আব্দুল খালেক ফারুক'র গল্প


লকডাউন

‘কোটে যান?’
‘লকডাউন দেইখপ্যার’
‘মানে কী? কীসের ফির লকডাউন।’
‘মেয়েছেলের ওই এক দোষ। সউগ বুঝব্যার চায়।’
‘যাও। লকডাউন দেইখপ্যার যায়া ফির বুকডাউন দিয়া আইসেন না। পুলিশ বোলে কষি ডাংবার নাগছে।’
‘আরে তুইয়ো যেমন কম বুঝিস। পুলিশ স্যারেরা মোর সগাই পরিচিত। ডেইলি দিন টার্মিনালে দেখা হয়। ভালো মন্দ কথা হয়। পুলিশ ক আর ম্যাজিষ্ট্রেট ক, মটর ডিপারমেন্টের লোকোক সগাই ভয় করে বুঝলু?’
‘হইছে। চাপা মারেন না। তোমার ফিতা মুই জানোং।’
মজনু মিয়ার এসব ফুটানির আলাপে মন গলেনা মর্জিনা বিবির। সংসারের কাজে মন বসায় সে। মজনু ঘরবন্দি থাকলেও তাকে দিয়ে সংসারের কাজ করানো দুরাশা। একাই সব কিছু সামলাতে হয়। দু’টি ছেলে মেয়ে স্কুলে যায়। অবশ্য বর্তমানে স্কুল বন্ধ। কাজ বন্ধ হওয়ায় খাবার কষ্টটা হঠাৎ জাগান দিয়েছে। চাল প্রায় শেষ। টার্মিনালের সামনে একদিন ১০ টাকার চালের লাইনে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে চাল না পেয়ে ফিরে এসেছেন মজনু। এখন দুইবেলা খাবার জোটানো কঠিন হয়ে গেছে।
মজনু মিয়া পুরোনো জিন্সের প্যান্টের উপর নতুন শার্ট চাপিয়ে একটু কেতাদুরস্ত হবার চেষ্টা করে। চুলে চিরুনি চালানোর সময় গুন গুন করে ভাওয়াইয়া গান ধরে। ‘যাওয়া আইস্যার ঘাটাতে তোমরা বসাইছেন পিরিতির কল।’
গত তিন দিন বাড়ির বাইরে বেরুতে পারছেননা। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। মনে হয় হাড় হাড্ডিতে জং ধরেছে। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকারি নির্দেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ। বাসের হেলপার মজনু মিয়া তাই বর্তমানে বেকার। কিন্তু এভাবে বসে থাকলেতো চলবেনা। বাইরের আবহাওয়াটা দেখা দরকার। এর মধ্যে লকডাউন জিনিষটা কেমন-দেখার জন্য মজনু মিয়ার মন আনচান করছে।
বাড়ি থেকে কিলো তিনেক হেঁটে দাদামোড় পর্যন্ত এলেন মজনু মিয়া। দু’জন ট্রাফিক পুলিশ রিকশাচালকদের থামিয়ে পথ ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। জিয়া বাজারে যেতে দিচ্ছেন না। এক রিকশাওয়ালা ট্রাফিক পুলিশকে বলছেন ‘স্যার আগ হননা। একটু রহম করেন’।
দাদামোড়ে মন্টু মিয়ার টিস্টলের টিনের চালের ফাঁক দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া উড়ছে। তারমানে দোকান খোলা। মজনু এগিয়ে যান। এক কাপ চা খেলে মন্দ হয়না। চা খেতে খেতে দিন দুনিয়ার কিছু খবরাখবর নিতে চান। তারপর বাড়িতে ফিরে স্ত্রী মর্জিনার সাথে চোটপাট করে জ্ঞানগর্ভ কিছু কথা বার্তা উগরে দিতে চান।
টি স্টলের ভেতর ঢুকে দেখেন তারমতো আরো কয়েকজন বসা। ছোটখাটো মজমার মতো। টি স্টলের মালিক ফজলু পিঁয়াজু ভাজছেন কড়া তেলে। আদা আর রসুনের একটা উৎকট অথচ সুগন্ধ মজনু মিয়ার নাক ছুঁয়ে একেবারে পেটে জমা হয়ে গেলো। চায়ের সাথে গরম গরম দুই পিস পিঁয়াজু খেতে পারলে বিরাট ব্যাপার হবে।
‘ম্যানেজার ভাই এই লকডাউন আর কয়দিন থাকপে? বেচাবিক্রি নাই। মরি যাই হিনা।’
‘ধরিনে আরোর দুই মাস।’
‘কন কী? হামরা বাঁচমো কেমন করি?’
