ঝর্ণার বাপ পেশায় একজন কামার। আর মাও বাড়ির কাজ-কর্মে নিপুনা। লোহার কাজ করা বাপ সবসমায় কয়লার ধোমাত থাকিতে থাকিতে মানষিটার চেহারাটায় পাল্টি গেইসে। বুকোত কফ জমি হাপানি ধরিসে।
একদিন ভোর ভোর সমায়ে ঝর্ণার বাপ নিন থাকি উঠি ঘরের বায়রা বিরাইতে স্ট্রোক করিসে। তার পর আর শত চেষ্টা করিয়াও বাঁচা সম্ভব হয় নাই! সেলা থাকি উমার সংসার ভাঙি পড়িসে। ঝর্ণার মাও বেশি খাটুনি কাজ করির পারে না। কাজে পাড়ার মানষিও সহজে কুনো কাজ দ্যায় না।
ঝর্ণার ছোটোবেলা থাকি স্বপ্ন ছিলো পুলিশ হওয়ার। কিন্তু স্বপ্ন পুরোনের লক্ষ্যে বাধা হয়া দাঁড়াইসে অভাব। অভাবের সংসার থাকিলেও যতদিন পর্যন্ত ঝর্ণার বাপ বাঁচি ছিলো, ততদিন উয়ায় অভাব জিনিসটা বুঝে নাই-- যা চাইসে তাই পাইসে। কিন্তু ঝর্ণার মাও সেই অভাবটা পুরোন করির পারে না। অভাব পুরোন করা তো দূরের কথা, কুনো কুনোদিন মুখোত এক গাস ভাতও চড়ে না!
একদিন পাড়ার বুধারু আসি ঝর্ণার মাক কইল, “কাকি, একটা ভালো ঘরের খবর আছে। ঝর্ণার বাদে আলোচনা করিম নাকি?”... ঝর্ণার মাও কি কবে ভাবি পাছে না। আরও ভাবেছে, “যুদি কুনো মতনে মাইটাক একটা ভালো ঘরত ব্যাচে খাওয়া যায়, তাহলে চিন্তা দূর হয়।”
ঝর্ণার মাও চুপচাপ আছে দেখি বুধারু আরও পুছিল, “কি কন কাকি? চেংরা ভালো, গাইনো ডাক্তার। বাপের জমি-জাগাও ভালে আছে। এমন ঘরের খবর সব সমায় পাওয়া যায় না কাকি। ভালো করি ভাবিয়া মোক খবর দ্যান।”
ঝর্ণার মাও কইল, “ঠিক আছে বাউ, তুই আজি যা। মুই তোক খবর দিম।”... বুধারু চা-পান-সুপারি খায়া চলি গেল।
সারা আতি কি যে সাত-পাঁচ ভাবিল ঝর্ণার মাও, সকালে উঠি চলি গেইসে বুধারুরটে।
বাড়ি ফিরি আসি ঝর্ণাক কয়, “মাই, একটা ভালো ঘরের খবর আছে। তোর বুধারু দা শুকুর বারে চেংরাটাক ধরি তোক দেখির আসিবে। তোর আপত্তি নাই তো?”... ঝর্ণা যে উয়ার মাক কি উত্তর দিবে, ভাবি পাইল না। মাওয়ের মুখের ভিত্তি খোং খোং করি চায়া নইল। তাছাড়া এত কম বয়সের একটা চেংরিক এংকরি ফটকরি পুছিলে উয়ায় জবাবে বা কি দিবে।
শুকুর বার সকালে ঝর্ণার মাও বাড়ি-ঘর মুছি-কুছি পরিস্কার করি থুইয়া, পাড়ার দুইজন মানী ডাঙোরিয়াকও কয়া আসিসে। বিকালে বুধারু চেংরা ধরি ঝর্ণাক দেখির আসিলে পাড়ার ডাঙোরিয়া দুইজনও আইসে। অনেক গল্প-গুজব হইল। চেংরা কি করে, না করে, তার পরিচয় সবকিছু নেওয়া হইল। চা, পান-সুপারি, মিষ্টি খাওয়া-দাওয়া হইল। চেংরা ঝর্ণাক দেখি, মুখ দেখানি একশো এক টাকাও দিয়া গেল।
কয়েক দিন পরে বুধারু আসি ঝর্ণার মাক কইল, “কাকি, ঝর্ণার কপাল ভালো বারে। চেংরা হামার ঝর্ণাক পছন্দ করিসে।”... খবরকেনা শুনি ঝর্ণার মাও খুবে খুশি।
“হয় বারে, ঝর্ণার কপালখান বোধায় ভালে আছে।”
“তোমাকও যায়া বাড়ি-ঘর দেখি আসির কইসে কাকি।”
“হামাক!”
“হ্যাঁ, তোমাকে। কুনদিন যাবেন কন।”
“হামরা আর কি যামু বাউ! তুই দেখি আচ্চিস, ওইটায় মেলা।”
“চেংরার বাপ কইল, এই মাসে উমুরা বেটার বিয়া নাগাবে।”
“এই মাসে!”
