স্রোতের বিরামহীন ধাক্কায় ভাঙ্গা কিনারের উপরের অংশটুকুতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে শহর আলী। বেশি না আর তিন কিংবা চার বড় ধাক্কায় এ অংশটুকুও যেকোন মহুর্তে ভেঙ্গে যাবে নিশ্চিত। নিচে ছোট একটা ডিঙি নৌকা স্রোতের ধাক্কায় যাই যাই করছে। চারদিকে অতাল পানি। ছল ছল নীরব হিংস্রতায় আপন খেয়ালে দাপিয়ে চলছে দুকূল। এই নদী, একে নিষ্ঠুরই বলা কর্তব্য। অথচ কেউ একে বলে স্রোতস্বিনী, কেউ মায়াবিনী। কেউ মা, জননী। যারা এমন ঢঙ করে সোহাগ মাখা ডাক ডাকে তারা কি কখনো শহরের চোখে এই নিষ্ঠুর জননীকে দেখেছে? কি ভেবে শহর ক্ষ্যান্ত হলো। এই নদীই তো তার ঠিকানা। নদী, নদীর চর। এই নিয়েই তো তার জীবন। হলে হতে পারে জননী। আজ সন্তানের এমন দিনেও সে এত নিষ্ঠুর হতে পারে! যেসবের সদোত্তর সে কোনদিন পায় না, সেসব ভেবে পেটের জ্বালা বাড়িয়ে কাম নাই। ঘারে ভেজা গামছা। পরনে চেকের লুঙ্গি। স্যান্ডো গেঞ্জিটা ময়লা এবং পিছনের দিকের বেশির ভাগ অংশই ছিঁড়ে সামনের কোমড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে তখনও। বৃষ্টি এবং মেঘের ঘনঘটায় সূর্যের অবস্থানটা নির্ণয় করা গেল না। শহর ভাবছে পেটের কথা। সে পেট নিতান্তই তার নয়, পেট বলতে তার স্ত্রী শাহিদা এবং পাঁচ বছরের ছেলে বকুলের পেট মিলে পরিপূর্ণ এক। আজ তিন দিন পার হতে চললো বকুলের মুখে আহার জুটলো না। ঘাটে মালামাল টানাটানির কাজ করে শহর। এক কথায় কুলি। কুলি হলেও খেটে খাওয়া তার রক্তের স্বভাব। ছরৎ থাকতে কোনদিন কারো দ্বারস্থ হউক তা সে আশা করে না। এ পাড়ায় শহরের বাড়ীটিই শুধু অবশিষ্ট আছে। নদীর হিংস্র গোগ্রাসে হজম হয়েছে সোনার সোহাগা গ্রামটি। যেমন বিলিন হয়েছে তার হিরের মত মূল্যবান জমিজমা ঘরবাড়ি সব। একরে একর জমি তার নদীগর্ভে।
শহর ভাবছে বউ ছেলে তার তিন দিন হলো না খেয়ে। এবারের বন্যা এতদিন ব্যাপী হতে পারে আর তার পরিণতি যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি শহর। সে কথা ভেবে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে বারবার। ধিক্কার দিয়েই বা কী হবে, গেল বারের মতন এবারের আয় রোজগার তেমন ভালো ছিল না। নইলে এভাবে না খেয়ে মরার পক্ষে নয় সে, প্রতিবারই দুর্যোগকালীন সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে আগাম। আল্লাহ বুঝি এবার তার দিকে মুখ তুলে তাকাল না। আর একবার নিজেরই উপর দোষ চাপাচ্ছে। কেন যে সে তার বউয়ের কথাটা কানে তুললো না। বউ বলেছিলো, ' হ্যাঁ গো, এবার তো পানির আবহাব বোঝা যায় না, তোমরা না হয় গরুট্যা ব্যাচেয়ায় কিছু ট্যাকা পইসা হাতোত আকো। না হইলে ছাওয়াটাক ধরি না খায়া মরা নাইগবে।' 