‘খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়া জীবনের চিন্তা কর। আমেরিকার অবস্থা শুনিস নাই। দিনে আড়াই তিন হাজার মানুষ সাফা হবার নাগছে। খাল খুঁড়ি লাশ পোতে থুবার নাগছে। ট্রাম্প মিয়ার ভুরুর চুল এমনি নাই। যে কয়টা আছে তাও উঠি যাবার নাগছে। আর চীনে মৃত্যুর হিসাবে গড়মিল দেখা দিছে।’
মুদির দোকান নুর স্টোরের ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চায়ে আয়েশ করে চমুক দিয়ে করোনা বিষয়ক আপডেট দিচ্ছেন। মজমার শ্রোতারা হা করে গিলছেন তার কথা।
এবার হুজুর টাইপের একজন আলাপের ফ্লোর নিতে চান। ইনি কোনো মসজিদের খাদেম বা মোয়াজ্জ্বিন হতে পারেন।
‘শোনেন ভাইজান। আপনার ম্যালা কথা শুনলোং। এলা মোর কথা শোনেন। আমেরিকা-স্পেনের কথা কয়া লাভ নাই। এই বাংলাদেশে যত হক্কানি ওলামায়ে কেরাম আছে, তাদের দোয়ায় করোনা চাইপপ্যার পাবার নয়। যে দেশে সাঈদী-আজহারির মতোন আলেম থাকে, সেই দেশে কোন বালা মুসিবত কাচপ্যার পায়না। শোনেন ভাইসব, একটা কথা কই কিছু মনে করেন না, মসজিদে নামাজ বন্ধ করা ঠিক করে নাই সরকার। করোনা আল্লার গজব। এ সময় বেশী বেশী দোয়া কালাম পড়া দরকার ছিলো।’
‘হুজুর নামাজতো বন্ধ করে নাই সরকার। কইছে পাঁচ-ছয় জনে নামাজ পড়া যাইবে’-মজনু সুযোগ বুঝে আলাপে অংশ নেয়। সে আবার শ্রমিকলীগের সদস্য। হুজুরের ডানপন্থী কথায় একটু নাখোশ হবারই কথা।
‘আরে ভাইরে ওই একে কথা। জামাত ছাড়া নামাজ হয়?-হুজুর জবাব দেন।
টি স্টলের এক কোনায় ঝিম মেরে সবার কথা শুনছিলেন চর ভেলাকোপার কলিমুদ্দিন। পেশায় দিনমজুর। জাংলির ৪টি লাউ বেচে দুই কেজি চাল কিনেছেন। আর কিছু কিনতে পারেননি। বাড়িতে লাউ শাক আছে, তা দিয়েই দুইবেলা চালাতে হবে। পকেটে বেচে যাওয়া পাঁচ টাকায় এককাপ চা খেয়ে টাউনের খবরাখবর নিয়ে গ্রামে যেতে চান । গরম গরম খবর। হুজুরের কথায় একটু মনে হয় নাখোশ হলেন কলিমুদ্দিন।
‘হুজুর উগলা ফতোয়া না দেনতো। তোমরা সকালে এক কথা কইলে, বিকালে কন আরেক কথা। তোমার কথা শোনে কাঁই। কয়দিন আগোত কোন কোন হুজুর বোলে কইল্-করোনা এই দ্যাশে আইসপ্যার নয়। তা এলা ফির আসিল ক্যা। আরে বাহে, বড়লোকরা ঘরোত বসি আরামে ফ্রিজের গোশত-মাছ খাবার নাগছে। যতো গজব হামার গরীরের উপরা। কাম নাই, কামাই নাই। ওজি ওজগারের পথ বন্ধ। করোনা হামার করকরা না বানে যাবার নয়।’
কলিমুদ্দিনের এসব আলাপে সমবেত শ্রোতা হা হু করে যান। মজনু মিয়া খুশির চোটে এক পা বেঞ্চের উপর তুলে অনেকটা আয়েশ করে বসেন। আসর জমবে মনে হচ্ছে। টি স্টলের মালিক ফজলু মিয়ার মুখে চোরা হাসি। আজ বেচা বিক্রি মনে হয় ভালোই হবে। আর এক খোলা পিঁয়াজু কড়াইয়ে ছেড়ে গামছা দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নেন ফজলু। ম্যানেজার আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দেন।
কলিমুদ্দিন এখনও জারি রেখেছেন তার বয়ান। একটা জলিল বিড়ি ধরিয়ে সুখ টান দিচ্ছেন মাঝেমধ্যে।
