ধারাবাহিক উপন্যাস: দিদার চৌধুরী'র "হৃদয়ের কান্না" -৮।। বর্ণপ্রপাত



ইন্ধনের প্রতিও শিউলির নারীত্বের স্বভাব সুলভ আচরণ প্রকাশ পেল । মায়া-মমতায় ভরা ভালোবাসাও নিঃশব্দে প্রকাশ পেল।
সেদিন শিউলী তার পিতাকে বলল,
: বাবা , ঐ যে সেদিন ,
যে একটি ছেলে এসেছিল, তার নাম ইন্ধন।
শিউলির বাবা একটি বইয়ের মাঝে কি যেন দেখছিল। চোখে মোটা ফ্রেমের পাওয়ার ফুল কাঁচের চশমা। বারবার সিটি নাকের উপর টেনে টেনে তুলছে। আর মেয়ের কথা শুনে, তার দিকে তাকিয়ে চশমার উপর দিয়ে চোখ ফেলে বলল,
: ঐ যে ,ঐ দিনের সে ছেলেটির কথা বলছিলুম?
: হ্যাঁ বাবা , ঐ ভদ্র লোকের কথা বলছি।
: হ্যাঁরে ,ছেলেটি ভদ্র, নম্র । সে কি পরিশ্রম না করেছিলুম। ভগবান তার মঙ্গল করুক।
: বাবা বলছিলাম কি,
 ভদ্রলোক কেমন জানি বারবার একটি চাকুরির কথা বলছিল। 
কথা গুলো শিউলী আমতা আমতা করে তার বাবাকে বললো।
প্রথমে তার বাবা তার কথার মনোযোগ দেয়নি। পরক্ষণে ভালো করে শুনে বলল,
: সে কি ! চাকুরির কথা বলেছিলুম? তা ছেলেটি পার দিয়েছে কত ক্লাস?
প্রতি উত্তরে তার বাবাকে শিউলী বললো,
: বিএ পাস করেছে।

মা মরা মেয়ে শিউলির প্রতি তার বাবার আষ্টেপিষ্টে নজর ছিল। মেয়ের স্বাদ আহলাদ কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। সারা জমিদারি তার আস্তরন হিসেবে থেকেছে। শিউলীর এই প্রস্তাব‌ও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। মেয়ের মুখে একটু হাসি ফুটানোর জন্য অতিশয় বৃদ্ধ পিতা কিনা করতে চায়?
দিন দুই-চারেক এর গত হওয়ার পর ,শিউলির পিতা শিউলির হাতে একখানা কাগজ এনে ধরিয়ে দিল। পত্রখানা পড়ে ,পরিশেষে শিউলী জানতে পারল। এটি ইন্দনের চাকুরির নিয়োগ পত্র।

শিউলি এই নিয়োগ পত্র হাতে পেয়ে খুব আনন্দিত বোধ করলো। অতিশয় যত্ন সহকারে সে নিয়োগপত্রটি পাঠানোর জন্য দ্রুত একটি ব্যবস্থা করল।
শিউলী তাদের বিশ্বস্ত কোতয়ালকে ডেকে পত্রখানা পাঠিয়ে দিলো। সাথে একখানা চিরকুট‌ও লিখে পাঠালো। তাতে কি লেখা ছিল তা জানা হলো না। হয়তো মনের কোন কথা হবে, মনের ভিতরে আমাদের প্রবেশ নিষেধ কিনা, তাই জানতে পারা গেল না।

মাথার চুলগুলো বেশ লম্বা হয়েছে। কোকড়ানো চুল গুলো পাখির বাসার মত দেখাচ্ছে। গায়ের সাথে শার্ট একেবারেই লেগে আছে। আর পরানের প্যান্ট টি কেমন যেন কালবৈশাখী ঝড় তুলছে। প্যান্টের নিচে মুঠোম হাত প্রশস্ত প্যান্টের হাতা, দোলনার মত দুলছে। হাতে একটি রসমালাইর হাড়ি। মুখে হাসির ঝলক লেগে আছে। সদর দরজা দিয়ে হনহনিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। কারো অনুমতির আর অপেক্ষা সইল না। সোজা গিয়ে প্রবেশ করলো শিউলীর কামরায়।

