নাজমা সুলতানার গল্প "গোলাপী ব্যাগ"


শেফালী সন্ধ্যা হলে ফার্মগেট ও আরও কয়েকটা ফুটব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে খদ্দের নেয়। তাতে দেশে মা ও দুমেয়ের খরচ দিতে পারে। পঁচিশ-ছাব্বিশের গার্মেন্টস শ্রমিক শেফালীর একদিন বাসের ধাক্কায় ডানহাতের কব্জি থেতলে গেলে সে কাজটা থাকে না। এরপরে কোনো কাজ না পেয়ে কদিন ভিক্ষেয় নামে। ভিক্ষে পাবে কী! মানুষের জ্বালাধরা চোখের নজরে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে কখন যে ভ্রাম্যমান পতিতা বনে যায় টের পায় না।
এবার অল্পকিছু বেশি কামাই হলে ঘরের ভাঙা চালগুলো বদলাবে। বর্ষা আসার আগে যাতে কাজটা সারতে পারে, সেআশায় সহসা দেশে যাবে না বলে ঠিক করে। প্রায়ই তার মেয়েদের ফোনে আবদার থাকে,
-মা দ্যাশে আসবা না?
-হরে মা, ঈদে আসমু, কী কী আনমু?
তার মা বিশেষ করে বলে দেয়,
-এইবার আইলে বড় নাতনি শিউলির লাইগা ইসকুলের একটা ব্যাগ আনবি, মা।
শহরে কী একটা বিপদ যেন শুরু হয়েছে। শেফালী শুনেও তেমন বুঝতে পারে না। দিনে দিনে তার কাজ কমতে থাকে। আরও শুনতে পেলো, রাস্তায় নাকি নামা যাবে না। এরমধ্যে শুরু হয়ে গেলো শহর ছাড়ার হিড়িক। শেফালী মাসের সবটাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলে দেয়,
-মা, হিসাব কইরা খরচ করবা। আমি তিনচাইরদিন বাদে আসমু।
আজ শেফালী ফার্মগেটের ব্রিজের নিচে। বোরকার নেকাব ওঠানো। তার পাশে রূপালীও খদ্দেরের আশায়। একজন সিএনজি থেকে ইশারা করলে রূপালী উঠে যায়। একা দাঁড়ানো শেফালী কাউকে দেখে না। মনে পড়ে, কয়েকটা ফোন নম্বর আছে।
-হ্যালো,
-হ্যালো, আমি শেফালী। আইজ আইবেন না?
-কই তুমি?
-আপনাগো মার্কেটের কাছে।
-আইতে পারি, থাইকো।
-আপনে একটা কাম করতে পারবেন? আপনার দোকান থনে আমার বড় মাইয়ার জন্যি একটা গোলাপী রঙের ইস্কুলের ব্যাগ আনতে পারবেন?
-হ, আনমুনে
শেফালীর দীর্ঘ অপেক্ষার পরে পঞ্চাশ বছরের কুদরত আসে। তার হাতে গোলাপী ব্যাগটা। পরিবার দেশে থাকে। ছুটি পেলে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দোকানের সবচেয়ে দামি ব্যাগটা সে এনেছে। বিদেশ থেকে আসা নানাজনে দোকানে বিদেশী ব্যাগ বেচে যায়। এটাও বিদেশী।
দু’জনে নিরিবিলিতে যেয়ে বসে। একসময় কুদরত বলে,
-আমার শরীলডা কেমন জানি করে। মাথায় বেদনা, জ্বর জ্বর ঠ্যাকে। চা খাইলাম, কিছু হইলো না। কথা বলার সময় থেকে থেকে কাশছে। মমতায় শেফালী ওড়নার খুঁট দিয়ে কুদরতের নাক-মুখ মুছে দেয়।
ব্যাগের দোকানের কর্মচারি কুদরতের পাশে সেলিম কাজ করে। সে গল্প করেছে, তার মামাতে ভাই নাকি ইতালি থেকে ফিরেছে। সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। কাগজপত্র হলে ছয়মাসের মধ্যে সেও ইতালি চলে যাবে। আরও শুনেছে, সেদেশে নাকি ‘করুনা’(করোনাভাইরাস) নামে রোগ দেখা দিয়েছে, সেজন্যে ভাই দেশে আসার সুযোগ পায়। সেলিমের সে ভাইটা ঈদের পরে ঠিক করা বিয়ে এইফাঁকে করে ফেলবে।
কুদরত কাশতে কাশতে, কিছুদিন দেখা হবে না বলে অর্ধসমাপ্ত বিল্ডিং এর ফাঁকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। শেফালীর কালো বোরকার ওপরে বুকে আঁকড়ানো গোলাপী স্কুলব্যগটা। তাতে ছাপানো, পরীর মতো এক মেয়ে সাদা ঘোড়ায় চড়ে আছে। আহা এ যেন তার মেয়েটা। লাইটপোস্টের উজ্জ্বল বাতিতে ব্যাগটায় ডালিমের মতো রঙ ধরেছে। সকালে উঠে ভোরেই বাড়ির বাস ধরবে। বস্তির দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে শেফালী।
২৮.০৩.২০২০


Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।