সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মেঘেদের ফাঁক গলেই ঈদের চাঁদ উঠেছে পুবাকাশে। প্রতিটা মুমিনের হৃদয় তাই ঈদের খুশিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নতুন নতুন সাজে সেজে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। সবাই ঈদের খুশিতে মেতে উঠলেও বড়বাড়ির পুকুরপাড়ে বিষণ্ণ মনে বসে আছে ফারহান। নিত্যদিনের তার হাসি-খুশি চেহারাটা আজ বড্ড মলিন। সবার মাঝে আনন্দের ধুম পড়লেও আজ তার ভীষণ মন খারাপ। তার এই মন খারাপির কারণ পাড়ার কারোরই অজানা নয়। প্রতিবছর চাঁদরাতের এই দিনটি এলেই সবার চোখে ভেসে উঠে রক্তে রঞ্জিত দুটো বীভৎস দেহ। রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় ছিটকে পড়ে আছে। এ এক বেদনাদায়ক ঘটনার উপাখ্যান। সবার টনক নেড়ে উঠে।
আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের এমনই এক চাঁদরাতের দিন। সেদিনও আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল মেঘেদের ভেলা। ঈদের খুশিতে মেতে উঠেছিল পাড়ার ছোট-বড়ো সবাই। সবার মাঝে ঈদের সে কী প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস। নবজাতক শিশু ও মাকে নিয়ে তখন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব জামিল সাহেব। আজ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের একজন। হবেনই তো। কারণ, এই শিশুপুত্র যে তাঁর যক্ষের ধন। হাজারো সাধনার ফসল। তাঁর বিনিদ্র রজনীর চোখের অশ্রুর প্রতিদান। এ যেন শেষ বয়সে এসে বুড়ো ইব্রাহিম (আ:) কে আল্লাহর দেওয়া ইসমাঈল এর জীবন্ত ঘটনার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
এদিকে বাড়িতে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন জামিল সাহেবের বুড়ো বাবা-মা। কখন নাতির সোনামুখ দেখে প্রাণ জুড়াবে। এ নাতিই যে বংশের উজ্জ্বল প্রদীপ। এ যেন এক ঈদের মাঝে আরেক ঈদ। কিন্তু সেদিন নিয়তি যে ছিল তাদের প্রতিকূল, তা কেই-বা জানত! অপেক্ষা যে করছিল এক কঠিন মর্মান্তিক দুঃসংবাদ, তা কারই-বা জানা ছিল। খরস্রোতা নদীর মতো সময় যতো বয়ে চলে, অজানা বিপদেরাও ততো প্রকট হয়ে ঘনীভূত হয়।
সি এন জি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হাসি-আনন্দেই বাড়ি ফিরছেন জামিল সাহেব। সন্তানের মায়াবী চেহারা দেখে মায়ের মুখেও অঙ্কিত হয় মুচকি হাসির সরল রেখা। প্রসব-বেদনা যেন নিমিষেই মুছে যায় তার স্মৃতিপট থেকে। সন্তানের রাঙামুখ দেখতে পারা, এটাই তো পৃথিবীর সকল মায়েদের পরম আনন্দ ও অসীম সুখ।
হঠাৎ এক বিকট আওয়াজ শুনতে পায় রাস্তার আশেপাশে থাকা মানুষগুলো। দৌঁড়ে এসে তারা দেখতে পায়, রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তমাখা দুটো বীভৎস লাশ। আধমরা হয়ে পড়ে আছে সি এন জি চালক। তার পাশেই হাউমাউ করে কাঁদছে নবজাতক শিশু। মালবাহী ট্রাকের চাপায় প্রাণ হারায় জামিল সাহেব ও তাঁর স্ত্রী আমেনা বেগম। ঈদের আনন্দঘন দিন পরিণত হয় এক কালো দিনে। নিয়তি বড়ো নিষ্ঠুর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে সেদিন। আসলে, নিয়তির খেলা বোঝা বড়ো দায়। কখন কার অনুকূল কিংবা প্রতিকূল হয়ে উঠে, তা কেউই জানে না। তবে সেদিন আল্লাহর অশেষ কৃপায় বেঁচে ফিরেছিল সেদিনের নবজাতক শিশু, আজকের ফারহান। পরবর্তীতে এই মর্মান্তিক ঘটনা সে তার দাদীর মুখে শুনতে পায়। সেই থেকে চাঁদরাত এলেই শোকে কাতর হয় ফারহান।