন ? রাস্তায় দেরীও তো হতে পারে। এতদূর থেকে আসবে, না পেলে আমাকে ভুল বুঝবে না ?
----আহ কি দরদ ! যার সময়বোধ নেই সে কি করে আরেক জনের মর্ম বুঝবে ? দেখো না ছেলেপেলেরা কেমন করে তাকিয়ে আছে ।
-----ছেলেরাতো তাকাবেই, এটা নতুন কি? তুইও তাকিয়ে দেখ।
----এইসব হ্যাংলা ছেলে আমার দু'চোখের বিষ। ছেলেদের মিনিমাম একটা পার্সোনালিটি থাকতে হয়।
----তোমার বেলায় দেখবো।
----দেখো। কিন্তু এখন আমার ক্ষিধে পেয়েছে। অনেক্ষণ ধরে বকবক করছি। চটপটি বা ফুচকা হলে ভালো হোত। সে আসলে কিন্তু উসুল করে নিবো। তখন আবার তার পক্ষ নিস না। তোমারতো আবার কবিঅন্ত প্রাণ !
রাজীব ভাবে, নাহ আর অপেক্ষায় রাখা ঠিক না। লেবু বেশি টিপলে তিতা হয়ে যায়।
তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলা করে। সে চট করে পাশের স্নাস্কসে যায়। বলা নেই কওয়া নেই তিন প্লেট চটপটি আর ড্রিংস হাতে করে সামনে এসে বসে পড়ে।
দু'বোনকে অপ্রস্তুত করে বলে , আপাতত ক্ষুধা
নিবারন হোক তারপর ধান্দাবাজ হাবলুস ছেলেটিকে
ব্যবচ্ছেদ করা যাবে বিলম্বের কারনে।
এমন অভাবনীয় স্মার্ট এ্যাপ্রোচে হকচকিত হয়ে যায় দুজন।
এই ছেলেতো এতক্ষণ আশেপাশেই ছিল। ইরা ভাবে, ছি ছি কী লজ্জা। কী মনে করবেন উনি।
ইরা মুখরা মেয়ে। ধান্দাবাজ। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে , আপনিতো ভয়ানক। অচেনার সুযোগ নিয়ে আমাদের সব কথা শুনে ফেলেছেন।
----শুনে ক্ষতি হয়নি বরং লাভ হয়েছে আমার। নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারবো। ধান্দাবাজিতো ভাল নয়।
---- আমি কি ইচ্ছা করে বলেছি, ওটাতো মজা করার জন্য বলেছি।
----ইচ্ছা অনিচ্ছা বুঝি না তবে নিজের গুনগান শুনতে ভালই লাগে কোন তরুণীর মুখে ।
---গুনগান না ছাই।
ইরা দুষ্টমি করে বলে, পরিচয় করিয়ে দেই ইনি আমার লজ্জাবতী বড়বোন নীরা, ইডেন কলেজ,ঢাকা। আর আমি ইরা, বিশিষ্ট সমালোচক, ড্যাম কেয়ার ফাস্ট ইয়ার।
নীরা বলে, কীনি শুরু করলি ?
রাজীবও মজা পায় ইরার স্মার্ট কথায়। পরিচয় দেয় নিজের, আমি জনৈক হাবলুস, বজ্জাতের হাড্ডি, ধান্দাবাজ হিসেবে খ্যাতি আছে,পড়াশুনা করছি রাজশাহী ভার্সিটিতে। একটু আধটু কবিতা লেখার বদ অভ্যাস আছে।
রাজীবের কথার চমৎকারিত্বে দু'বোনই হেসে ওঠে।
নীরা বলে, আমি জানতাম আপনি কবি এখন দেখি কবিতার সাথেসাথে খোঁচা দিতেও ওস্তাদ।
---তুইতো কম যাস না ? ইরা বলে।
---ওরে বাবা আসতে না আসতে এত টান ! আমিতো
এখন কাবাবমে হাড্ডি।
ঠিক আছে আপনারা বসে গল্প করেন আমি একটু ফিল্ডিং মেরে আসি।
---এই দূরে যাবি না। আমি একাই কিন্তু বাসায় যেতে
পারবো না।
---একটা অনিরাপদ বাউন্ডেলে ছেলের কাছে বোনকে রেখে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? রিজভী আবার খোঁচা দেয় ইরা কে।
---এখানে কিন্তু গুন্ডাপান্ডার অভাব নেই। যা করবেন ভেবেচিন্তে । দেখা হবে আধঘন্টা পরেই।
তিন
ইরা চলে যাবার পর কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে
আসে । কেউ কথা বলে না। রাজীব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নীরাকে।সে অন্যরকম নান্দনিকতায় ভরা একটি মেয়ে। বেশ
গোছালো, রুচিশীলতায় ভরপুর । সিল্কের মত চুল। শরীর জুড়ে মিষ্টি গন্ধের ঘোরাফেরা।
রাজীব তন্ময়তা ভাঙ্গে। বলে,আমাকে দেখে কল্পনা আর বাস্তবতার মধ্যে মিল কতখানি পেলে ?
নীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে, পুরোটাই মিল। মেয়েদের চোখে দেখা আর কল্পনার তেমন তফাৎ থাকে না।
---নতুন কথা শুনলাম। চমৎকার। তুমি কিন্তু পাঠানো ছবির মত নও।
---কেমন ?
---তুমিই বলো।
---কবিতার মত ?
---নাহ।
---তাহলে ?
---ততোধিক।
---এটা কবিদের স্বভাব। ইরা থাকলে দু'কথা শুনিয়ে দিত।
----আমারও তাই মনে হয়। ও খুব শার্প। মুখরা।
আবারও কিছুক্ষণ নীরবতা। রাজীব নীরার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কিন্তু অন্যরকম। মগ্নতায় ভরপুর।
নীরা হাসে। রাজীবের মুগ্ধতা বাড়ে। সে ভাবে, হাসিটা ঈশ্বর শিশু আর মেয়েদের জন্যই যেন সৃষ্টি করেছে।
রাজীব বলে, তোমার হাসির ক্ষয়ক্ষতি বুঝতে পার ?
---এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দায়ের করেনি।
বাহ সুন্দর বলেছ তো। রাজীব বলে, এই সৌন্দর্যটা আরো ভয়াবহ হোত যদি চোখের উপর থেকে সানগ্লাসের পর্দাটা সরিয়ে ফেলতে।
নীরা বিষন্ন ভাবে হাসে। বলে, সময় হলে খুলে ফেলবো।
রাজীব বলে, এখন আপত্তি আছে ?
---তাড়া কিসের ?
---ইরা আসার আগে নিলজ্জ ভাবে দেখে নিতাম একবার।
---তোমার কথা কবিতার মতই গোছানো।
---সাহিত্যের মানুষ যে। যাহোক ইরা কিন্তু চলে আসবে।
নীরা কম্পিত হাতে খুলে ফেলে সানগ্লাস।
রাজীব তাকিয়ে থাকে নির্নিমেশ। ডাগর চোখের দু'ধারে ঘন পল্লব পাহারা দিয়ে রেখেছে একজোড়া শীতল ঝিল।
নীরার দৃষ্টি অন্যদিকে।
রাজীব বলে, একটা উর্দূ কবিতা আছে, শুনবে ?
নীরা মাথা নাড়ে।
রাজীব বলে, তেরি আখোকা কুছ কসুর নেহি,মুজকো খারাপ হোনাই থা।
--অর্থাৎ ? আকুলতা প্রকাশ পায়।
--তোমার চোখের কোন দোষ নেই, আমাকে খারাপ
হোতেই হোত।
নীরা মুখ নীচু করে থাকে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে গেল পড়ে।
রাজীব বলে, একটা কথা বলবো কিছু মনে করবে নাতো?
নীরা মাথা নাড়ায়।
---কেন জানি মনে হয় তোমার অনেক কষ্ট। ভেতরে একটা শূন্যতা। তুমি না বললেও চিঠি ছাপিয়ে তোমার কষ্টগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। আমাকে বলা যায় কি ?
নীরা নিরুত্তর থাকে। মুখ নীচু করে রাখে।
রাজীব বলে, তোমার আপন মা নেই ?
নীরা যেন কেঁপে ওঠে। কবিরা কি অন্তর্যামী ?