'তোর খালি আজাইরা প্যাচাল' বলে কথাটা নদীর হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল শহর। কিন্তু সে হাওয়া যে তারই কপালে ধাক্কা খেয়ে তীর হয়ে তার দিকেই ধাবিত হয়েছে তা যেন সে টের পাচ্ছে। তাছাড়া অমন টগবগে মনে ধরার মতন গরুটাকে সামান্য পেট বাঁচানোর অযুহাতে সে বেঁচে দিতে পারে না। আল্লাহ ভরসা। যা হবার হবে ভেবে নিল শহর। নিকটেই কাছার ভাঙ্গার ধরাম শব্দে শহর চকিত হলো। না, আর বসে থাকে চলে না। বেলা গড়িয়ে চলছে ক্রমশ। বাঁচার জন্য, তিন তিনটে প্রাণ বাঁচার জন্য অন্তত তাকে একটা কিছু করতেই হবে। নইলে এ কালো রাত পার হওয়া দায় আছে। ওপারে গেলে যদি কোন কাজ, কোন বকেয়া বা ধার হলেও যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় এই ভেবে ভেজা গামছা কোমড়ে বেঁধে নিচে বাঁধা নৌকায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। চিন্তা ও ক্ষুধায় মুহ্য হয়ে শহর নৌকা বেয়ে চললো। এ সময় সরকারি বেসরকারি আধা সরকারি বহু ত্রান পাওয়া যায় বটে,কিন্তু ত্রান বিষয়টায় শহরের কেন জানি এলার্জি ঠ্যাকে। এর চেয়ে ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষা চাইতেও সম্মানবোধ করে তার। ত্রান জিনিসটাকে শহরের ভয়ের যথাযথ কারণ আছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য ত্রান বিলি করেন যে ত্রানকর্তারা তাতে প্রাণ তো দুরে থাক কর্তাবাবুদের মান বাঁচানোই মুস্কিল হয়ে পরে।
নদীর মাঝামাঝি আসতেই হঠাৎ উচ্চস্বরে তাকে হাঁকিয়ে কেউ নাজেহাল হচ্ছে ভেবে শহর বামে ঘুরে তাকালো। বোধ হয় ভদ্রলোক। ভদ্র ভাষায় মিনতি করে ডাকছে। প্রথম কয়েকবার উপেক্ষা করলেও উপর্যুপরি ডাককে শহর উপক্ষা করতে না পেরে তাদের দিকে নৌকা ঘুরিয়ে নিলো। নৌকাটিতে পনের বিশ জন লোক হবে আনুমানিক। পাড়ে পাঁচ ছয় জন দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো নৌকার কারো শহরের বিশেষ প্রয়োজন বলে তাকে বেশ খোঁজ করছিল। পাড়ের লোকেরা তার আচমকা দেখা পেতেই অমন শশব্যস্ত ডাকতে আরম্ভ করেছে। হতে পারে কন্ডাক্টর গোছের কেউ। কাজের লোক খুঁজতে বেড়িয়েছে । শহর নিশ্চিন্ত হল কিছুটা। এমন দিনে কাজের লোক পাওয়াও দুক্কর। হোক। কথা পাকাপাকি হলে আজ না হয় তার অবস্থার কথা বলে অগ্রীম কিছু নিয়ে নেবে। কিছু তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। পঞ্চাশ টাকা হলেও আজকে তার চলে। তার ছাড়া আর কার তেমন ঠ্যাকা আছে এদিনে। এই তো কাল দেখলো তাদেরই দলের ছোবেদ প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ব্যাগ হাতে উর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে। বাজার থেকে ফিরলো হয়তো। দেখে