ওয়াসীম আকরাম'র গল্প পোস্টকার্ড প্রথম পর্ব ।। বর্ণপ্রপাত




সালটা ২০০২/৩ হবে, ইন্টারমিডিয়েট পড়াশুনা করি। ঐ বয়সটাই একটু উড়ো উড়ো, দুরু দুরু উড়নচন্ডি মন। সব কিছুই যেন মনে হত হাতের নাগালে, সাধ্যের চেয়ে আত্মবিশ্বাস বেশি। পড়াশোনার চেয়ে কবিতা লেখা আর গান শোনায় বেশি মনোযোগ, তখনকার সময় এত ফোন বা স্মার্ট ফোনের ছড়াছড়ি ছিলো না, আমার গান শোনার একমাত্র মাধ্যম ছিলো একটি টেপ-রেকর্ডার, তখনকার সব টেপ-রেকর্ডারেই সর্ট ওয়েভ, মেঘা ওয়েভ, এফ এম রেডিও থাকতো। ২৪ ঘন্টার প্রায় ১২/১৩ ঘন্টাই গান শোনা হত আর গান শোনার একটি উত্তম উৎস ছিলো রেডিও তে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান। রেডিওর গান শুনতে শুনতে মাথায় এক দুস্টু বুদ্ধি চা্পল। এমনও রাত গেছে সারা রাত গান চলতো, মাঝ রাতে মা এসে গানটা বন্ধ করে দিয়ে যেত আর বলতো “কি একটা শয়তানের বাক্স পাইছে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর” মায়ের মিষ্টি বিরক্তিটা আমার ঘুম ভেঙ্গে দিত। আজ মা অনেক দূরে, ত্রিশ হাজার মাইল দূরে আমার আর মায়ের বসবাস। খুব মিস করি সেইসব দিন-রাত।

আগে রেডিও তে অনুরোধের গানের অনুষ্ঠান হত, বিশেষ করে ছায়া-ছবির গান আর গানের অনুরোধ করা হত চিঠি বা পোস্ট কার্ডের মাধ্যমে। এখন হয়তো অনেকেই জানে না পোস্ট কার্ড কি! পোস্ট কার্ড হলো বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সীলমোহর যুক্ত এক টাকা মূল্যের একটি খোলা চিঠির হলুদ বর্ণের কার্ড যার প্রথম পৃষ্ঠায় বাম পাশে প্রেরকের ঠিকানা আর ডান পাশে প্রাপকের ঠিকানা লেখার কলাম এবং অপর পৃষ্ঠায় চিঠির কলাম। মাঝে মাঝে বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পোস্ট কার্ড খোলা চিঠি লিখা হতো আমারও, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অশংখ্য শ্রোতা তেমনি চিঠি পাঠাতো। তখনের রেডিও জকি বা উপস্থপনায় যিনি থাকতেন মজার মজার চিঠিগুলো পড়ে শোনাতেন আর ফাঁকে ফাঁকে অনুরোধের গানগুলো বাজাতেন। যাদের অনুরোধের গান শোনাতেন নাম ঠিকানাসহ প্রচার করতেন আর যাদের অনুরোধ না রাখতে পারতেন তাদের নাম ঠিকানাসহ চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করতেন।

আর যেদিন নিজের অনুরোধের গান বাজানো হত বা চিঠি পাঠ করা হত বা চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করা হত সেদিন ত আনন্দের সীমা নেই, সেই কারনে অনুষ্ঠানগুলো আবার এমপ্টি ক্যাসেট কিনে রেকর্ড করে রাখাতাম বন্ধুদের শোনানোর জন্য। রেডিও জকিদের মজার মজার কথা আর শ্রুতিমধুর গান বার বার রিপ্লে করে শুনতাম। এভাবেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান শোনতে শোনতে মাথায় একটি দুষ্টুমি বুদ্ধি চেপে বসলো।

