বিপুল রায়'র গল্প উদয়কৃষ্ণর পালানাটক ০৩ ।। বর্ণপ্রপাত

দ্যাওবার সকাল দশটার মইধ্যে উদয়কৃষ্ণর নাটকের দল ব্যালতলীত আসি হাজির। আগের মতন করি আর মানষি দেখির আইসে না। আগোত তো নাটকের দলের গাড়ি আসিলে মানষি দিনতে ঝুম্কুটি নাগি আসিয়া দলের মানষিগিলাক দেখি গেইসে। এলা মানষি ব্যস্ত, হাতোত সমায় কম। তাছাড়া এলা নাটকের দল মানেও বিশাল কিছু না হয়।

সইন্ধ্যার সমায় মঞ্চত লাইট নাগাছে উদয়কৃষ্ণর নাটক দলের মানষি। আর ক্লাবের চেংরাগিলার মাইকোত বারবার চিকিরা-চিকিরি নাগাইসে, আর মিনিটে মিনিটে গানের বদল– রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া গান, হানি সিং এর গান, শ্রেয়া ঘোষালের গান, লতা মঙ্গেস্করের গান.... আরও কত নাম না জান গায়ক-গায়িকার গান। উদয়কৃষ্ণ যুদিও এত দুমদুমি পছন্দ করে না, কিন্তু মনটাত তাও খুশি– আজি কতদিন পর পালানাটক করিবে।

আতির আটটা বাজিতে না বাজিতে মানষি আইসার লাইন দেখি উদয়কৃষ্ণ টোকটোকি খাইসে। আজিকালিকার জামানায়ও মানষি যে পালানাটক এত পছন্দ করে কুনোদিন ভাবে নাই উয়ায়। মঞ্চের উত্তর পাখে বেটিছাওয়া আর দক্ষিন পাখে বেটাছাওয়া। খালি বুড়া-বুড়ি বা আদাবসা-আদাবসি না হয় গাবুর গাবুরি চেংরা-চেংরিগিলারও ভালে ভির জমিসে। ভির হবে না ক্যানে– পালানাটকের নামটা তো শুনির নাগিবে। তাছাড়া নাট্যকারটা কায়, হুটাও তো দেখির নাগিবে।

আতির দশটার সমায় শুরু হইল পালানাটক। দর্শকের হৈদ্দানি, হাততালি আর শিটি নাটকের প্লেয়ারের জোশটা বেশী করি বারে দ্যাছে। নাটকের কাহিনী মোহিত(বিজয়)- বৈশালির(ডালিয়া) আর কৌশিকের চলতি প্রেম। মাঝে মাঝে নিখিল-চন্দ্রিমার পরকীয়া প্রেম। এই দুই প্রেম-কাহিনী আগাগোড়া নাটকের মূল বিষয়বস্তু।

মোহিত সাধারণ একজন ভ্যানচালা বাপের এম.এ.পাশ বেটা। বি.এডও করা আছে। বৈশালিও গ্রামের একজন মইধ্যবিত্ত পরিবারের বেটি। কলেজ থাকি দুইজনকারে প্রেম। মোহিত যেলা এম.এ ক্লাসের দুত্বীয় বছরত, বৈশালি সেলা বি.এ ক্লাসের প্রথোম বছরত। মোহিত চাকরীর আশায় দিন গণে, আর বৈশালিও উয়াক সাহাইয্য করে।

কিন্তু মানষির মন বড়ো স্বার্থপর, পরিবর্তনশীল। মোহিতের আগাগোড়া স্বপ্ন মাস্টারি চাকরী করা। কিন্তু বৈশালি ধৈয্যহীনা। এতদিন মোহিতোক সাহস দিসে, উয়ার সাথে ছিল। যেই না চাকরিসুত্রে আইসা চন্দ্রিমার ভাতার কৌশিক প্রেমের প্রস্তাব দিল বৈশালিক, উয়ায় আগ-পাছ কিছু না ভাবিয়া রাজি হয়া গেল। 

