আখের আলীর গল্প "জীর্ণ কুটিরের স্বপ্ন" ।। বর্ণপ্রপাত


গ্রীষ্মের দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ হঠাৎ চারপাশের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। এদিকে আয়েশা বেগম প্রসব যন্ত্রনায় কাতর। আয়েশাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কেউ নেই তাঁর পাশে। মেঘে ঢাকা আকাশ ক্রমশ অন্ধকারের রূপ নিচ্ছে।মাঝে মাঝে বিকট মেঘের আওয়াজে কেঁপে উঠছে পৃথিবী। ঠিক যেমনটা কাঁপছে আয়েশার যন্ত্রনাময় দেহ। আয়েশা খানিকটা কাঁত হয়ে শুয়ে আছে ছিন্ন কাথায় মোড়ানো বিছানার উপর।হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি, আয়েশার জীর্ণ কুঠিরের চাল চুইয়ে টুপ টুপ বৃষ্টি পরছে। আয়েশার কষ্ট ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। এমন সময় আয়েশার অসহ্য বেদনাদায়ক চিৎকার শুনে তার কাছে এসে বসল পাশের বাড়ির মহিলা।কিছুক্ষণ পর ভূমিষ্ঠ হল ছোট রক্তিম সাদা চামড়ার ছেলে সন্তান। বৃষ্টির সময় জন্মের জন্য তার কলিজার টুকরো সোনা মানিক এর নাম রাখল বাদল।

বাদলের বাবা মারা গেছে তাদের বিয়ের কিছুদিন পর, ট্রাম দূর্ঘটনায়। সে ছিল সামান্য ব্যবসায়ী,শহর থেকে অল্প দামে পণ্য ক্র‍য় করে সামান্য লাভে বিক্রি করত গ্রামের ছোট বাজারে। জন্মের পর বাবাকে দেখে নি বাদল । তার বাবা-মা বলতে শুধুই মা।

আয়েশার এতদিন ভালোই চলছিল, খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যেত, জীর্ণ কুটিরের সেই ছিন্ন বিছানাতেই এক দন্ড ঘুমিয়ে রাত পার হত তার। এখন তাকে কিছু একটা করতে হবে, নিজের জন্য না-ই হোক তার বাদলের জন্য হলেও চিন্তা বেড়ে গেছে ৷ বাদলের দেখাশোনা,খাওয়ানো,ভালো-মন্দ সবকিছুর দায়দায়িত্ব তার।
আয়েশা তার ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। ছেলে তার পড়াশোনা করবে মানুষের মত মানুষ হবে। আয়েশা আপন মনে চিন্তা করা তার ছেলে বড় হলে তাকে আর এই কুটিরে থাকতে হবে না। অনেক স্বপ্ন তার ছেলেকে নিয়ে অনেক বড় ও আদর্শ মানুষ বানাবে তার বাদলকে।

বাদল দিনে দিনে বড় হতে থাকে, বাদল ছোট থেকেই মেধাবী,পরিশ্রমী,তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান ছেলে।
এখন বয়স তার ছয় কি সাত। অল্পকিছু টাকা জমিয়ে বাদলকে ভর্তি করালো গ্রামের স্কুলে। বাদল নিয়মিত স্কুলে যায়। ক্লাসের সবাই তাকে চেনে। দেখতে দেখতে তার অনেক সহপাঠী হয়েছে। সহপাঠীদের সাথে সেও স্কুলে যায়, নানান খেলায় মেতে থাকে বাদল।
সহপাঠীদের বাবা তাদের সন্তানকে স্কুলে এগিয়ে দিয়ে যায় । কিন্তু বাদল কল্পনাও করতে পারে না তাঁর বাবা কেমন ছিল। এ নিয়ে বাদলের মনে উদ্রেক ঘটে অজানা সব ক্ষোভের ।বাদল আপন মনে চিন্তা করে, আজ মাকে বলবে ওর বাবার কথা।
বাদল, "আচ্ছা মা, সবার বাবা কেমন তাদের স্কুলে দিয়ে যায় আমার বাবা কোথায়?"
নিজেত অজান্তেই মায়ের চোখের কোটরে পানি এসে যায়। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে, "বাবারে তোর বাবা কখনও তোকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারবে না। মন খারাপ করিস না আমি তোকে স্কুলে দিয়ে আসব। তুই মন খারাপ করলে যে আমার পৃথিবীটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। তুই যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।"
দিনের পর দিন আয়েশা তার ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসে,বাদলও আর কখনও তার বাবার কথা মনে করে না। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বাদল কলেজে ভর্তি হবে। বাদলের বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা খুব কষ্ট করে দুমুঠো আহার জোগাড় করে।