আগেই বলেছিলাম এই বয়সটাই যেন এমন সবসময় দুষ্টু বুদ্ধি মাথার ভিতর ঘোরপাক খেতেই থাকে, যাই হোক যেই বুদ্ধি সেই কাজ...
এই সব অনুষ্ঠানে যে সমস্ত শ্রোতাদের নাম ঠিকানা বলা হয় সেখান থেকে কয়েকটি মেয়ের ঠিকানা সংগ্রহ করে ডাইরীতে লিখে নিলাম। সেখান থেকে পাঁচটি নাম ছোট ছোট পাঁচটি কাগজে লিখে নিলাম এবং কাগজগুলো এমন ভাবে ভাঁজ করলাম যাতে কোন রকম লেখা দেখা না যায়, পড়াশোনা শেষ করে রাতে এসব করতে করতে রাত সোয়া একটা বেজে গেল, ভাবলাম একটু রেষ্ট করি বাকি কাজটা একটু পরে করব। কিন্তু কোন ফাঁকে যে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেলাম, বিভোর ঘুমে সকাল। সকালে আবার হিসাব বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়তে হবে স্যারের কাছে। পাশের বাড়ির ক্লাস মেট বন্ধু এসে ডেকে তুলল আমায়। গায়ে ধাক্কা দেয় “অই ওঠ পড়তে যাবি না?”
~হুম
-ওঠবি না পানি ঢালবো
~দাঁড়া উঠছি
কোন রকমে চোখমুখ ডলেডুলে ঘুমের চোখে বই খাতা কলম নিয়ে যেই টি-সার্ট প্যান্ট পড়া ছিলাম চলে গেলাম। যেতে যেতে বেশ লেট।
আমার অবস্থা দেখে স্যার বললেন—
“কি জনাব ঘুম কি ভাঙলো তবে?”
আমি চুপচাপ যেয়ে বসে পরলাম। পড়াটা শেষ করে আসার পথে বন্ধু— 
-কিরে মামা তোমার টেবিলে সুন্দর সুন্দর পাঁচটা মেয়ের নাম চিরকুটে ভাঁজ করা! (বিদ্রুপ স্বরে) ব্যাপারটা কি? আমরা একটা পাই না আর তুমি পাঁচ পাঁচটা! ক্যামনে কি?
~আরে কি বলছিস তুই? মেয়ে, পাঁচটা, বন্ধু রাতে ঠিক ঘুম হইছে তোর?
-আরে মামা আমার ঘুম ঠিকই হইছে, তুমি ঘুমের ঘোরে সব গুলিয়ে ফেলেছ।
~মানে কি?
-নাম লেখা কাগজগুলো হাতের মুষ্ঠি খুলে দেখিয়ে বললো এগুলো কি?
~আরে তুই কই পেলি এগুলো?
-আরে মামা! তোমার পড়ার টেবিল থেকে পেয়েছি, এরা ত আমাদের ক্লাসের কেউ না, ত কি ছোট ক্লাসের কেউ!?
~আরে না ওসব কিছু না! পরে তোকে বলবো!
-ওকে তাহলে এগুলো তোমাকে দিচ্ছি না মামা!
~যাহ! না দিলি, ওগুলো দিয়ে আমি কি করবো? তুই নিয়া খুসি থাকলে নে!
-ওকে তাহলে গেলাম, কলেজে দেখা হবে।
~ওকে...
পরদিন রাতে ঠিক পড়শোনা শেষে আবার যথারীতি সেই পাঁচটি নাম পুনরায় কাগজে লিখে ভাঁজ করলাম, এবং ভালোভাবে এলোমেলো করে মিলিয়ে নিলাম। মেলানো হয়ে গেলে পাঁচটি কাগজ টেবিলের উপর রাখলাম এবং চোখ বন্ধ করে একটি কাগজ হাতে তুলে নিলাম। ঐ একটি কাগজ সরিয়ে রেখে বাকি চারটে না দেখেই ছিঁড়ে কুচি কুচি করে জানালা খুলে বাহিরে ফেলে দিলাম। 

