সুচিস্মিতা ।। তাসনিম তিশা


টুংটাং শব্দ করে হঠাৎ করে ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে উঠলো আর রোশনি দেখলো একটা মেসেজ। 
ম্যাসেজে লেখা ছিল-“হাই , আমাকে চিনেছ নিশ্চয়। আমি আবির। কালকের মিটিং এর বিষ়বস্তুটা আমাকে যদি একটু বুঝিয়ে দিতে তাহলে একটু সুবিধা হতো।"

রোশনি কিছু বুঝতে পারলো না, তাই সে ম্যাসেজ এর উত্তর দেওয়ার ও প্রয়োজন বোধ করলো না ।
কিন্তু একটু পরেই আবার সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো, রোশনি দেখলো আবার সেই একই লোক এর ম্যাসেজ এসেছে। 

এইবার লেখা আছে
“আমাকে বোধ হয় চিনতে পারোনি। আমি তোমার নিউ কলিগ। আজকেই অফিসে প্রথম জয়েন করেছি। আসলে অফিসে কাজের দ্বিতীয় দিনেই এত বড় একটা মিটিং এ বসতে হবে, তাই সব কিছু বুঝতে তোমার একটু সাহায্য চাই।"

এইবার রোশনি উত্তর দিলো,“ আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি যাকে চাচ্ছেন সে হয়ত আমি নই।"ম্যাসেজ টা পড়ে আবির একটু চমকে গেলো এবং খেয়াল করে দেখলো ভুল সে একটা করেছে।
তার কলিগ এর নাম“ নাজমিন নাহার" আর সে ম্যাসেজ দিয়েছে “নাজনিন নাহার"কে ।

রোশনির ভালো নাম“নাজনিন নাহার রোশনি"। আইডিতে রোশনি নামটা দেওয়া নেই বলেই বেচারা আবির এই ভুলটা করেছে ।

যাই হোক ভুল যখন একটা হয়েছে ই তখন আর কি করা যাবে, তারথেকে ভালো মেয়েটার প্রোফাইল থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। রোশনির প্রোফাইল এ গিয়ে দেখা গেলো এর থেকে সাদা মাটা প্রোফাইল বুঝি আর হয় না। আইডিতে তেমন কিছুই নেই ।শুধু কিছু ইসলামিক পোস্ট শেয়ার করা, আর প্রোফাইল পিক এ একগুচ্ছ শিউলি ফুলের ছবি । 

প্রোফাইল ভ্রমণ শেষ করে আবির আবার ম্যাসেজ দিলো।
“আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।আসলে আমার একটু ভুল হয়ে গেছে। আমি যাকে চাচ্ছিলাম তার নাম ও আপনার নাম প্রায় একই রকম হওয়ায় এই ভুলটা হয়েছে।
আশা করি আপনি কিছু মনে করেননি।"

“নাহ কিছুই মনে করিনি, ভুল হতেই পারে।" 
শুধু মাত্র এইটুকু উত্তর দিলো রোশনি।

আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনার পরিচয়টা কি জানতে পারি?
আবিরের এই ম্যাসেজ এর মাধ্যমে শুরু হলো আবির- রোশনির কথোপকথন।

পরিচয় এর মাধ্যমে জানা গেলো আবির একটা সটওয়্যার কোম্পানিতে সদ্য জয়েন করেছে আর রোশনি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো । কিন্তু প্রথম বর্ষ এর মাঝামাঝি এসে একটা সমস্যার জন্য সে আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেনি। কি সমস্যা সেইটা অবশ্য রোশনি কোনো দিনই আবিরকে বলেনি। পড়ালেখা শেষ করতে না পারলে ও রোশনি বসে থাকেনি। সে সাবলম্বী হাওয়ার চেষ্টা করছে। সে এখন অনলাইনে একটা আউটসোর্সিং এর কাজ করে। জীবনে ভালো কিছু তাকে করতেই হবে।

আর রোশনির এই জিনিসটা আবিরকে সব থেকে বেশি মুগ্ধ করে। এই কিছু দিনের আলাপে আবির বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী। তাছাড়া মেয়েটার কথা গুলো ও অসাধারণ। খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এবং আবিরের ধারণা মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী ও।

প্রায় ২ মাস পর আবিরের মনে হলো রোশনির জন্য তার মনে একটা আলাদা ভালো লাগা তৈরী হচ্ছে। তবে কি সে রোশনিকে ভালোবেসে ফেললো? সে কি রোশনিকে তার ভালোবাসার কথা বলবে নাকি সরাসরি বিয়ের কথা বলবে?
এমনিতেও আবিরের মা তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছে।
হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে আবিরের মাথায়। ভাবলো রোশনিকে একবার দেখা করার কথা বলেই দেখি পরে যা হয় হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। আবির কোনো ভনিতা না করেই ম্যাসেজ এ লিখে দিলো, “আমার মনে হয় তোমাকে ভালো লেগে গেছে। আমরা কি একদিন দেখা করতে পারি?"
আবির অনেকক্ষন অপেক্ষা করলো কোনো উত্তর এলো না।
তারপর সে আবার ম্যাসেজ দিলো
তুমি খারাপ ভাবে নিও না , আমরা বন্ধু হিসেবে তো দেখা করতেই পারি।"
এইবার রোশনি ম্যাসাজ এর উত্তর দিলো,
আমার মত মেয়েকে কারো ভালো লাগে না, ভালো লাগতে পারে না।

