শুনশান মধ্য দুপুর।
শুয়ে শুয়ে বিছানার পাশের খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নীলা। ধূসর,মসৃন, নিস্তরঙ্গ আকাশ। রোদ্দুরটা লুকিয়ে আছে। কেমন মায়া ছড়ানো ছায়া চারদিকে। একটা চিল আনমনে উড়ছে,ঘুরে ঘুরে।
নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কতদিন সে স্কুলে যেতে পারে না। স্কুলের বন্ধুরা প্রথম প্রথম খোঁজ নিত,ফোন করতো। ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মারিয়াম তো দুবার তার আম্মুকে সাথে নিয়ে নীলাকে দেখতেও এসেছিল। নীলার প্রিয় চকোলেট নিয়ে এসেছিল এত্তগুলো। তারপর কতদিন চলে গেছে,আর আসে নি। অবশ্য মাঝে মাঝে ফোন করে। কিন্তু ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না নীলার। কেউ কেমন আছো প্রশ্ন করলে ভালো নেই বলতেই ইচ্ছে করে না। কিন্তু মিথ্যে করে ভালো আছিই কী বলা যায়?
স্কুল আর বন্ধুদের খুব মিস করে নীলা। স্কুলের মিসদেরও। ক্লাস পার্টি,টিফিন পিরিয়ড আর সকালের প্রেয়ার!
ইস কতদিন স্কুল যেতে পারছে না । নীলা আঙুলের কড়ায় গোণে এপ্রিল, মে--- পাঁচ মাস!
আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
পাশ ফিরে শোয়।
বাবা - মা দুজনেই চাকরি করে। বড় বোন মিলা আর ছোট ভাই বাবুই স্কুলে। তাই সারাদিন একা একাই বাসায় থাকতে হয় তাকে। কাজের খালা জায়েদা অবশ্য থাকে। তবে, জায়েদা খালা সারাক্ষণ ঘুমায়। একা একা নীলার ভালো লাগে না। জায়েদা খালার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাজ ছাড়া জায়েদা খালাকে পাওয়াই যায় না। সে আসে খাবার দিতে, গোসল করাতে কিংবা ঔষধ খাওয়াতে। নীলা চাইলে মাঝে মাঝে ড্রইংরুমে নিয়ে বসিয়ে টিভি অন করে দেয়। কিন্তু টিভি দেখতে ভালো লাগে না নীলার। তাই বিছানাতেই শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ক্লাসের বইগুলোর পাতা উল্টে দেখে। এবার নিশ্চয় তাহরিমা সেকেন্ড হবে।সেই ক্লাস ওয়ান থেকে সেকেন্ড পজিশন টা ধরে রেখেছে নীলা। ফার্স্ট গার্ল শম্পার সাথে মাত্র দুই বা তিন নম্বরের ব্যবধান প্রতিবার। নীলা তো এবার প্রতিজ্ঞা করেই ছিল যেভাবে হোক সপ্তম শ্রেণীতে শম্পাকে হারাবেই।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নীলার হয়ত পরীক্ষা দেওয়াই হবে না।
নীলা পাশ ফিরে শোয়। বালিশের পাশে মোবাইলটা উল্টে রাখা। এত ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল থাকে না। নীলার ও ছিল না। কিন্ত কয়দিন আগে বাবা কিনে দিয়েছে। নীলা যাতে কার্টুন দেখতে পারে,সেজন্য।
নীলার অবশ্য আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে ভয় হয় ও কি আর কোনদিন ভালো হবে না?তার বড় সখ পড়াশোনা শেষ করে পর্যটক হবে। সারা পৃথিবীর সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবে। চাই কী একবার চাঁদ আর মঙ্গলেও ঘুরতে যাবে। অবশ্য চাঁদ আর মঙ্গলে যাবার কথা শুনে বন্ধুরা খুব হেসেছিল। ওরা বলে, চাঁদ আর মঙ্গলে যেতে হলে বিজ্ঞানী হতে হয়। নীলা বোঝে না, ঘুরতে গেলে বিজ্ঞানী হতে হবে কেন? বিজ্ঞানী হতে হয় গবেষণা করতে হলে। নীলা তো ঘুরতে যেতে চায়!
