সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল গ্রাম বাংলার এক অজপাড়া গাঁয়ে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। বাড়ির পিছনে বড় জঙ্গল যা দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে থাকতো। কুপি বাতি ও হারিকেনই ছিল ভরসা। সন্ধ্যা নেমে আসলেই গ্রামে মনে হতো মধ্যরাত। গ্রামের স্কুলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ছোট আপাও একই স্কুল থেকে এসএসসি দেবেন। উনার সাথে পড়েন আপুরা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন। বিভিন্ন উপলক্ষে একে অপরকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজই ছিলো। আপার সাথে যারা ছিলেন সেই গ্রুপে হেনাআপা ছিলেন সবচেয়ে সুন্দরী। আপার হাতের লেখা যেনো টাইপ করা, মুক্তো ঝরানো। আপারা প্রাইভেট পড়তেন। হেনা আপার বাড়ি একটু দূরে থাকায় প্রায়ই আসা হতোনা। আমি আবার প্রাইভেট পড়তাম হেনা আপার বাড়ির কাছে এক নামকরা ম্যাথ ও ফিজিক্স স্যারের কাছে। ফলে প্রায়ই প্রাইভেট খাতা দিয়ে আসতে পাঠাতো ছোট আপা আমাকে। পাঁচফুট উচ্চতার গোছানো, চোখ দুটো আঙুর চোখের ভাসা ভাসা, ফর্সা, জোড়া ভুরুর হেনা আপাকে আমার ভালো লাগতো খুব। কবিতা লিখি, তাই উনাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে লিখে ফেলতাম কবিতা। হেনা আপাকে দেওয়া খাতার ভিতর ঢুকিয়ে দিতাম কবিতা। পরদিন দেখা হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করতাম, "কেমন হলো কবিতাটা বল্লেন না তো?
"তুমি তো ভালোই লেখো।
"এটুকুই? আর কিছুনা?
"আমি তোমার দুই বছরের বড়।
" তাতে কি? আপাকে বলবেন না কিন্তু!
"পাগল নাকি?
এভাবে কবিতা থেকে চিঠিতে চলে যাই। হেনা আপার বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আমার আব্বাকে চিনেন, এলাকার গণ্যমাণ্য আমার বাবা। তাই আমাকে ও বাড়ির সবাই আদর করতেন। বৈশাখের প্রথম দিন বৈশাখী মেলা হয় আমাদের বাড়ির পাশেই। আপা আমাকে টাকা দিয়ে বলে দিলেন,
" মেলায় গিয়ে একডজন কাঁচের চুড়ি, মালা, লিপস্টিক, পাউডার, সাবান, ফিতা কিনে হেনাদের বাড়িতে দিয়ে আসবি, পারবিনা?
" পারবো আপা।
আমাকে আর পায় কে? মেলায় গিয়ে আপার লিস্ট অনুযায়ী সব কিনলাম। সাথে অনেকগুলো ভিউকার্ড, আর চিঠি। কেনাকাটা করে দুইমাইল দূরে হেনা আপাদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা। বাড়ি পৌঁছার আগেই টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু। আধা ভিজা হয়ে হেনা আপাদের বাড়িতে পৌঁছি। টিনের বড় ঘর। শোলার বেড়া দিয়ে বাড়ির বাউন্ডারি। ঘরের সামনেই গন্ধরাজ, গেন্দা ফুলের গাছ। মেলা থেকে জিলাপি কিনে নিলাম নিজের টাকায়।
"জিলাপি কেনার টাকা নিশ্চয়ই তুমি দিলে তাইনা?
"কেমনে বুঝলেন?
" মেয়েরা বুঝে সব। এতো ভিজলে কেন, কোথাও দাড়াতে পারতে। যদি জ্বর আস?
"আপনার জন্যই তো এলাম, বুঝেন না?
" পাগল তুমি একটা।
" আপনার জন্য পাগল।
"নাও, গামছা, শরীর মুছো
" আপনি মুছে দিন
"কেউ দেখে ফেলবে তো
" দিতে হবে
"দাড়াও হারিকেনটা একটু দূরে সরিয়ে রাখি।
ততক্ষণে বৃষ্টির তোড় বেড়ে গেছে। ইচ্ছা করলেও এ ঘরে আসতে পারবে না কেউ। আপা আমাকে তার বুকের কাছে মাথাটা নিয়ে গামছা দিয়ে মুছে দিতে লাগলেন। আমি যেনো পৃথিবীতে নেই ততক্ষণ। অসম বয়সের ভালোলাগা, দুজন ছাড়া কেউ নেই, এমন পরিস্থিতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো। আপার বুকের ঘ্রাণ নিতে নড়ে উঠতেই আপা বল্লেন,
" সুযোগ দিয়েছি বলে সুযোগ বেশি নিওনা। বেশি খেলে মুখ পোড়ে।
আমি থেমে যাই। আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মিশিয়ে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর সরে যায়। চুড়ি, কানের দুল, পড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,
" কেমন লাগছে আমাকে বলো?
" রোজি সামাদ নায়িকার মত।
"পাম দিওনা তো।
ওইরাতে আমি আসতে পারিনি বৃষ্টি ও ঝড়ের জন্য। থেকে গেলাম হেনা আপাার বাড়িতে। রাতেই ঘরের মুরগী জবাই, মসলা পিঠা বানিয়ে খালাম্মা খাওয়ালেন। হেনা আপার ছোট বোনটা খুব আগ বাড়িয়ে কথা বলা, এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে কথা বল্লো। আমার মন হেনা আপার সাথে, কেমন করে ছোটবোনের সাথে ফ্রি হবো?
সে রাতে অনেক রাত অব্দি সজাগ ছিলাম। কাছারি ঘরে থাকতে দিলেও আপা ছিলেন অনেকটা সময়।
আপার বিয়ে হয়ে গেছিলো হঠাৎ করেই। দেখতে এসে পছন্দ হওয়ায় ঐরাতেই বিয়ে। আমি তখন বিদেশে। ফিরে এসে আর দেখা হয়নি। এখনো বৈশাখী মেলা আসলে ঐ রাতের কথা মনে পড়ে। স্বামীর ঘরে থেকে হেনা আপা আমাকে কি কখনো ভাবে? জানা হয়না। সমাজ এখানে রক্তচক্ষু হয়ে বাধা দেয়। অথচ মন কি মানে, কখনো?