মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ জন্মেছিলেন ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই শুক্রবার।তিনি নিজেই লিখেছেন-
"আমার বেহেশতবাসী পিতা আমার ও আমার ভাই-বোনদের জন্মতারিখ নিজ হাতে লিখে গিয়েছেন।"
(আমার সাহিত্যিক জীবন-ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্)
এই তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয় শহীদুল্লাহ্ সাহেবের পিতা মফিজউদ্দিন আহমদ তারিখ (ইতিহাস) সচেতন ছিলেন।পারিবারিক নছবনামা তৎকালে অনেক পরিবার সংরক্ষণ করতো, এটা আরবি রীতি। শহীদুল্লাহ্ সাহেবের ডাক নাম ছিল সদানন্দ। তখনকার দিনে মুসলমান পরিবারে ছেলেদের নামের সঙ্গে একটি বাংলা নামও থাকতো।তাঁকে শৈশবেই"গুলেস্তা","বুসতা" পড়তে হয়েছে।মক্তবে পড়ার সময় তাঁকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিশুপাঠ্যগ্রন্থ" বর্ণ পরিচয়" (প্রথম ভাগ,দ্বিতীয় ভাগ), "কথামালা", "বোধোদয়" পড়তে হয়েছে।তিনি না পড়ে মৌলভী হননি। তাঁকে পড়তে হয়েছে।তিনি আরবি,ফার্সির পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষার পাঠ নিয়েছেন।শৈশবকালীন পড়াশোনা সম্বন্ধে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন -
"বটতলার বাজে উপন্যাস পড়া আমার ভালো লাগত না।তবে কিছু কিছু ইংরেজি ও বাংলা ভালো উপন্যাস ও গল্পের বই পড়েছিলাম, কিন্তু সবগুলোর নাম এখন মনে নেই।ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের "কুরআন শরীফের" বঙ্গানুবাদ এবং "তাপসমালা" এবং পরলোকগত কৃষ্ণকুমার মিত্রের" মুহম্মদ চরিত" পড়ে ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরাগ গাঢ় হয়েছিল।"
ডঃ শহীদুল্লাহ্ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি ছিলো না। তিনি শৈশবেই সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছেন। সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।ভর্তি হলেন বটে, কিন্তু ক্লাস করার অনুমতি পেলেননা। যে পণ্ডিত এম.এ ক্লাসে বেদ পড়াতেন তিনি শহীদুল্লাহর মতো অহিন্দু ছাত্রকে বেদ পড়াতে রাজি হলেন না।শহীদুল্লাহ্ সাহেব স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণ নিলেন, কিন্তু তিনিও কিছু করতে পারলেন না।এই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য তৎকালে পত্র-পত্রিকায় Shahidullah affair হিসেবে বেদের অধ্যাপক সত্যব্রত সামশ্রমীকে কঠোর নিন্দা করে।এই হলো ডঃ শহীদুল্লাহ্, যিনি তৎকালে প্রতিষ্ঠিত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম ছাত্র ছিলেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ পাশ করেন।১৯১৩ সালে তিনি জার্মানে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভারত সরকারের বৃত্তিলাভ করেন।কিন্তু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ছাড়পত্র না পাওয়ায় যেতে পারেননি। ১৯১৪ সালে তিনি বি.এল পাশ করেন। ১৯২১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে(সংস্কৃত ও বাংলা, প্রভাষক) তিনি যোগদান করেন।কিন্তু বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ তাঁর জন্য একান্ত আবশ্যক ছিল।আর সে সুযোগ আসে ১৯২৬ সালে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু'বছরের ছুটি নিয়ে ৭০০০ টাকা ধার নিয়ে প্যারিস সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।তাঁর এ বিদেশ যাত্রা নিয়ে আলোচনা -সমালোচনা রয়েছে।অনেকগুলো প্রশ্ন ডালপালা গজায় তাঁকে ঘিরে। সর্বোনে পড়াশোনা করা অপর একজন বিদ্বান মাহমুদ শাহ কোরেশী এ বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে কতগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসেন।সমালোচকরা মনে করেন শহীদুল্লাহ্ সাহেবের প্যারিসে যাওয়া কেন প্রয়োজন হল, তিনি চর্যাপদ ও দোহাকোষ নিয়েই বা গবেষণা করলেন কেন।এই প্রশ্নগুলো নিয়ে উত্তরকালেও অনেক সমালোচনা হয়েছে।শহীদুল্লাহ্ সাহেবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। শহীদুল্লাহ্ সাহেবের প্যারিসে উচ্চশিক্ষা লাভ সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন সামনে এসেছে সেগুলোর উত্তর দান দুরূহ নয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন স্যার পি.