এস আর শাহিন'র গল্প মুক্তির স্বাদ ।। বর্ণপ্রপাত


নিলু আজ খুব উৎফুল্ল মন নিয়ে শহরে যাচ্ছে তার বাবার সাথে।অনেক দিনের শখ একটি ময়না পাখি কিনবে।

বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে নিলু।দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠায় নিলুর সব শখ পূরণ করতে পারেনি তার বাবা মা।কিন্তু একটি ময়না পাখির আবদার সে অনেক দিন থেকেই করে যাচ্ছিল।তৃতীয় শ্রেণিতে ভালো ফলাফল করায় পাখি কিনে দেবার প্রতিশ্রুতিতে তার বাবা তাকে নিয়ে আজ পাখি কিনতে যাচ্ছে।এরপর নিলুর পছন্দমত সুন্দর একটি ময়না পাখি কিনে ঘরে ফিরে তারা।

এখন থেকে পাখির খাবার দেওয়া,যত্ন করা,খাঁচা পরিষ্কার করা ও নতুন বুলি শেখানো যেন নিলুর প্রতিদিনের রুটিনেই যোগ হয়।

এভাবেই পাখির যত্ন নেওয়া,খেলাধুলা আর লেখাপড়ার মধ্য দিয়েই সুন্দর দিন কাটাচ্ছিল সে।

হঠাৎ একদিন নিলু শুনতে পায় দেশে কি যেন এক অসুখ আসছে,অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শে সুস্থ মানুষও আক্রান্ত হয়।এর প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় এ অসুখ হলে শেষ পরিণতি মৃত্যুও হতে পারে।

পরের দিন স্কুলে গেলে প্রথম ক্লাস করার পর অনেক দিনের জন্য ছুটি দেয় তার স্কুল।হঠাৎ অনেক দিনের ছুটি পেয়ে খুব উচ্ছল মনে বাড়ি ফিরে নিলু।কেননা এই কয়েকদিন পাখিটির সাথে অনেক সময় কাটাতে পারবে তাছাড়াও থাকবেনা স্কুলে যাওয়ার তাড়া।

প্রতিদিনের মত আজও পাখিকে খাবার দিচ্ছে নিলু।পাখিটির চকচকে কৃষ্ণবর্ণের পালক,হলুদ ও কমলা রংয়ের মিশ্রণে রঙ্গীন ঠোঁট,হলুদ পা,পাখির মিষ্টি সুর ইত্যাদি কারণে পাখিটিকে খুব ভালোবাসে সে।

এতদিনে পাখিটি তার নাম ধরে ডাকতে শিখেছে।পাখিটির মুখ থেকে নিলু ডাক শোনায় সে খুশীতে আত্মহারা।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে পাখিটির দিকে তাকিয়ে থাকে নিলু।ছুটির প্রথম দুই দিন পাখিটির সাথে অনেক ভালো সময় কাটলো।সব সময় পাখিটিকে খাবার দেয়,যত্ন নেয়,মাঝে মাঝে গোসল করায় আর শেখায় নতুন নতুন বুলি।

কিন্তু হঠাৎ করে ঐ অসুখ টার ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।যার কারণে একদম ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হয় তাদের। চারপাশে আতঙ্ক বিরাজ করছে ঐ অসুখ টার জন্য।এলাকার চেয়ারম্যান কর্তৃক মাইকিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারে অসুখ সম্পর্কে।নাম করোনা (কভিড ১৯)ভাইরাস।অদৃশ্য এক শত্রু।অভিশপ্ত এ অদৃশ্য শত্রু থেকে বাঁচার উপায় হলো ঘরে থাকা।সব সময় পরিষ্কার থাকা,মুখে মাস্ক ব্যবহার এবং সবার থেকে সামাজিক নিরাপদ দূরত্বে থাকা।