মোহিত সাদা মনের চেংরা, বৈশালিক নিজের থাকি বেশি বিশ্বাস করে। বৈশালি যে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে, সেইটা উয়ায় কুনোদিন কল্পনাও করে না। কিন্তু বৈশালি সেইটা করি ফ্যালাইল। উয়ায় এলা দুই নৌকাত ঠ্যাঙ দিয়া আছে– না পাছে ভাল করি মোহিতোক ছাড়িবার, আর না পাছে কৌশিকোক মন থাকি ভালোবাসিবার। আস্তে আস্তে আগে যাছে এই খুচুরা প্রেমের কাহিনী।

কতদিন আর নুক্কাচাপা প্রেম চলে। মোহিত ভাল করি জানে কৌশিকের ব্যপারে। একদিন মোহিত উয়ার এক বন্ধুর মুখোত শুনিসে, “বৈশালি কৌশিকের প্রেমোত হাবুডুবু খাছে।”.... সেলা থাকি উয়ায় বৈশালিক নজরে নজরে থুবার চেষ্টা করিসে। চেষ্টা ফির বিফলে যায় নাই– মোহিত একদিন হাতেনাতে ধরিসে বৈশালি আর কৌশিকোক। সাথে সাথে মোহিত কিছু কয় নাই বৈশালিক। কিন্তু চোখুৃর জল তো আটকেবার পাইল না, নিজের মনটাকও আর সান্তনা দিবার পাইল না। সাথে সাথে বুকের কলিজা যুনি ভাঙি-ছিঁড়ি চুরমার হয়া গেল মোহিতের। পিরিতের ধোকা সইহ্য করা খুবে মুশকিল। 

একদিন মোহিত বৈশালির নাগাল ধরি কইল, ”বৈশালি কৌশিকের সাথে তোর কতদিনের সম্পর্ক ?”
 “ কি কইস তুই মোহিত !”
 “ মুই যেইটা কছোং সেইটার জবাব দে।”
  “ কৌশিক ! উয়াক মুই দাদা বুলি মানোং। ছিঃ মোহিত ছিঃ, মুই ভাবির পাং নাই– তুই মোক সন্দেহ করিবু।”
 “ সন্দেহ না করিবার মতন কি কিছু বাকি থুসিত !”.... মোহিত আর বৈসালির তর্ক-বিতর্ক আস্তে আস্তে বাড়িতে আছে। শ্যাসে বৈশালি কয়ায় ফ্যালাইল, “ হ্যাঁ, মুই কৌশিকোক ভালোবাসোং। তোর মতন চেংরাক মোর দরকার নাই।”.... মোহিত খোং খোং হয়া বৈশালির মুখের ভিত্তি দেখি নইল। কুনোদিন ভাবে নাই বৈশালি উয়ার মুখের উপর এই কথাটা কবে।

যত হলো কৌশিকের মাইয়া-ছাওয়া আছে বাড়িত। কোনেক কোনেক মনটা উমারও বাদে ক্যামন ক্যামন করে। যেলায় মাইয়া-ছাওয়ার কথা ফম পড়ে সেলায় মনটা হালকা হয়া যায় কৌশিকের। বৈশালি দ্যাখে দিনের পর দিন কৌশিকের ভালোবাসাটা ক্যানে যুনি কম হয়া আইসেছে। যতয় দিন যায় ততয় এই সমস্যাটা বেশি করি হছে। বৈশালির মনটা খারাপ হয়া যায় কৌশিকের এই আচরণোত। মাঝে মাঝে কয়া ফ্যালায়, “ তুই কি মোহিতের মতন মোক ভালোবাসির পাইস না কৌশিক ? মোহিত মোক ক্যামন পাগোলের মতন ভালোবাসিসে, তুই কি উয়ার মতন করি মোক ভালোবাসির পাবু না ?”.....এই কথা শুনি কৌশিক রাগ উঠি কয়া ফ্যালায়, “ যা মোহিতেরটে ফিরি যা। মোক ক্যানে ভালোবাসির আসিসিত ? যেলায় সেলায় মোহিতের উগুনা দিস।”.... বৈশালি আর কুনো কবার পায় না কৌশিকোক। উয়ায় জানেও না যে কৌশিক একজন বিয়াও করা মানষি।