“হ্যাঁ, এই মাসে। চেংরার মাওয়ের শরীল খুব খারাপ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেটার বিয়া দিবে।”
“কিন্তু...”
“কুনো কিন্তু না হয় কাকি।”
“কিন্তু, বিয়ার বাদে হুট করি এত টাকা-পাইসা কোটে জোগার করিম বাউ? দাবি-দাবা এলা কি চায় উমুরা!”
“দাবি-দাবার কুনো কথা নাই কাকি। চেংরার বাপ কইসে, একখান নাল সুতাও নাগিবে না। বিয়াখানও যুদি দিবার না পান, তাহলে উমুরা ঝর্ণাক উমারে বাড়িত নিগি বিয়া দিবে। তোমরা কি কন?”
“মুই আর কি কইম বাউ!”... ঝর্ণা চাটির গোরত দাঁড়ে দাঁড়ে চুপ করি সব শুনিসে। খুব কষ্ট হছে কথাগিলা শুনিয়া। একমাত্র বিধুয়া মাওটাক ছাড়ি পরার বাড়িত যায়া ক্যাংকরি থাকিবে-- নানানখান চিন্তা ঘুরেছে উয়ার মাথাত।
এক মাস পর ঝর্ণার বিয়া হইল-- চেংরার বাড়িত।
এতদিন ঝর্ণা ডোংডোং-ফোংফোং খেরি ঘরত দিন কাটাইসে। এলা স্বোয়ামীর বিশাল পাকা বাড়ি। পাকা বাড়ি হলেও উয়াক অসস্থি নাগেছে সেই বাড়িত। বার বার ফম পড়ে বিধুয়া মাওটার কথা। কি খাছে, ক্যামন আছে-- এই ভাবি চোখুর জল ছচ্ছরে বিরি আইসে ঝর্ণার।
বিয়ার ছয় মাস বিতি গেল। ততদিনে শশুড় বাড়ির আদরে-যতনে ঝর্ণা বাপের বাড়ির কথা ভুলি গেইসে কইলেও চলে। তাছাড়া উয়ার শাশুড়ি অসুখের কারণে বিছিনায় মানষি একটা। উয়ার শশুড়-শাশুড়ি উয়াক বেটার বউ না হয়, নিজের বেটির মতন দ্যাখে। শশুড়-শাশুড়ির এই ভালোবাসাতে মাওয়ের কথা আর বার বার ফম পড়ে না ঝর্ণার।
বেচারির ভাইগ্যটায় বোধায় খারাপ! চোখুর জল আর পাছ ছাড়িল না। উয়ার স্বোয়ামী একদিন রুগি দেখির যায়া, এক বিধুয়া বউয়ের সাথে কেচাল করি মুখ কালা করিসে। মানষিও ধরি হাড্ডি ফাটা মাইর মারিসে। ঝর্ণা খবরটা পায়া পরিহরি যায়া মানষির হাত-পাও ধরি কুনো মতনে বাঁচে আনিসে। স্বোয়ামীর এইমন অবস্থা দেখি কুন বউটার মন ঠিক থাকে! ঝর্ণাও ভাঙি পড়িল।
এংকরি বিতি গেল দিন। ঝর্ণার স্বোয়ামী আস্তে আস্তে ভাল হইল। খুব হাসি-খুশি থাকে এলা।
কিন্তু, কয়লার মইলা কি আর কুনোদিন উঠে! ত্যামনে হইল ঝর্ণার জীবনত। উয়ার স্বোয়ামীর কেচালটা হওয়ার বছরখানে না হইল ভাল করি, তাতে আরও যায়া ওই বিধুয়া বউটাক ধরি এবার বাড়ি আসিসে। এত অশান্তি কায় আর সইহ্য করে। ঝর্ণা প্রতিবাদ করিলে উয়ার স্বোয়ামী উয়াকে ধরি মারে। বাপ-মাও কাহরে কথা শুনে না উয়ার স্বোয়ামী। ঝর্ণা সেদিনে গ্রামের পঞ্চাইত, প্রধান সগাকে ধরি আসি ন্যাহ্য বিচার চাইল। প্রধান-পঞ্চাইত আরও পাড়ার মানী-গুনি ডাঙোরিয়ারঘর আসি বিধুয়া বউটাক খ্যাদে দিল।... এই ব্যপারটা ঝর্ণার স্বোয়ামী ভালো মনে নিল না।
বিয়ার প্রায় দুই বছর হয়া গেল, ঝর্ণা উয়ার মাওয়ের খবর করির যাবার পাইল না। উয়ার স্বোয়ামী যাবার দ্যায় না। কি আর করে বেচারি, স্বোয়ামীর কথা শুনি কষ্টে দিন কাটায়।
একদিন হঠাৎ বুধারু ঝর্ণার বাড়িত আসি হাজির। এতদিনে বাপের দ্যাশের বুধারু দাক দেখি ঝর্ণার মনত খুশি উথুলি পড়েছে। ঝর্ণা দৌড়ি আগে যায়া কইল, “এতদিন পর আসিলু দা! মাকও না সাথে আনির পালু হয়। আয় ভিতর আয়, বইস। বাবার সাথে গল্প কর, মুই ততক্ষণে চা বানে আনোং।”
বুধারু কইল, “চা খাম না ঝর্ণা।”
“কেনে দা?”
