এক সন্ধ্যায় ।। বিষ্ণু চক্রবর্তী



অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরার জন্য ছুটছে বীতশোক। অলরেডি একটা ট্রেন মিস করেছে, এটা মিস করলে আর আপাতত একঘন্টা কোনো ট্রেন নেই হাওড়া থেকে বর্ধমানের। স্টেশন লোকারণ্য। সবাই সবার মতো ছুটছে, এমন সময় একটা পরিচিত মুখ দেখে একটু থমকে দাঁড়ালো বীতশোক। 'মেহা না?' খটকা লাগে। যাইহোক দাঁড়ালে চলবে না, ছোট লাগায় সে। ট্রেন এনাউন্স করেছে, 'অনুগ্ৰহ করে শুনবেন। ট্রেন নম্বর ৩৭৮৫১ হাওড়া বর্ধমান লোকাল দুই নং প্লেটফর্মে আসছে।' ত্রিভাষিক এনাউন্সমেন্ট শেষ হলো, বীতশোক ওভার ব্রিজ দিয়ে ছুট দিলো দুই নম্বরের দিকে। তার প্লেটফর্মে যেতে না যেতেই ট্রেন এলো। ভিড় কাটিয়ে কোনো রকম চাপলো সে। 'উফ, বাবা!', একটু শ্বাস নিলো সে। কিন্তু সামনে তাকাতেই আবার যেন দম বন্ধ হবার উপক্রম। 'মেহা?' সামনে‌ দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে বীতশোক। এবার মেয়েটিও তাকায় ওর দিকে, তার চোখেও প্রশ্ন, দুজনে হয়তো কোনও দিন এই দেখা হওয়াটা চায়নি, অথবা চেয়েছিলো, কে জানে!
     চোখাচোখি হতেই দুজনে‌ বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু মন তো ফেরেনা সহজে, আড়চোখে তাই দুজনেই একে অপরের দিকে তাকানো‌ থেকে বিরত থাকতে পারেনা। ট্রেন‌ শেওড়াফুলি এসে থামলো। বীতশোক এতোক্ষণে একটু সাহস সঞ্চয় করে বললো, 'অরিন কেমন‌ আছে?' মেহা হাসে। এই হাসি বীতশোক চেনে, প্রাণখোলা হাসি। একটা সময় তার সকাল সন্ধা এই হাসিতেই তো উদয়াস্ত হতো। 'কি হলো, হাসলে যে?' 'অরিনকে কল‌ করে জিজ্ঞেস করে নাও, কল‌ ধরিয়ে দেবো?' এই খোঁচা টা নিতে পারেনা বীতশোক। 'না, লাগবে না, থাক।' আবার মুচকি হাসি মেহার ঠোঁটে।
     বীতশোক আর মেহার ঘর ভেঙেছে আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর। কলেজ থেকে দুজনের ভালোবাসা, তারপর ইউনিভার্সিটি; চাকরি সব একসাথেই। পারিবারিক সম্মতিতে দুজনের চার হাত এক হয়। দিব্যি চলছিল সংসার, কিন্তু......
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বীতশোক। আর আড়চোখে তাকায় না মেহার দিকে। 'অরিনের সাথে মেহা হয়তো ভালোই আছে, হয়তো শ্রেয়াও তার বাবাকে মনে রাখে নি।' ভাবতে থাকে বীতশোক। ট্রেন চলছে আপন গতিতে সাথে ওর ভাবনাও নানা স্টেশন পেরোচ্ছে। 
      'শ্রেয়া...?' মেহা তাকায় তার প্রশ্ন শুনে, মুচকি হেসে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সান্ধ্য হাওয়ায় তার চুল উড়ছে, বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা বীতশোক এক মৃদু গন্ধে বিহ্বল হয়। মেহা এখনো কতোটা অপরিহার্য আজ হঠাৎ করে যেন‌ বীতশোক অনুভব করছে। কিন্তু মেহার কাছে তার হয়তো কোনও অস্তিত্ব নেই, এটা একপ্রকার নিশ্চিত সে। কিছু একটা বলতে গিয়ে দমে যায়, 'নাহ, এতো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।' নিজেকে বোঝায়, কারোর বিষয়ে এতো নাক গলানো কোনো ভাবেই কাম্য নয়। মনের মাটিতে নীতির বীজ ছড়ায় বীতশোক। 
        এবার মেহা বলে, 'বাড়ি পাল্টেছো? এখানে তো...!' 'কেন? এখানে আসতে নেই বুঝি?' বীতশোক একটু মুচকি হেসে বলে। কথা বাড়ায় না মেহা। সময়ের তৈরি ব্যবধান ঘোচানো  পারেনা কেউ। দুজনের নীরবতা ভাঙে ট্রেনের ভেঁপুর শব্দ। ট্রেন থামে বর্ধমান স্টেশনে, সবাই নামে, নামলো বীতশোক আর মেহাও। চোখে হাজারটা প্রশ্ন বীতশোকের। 'মনে‌ মনে‌ কাওকে খুঁজছো?' মেহা গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে। বীতশোক নীরব। মেহা আবার বলে, 'কোনোদিন সোজা কথা সোজা বলতে পারলে‌না বীতশোক। সেদিনও না, আর আজও না।' এগিয়ে এসে বীতশোকের দিকে শেক করতে হাত বাড়ায় সে। হাত মিলিয়ে অতীতকে আগামির শুভেচ্ছা জানিয়ে মেহা নিজের গন্তব্যের দিকে হেঁটে যায়, দাঁড়িয়ে থাকে বীতশোক। ট্রেনের ভিতর থেকে তখনও একটা এনাউন্সমেন্ট বাজছে, 'এটি এই যাত্রার শেষ স্টেশন.....'

2 Comments

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

  1. সত্যিই মন ছোঁয়া লেখা।

    ReplyDelete
  2. লাস্ট লাইন এ announcement টা সেরা

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।