ভাল্লাগেনা কিছু। শোয়া থেকে উঠে বসে নীলা। জায়েদা খালাকে ডাক দেয়। পাশের ঘরে যাবে। আমাজনের জঙ্গলের ওপর একটা বই আছে শেলফে, ওটা আনবে। সে তো একা হাঁটতে পারে না। মাথা ঘোরে। কয়দিন আগেও অবশ্য একাই হাঁটতো। এঘর থেকে ওঘরে যেতে কাউকে ডাকতে ভালো লাগে না৷ কিন্তু গত সপ্তাহে এরকম একা বারান্দায় যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল নীলা৷ মাথাতেও বড্ড চোট পেয়েছে। আজ তাই জায়েদা খালাকে ডাকছে, পাশের ঘরে যাবে।
দুতিনবার ডেকেও খালার সাড়া না পেয়ে আবার শুয়ে পড়লো নীলা। বাবুই এর স্কুল
দুটোয় ছুটি হয় আর মিলার ছুটি হয় চারটের সময়। বাবুই একা ফিরতে পারে না,মা তাই ওকে স্কুলের পাশে এক আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। স্কুল ছুটির পর বাবুই শেখানে আর্ট শেখে। মিলার ছুটি হলে মিলা বাবুইকে নিয়ে বাসায় ফেরে।
ওরা ফিরতে পাঁচটা পেরোয়। তারপর ফেরে বাবা। সবশেষে মা। মায়ের অফিসটা অনেক দূরে কী না।
নীলা একদিন মা কে বলেছিল, মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। তুমি বাসায় থাকলে আমার অনেক ভালো লাগে।
মা মৃদু হেসে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, আমারও তোমাদের ছেড়ে সারাদিন অফিসে থাকতে একদম ভালো লাগে না সোনা। কিন্তু এখন তুমি অসুস্থ বলে বাসায় আছো। নইলে দেখ, তোমরা সবাই যখন স্কুলে যাও তখন আমারও একা একা কত খারাপ লাগে।
মায়ের কথাটা বুঝেছিল নীলা। তবুও মনে হয় এখন মা পাশে থাকলে একটু গল্প করা যেত!
ট্রিং করে মোবাইলটা বেজে ওঠে।
নীলা দেখে মা ফোন করেছে।
হ্যাঁ মা, বলো।
কেমন আছো মা? আজ আর জ্বর বেড়েছে?
নীলা আজ জ্বর মাপেই নি। ভাল্লাগে না এসব। জায়েদা খালা থার্মোমিটার নিয়ে এলে চিৎকার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। একবারও দেখেনি। নীলা তাই চুপ করে থাকে।
মা ওপাশ থেকে বলল, জ্বর মাপোনি তাই না? আচ্ছা বাদ দাও। শোন তোমাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আগামী শুক্রবারই আমরা দেশের বাইরে যাব। এবার দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।
নীলা জানে ওর অনেক কঠিন একটা অসুখ করেছে। অবশ্য ডাক্তার বলেছে,ভালোমতো চিকিৎসা করলে সে সুস্থ হয়ে যাবে। তাইতো দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বাবা মা।
মা বলল, কী খুশি হওনি? এবার বিকেলের সুপটা ঠিকঠাক মতো খেয়ে নিও। রাখি সোনা।
মা ফোন রেখে দিল।
দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করলে নীলা সুস্থ হয়ে যাবে ভেবে ভালো লাগছে ওর। কিন্তু মিলা আর বাবুইকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। একদম।
নীলা মা কে ফোন দিল, মা, মিলা আর বাবুই একা এখানে কিভাবে থাকবে?
তোমাদের ছোট ফুপি আর টুনি চলে আসবে কাল। আমরা যতদিন না ফিরি ওরা থাকবে।
ছোট ফুপী আর টুনি আসবে-খুশি লাগছে নীলার। টুনি আর নীলা সমবয়সী। একই ক্লাসে পড়ে। টুনি চমৎকার ছড়া লিখতে পারে। এজন্য অবশ্য টুনিকে একটু একটু হিংসে হয় নীলার। টুনির ছড়াগুলো খুব মজার তাও শোনে না নীলা। এড়িয়ে যায়।যদিও দুজনের অনেক খাতির। একসাথে হলে গল্প আর শেষ হয় না। মা বলে, সবাই তো সব পারে না, যেমন ও ভালো রেজাল্ট করে টুনির তো তেমন নয়।
এবার থেকে টুনির সব ছড়া মন দিয়ে শুনবে- সিদ্ধান্ত নেয় নীলা।
ফুপীদের বাসা রাঙামাটি। পাহাড়ের গায়ে। পাশে একটা ঝিরঝিরে ঝর্ণা। থোকায় থোকায় বুনোফুল ফুটে থাকে বাড়ির চারপাশে। শীতল থিরথির বাতাসে মিষ্টি গন্ধ। আর কত রঙিন প্রজাপতি!
সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে বেশ কিছুদিন ফুপীদের রাঙামাটির বাংলোবাড়িতে বেড়াবে- মনে মনে ভাবতে থাকে নীলা।