“এমনি।”
“মাও ক্যামন আছে দা?”
“কাকি আর নাই ঝর্ণা! কালি আতিতে...! তুই তাড়াতাড়ি চল।”
কথাটা শুনি ঝর্ণা আর কিছু না কয়ায় হাউহাউ করি কান্দির ধরিল। এমন সমায় উয়ার স্বোয়ামী ঘর থাকি কইল, “এত নাটক কিসের?”... ঝর্ণা কিছু না কয়া আরও বেশী করি কান্দির ধরিল। ঝর্ণার স্বোয়ামীর কান্ড দেখি বুধারু তো অবাক! উয়ার স্বোয়ামী আরও কইল, “মরি গেইসে-- ফুরি গেইসে। এত নাটকের কি দরকার?”
ঝর্ণার শশুড় এতক্ষনে মুখ খুলিল। রাগ উঠিয়া কইল, “ছিঃ বীরভদ্র ছিঃ! তোর নামটায় খালি ভদ্র রে, তোর নামটায় খালি ভদ্র! তোক যে মুই কেনে জন্ম দিসুং রে! ওহ্ ভগবাণ! কুন সমায় কাক কি কবার নাগে তুই হুটাও জানিস না রে! তুই মানুষ হলু না!”
বুধারু চোখুর জল ছলছল করি কইল, “মুই যাং ঝর্ণা, তুই আসিস।”
ঝর্ণার শশুড় কইল, “বৌমাক সাথে ধরি যাও বারে।”
ঝর্ণার স্বোয়ামী বাধা দিয়া কয়, “না, ঝর্ণা যাবে না।”
ঝর্ণার শশুড় কয়, “তুই পাগলা হসিস নাকি বীরভদ্র!”
“হ্যাঁ, মুই পাগলায় হসুং। আজি যুদি উয়ায় এই বাড়ি থাকি যায়, তাহলে চিরকালের জইন্যে এই বাড়ির রাস্তা বন্ধ হবে উয়ার।”
ঝর্ণা কি করিবে ভাবি পাছে না! তাতে উয়ার শশুড় কইল, “তোমরা যাওতো বৌমা। উয়ায় কি করে মুইও দ্যাখোং।”... শশুড়ের কথা শুনি ঝর্ণা সেলায় বুধারুর সাথে মাওটাক শ্যাস বারের জইন্যে দেখির চলি গেল।
মাওয়ের মুখ শ্যাস বার দেখিয়া, সেদিন আতিটা বুধারুঘরের বাড়িতে থাকি, পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরিল বুধারুরে সাথে।
বাড়ি আসি কয়েকদিন বিতি গেল, কিন্তু উয়ার স্বোয়ামীর পাত্তা নাই বাড়িত। একটার পর একটা দুশ্চিন্তা ক্যামন করি যে সইহ্য করেছে সেইটা একমাত্র ঝর্ণায় জানে।... খবর পাইল, উয়ার স্বোয়ামী নাকি সেই বিধুয়া বউটাক ধরি আরও পালাইসে!
এবারে কষ্ট বুকোত চাপা দিয়া ঝর্ণা চুপচাপ বাড়িতে পড়ি থাকিল। স্বোয়ামীর খোঁজত আর বিরায় নাই কুনোদিন। উয়ার শশুড় খোঁজত বিরাইলে ঝর্ণা বাধা দিয়া কয়, “উমাক উমার মতন থাকির দ্যাও বাবা।”... উয়ার শশুড়ও ভাবে কথাটা ঠিকে, “এই অমানুষটা(বীরভদ্র) আর কুনোদিন মানুষ হবে না।”
ঝর্ণার শশুড় কয়, “বৌমা, মোর বাপকালিয়া যত সম্পত্তি আছে, সব তোমার নামে লেখি দ্যাছোং। আর অমানুষটা যুনি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করি খায়!”
ঝর্ণা কয়, “মনটায় ঠিক নাই, ধন-সম্পত্তি দিয়া কি হবে বাবা!”
ঝর্ণা একবার ভাবে আত্মহত্যা করিবে। একটার পর একটা আঘাত সইহ্য হয় না। আর একবার ভাবে, আত্মহত্যা করিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? একজনের ভুলের জইন্যে আরেকজনের প্রান নষ্ট-- এইটা তো ঠিক না হয়। ঝর্ণা জানে, সব অপরাধের একদিন বিচার হবে, সব অপরাধী একদিন শাস্তি পাবে।
তারিখ: ১৯.০৬.২০২০