এখন শুরু হলো বুক ধুকপুক সেই কাঙ্খিত নামটি দেখার পালা! সযতনে কাগজটি হাতে নিলাম, অনেকগুলো ভাঁজ করা ছিলো আস্তে আস্তে একে একে ভাঁজ খুলতে লাগলাম, খুলতে খুলতে শেষ ভাঁজ খোলার পালা, হার্টবিট যেন ক্রমশ বেড়েই চললো, এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। চোখ বন্ধ শেষ ভাঁজ খুলেছি অতিরিক্ত এক্সসাইটেশনে ফ্যানের এক দমকা বাতাসে কাগজটি উড়ে গিয়ে পরলো খাটের নিচে। খাটের নিচে ছিলো পুরনো সব বই খাতা সিক্স টু টেন ক্লাসের সব। খুঁজতে গিয়ে ত এখন আর পাচ্ছি না। কোথায় গিয়ে যে লুকালো— নিজের উপরই জেদ হচ্ছে কেনো যে চোখ বন্ধ করতে গেলাম? যতই খুঁজছি কিছুতেই পাচ্ছি না। সিদ্ধান্ত নিলাম সব বই খাতা বের করবো, যেই কথা সেই কাজ শুরু করলাম গাধার খাটুনি। একে একে বের করতে করতে প্রায় সব শেষ তবু পাচ্ছি না, না পেলেও এই ভেবে খুসি হচ্ছিলাম আর অল্প কিছু আছে এগুলো বের করলে নিশ্চই পাবো শেষ পর্যন্ত সবগুলো বই খাতা বের করেও পাওয়া গেলো না, খুব ক্লান্ত হতাশ হয়ে ধপাস করে শুয়ে পরলাম খাটে। শুয়ে শুয়ে চোখে পরলো টেবিলে রাখা টর্চ লাইটটি, আবার আশার সঞ্চার, নতুন উদ্যমে লাইট নিয়ে ঢুকে পরলাম খাটের নিচে, শেষ পর্যন্ত পেলাম খাটের পা’য়ের আড়ালে সেই কাঙ্খিত নামটি! এদিকে ঘড়ির কাটা চারটা ছুঁই ছুঁই। সব গুছিয়ে-টুছিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুম।

পৃথিবীর রীতি মেনে দৈনন্দিন কাজ শেষ করে যখন রাত্রি এসে কড়া নাড়ে উড়নচন্ডি মনে, মনের সকল জানালা, দরজা, কপাট খুলে বসলাম সেই কু-বুদ্ধির বেড়া জালে।
রাত্রি শুনশান, জনপদে নেই কোলাহল, চৈত্রের চাঁদনী রাত, খোলা জানালা, চাঁদের আলো উঠোনের নারিকেল গাছের চিরল পাতায় মৃদু বাতাসে ঝলমল করে ফিরে আসছে আমার জানালা বেয়ে, সাথে সেই নামটি, হাতে কলম, টেবিলে সাদা খাতা, মনে প্রবল রোমাঞ্চ কিছু লিখবো বলে—


প্রিয়, মৌসুমী ইসলাম (মৌ)

প্রথমেই বলবো আমি দুঃখিত, অনুমতিহীন অনধিকার দুঃসাহসের জন্য।
নিশ্চয় ভালো আছেন, এত সুন্দর নাম যার সে ভাল না থাকতে পারেই না। হয়তো ভাবতে পারেন বেশি বলছি, বেশি না আমার বিশ্বাস।

রাত্রি বারটার কিছুটা বেশি, চৈত্রের পূর্ণিমা, চাঁদে ও মেঘে লুকোচুরি খেলছে যদি চাঁদ ভালোবাসেন তবে এক আকাশ জ্যোৎস্নার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আজ পূর্ণিমা চাঁদ ক্রমশ ক্ষয়ে যাবে, তাই মনের অন্ত কুটির হতে শুভকামনা জানিয়ে শুরু করতে চাই কারণ এই মন কখনো ক্ষয়ে যাবে না।

আমার লেখাটি হাতে পেলে হয়তো ভাববেন আমি আপনার অপরিচিত একজন মানুষ কেনো আমি আপনাকে লিখছি! হয়তো রাগও হতে পারে। আমার নিজস্ব একটি ফিলোসপি আছে তার জোর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে লিখছি— সেটি হলো ‘পৃথিবীতে মানুষ পরিচিত হয়ে আসে না, পৃথিবীতে এসেই পরিচিত হয়’ তাই আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে বা বন্ধত্ব করার প্রয়াসে লিখছি, আশা করছি বিমুখ হবো না। এখন নিশ্চই ভাববেন আমি আপনার ঠিকানা কোথায় পেলাম, আমি অনেক গান প্রিয় মানুষ রেডিও তে একটি অনুষ্ঠানে গান শোনতে শোনতে এক সময় আপনার নামটি বেজে উঠে, আর নামটি শোনতেই আমার কর্ণকোহরে এক আলোরণ তৈরি করে হৃদয়ে গেঁথে যায়, আমি ঠিকানাটি সংগ্রহ করে রাখি এবং লেখার দুঃসাহস করি।

ভালো না লাগলে চিঠির সাথে আমার অরুণ সুন্দর বন্ধুত্বের দাবিটাও দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়েন কোন এক ডাস্টবিনে। আর সদি সামান্যতম মনে আচর কাটে তবে আপনার উত্তরের প্রত্যাশায় কাল
ক্ষেপন করব।

ইতি
অচেনা বন্ধু!

(চলবে)

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।