তখন থেকে নিলু খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না।নিলু ঘরে থাকে আর সময় কাটায় তার একমাত্র সঙ্গী পাখিটির সাথে।প্রথম কিছুদিন খেলাধুলা,হই হুল্লোর করার আক্ষেপ টা পাখির সাথে করা খুনসুটির বদলে পুষিয়ে নিলো।কিন্তু গ্রামে বেড়ে উঠা মেয়ে,মুক্ত প্রান্তরে ভেসে বেড়ানো যার নেশা,সময়ের দুরন্তপনা যার অস্তিত্বে মাখানো।কতক্ষণই বা ঘরে থাকতে পারে।
এমন বন্দি জীবন অসহ্য লাগে নিলুর,যেন দম বন্ধ হবার উপক্রম।

এক সময় গম্ভীর ভাবে মন খারাপ করে ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে থাকে চির সবুজ প্রকৃতি।কিন্তু বাইরে খোলা আকাশের নিচে খালি পায়ে শিশিরের ভরে নুইয়ে পড়া সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখার আনন্দ কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছে না।বঞ্চিত হচ্ছে মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বাতাসে মিশে থাকা প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে।এছাড়াও বৃষ্টিতে ভেজার পর উজ্জীবিত প্রকৃতি না দেখতে পারার আক্ষেপ যেন থেকেই যায় নিলুর।এসব কিছুর কারণে প্রকৃতির সাথে নিরব অভিমান করে বসে সে।

এখন তার মনে পড়ছে কিছুদিন আগের কথা যখন ইচ্ছে হলেই আপন মনে ছুটে চলত বিশাল বিস্তীর্ণ মাঠের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ও বিকেলের হালকা বাতাসে নানা রকমের নানা রংয়ের ঘুড়ি উড়ানোর সময়টা।
অপেক্ষা করছে সেই সময়ের যেসময় মানুষ এই জিম্মা থেকে মুক্ত হবে এবং পরিত্রাণ পাবে এই অবরুদ্ধ জীবন থেকে।আবারো নতুন সূর্য উঠবে,ফিরে পাবে সেই চিরচেনা সকাল।জনশূন্য রাস্তা গুলো হবে আবারো ক্লান্ত। যেদিন বিশুদ্ধ হবে প্রকৃতির বাতাস আর থাকবে না কোন সামাজিক দূরত্ব নামক অদৃশ্য বেড়াজাল।

এসব ভাবতেই হঠাৎ তার চোখ পরে ঘরের কোনায় ঝুলিয়ে রাখা রঙীন খাঁচায় বন্দি পাখিটির দিকে।কিভাবে যেন সে অনুভব করলো পাখিটি বিষন্ন মনে অসহায়ত্ব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।প্রকৃতি তাকে ডাকছে কিন্তু সে পারছে না প্রকৃতির বুকে আপন মনে ফিরে যেতে খাঁচা নামক এই অভিশাপের কারণে।
নিলু উপলব্ধি করতে পারে পাখিটির মনের কষ্ট।বুঝতে পারে সময়টা এখন মানুষদের জন্য না হলেও পাখিদের জন্য সুসময়।

পাখিটি এখন বাড়ির পাশের নিম গাছটার ডালে বসে আছে।কেটে গিয়েছে অশনি অন্ধকার।ফিরে পেয়েছে স্বকীয় স্বাধীনতা।উপভোগ করছে মুক্তির স্বাদ।এখন ইচ্ছে হলেই ভেসে বেড়াবে মেঘের নিচে,লুকোচুরি খেলবে বাতাসের সাথে, গান গাইবে মিষ্টি সুরে।

শূন্য খাঁচা হাতে নিলু দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাখিটির দিকে।

হয়তো পাখিটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই তাকিয়ে থাকবে নিলু।

আপনার লেখা ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্যিকের জীবনী, সাক্ষাৎকার, সাহিত্যের খবর বর্ণপ্রপাতে প্রকাশ করতে চাইলে ইমেইল করুন bornopropat@gmail.com

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।