তো তাই মনে হলো। তার অমন ঝড়ের সাথে পাল্লা দেয়া গতিতে বিস্তর কিছু জানার বা প্রশ্ন করার সময় ছিলো না। শুধু ' কেমন আচিস, শহর' এর উত্তরে গ*লা উচি*য়ে ' ভালো আচি' বলা শেষের আগেই কেটে পরেছিল ছোবেদ। সময় পেলে না হয় তার থেকে কিছু জানা যেত। ছোবেদ শহরের দলের লোক। বন্ধু মানুষ। তার সাথে অনায়াসেই লাজ শরমের তোয়াক্কা না করে তার পরিস্থিতিটা বুঝাতে পারতো। অন্তত তার হুট করে ' ভালো
আচি' উত্তরের একটু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তো করা যেত অবশ্যই। তাতে কোন উপায়ের দিশা না পেলেও মনের ভার কিছুটা কমতো।
শহরের ডিঙি নৌকা সাহেবদের নৌকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই পাড়ে দাড়িয়ে থাকা নরেন 'জোড়ে আয়, জোড়ে আয়' বলে হাঁকিয়ে জোড় তাগিদ দিতে লাগলো। বোধ হয় শুধুমাত্র শহরের জন্যই সাহেবদের জনবহুল নৌকাকে তারাই আটকিয়ে রেখেছে শত অনুরোধ অনুনয়ে। হতে পারে। নরেন শহরের প্রিয় বন্ধু। শহরের মত সেও কপাল পোড়া। তাই শহরের হাড়ির খবর তার অজানা নয়। শহরের ডিঙি পৌঁছাতেই সাহেবদের সবাই সজাগ হলেন। যুদ্ধে আসন্ন শত্রুর আভাস পেলে যেমন সৈন্যরা সতর্ক হয়। কেউ কেউ বলতে লাগলো ' চাচা, নেন নেন, সময় খুব কম। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আমাদের ফিরতে সমস্যা হবে।' ' আপনি আপনার নৌকাতেই দাড়ান, তাহলে কাপশনটা ভালো হবে।' বলে ক্যামেরাধারী যুবকের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন দলনেতা। তারপর হ্যাঁ হ্যাঁ সমর্থনবোধক শব্দে তিনি জয়ী হলেন। পলিথিন প্যাকে মোড়ানোএকটি পোটলা, সম্ভবত শুকনা খাবার আছে তাতে। হাতে নিয়েই বাকি সবাইকে ডেকে ঝুঁকে ক্যামেরাকে ফলো করে হাত বাড়িয়ে দিলো ডিঙিতে দাড়িয়ে থাকা শহরের দিকে। অপ্রস্তুত শহর হাত না বাড়িতেই 'হবে না, এভাবে হবে না' বলে ঝামেলা বাঁধলো। এত গুলো লোক। ক্যামেরায় কুলাতে পারছে না। শেষমেশ ক্যামেরাম্যানের পরামর্শে দলনেতা সিদ্ধান্ত দিলেন পাঁচজন পাঁচজন করে গ্রুপ করে ছবি উঠানো হবে। প্রথমে দলনেতার গ্রুপ। ক্রমান্বয়ে বাকিরা। তাড়াহুড়া করে লাভ নেই। শহর অবশ্য গাঁয়ের ছেঁড়া গেঞ্জি নিয়ে ইতস্ত বোধ করলেও ' না না, ঠিক আছে,ঠিক আছে' বলে বরং এ পোষাকের জন্য তাকে তার প্রাপ্য ধন্যবাদটুকু উজাড় করে দিল ক্যামেরাম্যান। হয়তো কাপশনটা ভালো হবে। এদিকে শহরের যাই যাই অবস্থা। পেটের ক্ষুধায় মাথা জ্বলছে। মনে হচ্ছে পোটলা ছেড়েই দৌড় দিয়ে বাঁচতে পারলে সে বড় বাঁচা বেঁচে যেত। উপায় অন্তহীন শহর ফৌজদারি দন্ডবিধিতে লাল পিঁপড়ের কামড়ের শাস্তি পেয়েছে যেন। তাই দাঁতে কামড় দিয়ে ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকলো। বেলা গড়িয়ে না গেলে 'আমার লাগবে না' বলে তখনই কেটে পরতো সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জড়বস্তু ক্যামেরা যাদেরকে সহ্য করতে পারলো না বলে সোজা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারলো। নিস্তেজ একটা প্রান নিয়ে শহর তা পারলো না।