নীরা কিছু বলে না। একটা নীরবতা। অখন্ড নির্জনতা।
---না বললে থাক।
বেশ কিছুক্ষণ পর নীরা নীরবতা ভঙ্গ করে। বলে ছোটবেলায় তার মা মারা গেছেন। ইরা তার সৎবোন।
এখন রাজীব বুঝতে পারে কেন নীরাকে ঘর মুছতে হয়, কেন সংসারের সব কাজ করতে হয়। তিলেতিলে কুড়াতে হয় অবহেলার চোরকাঁটা।
নীরা বলে, ইরা জানে আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।
রাজীব অবাক হয়। যেন আকাশ থেকে পড়ে। তাকিয়ে থাকে নীরার দিকে।
বলে আসলে কি কোন সম্পর্ক আছে ?
---নাহ । মুখ নীচু করে উত্তর দেয়।
---তাহলে কেন বলেছ ?
নীরা কোন উত্তর দেয় না। মুখ নীচু করে থাকে। যেন এর
উত্তর তার জানা নেই।
একটা অস্বস্তিকর মূহুর্ত।
তাকে সহজ করার জন্য রাজীব বলে, কিছু বলবে না ?
শেষে নীরা মুখ খোলে, তোমার আমার সব চিঠি তার নখদর্পনে। যখন ক্লান্ত হয়ে যাই তখন আমার অনুভূতিগুলো সেই লিখে দেয় কাগজের পাতায়। পড়েও শোনায় তোমার সৌন্দর্য্যময়তার উপাখ্যান।
----এও সম্ভব ? এত ঘনিষ্ঠতা ?
নীরা নিরুত্তর থাকে। কোন কথা বলে না। রাজীব বুঝতে
পারে নীরার ভিতর কিছু একটা হচ্ছে যা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। মেয়েদের কিছু কষ্ট অবোধ্য, ব্যাখ্যাতীত। যদি হয় অন্তর্মুখী সেটা আরো হয় দূরতিক্রম্য।
রাজীব আর কিছু ঘাটতে সাহস পায় না। নীরা সফট মেয়ে হলেও তার কমনীয়তার ভিতরে রয়েছে এক দৃঢ় ব্যক্তিত্ববোধ।
পরিবেশকে হালকা করতে রাজীব বলে, কবিতা শুনতে যাবে ?
নীরা অসম্মতি জানায়। বলে, এখন বাসায় ফিরতে হবে। দেরী করে গেলে মা রাগ করবেন।
রাজীব বুঝতে পারে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখুনি নীরা চলে যাবে। অথচ তার কোন কথাই শোনা হোল না। এত বড়লোকের মেয়ে অথচ এত কষ্ট নিয়ে দিন যাপন করে!
নীরবতা ভেঙ্গে রাজীব বলে, তাহলে আর দেখা হচ্ছে না?
নীরা মুখ নীচু করে থাকে। কালো সানগ্লাসের ভিতর দিয়ে একটি ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে এটা রাজীব বুঝতে পারে।
রাজীব বলে, তাহলে আমাদের সম্পর্কটা পেনফ্রেন্ডের খোলসেই আটকে থাকলো ? কেউ কারো কোমলতাকে স্পর্শ করতে পারলাম না ?
নীরা কিছু বলে না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে সে নিজেও যেন জানে না।
রাজীব বলে, ইরা চলে আসবে এখুনি। যদি মনে করো কোনদিন কোথাও সামান্য উপকারে আসতে পারে এই তুচ্ছ তৃণখন্ড তাহলে জানিও।
নীরা যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু আটকে থাকে ঠোটের কার্নিসে । ইচ্ছা করে রাজীবকে ছুয়ে দেখতে। শক্ত করে তার হাতটা ধরতে। কিন্তু পারে না। এমন সময় হৈচৈ করে ছুটে আসে ইরা।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, টাইম ইজ ওভার। আধ ঘন্টার জায়গায় দুই ঘন্টা। কবি সাহেব হঠাৎ করে বেশি খেলে বদহজম হবে। এবার বিদায় দিন। আরো দেরী হলে মা ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবে।
নীরা উঠে দাড়ায়। মুখ নিচু করে থাকে। তারপর তাকায় রাজীবের দিকে।
আসি বলে ইরার হাত ধরে।
সে ধীর পায়ে হাটতে থাকে।
আগে ইরা, তার গা ঘেসে ঘেসে নীরা।
রাজীব দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে দু'বোন চলে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে দূরত্ব বাড়ছে। ভর করছে একটা শূণ্যতা। ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে আচমকা। এভাবে একসময় গেটের বাইরে চলে যায় ওরা।
রাজীব নীরার শেষটুকু দেখার জন্য বাইরে এসে দাড়ায়। দেখে দু'বোন রাস্তা পার হচ্ছে। রাস্তায় বেশ ভিড়। গাড়ীর জটীলতা। হঠাৎ একটি গাড়ী চলে আসায় থতোমতো থেয়ে দু'বোন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইরা রাস্তার ওপারে চলে গেলেও নীরা আটকে যায় রাস্তার মাঝখানে । ভয়াবহ অবস্থা। হঠাৎ জ্যামে হাতড়াতে থাকে কোনদিকে যাবে।
গাড়ীর ভিতর থেকে রাগান্বিত এক ড্রাইভার চিৎকার করে ওঠে, এই মেয়ে চোখে দেখ না?