‘শোনেন এই দ্যাশে ষোল-সোতরো কুটি মানুষ। দুই তিন লাখ মানুষ মরলে কী হইবে? কোনো যায় আইসে? হলোখানার সারোডোবের আজিমুদ্দিন মেম্বারের চার বউ ছিলো। ছেলেপুলে মোটে ১৮ জন। একবার ধরলা নদী ভুড়া দিয়া পার হইতে দুই ব্যাটা মরি গেইল। মেম্বার খবর পায়া কয়-যায়না। দুইটা গেইলতা মোর---হইল। আরো ষোলটা আছে।’
কলিমুদ্দিনের কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসে। হাসির চোটে মনে হয় টি স্টল উড়ে যায়। কীসের লকডাউন, কীসের নিষেধাজ্ঞা। একটা আমোদ এসে ভর করে সবার চোখে মুখে। উপভোগ্য ব্যাপার বটে!
এ সময় হঠাৎ সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। ফজলু কান পাতে এই আওয়াজটাতো ভালো নয়। মুহূর্তের মধ্যে ডজনখানেক মটর সাইকেল আর কয়েকটি গাড়িতে পুলিশ এসে লাঠিচার্জ শুরু করলো দাদামোড়ে, সমবেত ভিড়ের মধ্যে। ফজলু চুলা নিভিয়ে টি স্টলের ভাঙা দরজাটা বন্ধের নানা কোশেশ করতেই দুই পুলিশ সদস্য লাঠি হাতে চড়াও হলেন মজমার উপর। দরজা ভেঙে যে যেভাবে পারে পগার পার হবার চেষ্টা করছে। প্রথমে মারের ভয়ে হুজুর রিলে দৌড় দিয়ে দরজা পার হতেই পায়ে কী যেন লেগে পাকা রাস্তায় পড়ে গেলেন। আহা! বেচারার হাঁটুর বারোটা বেজে গেলো। তিনি পড়িমড়ি করে পালালেন। ম্যানেজার পালাতে গিয়ে ধরা খেয়ে কয়েক ঘা খেলেন। কলিমুদ্দিন পুলিশের হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইলেন। সবশেষে মজনু মিয়া বের হতেই দুই পুলিশ তার পশ্চাৎদেশে একযোগে সবেগে লাঠি চালালেন। বাগে পেয়ে বেশ আরাম করে পেটালেন তাকে। মজনু কী করে যেন এদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে গলির দিকে ছুটলেন, বুঝতে পারলেন না। গলি পেরিয়ে হরিকেশ মোড় হয়ে বাড়ির পথ। কিছুদূর এসে আর হাঁটতে পারছেননা। হরিকেশের উঁচু ব্রিজটার পাশে বসে পড়লেন। প্রচন্ত পিপাসা পেয়েছে, কিন্তু হাঁটার শক্তি নেই। দোকানপাট সব বন্ধ। রিকশাও চলছেনা।
শহরে পুলিশতো আছেই। সাথে আর্মিও নামলো মনে হয়। কেন যে বাড়ি থেকে বের হলেন। লকডাউন দেখতে গিয়ে কী বিপদ হলো। মর্জিনার বিবির কথা না শুনে বড় আহাম্মকের মতো কাজ করেছে মজনু।
‘আরে মজনু ভাই রাস্তার উপর বসি ক্যা। কী হইছে।’
মজনু কথা বলে না। বোবায় ধরেছে। বিত্তান্ত কী করে বলেন? একেতো পুলিশের মাইর খেয়েছেন, তার উপর বেকায়দা জায়গায়। সবাই জানলে ইজ্জত কা সওয়াল।
‘ভাইরে শরীলটা ভাল নোয়ায় তুই তোর ভ্যানোত তুলি মোক বাড়ি নিয়া যা।’
‘হয় হয় ওঠোতো।’
গ্রামের ভ্যানওয়ালা আব্দুস ছোবানের হাত ধরা ধরি করে কোন মতে ভ্যানে ওঠে মজনু। তবে বসতে গিয়ে মনে হয় জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। প্যান্টের ফাঁক গলে কয়েক ফোঁটা রক্তও জমা হয়েছে পায়ের আঙ্গুলের উপর। একক্ষণে খেয়াল করলো মজনু।
‘ভাইরে আস্তে আস্তে চালাইস। মোর জীবনটা ব্যার হয়া যাবার নাগছে। ওহ-রে।’
‘ক্যা মজনু ভাই কাবরান ক্যা। শুননুং কিছুক্ষণ আগোত বোলে দাদামোড়োত পুলিশ সগাইকে ধোলাই দিছে। তোমরাও ওটে গেইছেন নাকি?