জে হার্টজ।বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করতেন তাদের শিক্ষকতার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের পথ উন্মুক্ত করে।এই উন্নয়ন কার্যক্রমে তরুণ প্রভাষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। উপাচার্যের ধারণা ছিলো এতে করে শহীদুল্লাহ্ সাহেব জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ারসন,আঁদ্রে মিলে গেইগার,জুল ব্লখ প্রভৃতি পণ্ডিতের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশ যাওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি হয়তো জানতেন না যে তিনি বৌদ্ধতান্ত্রিক গীতি নিয়ে গবেষণা করবেন।চর্যাগীতি নিয়ে গবেষণা করতে হবে জেনে তিনি ১৯২৬ সালে উপাচার্যের কাছে ৮ টি বই চেয়ে পাঠান।তিনি দুই বছরের ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। সে সময়ের বর্ণনা, "
"আমাকে আমার Thesis উপলক্ষে বাংলা ব্যতীত আসামী,সিন্ধী, উড়িয়া,মৈথিলী, পূরবীয়া হিন্দী,পাঞ্জাবী, গুজরাটী,মারাঠী,লাহিন্দী,কাশ্মিরী,নেপালী, সিংহলী ও মালদ্বীপী ভাষায় আলোচনা করিতে হইতেছে। প্রাচীন ভাষার মধ্যে প্রাকৃত ও অবেস্তারও চর্চা করিতেছি।বিরাট ব্যাপার সন্দেহ নাই।কিন্তু বিরাট কার্যের জন্য বিরাট আয়োজন চাই।তিব্বতীও শিখিতেছি। কাজেই বুঝতে পার আমার সময়ের উপর কিরূপ গুরুতর চাপ পড়িতেছে।কিন্তু স্বাস্থ্য সম্বন্ধে অমনোযোগী নই।"
শহীদুল্লাহ্ সাহেব প্যারিসে গিয়ে আমোদ-প্রমোদে কাটিয়ে দেননি। রাত ১২ পর্যন্ত কাজ করেও তিনি গবেষণার কাজ শেষ করতে পারেননি। তাঁর ছুটি ফুরিয়ে যায়, জর্মনীর ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।অগত্যা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে ভগ্ন মনোরথে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেন।শহীদুল্লাহ্ সম্পর্কে উত্তরকালে এ সমালোচনার ডালপালা বিস্তার করেন হুমায়ুন আজাদ, মুনীর চৌধুরী, আহমদ ছফা। অনেকেই মনে করেন শহীদুল্লাহ্ বিদেশে কোনো কাজই করেননি। কিন্তু ১৯২৭ সালের একটা চিঠি থেকে জানা যায় প্যারিস থেকে তিনি জার্মানি গিয়েছিলেন এবং প্রথম বছরের শেষ দিকে তিনি থিসিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।শহীদুল্লাহ্ সাহেব হালকা চালের লোক ছিলেননা। ওকালতি ছেড়েছেন মিথ্যে বলতে হয় বলে।সন্তানদের তিনি সে শিক্ষাই দিয়েছেন। ডঃ শহীদুল্লাহ্ রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বেই পাঠ করেন", ভারতের সাধারণ ভাষা " শীর্ষক প্রবন্ধ।হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সভাপতিত্বে পাঠ করেন", বাংলা সাহিত্য ও ছাত্র সমাজ " প্রবন্ধ।তিনি রচনা করেছেন,"হাজার বছরের পুরান বাঙ্গলায় সিদ্ধা কানপার গীত ও দোহা", "বাংলা ব্যাকরণ ", "দীওয়ান -ই-হাফিজ", " রুবাইয়াত -উমরখয়্যাম" ",আমাদের সমস্যা " " প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী" "বাংলা সাহিত্যের কথা(১ খন্ড), "বাঙ্গলা ভাষার ইতিবৃত্ত " সমগ্র জীবনব্যাপী তিনি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সেবা করে গিয়েছেন।তাঁর কর্মপরিধি এতোটাই ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে কোনো মানুষের পক্ষেই তাঁকে অধ্যয়ন করা সম্ভব নয়।সুদীর্ঘকাল ব্যাপী তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, আজিজুল হক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।তিনি ভাষা সমস্যা তিনি কাজ করেছেন।দেশ ভাগের পর পূর্ববঙ্গের ভাষা সমস্যা নিয়ে তিনিই প্রথম কলম ধরেন।এমন একজন ভাষাতাত্ত্বিককে নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল বিভক্ত।তিনিসহ তখন মানে পাকিস্তান আন্দোলনে অনেকেই যুক্ত ছিলেন।শহীদুল্লাহ্ সাহেব ধার্মিক ছিলেন, এটা কি তাঁর অপরাধ ? শহীদুল্লাহ্ সাহেবরা বছরে -বছরে, যুগে - যুগে কিংবা দেশে-দেশে জন্মায় না।তাঁকে সম্মান জানানোর অর্থ মাতৃভাষাকে সম্মান করা, নিজেকে অনুভব করা।কিন্তু এ সত্য আজ নির্বাপিত, এ সত্য আজ নিগৃহীত। এ ভূ-খণ্ড বন্ধ্যা সময় অতিক্রম করছে, যেন চর্যাপদের অন্ধকার!