মোহিত আনাচে-কানাচে বৈশালির এইলা কথা শুনে আর হাসে। মোহিত জানে, একদিন না একদিন বৈশালির মনত পড়িবে উয়ার কথা। ততদিনে নাড়াবাড়ির একটা চেংরির সাথে মোহিতের বিয়াও ঠিকঠাক হইসে। সেই চেংরিটা উয়াক মনে-প্রানে ভালোবাসে। বৈশালি তো উয়াক ধোকা দিসে। কিন্তু জায় উয়াক ভালোবাসে, তাক উয়ায় ধোকা দিবার পাইল না, আপন করি নিল। কারণ মোহিত জানে, ‘জায় হামাক ভালোবাসে, হামার উচিত তাকে ভালোবাসা।’

হুদি চন্দ্রিমা নিখিলোক কয়, “চল নিখিল হামরা দুইজনে পালে যাই।” কিন্তু নিখিল সুযোগসন্ধানী চেংরা। গাবুর বয়সের জ্বালাতে চন্দ্রিমার সাথে অবৈধ সম্পর্ক করিসে। আর চন্দ্রিমার মতন একজন বিয়াওওলির সাথে যে উয়ায় পালাবে, সেই নাখান বোকা চেংরাও না হয় নিখিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ইয়ায়-উয়ায় শুনিতে শুনিতে উমার এই অবৈধ সম্পর্কের ঘটনাটা ফল্যাও হয়া গেল।

আবভাব খুব খারাপ দেখিয়া নিখিল চন্দ্রিমাক ফ্যালে থুইয়া চলি গেল বৈদ্যাশ।

চন্দ্রিমার সাথে নিখিলের এই অবৈধ সম্পর্কের কথাটা পৌঁছাইল কৌশিকের কানোত। কৌশিক ফটাফট বাড়ি ফিরি আসিয়া চন্দ্রিমাক করে গালাগালি, ধরিয়া মারে মাইর। 

কৌশিক দুইদিন পোষ্ট অফিস আইসে নাই দেখি বৈশালির মনত চিন্তা, “কি হইসে মানষিটার ! ফোন করিলো ফোন ধরে না। কুনো খোঁজ-খবরও নাই ! ব্যপারটা কী ?”... কুনোমতনে খবর জোগাড় করি বৈশালি শুনির পাইল যে, কৌশিক উয়ার বাড়ি চলি গেইসে। 

বৈশালিও প্রেমের টানে বাড়ি ছাড়ি চলি গেল কৌশিকের বাড়ি। কিন্তু উয়ায় যাওয়ার সাথে সাথে কৌশিকের সংসারের অগুন আরও দিমদিম করি জ্বলি উঠিল। বৈশালি কৌশিকের মাইয়া চন্দ্রিমাক দেখি অবাক! চন্দ্রিমাও বৈশালিক দেখি অবাক। আশ-পড়শীও উমার কান্ডকিত্তি দেখি অবাক। হছেটা কি ? এতক্ষন সগায় যে খালি চান্দ্রিমাকে দুষির ধরিসিলো তারপর দেখা পাছে যে, কৌশিকো তো সেই একে গোয়ালির গোরু। বৈশালি হাউহাউ করি কান্দি ফ্যালাইল। আশ-পড়শী কাহকে কুনো না কয়া, এক জোট হয়া কৌশিক আর চন্দ্রিমা– দুইটা মানষিকে গ্রাম ছাড়া করিল। সাথে সাথে বৈশালিকো বাড়ি প্যাটে দিল।

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।