আয়েশার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, ইদানীং তার প্রচন্ড শরীর কাপুনির সাথে জ্বর আসে। এমন শরীর নিয়ে আয়েশা মানুষের বাড়ি কাজ করে,কিছু টাকা জমিয়েই বাদলকে কলেজে ভর্তি করে। পড়াশোনা করতে থাকে বাদল।একদিন কলেজেই অনুর সাথে প্রথম দেখা বাদলের। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগার সুত্রপাত। যেন বিকেলের মিষ্টি রোদ, মেঘ বরণ কেশ, মুক্তাঝড়া হাসি যেন অপরূপ এক সৈন্দর্য্যের রমনী! বাদল মেধাবী ছাত্র, এই রেশ ধরে বাদলের সাথে বন্ধুত্ব হয় অনুর।

অনুর বাবা গ্রামের মাতবর, অনেক টাকাওয়ালা আর ক্ষমতাবান। অনু আর বাদলের মধ্যে খুব ভাব জমে যায়। দুজন যেনে একে অপরকে কে খুব ভালবাসে। কেউ কাউকে ছাড়া একটা মুহুর্ত কল্পনা করতে পারে না।বাদল গ্রাম ছেড়ে শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ছুটিতে বাড়ি আসলে অনুর সাথে ঘোরা ফেরাও করে। এভাবেই কেটে যেতে থাকে দুজনের দিন। বাদলের পড়াশোনা শেষে। চাকরির জন্য মরিয়া, তাকে যে তার মায়ের স্বপ্ন পুরোন করতে হবে। শেষ যেবার গ্রাম থেকে ঢাকায় যায় বাদল তখন থেকে অনুর সাথে যোগাযোগ কমে যায়। অনুর বয়স থেমে নেই, বাবা তার জম্য পাত্র দেখেছে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিবে। অনু তার বাবাকে বিয়েটা কিছুদিনের জন্য পিছাতে বলে, এদিকে বাদলের কোন খোজ খবর নেই। মাস সাত পর বাদল গ্রামে এসেছে। বাদলকে দেখে অনু যেন এক পাহাড় সমান আত্ববিশ্বাস নিয়ে বাদলকে বিয়ের কথা বলে।বাদল এমন সময় কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি না। ঘরে তার অসুস্থ মা। মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছে। চাকরির জন্য ছুটে বেড়াতে হয় তার।নিজের থাকার জায়গা নেই বিয়ে করে বউকে কোথায় রাখবে। তার মাকে চিকিৎসা করাতে হবে। কান্না করে চোখের পানি মুছতে মুছতে অনু চলে যায়। বাদল নিজের কষ্ট ভিতরে জমা করে চাপা কান্না করেই দিনানিপাত করে ।এত দিনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। বাদলের মায়ের অবস্থা বেজায় খারাপ, মাকে বাদল শহরের একটি নামিদামি হাসপাতালে ভর্তি করায়। বাদল চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে থাকে। আজ বাদলের মায়ের অবস্থা খুব মুমূর্ষু আর কিছু সময় বাঁচবে হয়তো। বাদল তার মায়ের পাশে দাঁড়ায়, মা তার হাত ধরে কান্না করতে থাকে, বাবা তুই আমার স্বপ্ন পুরন করিস।আমি হয়ত আর বেশিক্ষণ থাকব না। নিরবিতায় যেন চুপসে গেলো সব। আকষ্মিক বাদলের মা তার হাতের উপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মায়ের গল্পটা এখানেই থেমে গেলো। কয়েকদিন পর বাদলের কাছে একটা বাদলের চিঠি আসে। চিঠি হাতে নিয়ে বাদল চোখের পানি ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, আজ সে চাকরি পেয়েছে। তার মায়ের স্বপ্ন পুরন করেছে। স্বপ্ন দেখানো মা আজ পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই। বছর খানেক পর বাদল তার চিরচেনা গ্রামে যায়,গ্রামে গিয়ে অনুর খোঁজ করে সে। কলেজের বন্ধু কাঁজলের সাথে দেখা হলে বাদল তার অনুর কথা জিজ্ঞেস করে। কিছুক্ষণ নিরব থাকে কাঁজল। বলে, "তোর জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করেছে অনু। দুই মাস হল অনুর বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে।" থমকে গিয়ে আকাশে ওড়া শঙখচিলটার দিকে একাগ্রচত্তে তাঁকিয়ে থাকে বাদল......

আখের আলী
জবি, বাংলা বিভাগ

আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।