রাজীব দৌড়ে গিয়ে নীরার হাত ধরে ফেলে। তাকে আগলে রাস্তার ওপারে নিয়ে যায়। উগ্র ড্রাইভার রাজীব কে দেখে খেকিয়ে ওঠে, অন্ধ মেয়েকে রাস্তায় একাই ছেড়ে দিয়েছেন ?
যেন বিদ্যুৎ চমকায়।
রাজীব বিমূঢ় হয়ে যায়। সে নীরার দিকে তাকায়। ইরা হতভম্ব হয়ে একটু দূরে দাড়িয়ে। নীরা থতমত খেয়ে যায়। হু হু করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, রাজীব সত্যি আমি অন্ধ। সত্যি অন্ধ। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
রাজীব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
একি বলছে নীরা! এটা কি সত্যি?
কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে জোড় করে খুলে ফেলে তার কালো সানগ্লাস।
নীরা যেন থরথর করে কাঁপতে থাকে। যেন পড়ে যাবে শিলিগুড়ি শক্ত পাথরের উপর।
একসময় নীরার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয় রাজীব। তারপর শীতল দৃষ্টি হেনে চলে যায় নিজের পথে।
দু'বোন ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে নির্বাক। যেন দু'টি লাশ চৈত্রের হু হু করা বাতাসের সাথে টলছে। দু'জনে হাটছে পাথরের মত। পায়ের নীচে ভেঙ্গে যাচ্ছে শুকনো পাতার কংকাল।
চারিদিকে জীবনের অজস্র কোলাহল। মানুষের পদচারণা, যানবাহনের মুখরতায় একাকার এই প্রাণহীন শহর। নীরা নতুন করে অনুভব করে তার অর্থহীনতা, তার সীমাহীন অসারতা।
তবুও ইচ্ছে করেই আজ বেশিক্ষণ হাটছে নীরা। মাটির সাথে একাত্ম হয়ে ইচ্ছা করছে শীতল হতে। বুঝতে পারে দু'পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুটে আছে থোকা থোকা লাল। সে মিশে যেতে চায় কৃষ্ণচূড়ার আগুনে। ইরা কে অনুরোধ করে আরো কিছুক্ষণ থাকতে। ইরা অধৈর্য
হয়ে ওঠে। তাকে বোঝায় মায়ের উৎকন্ঠার কথা।
যাত্রী মনে করে তাদের সামনে এক বাস এসে দাড়ায়।
হেলপার চিৎকার করে বলে ,আপা আসেন আসেন। কোন কিছু না বুঝে ইরা লাফ দিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়ে। তারপর হাত ধরে টানতে থাকে নীরাকে।
কিন্তু আরো একজন যাত্রী দৌড়ে আসতে থাকে। বাড়তে থাকে বাসের গতি। সে চোখের পলকে তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দু'বোনকে। ইরা চমকে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। দেখে রাজীবের বেষ্টনিতে নীরা। কী পরম ঘনবদ্ধতায় আবদ্ধ ।
বাসটা চলে যাচ্ছে।
হেলপার চিৎকার করে বলে, আপা বাস থামামু ?
ইরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে।
হেলপার বলে, আপা থামামু?
ইরা অসম্মতি জানায়।
বাস ছুটছে।
সে ঝাপসা চেখে দেখে ছোট হয়ে যাচ্ছে রাজীব, ছোট হয়ে যাচ্ছে নীরা ।