শিউলী তখন হাতে সুতার কাজ করছিল। ইন্ধনকে দেখে চমকে গেল। এত দ্রুত আসবে তা শিউলীর ধারণা ছিল না। তাই ঠাট্টার ছলে বলল,
: আর বুঝি বিলম্ব সহেনা?
: অবশ্য আজ আসতে চাইনি।
: তবে যে এলেন?
: তা এলাম চিরকুটের আহবানে। 
: তাই বুঝি ? তা চিরকুটের গুরুত্ব বুঝি় এতো বেশি?
: অবশ্যই চিরকুটের গুরুত্ব তেমন নয়,তার চেয়ে দাতার প্রতি গুরুত্বটা একটু বেশিই ছিল।
শিউলী পাছে অভদ্রতা হয় ভেবে কথার চলনকে অন্যপথে চালিয়ে দিল।
: আজ বন্ধুকে নিয়ে আসেননি কেন?
: তার প্রয়োজনের কথা তো চিরকুটে উল্লেখ ছিল না।
: প্রয়োজন ব্যতীত মানুষ কি কিছুই করেনা?
: তা অনেকেই অবশ্য করে, তবে তা হবে অযথা অপচয়।
: জ্ঞান থাকা সমুচিত,তবে জ্ঞানের খাতিরে সবাইকে শিষ্য করার ইচ্ছাটা ,যত কম থাকে ততই উত্তম নয় কি?
: এখনো তেমন শিষ্য পায়নি, তবে ?
: তবে কি?
: তবে একটি অসমাপিকা ক্রিয়া, যার আশা থাকে কিন্তু আশার শেষ থাকেনা। যা এক কথায় বর্জনীয়।

শিউলীর হাতের পত্র পাওয়ার কিছুদিন আগের কথা, সেই দিনের সে কথা । গভীর মৌনতা ভঙ্গ করে আজ ইন্ধনের মনে পড়লো। একবার দৃষ্টি ফেলে পুনরায় চোখ বন্ধ করে রইল।
এমন সময় শিউলী বিদ্রূপ করিয়া বললো,
: জানি চিন্তা করে কথা বলা ভালো। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের অমিতের ন্যায় আবিষ্কারক মন নিয়ে কথা বললে, আজ কালকার মেয়েরা নির্ঘাত দল ত্যাগ করবে। তখন আমরণ কুমার সেজে নারীত্যাগেষু হয়ে থাকতে হবে।

ইন্ধন তিন দশকের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া আজ-ই ভবনায় পড়ল। পিতৃহারা সংসারে এতদিন বসবাস করিয়া আসছিল। শুরু থেকে এ পর্যন্ত জীবনের করিডোরে সুখ তেমন খুজিয়া পাইনি। নিরপরাধ চাহিদার কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘাত কতইনা দেখেছে। কিন্তু তার চাহিদা অমূলক ছিল না। ন্যূনতম চাহিদাও তার উপলব্ধ হয়নি। অর্থের তীব্র অভাবে আজ জীবন মূল্যহীন। সুখ ও সুখের স্বপ্ন দেখা, আজ যেন মরীচিকাময় ।

শিউলীর নখের আঘাতে ইন্ধনের চেতনা ফিরে পেল।তারপর প্রসঙ্গহীন একটি কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসলো ,
: কি যে বলো , আমি কি তোমায় দোষ দিচ্ছি?
শিউলী কথাটির অর্থ বুঝতে না পেরে বলল,
: দোষ? কিসের দোষ?
: না-না দোষের কথা বলতে যাবে যেন?
: তা হলে?
: বলছিলাম কি, বিধাতা এমন নিখুঁত সুন্দর করে তোমাকে তৈরি করেছেন। অথচ......
: অথচ কি?
: অথচ, আমরা বিধাতার সেই তৈরি করার অংশ হতে বঞ্চিত।
শিউলী এক ঝলক হেঁসে বলল,
: তাই বুঝি?
শিউলী আর ইন্ধন নানা বিধ কথা বলে চলল। ঠাট্টা-বিদ্রুপ খুনসুটি কিছুই বাকি রইল না। কখন যে আপনি হতে তুমি সম্পর্কে রূপান্তরিত হল। কেউ টের পেল না। মনে হয় যুগ-যুগান্ত তাদের এই পরিচিতি অবারিত ছিল।
সেদিন অনেক ক্ষণ কথা বলার পর ইন্ধন বাড়িতে চলে গেল।
 (চলবে)

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।