আনন্দমুখর হোক ঈদ উদযাপন ।। আ. আজিজ ইবনে আ. মালেক


দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের বার্তা নিয়ে এলো ঈদুল ফিতর । মাহে রমাদানের শুরু থেকেই ঈদুল ফিতরের পবিত্র এ দিনটির জন্য বিশ্বজুড়ে অপেক্ষমান মুসলিম জাতি। আমরা যথাসাধ্য এই আনন্দমুখর দিনে আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করে থাকি । কাজেই আনন্দ,সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় রেখে প্রশংসার সহিত ঈদের আনন্দ উৎসব করা প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের প্রমাণ বহন করে ৷
বিশ্বব্যাপী ঈদ আমাদের মাঝে যেমন আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে,তেমনি নিয়ে আসে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গত মান-অভিমান এবং ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে ঈদের উৎসব পালন করার মহাসুযোগ ৷ মা-বাবা,ভাই-বোন,আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি আন্তরিকতার সাথে আমরা হৃদয়ের গহীন থেকে জানাই ঈদ মোবারক ৷

আমাদের জীবনে ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ এলেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি ঈদ শপিংএ । সামর্থ্যানুযায়ী চলে ক্রয়-বিক্রয় । ধনীদের অনেকেই জামা-কাপড় ক্রয়ের খুশিতে আত্মহারা। অথচ আমাদের সমাজে সুবিধাবঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাদের প্রতি আমাদের কোন সহযোগিতা নেই ৷ অথচ শরীয়াহ্ অনুযায়ী তাদের প্রতি আমাদের রয়েছে সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা হল ঈদুল ফিতরের আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ৷ তবে সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য কোরআন ও হাদীসে রমাদান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, যাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য। এ ছাড়া ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন কিছু খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে গমন এবং নামাজ শেষে ভিন্ন পথে বাড়ি প্রত্যাবর্তন। এ ছাড়া সর্বাগ্রে অজু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বর্ণনাও রয়েছে । সামর্থানুযায়ী ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করারও নির্দেশনা রয়েছে ৷ 

ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াউ'মুল জায়েজ অর্থাৎ পুরস্কারের দিবস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালনসহ আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে। শ্রেণিবৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতা মুক্ত সুনির্মল আনন্দে ভরা সুস্নিগ্ধ, প্রীতি-শুভেচ্ছা মিলন উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের মানে আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতরের আগমন হয় । বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি, সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মিল-বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন।
ঈদের দিন মসজিদে, ঈদগাহে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে ধনী-নির্ধন, পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন। সব ঈদগাহে নিজেদের জন্য দুআ করা হয় এবং  মহান রবের দরবারে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও সংহতি কামনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী ও সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন।
মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো, জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি মুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমন্ডিত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক- এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক তামান্না। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনেপ্রাণে। বুকে বুক মিলিয়ে আসুন সবাই সবার হয়ে যাই।

কিন্তু বর্তমান সময়ে ঈদুল ফিতরের দিনে বা এর আগে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা একান্ত কর্তব্য । কারণ জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত ৷ কাজেই ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে; যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তাআ'লার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে অপচয়ে মত্ত হয় এক স্তরের মানুষ এই ঈদকে কেন্দ্র করে। আর পাশের বাড়ির মানুষটি না খেয়ে থাকলেও খবর রাখে না কেউ। তাই কাছের অসহায়,আশ্রয়হীন মানুষটার প্রতি আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব ৷ এতে বিভেদ ভুলে ঈদ হবে সমতার। ঈদ হবে সম্প্রীতির ও ভ্রাতৃত্বের ৷ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরো কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। আজ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ইসলাম যে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম, সেটি প্রমাণ করতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ । 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।