(চলবে)
শহরের ডিঙি নৌকা সাহেবদের নৌকার কাছাকাছি পৌঁছাতেই পাড়ে দাড়িয়ে থাকা নরেন 'জোড়ে আয়, জোড়ে আয়' বলে হাঁকিয়ে জোড় তাগিদ দিতে লাগলো। বোধ হয় শুধুমাত্র শহরের জন্যই সাহেবদের জনবহুল নৌকাকে তারাই আটকিয়ে রেখেছে শত অনুরোধ অনুনয়ে। হতে পারে। নরেন শহরের প্রিয় বন্ধু। শহরের মত সেও কপাল পোড়া। তাই শহরের হাড়ির খবর তার অজানা নয়। শহরের ডিঙি পৌঁছাতেই সাহেবদের সবাই সজাগ হলেন। যুদ্ধে আসন্ন শত্রুর আভাস পেলে যেমন সৈন্যরা সতর্ক হয়। কেউ কেউ বলতে লাগলো ' চাচা, নেন নেন, সময় খুব কম। সন্ধ্যা হয়ে গেলে আমাদের ফিরতে সমস্যা হবে।' ' আপনি আপনার নৌকাতেই দাড়ান, তাহলে কাপশনটা ভালো হবে।' বলে ক্যামেরাধারী যুবকের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন দলনেতা। তারপর হ্যাঁ হ্যাঁ সমর্থনবোধক শব্দে তিনি জয়ী হলেন। পলিথিন প্যাকে মোড়ানোএকটি পোটলা, সম্ভবত শুকনা খাবার আছে তাতে। হাতে নিয়েই বাকি সবাইকে ডেকে ঝুঁকে ক্যামেরাকে ফলো করে হাত বাড়িয়ে দিলো ডিঙিতে দাড়িয়ে থাকা শহরের দিকে। অপ্রস্তুত শহর হাত না বাড়িতেই 'হবে না, এভাবে হবে না' বলে ঝামেলা বাঁধলো। এত গুলো লোক। ক্যামেরায় কুলাতে পারছে না। শেষমেশ ক্যামেরাম্যানের পরামর্শে দলনেতা সিদ্ধান্ত দিলেন পাঁচজন পাঁচজন করে গ্রুপ করে ছবি উঠানো হবে। প্রথমে দলনেতার গ্রুপ। ক্রমান্বয়ে বাকিরা। তাড়াহুড়া করে লাভ নেই। শহর অবশ্য গাঁয়ের ছেঁড়া গেঞ্জি নিয়ে ইতস্ত বোধ করলেও ' না না, ঠিক আছে,ঠিক আছে' বলে বরং এ পোষাকের জন্য তাকে তার প্রাপ্য ধন্যবাদটুকু উজাড় করে দিল ক্যামেরাম্যান। হয়তো কাপশনটা ভালো হবে। এদিকে শহরের যাই যাই অবস্থা। পেটের ক্ষুধায় মাথা জ্বলছে। মনে হচ্ছে পোটলা ছেড়েই দৌড় দিয়ে বাঁচতে পারলে সে বড় বাঁচা বেঁচে যেত। উপায় অন্তহীন শহর ফৌজদারি দন্ডবিধিতে লাল পিঁপড়ের কামড়ের শাস্তি পেয়েছে যেন। তাই দাঁতে কামড় দিয়ে ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকলো। বেলা গড়িয়ে না গেলে 'আমার লাগবে না' বলে তখনই কেটে পরতো সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জড়বস্তু ক্যামেরা যাদেরকে সহ্য করতে পারলো না বলে সোজা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারলো। নিস্তেজ একটা প্রান নিয়ে শহর তা পারলো না।
(চলবে)