‘না। মুই ক্যা ওঠায় যাং। তুই মোক পাগলা পালু।’
‘না গেইলেই ভালো। হামার কুড়িগ্রামোত বোলে করোনা বেরাইছে। যতিনের হাটোত বোলে একজন মরচে। বেলগাছাতো নাকি করোনা ধরা পড়ছে। রোগী পালাইছে। এলা পুলিশ খুঁজি বেরব্যার নাগছে। কত কী যন্ত্রণা ক। ইলিপ ছিলিপতো কিছুই পাইলোং না। মেম্বার যে আন্দারে আন্দারে কাক কাক দিলে। তুই কি ইলিপ পাচিস?
‘না। কায় দেয় হামাক ইলিপ। ও বাবারে।’
বেজায়গায় আবার ভ্যানের তক্তার চাপ পড়েছে। মজনুর মরো মরো অবস্থা। তাতেও বিকার নেই ভ্যানওয়ালা ছোবানের। সে অনবরত বকবক করে যাচ্ছে।
‘এই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থাকি শালারা আসি হামার বারোটা বাজাইলে। পুলিশ যদি আগোতে লকডাউন করি দিলে হয়, তাইলে কী এই অবস্থা হয় কন?’
ছোবানের মুখে লকডাউন শব্দটা শুনে চমকে ওঠে মজনু।
‘এই শালার লকডাউন শব্দটা কাইযে আবিস্কার কল্লে? এই লকডাউন দেইখপ্যার যায়াতো মোর বিপদটা হইল।’ বিরবির করে প্রলাপ বকে মজনু। ছোবহান বুঝতে পারেনা।
‘আর একটু চাপি ধরি থাকেন ভাইয়ো। এইযে তোমার বাড়ি আসি গেইলোং।’
আঙিনায় মর্জিনা দাঁড়িয়েই ছিলেন। মুখে মাস্ক। ভ্যানে মজনুকে আসতে দেখে এগিয়ে আসেন। বুঝতে পারেন কিছু হয়েছে।
‘কী হইছে তোমার। নামেন। দাঁড়বার পাননা ক্যা?
মজনু নিরুত্তোর। পশ্চাৎদেশের ব্যথাটা বাড়ন্ত। পা ফেলাতেই পারছেন না। একহাত ছোবান অন্যহাত মর্জিনার শরীরের উপর ভর করে বিছানা পর্যন্ত যান মজনু।
‘তোমার কী হইছে গো। খুলি কননা ক্যা?’
‘এলাও বুঝিস নাই?
‘না কইলে বুঝিম কেমন করি?’
‘ লকডাউন’
‘ও বুঝছোং। পুলিশ মনে হয় আদর করছে। তখনে তোমাক কইছিনুং-যান না। তা শুনবেন মোর কতা? কাঙালের কতা বাসি হইলে ফলে।’
‘প্যাচাল পারিস না। বাবুল ডাক্তারোক খবর দে। মোর মনে হয় জ¦র আসিল। সর্দিও নাগিল্। করোনা মনে হয় ধরিল্ মর্জিনা।’
মর্জিনা মজনু মিয়ার ব্যথার বিলাপে কান না দিয়ে ছুটলেন গ্রাম্য ডাক্তার বাবুলকে মোবাইল করতে।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।