আবির রোশনির কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না । তাই সে লিখলো,সে কাকে ভালো লাগবে কি লাগবে না এইটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, আগে দেখা তো করি।আবিরের অনেক বুঝানোর পরে রোশনি রাজি হলো দেখা করতে।

কোথায় দেখা করতে হবে সেই জায়গার কথা আবির রোশনিকে জানিয়ে দিলো, শনিবার সকাল ১০ টায় তারা দেখা করবে। আর যেহেতু কেউ কাউকে আগে দেখেনি তাই চেনার সুবিধার্থে বলে দেওয়া হলো, আবির পরবে সাদা পাঞ্জাবি আর রোশনি পরবে নীল শাড়ি।

নির্দিষ্ট দিনে আবির এলো কিন্তু তার আসতে একটু দেরী হয়ে যায়, সে এসেছিল ১০:২৫ এ। আবির দেখে কদম গাছের নিচে নীল শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। আবির বুঝলো সে ই রোশনি। আর সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে রোশনি বুঝলো সে ই আবির।আবিরকে দেখে রোশনি একটু লজ্জসূচক হাসি দিলো, আর সেই হাসি দেখেই আবির থমকে গেলো, সে বুঝতে পারলো এইরকম মনোমুগ্ধকর হাসি সে কখনো দেখেনি। সেই মুহূর্তে আবিরের মনে হলো, মেয়েটির নাম রোশনি না হয়ে, সুচিস্মিতা হলে ভালো হতো।
কারণ মেয়েটির হাসি অনেক পবিত্র, নির্মল, প্রাণখোলা হাসি।

আবির কিছুক্ষণ কথা বার্তা বললো, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর আবির বুঝতে পারলো কথা শুধু সে একা ই বলছে রোশনি কোনো কথা বলছে না শুধু মাথা হেলাচ্ছে।

আবির বললো,“আরে তুমি এখন ও লজ্জা পাচ্ছো নাকি? কথা বলছো না কেনো।"
তবুও রোশনি কিছু বললো না, শুধু ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে কি যেনো লিখেছিল। এবং হঠাৎ করে সে ফোনের স্ক্রিনটা আবিরের দিকে দেখালো যেইটা দেখার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

রোশনি লিখেছে,কথা বলার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেইনি।কথাটা শুনে আবিরের খুব খারাপ লাগলো, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো।

সে বললো,সেইটা এক প্রকার ভালোই হলো। আমাদের মধ্যে ঝগড়া ঝাঁটি হবে না।
আবিরের কথা শুনে রোশনি একটু অবাক হলো কারণ তার ধারণা ছিল এই সত্যটা জানার পর আবির তাকে এড়িয়ে যাবে এবং তাকে ফেলে চলে যাবে। কিন্তু আবির সেইটা করলো না বরং সে হেসে হেসে কথা বলতে লাগলো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবির বললো, তোমার মত মেয়েকে কারো ভালো লাগতে পারেনা, তার কারণ কি এইটাই???

রোশনি মাথা নাড়ালো।
এইবার আবির বললো,হ্যা, ঠিক ই বলেছো- তোমাকে কারো ভালো লাগতে পারে না, আমার ও তোমাকে ভালো লাগেনি । আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।

“ভালোলাগা আপেক্ষিক, ভালোবাসা না।"

তোমার প্রতি যদি আমার সাময়িক ভালো লাগা তৈরী হতো তাহলে আমি তোমার কাছে তোমার ছবি চাইতাম, তোমার ফোন নাম্বার চাইতাম। কিন্তু আমি সেইসব কিছুই করিনি।

প্রতি মুহূর্তে তোমার বুদ্ধিমত্তা আমাকে তোমার প্রতি দূর্বল করে দিয়েছে। তোমার সাজানো গোছানো বাক্য শৈলী আমাকে আস্তে আস্তে তোমার জন্য উন্মাদ করে তুলেছে।
আর আজ তোমার ঐ হাসি দেখে আমি পুরোপুরি ঘায়েল হয়েছি। তোমার প্রতি আমার মনে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে অনেক আগেই আজ তোমার হাসি সেইটাকে পূর্ণতা দিলো।
আর আমার কিছু চাই না।
জগতে কোনো মানুষ ই পুরোপুরি পারফেক্ট হয় না। আমি নিজেও পারফেক্ট না।

কথা গুলো বলে আবির কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। হঠাৎ কি ভেবে রোশনির হাতটা ধরে হাটতে শুরু করলো।
রোশনি ও কোনো প্রতিবাদ করলো না। চুপচাপ হাটতে শুরু করলো আবিরের সাথে।
রোশনির ঠোঁটের কোণে দেখা দিলো সেই পবিত্র হাসির সূক্ষ্ম রেখা।

তাসনিম তিশা
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। 

Post a Comment

মন্তব্য বিষয়ক দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় বহন করবে না।

Previous Post Next Post

আপনিও লেখুন বর্ণপ্রপাতে

ছড়া-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ( শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকসাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ, বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রবন্ধ), উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ ও সাহিত্য পত্রিকার আলোচনা ও সমালোচনা, চিঠি, সাহিত্যের খবর, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা, ভিডিও ইত্যাদি পাঠাতে পারবেন। ইমেইল bornopropat@gmail.com বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ।